#তোমাতেই_পরিপূর্ণ
লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা
৩৭.
~
দরজার বাইরে যাওয়া মাত্রই মিথি থমকে গেল। নিমিষেই চোখের কোণটা ভিজে উঠল তার। অবাক হলো খুব। নিষ্পলক চোখে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। বুকটা ধিপ ধিপ করছে তার। পেছন ফেরে বাবার দিকে তাকাল। কথা বলতে গিয়েও যেন পারছে না। কন্ঠনালীতে আটকে যাচ্ছে। জোরে নিশ্বাস নিল। কাতর কন্ঠে বললো,
‘স্কুটি? কেন বাবা?’
আতাউর সাহেব মেয়ের কাছে এগিয়ে এলেন। চোখের কোণ টা তারও ভেজা। কোমল কন্ঠে তিনি বললেন,
‘দু বছর আগে ভাইয়ের জন্য তুই তোর স্কুটি টা বিক্রি করেছিলি। তোর সবথেকে প্রিয় জিনিস টা তখন তুই তোর ভাইয়ের চিকিৎসার জন্য হারিয়ে ফেলেছিলি। তাই আজ..আজ তোর ভাই বললো সে নাকি আবার তার বোনকে তার প্রিয় জিনিস টা ফিরিয়ে দিতে চায়। আর এসব কিছু মাহির আইডিয়া।’
মিথি যেন বাকরুদ্ধ। কি বলবে সে? কিভাবে নিজের অনুভূতি টা প্রকাশ করবে? অনেক টা সময় চুপ থেকে সে বললো,
‘এত টাকা..কিভাবে বাবা?’
আতাউর সাহেব মাথা নিচু করে হাসলেন। তারপর তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। অতঃপর বললেন,
‘মাহির কাছে জমানো কিছু টাকা ছিল। আর ব্যাংকে যেগুলো ছিল সেখান থেকেই মিলিয়ে জিলিয়ে নিয়ে এসেছি। তোর পছন্দ হয়েছে তো মা?’
মিথির এবার কান্না পেয়ে গেল। এমন একটা পরিবার না পেলে হয়তো সে কখনোই ভালোবাসার মর্ম বুঝত না। সে জড়িয়ে ধরল তার বাবাকে। কিছুক্ষণ কাঁদল। তার চোখের এই স্বচ্ছ শুভ্র দানাগুলোই প্রমাণ করছে সে তার পরিবারকে কতটা ভালোবাসে। মেয়ের কান্নায় এবার সকলেই ভেঙে পড়লেন যেন। কেঁদে কেটে সবাই নাক মুখ লাল করে তবেই ক্ষান্ত হলেন। মিথি তারপর নিজের স্কুটির কাছে গেল। ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখতে লাগল। একটা সময়ে তার এক বিশাল ভালোবাসা ছিল এই জিনিস টা। তখনই ভাই অসুস্থ হয়, আর চিকিৎসার জন্য এত টাকা না থাকায় বাধ্য হয়ে সে তার এই স্কুটি টা বিক্রি করে দেয়। আজ আবার সে একটা স্কুটি পেয়েছে; তার সেই ভালোবাসার জায়াগাটা আজ আবারও পূর্ণ হলো। আবারও একবার পরিবারের ভালোবাসায় সিক্ত হলো মিথি। তার মনে হলো, তার এই ছোট্ট জীবনে সে অনেক কিছু পেয়ে ফেলেছে। কুঁড়িয়েছে এক আকাশ ভালোবাসা। মনটা আজ খুশিতে অস্থির। মানুষ ঠিকই বলে, সৃষ্টিকর্তা কিছু কেড়ে নিলে তার থেকে দ্বিগুণ ফিরিয়ে দেয়। তার জন্য অবশ্যই ধৈর্য ধরতে হবে। সবসময় যেকোনো পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে নিতে হবে। আর মন খুলে সবাইকে ভালোবাসতে হবে। এটাতেই খুব করে বিশ্বাসী মিথি। ভালোবাসতে তো আর অর্থের প্রয়োজন হয় না, তবে এতে এত কিপটামী কিসের..!
.
.
বিকেলে বাইরের পিচ ঢালা রাস্তাটায় স্কুটি টা নিয়ে বের হয় মিথি। অনেকদিন হলো চালানো হয় না, এখন পারবে কি না কে জানে? মনে সাহস নিয়ে স্কুটিতে বসে সেটা স্টার্ট দেয় সে। প্রথমে সোজা ভাবে হ্যান্ডেল করতে না পারলেও কিছুক্ষণের মাঝেই কন্ট্রোল করে নেয়। খুশি হয়ে ছুটতে থাকে। এপাশটায় তেমন কোনো বড়ো গাড়ি চলাচল করতে দেখা যায় না। তাই এখানে সে খুব ভালোভাবে স্কুটি টা চালাতে পারে।
কিছু সময় পর মিথি একটু থামল। স্কুটি টা ব্যাক করে আবার তাদের বাসার গেইটের সামনে এসে দাঁড়াল। সেখানে মাহি দাঁড়িয়ে ছিল। মিথি তখন বললো,
‘চল, তুই আমার পেছনে বস। তোকেও সামনে থেকে একটু ঘুরিয়ে নিয়ে আসি।’
বোনের উপর এই মুহুর্তে ঠিক ভরসা করতে পারছে না মাহি। যদিও সে জানে একসময় মিথি বেশ পাঁকা ছিল এই ব্যাপারে। কিন্তু এখন অনেক দিন হয়ে গেছে, তাই মাহির একটু একটু ভয় করছে। যদি আবার কোনো দূর্ঘটনা ঘটে। মাহি তাই প্রথমে রাজি হয় না। মিথি একপ্রকার জোর করেই তাকে তার পেছনে বসিয়ে ছুটতে শুরু করে। অনেকটা পথ চলে আসে দুজন। অনেক দিন পর স্কুটি চালিয়ে খুশিতে মিথির আজ মনে হচ্ছে যেন পুরো বিশ্বটা এখনই ভ্রমণ করে ফেলবে। তার এখনও খেয়াল হয়নি যে সে কতটা পথ এসেছে। মাহিও এখন খুব এনজয় করছে। তাই তারও এই ব্যাপারে কোনো ধারণা নেই। তারা দুজনই এখন যেন অন্য এক দুনিয়ায় আছে।
.
অনেকটা পথ আসার পর মিথি এবার থামল। আরেকটু সামনে গেলেই হাই রোড। আর যাওয়া যাবে না। তাই সে স্কুটি ঘুরাল। ফেরার পথে একটা গাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেল সে। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। দেখে মনে হচ্ছে নৈরিথের গাড়ি। একটা কফিশপের সামনে দাঁড়ান। মিথি পেছনে ঘাড় ঘুরিয়ে মাহিকে বললো,
‘এই মাহি, দেখতো এটা নৈরিথের গাড়ি মনে হচ্ছে না?’
মাহিও সেদিকে তাকিয়ে বললো,
‘হ্যাঁ, এটা তো ভাইয়ার গাড়ির মতো।’
মিথি তখন কিছু একটা মনে মনে ভাবল। তারপর সে তার স্কুটি টা নৈরিথের গাড়ির সাথে পার্ক করে একপাশে দাঁড়াল। মাহির দিকে তাকিয়ে বললো,
‘আমার ফোনটা তোর কাছে না, দে তো!’
মাহি পকেট থেকে মিথির ফোনটা বের করে তার হাতে দিল। মিথি কল লাগাল নৈরিথের নাম্বারে। বারবার ব্যস্ত দেখাচ্ছে। মিথিও লাগাতার কল দিয়েই যাচ্ছে। অনেক গুলো কলের পর অবশেষে কলটা রিসিভ হলো। ওপাশ থেকে নৈরিথের ব্যস্ত কন্ঠখানা শোনা গেল,
‘আমি একটু ব্যস্ত আছি। পরে কল দিচ্ছি।’
মিথি তাড়াহুড়ো করে বললো,
‘আচ্ছা আচ্ছা, আপনি এখন কোথায় আছেন এইটুকু বলে দিন তাহলেই হবে।’
নৈরিথ কিছুটা বিরক্ত হলো। বললো,
‘একটা কফিশপে আছি। ক্লায়েন্টের সাথে মিটিং এ। এখন কথা বলতে পারবো না, রাখছি।’
নৈরিথ কল কেটে দেয়। মিথি সিউর হয়ে যায়, নৈরিথ এখানেই আছে। যদিও এখন তার ইচ্ছে করছে দেখা করার, কিন্তু এই ব্যস্ত মানুষের তো সেইটুকুও সময় নেই। সেই মুহুর্তে সে মনে মনে ভাবল, সে কি একবার বলবে নৈরিথ কে যে সে এই কফিশপের নিচে দাঁড়ান? এক উছিলায় তো দেখাও হয়ে যেতে পারতো। কিন্তু আবার যদি নৈরিথ রেগে যায় এটা ভেবে যে সে একটা স্কুটি চালিয়ে এত দূর চলে এসেছে? উনার তো আবার রাগের কোনো কারণ থাকে না। হুদাই চিল্লা ফাল্লা করে।
অনেকক্ষণ ভাবল। ভেবে ভেবে নৈরিথের নাম্বারে একটা ম্যাসেজ লিখল, ‘আপনি যেই কফিশপে আছেন আমি সেই কফিশপের নিচে দাঁড়ান।’ ম্যাসেজ টা সেন্ড করে হাঁসফাঁস করতে থাকে সে। মনে মনে ভয় পায়, নৈরিথ যদি রেগে যায়। আবার নিজেকে নিজেই আশ্বাস দিয়ে বলে, ‘উফফ, রাগবে কেন? উনি তো বরং খুশি হবে আমাকে দেখে। হ্যাঁ, একশো বার হবে। খুশি হতে বাধ্য উনি।’ মনে মনে সাহস জুগিয়ে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সে।
প্রায় বিশ মিনিট এইভাবেই দাঁড়িয়ে রইল।
.
.
‘তুমি এখানে কি করছো?’
কন্ঠস্বর টা চেনা মিথির। তাই খুশি হয়ে পেছন ফেরে তাকাল। নৈরিথকে দেখে ঠোঁটের হাসির রেশটা আরো কিছুটা গভীর হলো। নৈরিথ তার দিকে এগিয়ে এল। বুকের উপর হাত দুটো ভাজ করলো। গম্ভীর সুরে বললো,
‘কি হলো? কিছু বলছো না কেন? হঠাৎ এখানে?’
মিথি মুচকি হেসে ||℅বললো,
‘ঐ যে দেখুন।’
মিথির আঙ্গুলের ইশারা অনুসরণ করে নৈরিথ সামনের দিকে তাকাল। দেখল তার গাড়ির পাশেই একটা হালকা কমলা রঙের স্কুটি রাখা। নৈরিথ ব্রু কুঁচকাল। বললো,
‘কার স্কুটি এটা?’
জবাবে মিথি সরস গলায় বললো,
‘আমার। বাবা আর মাহি আজকে সকালে কিনে এনেছে। তাই মাহিকে নিয়ে এখন একটু বেরিয়েছি। আর রাস্তায় আপনার গাড়ি দেখে মনে হলো আপনি হয়তো এখানে আছেন। তাই কল দিয়ে সিউর হয়ে নিলাম।’
নৈরিথ চোখ মুখ কুঁচকে ফেলল মিথির কথা শোনে। হঠাৎই সে রেগে গেল। চেঁচিয়ে উঠে বললো,
‘হুয়াট? আজকে স্কুটি কিনেছো আর আজই সেটা নিয়ে এত দূর চলে এসেছো? পাগল নাকি তুমি? যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে যেত তখন? এত পাকনামি করো কেন? কিছুদিন তো অন্তত প্রেকটিস করবে ঠিক মতো চালাতে পারো কি পারো না। তা না আজকে কিনে একেবারেই আজকেই টই টই করে ঘুরতে বেরিয়ে যেতে হলো?’
মিথি গাল ফুলিয়ে তেতো মুখে বললো,
‘স্কুটি আমি আরো আগে থেকেই চালাতে জানি। তাই বেরিয়েছি। নাহলে এত দূর কখনোই আসতাম না।’
নৈরিথ দ্বিতীয় বার কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। মাহির সেদিনের বলা কথাগুলো মনে পড়ল তার। মাহি তাকে আগেই সব বলেছিল। তাই এবার নিজেকে কিছুটা শান্ত করে সে বললো,
‘তাও যতোই হোক, তুমি তো আজ অনেক দিন পর আবার স্কুটি চালাচ্ছো তাই না? তাই প্রথম দিনই এইভাবে এত দূরে চলে আসা ঠিক হয়নি। আচ্ছা যাকগে এসে যখন পড়েছো এখন তো আর কিছু বলেও লাভ নেই। এখন কি বাড়ি ফিরছিলে?’
মিথি মুখ কালো করে বললো,
‘জ্বি।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে তাহলে বাড়ি যাও। আমিও এখন বাসায় চলে যাব।’
মিথি তখন একহাতের নখ দিয়ে অন্য হাতের নখ খোঁচাতে খোঁচাতে মিহি কন্ঠে বললো,
‘আপনাকে একদিন আমি আমার স্কুটি তে চড়াবো। আপনি পেছনে বসবেন আর আমি সামনে বসে স্কুটি চালাব। অনেক ঘুরবো সেদিন, ঠিক আছে?’
নৈরিথ হাসে। শব্দহীন নিরব হাসি। তবে সেই হাসিতেই উপচে পড়ছে তার একরাশ প্রশান্তি। কোমল কন্ঠে সে বলে,
‘ঠিক আছে। আমার এই ব্যস্তময় জীবনের একটা দিন না হয় আমি তোমার নামে লিখে দিব। সেদিন যত খুশি আমাকে নিয়ে ঘুরো। কিন্তু এর আগে কখনও আর এই স্কুটি নিয়ে এত দূর আসবে না। একটা ছোট ভুল কিন্ত পুরো জীবন কে এলোমেলো করে দিতে পারে। তাই সবসময় সাবধানে থাকবে।’
মিথি খুশি হলো খুব। উচ্ছাস নিয়ে বললো,
‘ঠিক আছে। আর বের হবো না। তবে আপনাকেও তাড়াতাড়ি সময় বের করতে হবে। আমি এত অপেক্ষা করতে পারবো না কিন্তু।’
‘আচ্ছা, খুব তাড়াতাড়িই সেই সময় পেয়ে যাবে তুমি। এখন বাড়ি যাও। আর হ্যাঁ, একদম কম স্পিডে আর সাইডে সাইডে চালিয়ে যাবে। একদম কোনো গাড়ী কে অভারটেক করতে যাবে না। বুঝেছো?’
মিথি বাধ্য মেয়ের মতো মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানাল। তারপর যে যার মতো গাড়িতে গিয়ে বসল। স্কুটি সাথে না আনলে হয়তো নৈরিথই তাকে ড্রপ করে আসতো। কিন্তু এখন এই স্কুটির জন্য সেটা সম্ভব হচ্ছে না। মিথি তার স্কুটি নিয়ে রওনা দিল। নৈরিথ গাড়ি স্টার্ট করে সামনে আগালেও মনটা অস্থির হয়ে উঠল তার। গাড়িটা ঘুরিয়ে নিল সে। মিথি যে পথে গিয়েছে সেই পথেই আবার ছুটল। কিছুটা সামনে যেতেই মিথির স্কুটি টা দেখতে পেল সে। তারপর নৈরিথ তার গাড়ির স্পিড কমিয়ে মিথির স্কুটির পেছন পেছন যেতে লাগল। আসলে সে মিথিকে এখন একা ছাড়তে পারছিল না। মন সাঁই দিচ্ছিল না তার। তাই এখন মনের অস্থিরতা কমাতেই একই পথে ছুটল সেও।
চলবে..