#রংধনুর_স্নিগ্ধতা
#পর্ব_৩২
#নবনী_নীলা।
স্নিগ্ধা ফোনে ফাহাদের নাম্বার খোঁজায় ব্যাস্ত। অনেকদিন আগে একবার তার মোবাইলে ফাহাদ কল করেছিলো। ভালো করে খুঁজলে কল হিস্টরি থেকে নিশ্চই নাম্বারটা পাওয়া যাবে। ফাহাদকে এই মুহূর্তে তার ভীষন দরকার। লোকটার সাথে কথা বলতে না পারলে তার শান্তি হচ্ছে না। সেদিন অনেক প্রশ্নই তাকে করা হয়ে উঠেনি সেসব প্রশ্ন যে তার মনে জমাট বেঁধে আছে ।
স্নিগ্ধা ঘণ্টা খানেক ফোন ঘাটাঘাটি করলো। যত সহজে খুজে বের করা যাবে সে ভেবেছিল বিষয়টা এতটা সহজ নয়। কিছুতেই তারিখটা মনে করতে পারছে না সে। বিরক্তি নিয়ে ফোনটা পাশে ছুড়ে মারলো স্নিগ্ধা। অসহ্য লাগছে তার সব কিছু।
রুম থেকে বেরিয়ে একটু অবাক হলো সে। সামনে এগিয়ে এসে দেখতেই বুঝলো যে আজ আরোহীর ঘরটা তালা মারা নয়। দরজাটা চাপিয়ে রাখা হয়েছে। বেশ আগ্রহ নিয়েই স্নিগ্ধা রূমের ভিতরে দরজা ঠেলে প্রবেশ করলো। জিম সিড়ি দিয়ে উঠতেই স্নিগ্ধাকে রুমে প্রবেশ করতে দেখে এগিয়ে যাচ্ছিল স্নিগ্ধাকে থামাবে বলে কিন্তু পাশেই আদিলকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেললো সে।
তারপর সিড়ি বেয়ে উপরে এসে বললো,” আটকালেন না কেনো ওকে?”
আদিল বুকের কাছে দুই হাত ভাজ করে দাড়িয়ে ছিলো। জিমের প্রশ্নে দুই হাত পকেটে ভরে বললো,” আটকানোর প্রশ্ন উঠছে কেনো যখন আমি নিজেই রুমটা স্নিগ্ধার জন্যে খুলে দিয়েছি।”
_______________
রুমে ঢুকেই বিস্মিত চোখে চারিপাশ দেখতে লাগলো স্নিগ্ধা। আজ প্রথম সে আরোহীর মুখটা স্পষ্ট দেখতে পেলো। সামনের বড় দেওয়ালটায় বিশাল এক ছবি টাঙিয়ে রাখা হয়েছে। আরোহী যে খুব রূপবতী ছিলো বলাই বাহুল্য। স্নিগ্ধা অবাক হয়ে চারিদিক দেখতে লাগলো। রুমটা যেনো অন্য এক জগৎ। যেখানে শুধু এই একটি মানুষের বসবাস। শুধু তার অস্তিত্ব রয়েছে এই রুমটায়। স্নিগ্ধা সব কিছু বেশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো। একপাশের টেবিলে পড়ে থাকা ডায়রিটি তার নজর কাড়লো। হাত বাড়িয়ে সেটা নিতে গিয়ে প্রথমে দ্বিধায় পড়তে হয়েছে তাকে।
তবুও সে হাত বাড়িয়ে ডায়রিটা নিলো। পাতা উল্টাতে উল্টাতে দেখলো তারিখ দিয়ে দিয়ে কিছু ছোটো ছোটো ঘটনা লিখে রাখা। বেশ আগ্রহ নিয়ে স্নিগ্ধা পড়তে লাগলো। মাঝখানের ডায়রির একটি পাতায় লেখা,
” আজ আমার জীবনের অনেক সুন্দর এক মুহুর্ত। আমি মা হতে যাচ্ছি। আজ আমি অনেক খুশি হলেও এই খুশি আমি কারোর সাথে ভাগাভাগি করতে পারছি না। আমার ভালোবাসার মানুষটির কানে কানে গিয়ে লাজুক হেসে বলতে পারছি না যে,” তুমি বাবা হতে চলেছ।”
চাইলে এখন মধ্যরাতে ফাহাদের ঘুম ভাঙ্গিয়ে তাকে আমি অন্য এক ভালোলাগার স্বাদ দিতে পারি কিন্তু আজ না। আমি অপেক্ষায় আছি কারণ সামনে ফাহাদের জন্মদিন। সেই বিশেষ দিনে এর থেকে বেশি দামী উপহার কি আমার পক্ষে তাকে দেওয়া সম্ভব? কখনই না।
ফাহাদকে যেহেতু বলিনি তাই কাউকেই আমি এই মন ভালো করে দেওয়ার মতোন খবরটা দিতে পারছি না। হটাৎ যদি কেউ মুখ ফসকে ফাহাদকে বলে দেয় তখন আমার সারপ্রাইজটা মাটি হয়ে যাবে না?”
ডায়রি পড়তে পড়তে যেনো স্নিগ্ধা অন্য এক জগতে হারিয়ে গেছে। কি সব ছেলেমানুষী কথা বার্তা লেখা আছে তবুও যেনো পড়তে ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে আরোহী যেনো তার পাশে বসেই তাকে সব গল্প শুনিয়ে যাচ্ছে। ডায়রির পাতা থেকে চোখে সরাতেই একটা গ্রামোফোন চোখে পড়লো স্নিগ্ধার। এতো আধুনিক যুগেও গ্রামোফোন রাখা কেনো এই ঘরে? স্নিগ্ধা আগ্রহ নিয়ে উঠে দাড়ালো।
সেই ছোটো বেলায় নানুর কাছে প্রথম গ্রামোফোন গান শুনেছে স্নিগ্ধা। এটা দেখে তার খুব গান শুনতে ইচ্ছে হলো।
গ্রামোফোনের পাশেই কতো কেসেট রয়েছে। স্নিগ্ধা একটা হাতে নিয়ে দেখলো উপরে মার্কার পেন দিয়ে গানের নাম লেখা আছে। রবীন্দ্র সংগীতের নাম দেখেই বেশ লোভ হলো স্নিগ্ধার। কোনো কিছু না ভেবেই স্নিগ্ধা একটি কেসেট গ্রমফোনে বসিয়ে দিলো। প্রথমে বেজে উঠলো না। স্নিগ্ধা আরো কয়েকবার চেষ্টা করলো এতো সুন্দর গ্রামোফোন আছে চলবে না কেনো? স্নিগ্ধা সময় নিয়ে বার বার চেষ্টা করতে লাগলো।
এতবারের চেষ্টায় হটাৎ গান বেজে উঠলো সেই গ্রামোফোন থেকে। পুরো বাড়িটা যেনো মধুর এক আওয়াজে ভরে উঠলো। এমন মধুর কণ্ঠ যে স্নিগ্ধার চোখ জোড়া ভালো লাগার আবেশে বন্ধ হয়ে এলো।
অভ্র নিজ রুমে বসে আঁকিবুকি করছিলো। হটাৎ এই গানের আওয়াজে সে মুখ তুলে তাকালো। এই গানগুলো তার খুব প্রিয়, অভ্র দৌড়ে রূমে এসে হাজির হলো।
স্নিগ্ধা মনোমুগ্ধ হয়ে গানগুলো শুনছিল। হটাৎ তার পাশে কারোর উপস্থিতি বুঝে চোখ খুলে তাকালো। দেখলো অভ্র খুব আগ্রহ নিয়ে বসে বসে গানের সঙ্গে পা দুলাচ্ছে। স্নিগ্ধার মনটা খারাপ হয়ে গেলো। এইটুকু শিশুটা জানেই না তার জীবনের আসল সত্যিগুলো। এদিকে আদিল অনেক ভালো একটা কাজ করেছে। সে অভ্রকে কিছুই জানতে দেয় নি। এইটুকু বাচ্চাটা কি বা বুঝে এইসবের। স্নিগ্ধা হাত বাড়াতেই অভ্র ঝাপিয়ে পড়লো তার কোলে। দুই হাতে অভ্রকে জড়িয়ে ধরে স্নিগ্ধা বসে রইলো।
গ্রামোফোনটা নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর শত চেষ্টা করেও আদিল সেটা সারাতে পারেনি। এতো পুরোনো যন্ত্র ব্যবহার করা হয়নি কতো বছর। তাই অনেক চেষ্টা করেও সারানো গেলো না সেটা। গ্রামোফোনটা আরোহীর বড্ড শখের ছিলো। তাই শখের বসে কিছু গান সে নিজ কন্ঠে রেকর্ড করেছিলো। গানটা আজ বেজে উঠতেই চমকে উঠলো আদিল। কতো বছর পর শুনছে সে এই কণ্ঠস্বর। আদিল নিজের রুম থেকে বেরিয়ে এলো। চোখে মুখে তার বিষ্ময়। আরোহীর রুমটার সামনে এসে সে বিষ্ময়ের চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেলো। এটা কি করে সম্ভব?
গ্রামোফোনে গান বাজছে! রূমের ভিতরে স্নিগ্ধা আর অভ্রকে দেখে আদিল আর তার কৌতুহল বাড়লো না। সে রূমের একটি কোণায় চুপটি করে দাড়িয়ে শ্রুতিমধুর সেই গান শুনতে লাগলো। স্নিগ্ধার ক্ষমতা আছে বলা যায়। যেই গ্রামোফোন শত চেষ্টা করেও গত কয়েকবছরে একটিও রেকর্ড প্লেয়ার বাজানো যায় নি। আজ হটাৎ স্নিগ্ধা আসতেই সেই গ্রামোফোন সুর ধরলো!
আনোয়ার সাহেব ইজি চেয়ারে বসে ছিলেন। চুপ করে সে গান শুনছেন। নিজেকে সে কিছুতেই ক্ষমা করতে পারছেন না। এই গানটি শোনার পর যেনো সে আরো অসহায় বোধ করছে। কি করেছে সে এইসব? নিজের মেয়ের জীবনটা তো সে নিজেই বিষিয়ে দিয়েছিল। আজ তারই মুল্য সবাইকে দিতে হচ্ছে। ইজি চেয়ারে গা এলিয়ে দিলেন তিনি। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে তার। কি করতে পারে সে? কীই বা করার আছে তার?
গ্রামোফোনের সেই গান দীর্ঘস্থয়ী হলো না। মিনিট দশেক পরেই কেসেট প্লেয়ার বন্ধ হয়ে গেলো। এর পর স্নিগ্ধা বেশ কিছু চেষ্টা করলো কিন্তু এইবার আর কোনো কিছুতেই কাজ হচ্ছে না। স্নিগ্ধা হাল ছাড়লো এই গ্রামোফোনটা তাকে দয়া করে দশ মিনিট গান শুনিয়েছে বার বার সে দয়া করতে প্রস্তুত নয়।
আদিল গান থামতেই রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। স্নিগ্ধা পিছন ফিরে তাকালো তবে কাউকে দেখলো না। গানগুলো শুনে স্নিগ্ধার ধারণা এই সুর অন্য কারোর নয় নিশ্চই আরোহীর এই সুর। যত জানছে কৌতূহল যেনো তার আরো বেড়েই যাচ্ছে। সব কয়টি ডায়রি পড়লো সে। ডায়রি পড়ে এতটুকু সে ঠিকই বুঝেছে যে আরোহী ফাহাদকে এক সমুদ্র ভালোবাসলেও শেষ সময়টুকু তার চেয়েও বেশি ঘৃনা করে গেছে।
স্নিগ্ধা চুপটি করে ছাদে কিছুক্ষণ বসে রইলো আজ সে কারোর সাথেই কথা বললো না। এই ডায়রি যদি আদিল পড়ে থাকে তাহলে ফাহাদের প্রতি তার হিংস্র হয়ে উঠা খুব অস্বাভাবিক কিছু নয়। কারণ কাছের মানুষকে কষ্ট কেউই সহ্য করতে পারে না।
কিন্তু সবটা তাকেই কেনো জানালো প্রকৃতি। এই সত্যটা কেনো আদিল জানতে পারলো না। ফাহাদের সত্যি কি করে সামনে আনবে সে? কেউ কি তাকে বিশ্বাস করবে। ফাহাদের সেদিনের সেই চোখ মিথ্যে বলতে পারে না। আচ্ছা সে যদি আদিলকে সবটা বলে আদিল বিশ্বাস করবে?
ভাবনার অতল সাগরে ডুবে যাচ্ছে সে।
____________________
আজ সারাদিন স্নিগ্ধা একবারের জন্যেও আদিলের দেখা পায় নি। তার রাগ স্থির আছে কিন্তু মন মানছে না। একটিবারও দেখা পেলো না লোকটার? রাত কম হয় নি। বেশ রাত হয়েছে ঘড়ির কাঁটা বারোটা ছুঁই ছুঁই করছে। স্নিগ্ধা চুপ করে রুমে বসে আছে। কিন্তু এখন তার বেশ অসহ্য লাগছে।
স্নিগ্ধা রুম থেকে বেরিয়ে এলো। বের হতেই জিমকে দেখে এগিয়ে এলো সে। প্রথমে ইতস্তত করলো সে। পরে একটা ঢোক গিলে বললো,” কোথায় সে?”
এ কথার মানে জিম বুঝেছে ঠিকই কিন্তু তবুও না বোঝার ভান করে বললো,” কার কথা বলছেন?” বলেই আসে পাশে তাকালো।
স্নিগ্ধা ভ্রু কুঁচকে তাকালো জিমের না বোঝার ভান সে ঠিকই বুঝতে পেরেছে। স্নিগ্ধা সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,” আবরার ফাইয়াজ।”
জিম ঠোঁট প্রশস্ত করে একটু হাসলো তারপর অভ্রর রূমের দিকে হাত দিয়ে ঈশারা করতেই স্নিগ্ধা আর এক মুহুর্ত বিলম্ব না করে এগিয়ে গেলো। আদিল বাড়িতেই আছে অথচ সে জানেই না। তার সঙ্গে কি লোকটা রাগ দেখাচ্ছে?
স্নিগ্ধা অভ্রর রুমে এসে দাড়ালো। রুমে এক পলক চোখ বুলিয়ে তার রাগটা হালকা হলো।দুজনে কতো আরাম করে ঘুমিয়ে আছে। অভ্র আদিলের একদম বুকের মাঝে মুখ লুকিয়ে এক হাতে আদিলকে জড়িয়ে আছে। আদিল ও দুহাতে আগলে ধরেছে ছোট্ট দেহটিকে।
স্নিগ্ধা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো কয়েক পলক।
[ #চলবে ]