তোমাতেই পরিপূর্ণ পর্ব-৩৮

0
1195

#তোমাতেই_পরিপূর্ণ
লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা
৩৮.
~
তিন দিন ধরে টানা বৃষ্টি। প্রকৃতি যেন এই এক নতুন রূপে মেতে উঠেছে। গ্রীষ্মের রেশ সবেই শেষ হলো। প্রকৃতি জুড়ে শুরু হলো আষাঢ়ি কান্না। শহরের পিচঢালা রাস্তাগুলো বৃষ্টির পানিতে চকচক করছে। আবার অনেক জায়গায় জমেছে ভাঙা রাস্তার গর্তে পানি। বৃক্ষ লতাগুলো সবুজে সবুজে মেলা বসিয়েছে। চারদিকের আবহাওয়ার পরিবর্তন ঘটেছে। দক্ষিণা ঠান্ডা বাতাস বইছে ক্ষণে ক্ষণে।
বৃষ্টি বরাবরই মিথির পছন্দ হলেও আজ তার ভালো লাগছে না। এক লাগা তিন দিন বৃষ্টিতে চারদিক যেন কেমন শ্যাত শ্যাতে হয়ে আছে। গুমোট হয়ে আছে পুরো পরিবেশ। আজ নৈরিথের সাথে দেখা করার কথা ছিল কিন্তু এই বৃষ্টির কারণে সেটাও সম্ভব না। মিথি তার বিষন্ন মন নিয়ে বারান্দায় বসে আছে। বৃষ্টির আবছা এসে লাগছে তার গায়ে। চোখে মুখে ফোটা ফোটা বৃষ্টির পানি মাখানো। ভালো লাগছে না কিছুই। সিফাতও গ্রামে চলে গিয়েছে সে কবেই। যা কথা হয় ঐ একটু আধটু ম্যাসেজে। নেহা’টা আজকাল তার রিলেশন নিয়ে খুব টেনশনে আছে। বাড়ির সবাই ইতিমধ্যে সব মেনে নিলেও বেঁকে বসেছে নৈরিথ। সে অযথায় ঝামেলা পাকাচ্ছে। ঐ ছেলে কে নাকি তার পছন্দ না। এই নিয়ে মিথিও খুব রাগ দেখাচ্ছে তার সাথে। ভেবেছিলো আজ নৈরিথের সাথে দেখা করে তাকে একটু বোঝাবে, কিন্তু মনে তো হচ্ছে না সেটা আর পারবে বলে। আকাশের যা অবস্থা!

ফোন এল। নেহার নাম্বার। মিথি কলটা রিসিভ করলো। নেহার বিষন্ন কন্ঠখানা শুনতে পেল।

‘দোস্ত, ভাই কে এখনও কনভিন্স করতে পারছি না। ভাই কোনো ভাবেই সাদ কে মেনে নিচ্ছে না। কি করবো এখন? ঐদিকে সাদের মা বাবা এক পায়ে রাজি আমাকে তাদের বাড়ির বউ করার জন্য। বল না দোস্ত, কি করবো এখন আমি?’

মিথির চুপচাপ শুনল সব। অতঃপর দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বললো,

‘এত টেনশন করিস না দোস্ত। আমি আছি তো। আমি বোঝাব নৈরিথকে।’

নেহা কান্নার সুরে বলে,

‘ভাই যদি তোর কথা না শুনে?’

‘শুনবে না মানে? ও শুনবে ওর..না না আমার শ্বশুর তো অলরেডি শুনে নিয়েছে। আরে দোস্ত, প্যারা নিস না। আমি আছি কি করতে, আমি নিজে তোদের বিয়ে দিব। তোর ভাই যদি ভিলেনগিরি করতে আসে না তবে এক ঘুষি মেরে তার নাক ফাটিয়ে দেব।’

নেহা নাক টেনে বললো,

‘হ্যাঁ, এখন তুই’ই আমার শেষ ভরসা। প্লীজ দোস্ত ভাই কে বোঝা। আমি কিন্তু সাদ কে না পেলে মরে যাব।’

মিথি ধমক দিল। বললো,

‘বাংলা সিনেমার ডায়লগ বন্ধ কর। বললাম তো সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে। এখন রাখ তুই। আমি তোর ভাই কে কল দিচ্ছি।’

নেহার কল টা কেটে দিয়ে মিথি নৈরিথ কে কল লাগায়। কল কেটে দিয়ে সে আবার কল ব্যাক করে। মিথি সালাম দেয়। নৈরিথ তার জবাব দিয়ে বলে উঠে,

‘বৃষ্টি কমেনি, এখন আর কষ্ট করে বের হইও না। এই বৃষ্টি তে ঠান্ডা লাগতে পারে।’

আহারে কত কেয়ার। মিথি বুক ফুলিয়ে নিশ্বাস নেই। ক্ষীণ সুরে বলে,

‘কি করছেন?’

‘এই তো একটা ফাইল নিয়ে বসেছি। সামনে একটা প্রেজেন্টেশন আছে ঐটা কমপ্লিট করতে হবে।’

মিথি বিরক্তির সুরে বলে,

‘প্রেজেন্টেশন আর মিটিং ছাড়া আপনি আর কিছু বুঝেন না না? সারাদিন খালি মিটিং আর প্রেজেন্টেশন। এদিকে যে উনার বউ উনাকে না দেখতে পেয়ে দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছে সেদিকে উনার বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই।’

নৈরিথ আধশোয়া অবস্থায় ছিল এতক্ষণ। মিথির কথা শুনে সোজা হয়ে বসল। তারপর ফাইল টা বন্ধ করে হেয়ালির সুরে বললো,

‘আমি তো শুনেছি মানুষ না খেতে পেয়ে শুকিয়ে যায় কিন্তু এখানে তো দেখছি উল্টো, তুমি আমাকে দেখতে না পেয়ে শুকিয়ে যাচ্ছো? কিভাবে পসিবল বলতো? আমাকে দেখতে পেলে কি তোমার পেট ভরতো নাকি?’

মিথি মুচকি হেসে বললো,

‘পেট না ভরলেও মন তো ভরতো। আর আমার তাতেই হতো। কিন্তু এখন তো তাও হচ্ছে না।’

নৈরিথ মৃদু হাসে। বলে,

‘ঠিক আছে, কাল যদি বৃষ্টি না থাকে তবে কাল তোমার মন ভরাবো। বিকেলে স্কুটি টা নিয়ে বেরিও।’

মিথি এইটুকু শুনেই খুশিতে লাফিয়ে উঠল। বললো,

‘ঠিক আছে ঠিক আছে। আমি তো আজ তবে মনে প্রাণে দোয়া করবো যেন কাল বৃষ্টি না থাকে।’

নৈরিথও মুচকি হাসে। মেয়েটা অল্পতেই কত খুশি হতে পারে। তার সঙ্গ টা যে মিথি খুব করে চায় সেটা সে বোঝে। কিন্তু অফিসের এই এত এত কাজের চাপে এই সামান্য জিনিস টাই সে মিথি কে দিয়ে উঠতে পারে না। তবে যদি আবার একটু খানি সময় সে তাকে দেওয়ার কথা বলে তাতেই যেন মিথি হাতে আকাশের চাঁদ পেয়ে যায়। এখন তার মনে হয়, ভাগ্যিস মিথি তার জীবনে এসেছিল। নয়তো তার এই অন্ধকার জীবনে হয়তো কখনোই সে আর ভালোবাসার দেখা পেত না।
.
.
সাদের ব্যাপারে এখনই মিথি নৈরিথ কে কিছু বলে না। কালই একেবারে দেখা হওয়ার পর সব বলবে। তাই অন্য প্রসঙ্গে আরো কিছুক্ষণ কথা বলে তারা। কথার শেষ পর্যায়ে এসে মিথি হঠাৎ বলে,

‘জানেন তো আপনি না খুব আনরোমান্টিক।’

নৈরিথ ব্রু কুঁচকে বললো,

‘হঠাৎ আমাকে আনরোমান্টিক কেন মনে হলো?’

মিথি হালকা অভিমানের সুরে বলে,

‘অন্যসব ছেলেরা কি সুন্দর তাদের বউদের সাথে কথা বলা শেষে তাদের আই লাভ ইউ বলে কল কাটে। কিন্তু, আপনি আজ পর্যন্ত আমাকে একবারও আই লাভ ইউ বলেন নি। আই লাভ ইউ তো দূরে থাক একটু ভালোবেসে কথাও বলেন নি। কিছু হলেই ধমকা ধমকি আর না হয় হ্যালো হাই বাই বাই বলেই কল কেটে দিয়েছেন। যেন মনটার মধ্যে বিন্দুমাত্র কোনো ফিলিংস নেই।’

নৈরিথ ইতস্তত হলো খুব। সে কি আসলেই খুব আনরোমান্টিক? সত্যিই তো বিয়ে হলো দু মাস হয়ে গেছে অথচ মেয়েটাকে এখনও আই লাভ ইউ বলা হলো না। আচ্ছা, এটা কি ঘোর কোনো অন্যায় করে ফেলেছে সে? তবে কি সে আদর্শ স্বামী হতে পারলো না? একজন ভালো প্রেমিক পুরুষও হতে পারলো না? জীবন তো তবে তার ব্যর্থ, একেবারেই ব্যর্থ। হা হুতাশ করলো মনে মনে। নিজেকে নিজেই ধিক্কার জানাল। হ্যাঁ, এটা তার ভীষণ অন্যায় হয়েছে। এখনই সেই অন্যায়ের প্রায়াশ্চিত্ত তাকে করতে হবে। এই বলে গলা ঝাড়ল নৈরিথ। মোলায়েম কন্ঠে বললো,

‘আচ্ছা, এখন কি আমাকে আই লাভ ইউ বলতে হবে? আই মিন আমি যে খুব রোমান্টিক সেটা প্রুভ করতে গেলে দিনে আমাকে ঠিক কয়বার আই লাভ ইউ বলতে হবে বলতো? চার পাঁচ বার নাকি দশ বারো বার?’

মিথি তখন কপট রাগ দেখিয়ে জবাবে বললো,

‘মজা করছেন আমাকে নিয়ে। যান লাগবে আপনার আই লাভ ইউ বলা। আপনি থাকুন আপনার মত। আমি আর আপনাকে কলই দেব না।’

নৈরিথ হেসে বলে,

‘আহারে, বাচ্চা মেয়েটা আবারও রেগে যাচ্ছে। শোনো মেয়ে, আমি না আরো অনেক আগেই তোমার নেশায় আটকে গিয়েছিলাম। এখন যত দিন যাচ্ছে এই নেশা তত বাড়ছে।তুমি বোঝো একজন নেশাগ্রস্ত মানুষ ঠিক কি পরিমান উন্মাদ হয়? তার নেশা টা যখন মাত্রাতিরক্ত হয়ে যায় তখন সে পুরোপুরি পাগল হয়ে পড়ে। পারবে তো তখন আমার সেই পাগলামী টা সামলাতে। তখন যেন হাঁপিয়ে না উঠো। তাই আগে থেকে সাবধান করছি। বি প্রিপেয়ার ইউরসেল্ফ, ডেয়ার।’

নৈরিথের ঠান্ডা কন্ঠস্বর, স্তব্ধ হয়ে গেল মিথি। সামান্য কথাতেই হার্টবিট বেড়ে গিয়েছে তার। উফফ! মানুষ টা অদ্ভুত । এমনিতে কিছু বলে না বলে না কিন্তু একবার শুরু করলে আর হার্ট অ্যাটাক না করিয়ে ছাড়ে না।
.
জোরে জোরে নিশ্বাস নিয়ে নিজেকে কিছুটা শান্ত করে মিথি। এই হয়েছে তার এক বাজে অভ্যাস নৈরিথের মুখে একটু কিছু শুনলেই বুকের ধুকধুকানি বেড়ে যায়। এই বুক নিয়েই আবার কত বড়ো বড়ো কথা! নিজের উপর নিজেই চরম লেভেলের বিরক্ত সে। নৈরিথ অনেকক্ষণ যাবত নিশ্চুপ। মিথিও তাই। নৈরিথ সময় নিয়ে বললো,

‘আমি শুধু একটাই জিনিস ভাবি জানো তো, সামান্য কথাই যেই মেয়েকে এতটা দূর্বল করতে পারে সেই মেয়ে কে আমি কিভাবে বাসর রাতে কনভিন্স করবো। ইশ, মনে তো হচ্ছে অনেক কাঠ খড় পোড়াতে হবে।’

মিথি এবার অনেক বেশি লজ্জা পেয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে কল কেটে দিয়ে বুকটা চেপে ধরল। আরে ভাই, এইভাবে কেউ কথা বলে? বাচ্চা মেয়েটা মরে যাবে না। সত্যিই এই ছেলে ভয়ানক! সহজেই তার মুখ খুলতে দেওয়া যাবে না। নয়তো এই ভয়ংকর সব কথাগুলো শোনাতে শোনাতে কবে যে তাকে মেরে ফেলবে কে জানে..?

চলবে..

(আর অল্প কিছু পর্বের মধ্যে গল্পটা শেষ করে দিব ভাবছি..)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here