গোধূলি লগ্নের সেই তুমি পর্ব-১৫

0
1297

#গোধূলি_লগ্নের_সেই_তুমি
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_পনেরো

এক জোড়া ঠোঁট হুট করে ফাইজার কপাল ছুঁয়ে দিতেই ফাইজা নড়ে উঠলো। অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যাক্তি’টিকে দেখে নিজের চোখ’কেই বিশ্বাস করতে পারছেনা ফাইজা। যেই ব্যাক্তি’কে কিছুক্ষন আগে হসপিটালের বেডে দেখে আসলো। সেই ব্যাক্তি’কে কিছুতে’ই চোখের সামনে আশা করেনি ফাইজা। কপালে সাদা ব্যান্ডেজ প্যাঁচানো। বুকের দিকের ব্যান্ডেজ’টাও এখনো খোলা হয়নি। কিন্তু শার্টের জন্য অল্প খানিক’টা দেখা যাচ্ছে। পায়ে ব্যান্ডেজ নেই। হাতের কব্জি’তে ব্যান্ডেজ। কি আশ্চর্য এই লোক’টা এই শরীর নিয়ে এখানে কি করে আসলো? আবার স্বপ্ন দেখছে না তো ও? কোমায় যাওয়া একটা মানুষ কি করে আসবে এখানে? ফাইজা ড্যাব ড্যাব করে তাঁকিয়ে আছে ফারদিনের দিকে। ফারদিন ভ্রু উঁচু করে তাঁকিয়ে আছে ফাইজার দিকে। মুখে একটা মিষ্টি হাসি। দেখতে কি সুন্দর লাগছে ছেলে’টাকে। কে বলেছিলো এত সুন্দর হতে? ছেলেদের এত সুন্দর মানায় না। চোখের চাহনী’তে প্রেমে পড়ে যাবে যে কেউ। এমন করে কেউ তাঁকায় বুঝি? এই ছেলে’টার সৌন্দর্যের কাছে ফাইজা তুচ্ছ। তাও ছেলে’টা নিঃস্বার্থ ভাবে তিন বছর ধরে ভালোবেসে এসেছে। ফারদিন ফাইজার চোখের সামনে তু’রি বাজাতেই ওর ধ্যান ফিরে আসলো। ফাইজার মনে হচ্ছে ও ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছে। কিছুতে’ই নিজের চোখ’কে বিশ্বাস করাতে পারছেনা তুই সত্যি দেখছিস। কোনো স্বপ্ন দেখছিস না। ফাইজা এখনো অবাক নয়নে তাঁকিয়ে আছে। ফাইজার কান্ডে ফারদিন ও’কে বিশ্বাস করাতে আচমকা জোরে চি’মটি কে’টে বসলো ফাইজার গলার পাশে। ব্যাথায় ফাইজা “আহঃ” করে মৃদু শব্দ করে উঠলো। এখন কেনো যেনো ওর বিশ্বাস করতে মন চাচ্ছে ও স্বপ্ন দেখছে না সত্যি ফারদিন এসেছে? কিন্তু কি করে? ফারদিন ফাইজার চুল গুলো কানের পাশে গুঁজে দিয়ে বলে উঠলো…..

–বিশ্বাস করো তুমি স্বপ্ন দেখছো না। তুমি সত্যি দেখছো। তোমার সামনে মিস্টার অভ’দ্র বসে আছে।

বলেই খনিক হাসলো৷ ফাইজা অবাক স্বরে অস্পষ্ট ভাবে বলতে লাগলো…..

—আপনি আমাকে পা’গ’ল করে দিয়ে হসপিটালের বেডে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছেন তাইনা। আর আমি যেখানে সেখানে যখন তখন আপনাকে স্বপ্নে দেখা শুরু করেছি। আপনি কি আমার স্বপ্ন হয়েই থাকবেন বাকি জীবন। নাকি ফিরে আসবেন আমার কাছে? আপনাকে ছাড়া আমি ভালো নেই। একটু ও ভালো নেই। প্রতি মুহূর্ত বিষাদের আ’গুনে জ্বলে পুড়ে ছাড়খার হয়ে যাচ্ছি…….

বলতেই ওর চোখ বেয়ে পানি পড়তে লাগলো। ফাইজার কান্না দেখে ফারদিন অসহায় ভাবে ওর দিকে দৃষ্টি দিলো। মেয়ে’টার মুখ’টা শুকিয়ে গেছে। চোখ গুলো মারাত্মক ভাবে ফুলে লাল হয়ে আছে। গাল দুটো ও লাল হয়ে আছে। চুলের বেনুনী এলোমেলো হয়ে আছে৷ সত্যি মেয়ে’টা ভালো নেই। ভাবতে’ই ফারদিনের বুকের ভেতর ঝড় বইতে লাগলো। দুমড়ে-মুষড়ে উঠলো। চোখের পানি গুলো আছড়ে পড়া শুরু করবে কিছুক্ষন পর। কিন্তু, ছেলেদের যে যখন-তখন কাঁদতে বারন। ফাইজা কিছুক্ষন চুপ করে থেকে আবারো কান্না মাখা কন্ঠে বলে উঠলো…..

–“আপনি আমার খুব কাছের কেউ”
যাকে ভুলে যাওয়ার কোনো আলাদা পথ নেই
প্রতিদিন মনে পড়বে,
আর, বিষাদের স্মৃতি গুলো হাহাকার করতে থাকবে

ফাইজার কথা শুনে ফারদিন টলমল চোখে ফাইজা’কে একবার জড়িয়ে ধরলো। ফাইজা নিশ্চুপ। আজকে আর ফারদিন’কে আকড়ে ধরছে না। যদি সেদিনের মতো ঘুম ভেঙে যায়। ফারদিন ফাইজা’কে ছেড়ে ওর দুই হাত মুঠোয় বন্দী করে কাতর কন্ঠে বললো…..

–তুমি নামক তৃষ্ণা আমার কোনোদিন মিটবে না…..

বলেই ওর কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালো। ফাইজা হালকা কেঁপে উঠলো ঠিকি কিন্তু অবাক নয়নে তাঁকিয়ে দেখছে ফারদিন’কে। ও আবার স্বপ্ন দেখছে? কি করে হবে এই মিরাক্কেল? এই লোক’টাই তো হসপিটালের বেডে ছিলো। তাহলে? ফাইজার ভাবনার ছেদ ঘটিয়ে ফারদিন আলতো করে ফাইজার দুই গালে হাত রাখলো। ফাইজার নাকের সাথে নিজের নাক কয়েক’বার ঘ’ষে নিলো। তারপর ফাইজার কপালের সাথে নিজের কপাল লাগিয়ে নেশালো কন্ঠে বলে উঠলো…..

–কত দিন তোমাকে চু’মু খাই’নি বলো তো? চু’মুর অভাবে যে তৃষ্ণায় আমার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছে সে খেয়াল কি তোমার আছে? আমার এই তৃষ্ণা মিটিয়ে দিবে জান?

ফাইজা এইবার ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে ফারদিন’কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। হঠাৎ এমন ভাবে শক্ত করে ধরায় ফারদিন বুকে ব্যাথা পেয়েও নিজেকেও সামলে নিলো। ব্যান্ডেজ প্যাচানো হাত’টা ফাইজার চুলে ডুবালো। ফাইজা কেঁদেই যাচ্ছে। ওর চোখের পানি ফারদিনের শার্টের উপর পড়ে ভিজে যাচ্ছে। বেশ খানিক’টা সময় কেটে গেলো। ফাইজা’ শান্ত হয়ে ফারদিনের বুকে লেপ্টে আছে। ফারদিন ফাইজার মাথায় আলতো করে হাত বুলাচ্ছে। ফাইজা’কে শান্ত হতে দেখে ফারদিন বলা শুরু করলো……

–সেদিন তুমি স্বপ্ন দেখো নি। সেদিন সত্যি আমার জ্ঞান ফিরেছিলো। তোমার সাথে কথা বলার সময় চোখ যায় দরজার দিকে। একজন ব্যাক্তি ছিলো সেখানে আড়ালে। তার হাতে আমি স্পষ্ট ছু/ড়ি দেখতে পেয়েছিলাম। বুঝে গিয়েছিলাম এই মুহূর্তে আট্যাক করা হবে আমাকে’ই। চেষ্টা করলেও নিজেকে বাঁচাতে পারব না। আর তারা তোমার ক্ষ’তি করবে না সেটা আমি আগেই জানি। তাই তৎক্ষনাৎ পূর্বের মতো শান্ত হয়ে রইলাম। ব্যাক্তি’টা তোমাকে আট্যাক করবে আমি সত্যি বুঝতে পারি’নি। যখন তোমাকে আ’ঘাত করা হলো। আমি চেয়ে ও পারিনি তোমাকে সেভ করতে। সে তোমার মাথায় আ’ঘাত করেই আমাকে কিছুক্ষন তীক্ষ্ণ চোখে দেখে চলে গেলো। আমি চাইলেও তখন তোমার কাছে আসতে পারতাম না। তখনি রুমে তোমার মা ঢুকে তোমাকে ওই অবস্থায় দেখে সবাই’কে ডেকে তোমাকে নিয়ে যায়। তারা ভেবেছিলো তুমি সেন্সলেস হয়ে গিয়েছো। তোমাকে নেওয়ার সময় আমার অসহায় চাহনী কেউ দেখতে পায়’নি। দূর থেকে তাঁকিয়ে ভেতরে ভেতরে ম/রে যাচ্ছিলাম। সেদিন আমার জ্ঞান ফিরতে না দেখে নিরব ও ভেবেছিলো আমি কো’মায় চলে গিয়েছি। সবাই চলে যাওয়ার পর নিরব যখন একা আমার চেক-আপ করেছিলো তখন ও আর আমি মিলে এই কোমায় যাওয়ার ড্রামা’টা শুরু করি। কারন হসপিটালের সার্ভেন্ট দের মধ্যে কেউ একজন শত্রু পক্ষের লোক যে আমাদের উপর নজর রাখছিলো। সাড়া হসপিটালে আমার কো’মায় যাওয়ার ঘটনা’টা রটিয়ে দেওয়া হলো। এই খবর’টা শোনার পর আর কারোর উপর আট্যাক হবেনা আমি জানি। কারন, আমার শোকে সবাই এমনেই’ অর্ধেক ম/রে যাবে আর তারা দূর থেকে মজা নিবে। সেদিন আমার কেবিনের সিসি টিভি ফ্রুটেজ গুলো নিরব সরিয়ে রেখে দিয়েছিলো সবার আগে যার কারনে তারা কেউ কিছু জানতে পারিনি। তোমাকে সত্যি’টা জানানোর মতো সময় আমার হাতে ছিলো না। তাই এত’টা কষ্ট পেতে দেখতে হয়েছে তোমাকে? এই সাত দিন আমার সুস্থ হতে সময় লেগেছে। এখনো সব ক্ষ’ত রয়ে গেছে কিন্তু শারীরিক ভাবে অনেক’টাই ফিট তাই আজ আর নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারলাম না। ছুটে এসেছি তোমার কাছে। আমার এই লজ্জাবতী’কে ছাড়া সম্পূর্ণ অসহায়……

ফারদিনের কথা গুলো শুনে ফাইজা চুপ করে থাকলো কোনো রিয়েক্ট করলো না। যখন সব কথা গুলোর মানে বুঝলো তখন অভিমানে নিজেকে ফারদিনের থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে রাগী স্বরে বলতে লাগলো…..

–তার মানে এত দিন আপনি সব নাটক করেছেন। বাহ আর আমি আপনার শোকে পাথর হয়ে পড়ে আছি। আমাকে কষ্ট দিতে আপনার খুব ভালো লাগে তাইনা। খুব মজা পান আমাকে কষ্ট দিয়ে। কেনো এসেছেন আজ? চলে যান এক্ষুনি। আমার আপনাকে চাইনা…..

বলতে বলতে ওর চোখ গুলো জলে ভরে উঠলো। ফাইজার অভিমানী কন্ঠ শুনে ফারদিন অসহায় ফেস করে ফাইজা’কে আবারো টেনে জড়িয়ে নিলো। ফাইজা নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতেই ফারদিন একটু শক্ত করেই ধরে বললো…..

–ব্যাথা পাচ্ছি তো জান। এত অভিমান করতে নেই…..

ফারদিনের কথা শুনে ফাইজা শান্ত হয়ে গেলো। আলতো ফারদিনের পিঠে হাত র রাখলো। মাথা’টা একদম ফারদিনের বুকের সাথে মিশিয়ে নিয়ে চোখ দুটো বন্ধ করে নিলো। ফারদিন ফাইজা’র চুলে মুখ ডুবিয়ে শান্ত হয়ে রইলো। দুটি ভালোবাসার মানুষ আজ শান্তি’তে চোখ বন্ধ করে আছে……

#চলবে

[ভুল ত্রুটি ক্ষমা করুন। একটু সুন্দর সুন্দর মন্তব্য করে যাবেন প্লিজ🥺]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here