অপেক্ষার প্রহর পর্ব-২

0
1597

অপেক্ষার প্রহর(পর্ব-২)
ইয়াসমিনের খুব মজা লাগছে। বাচ্চাটা আবার নড়ে উঠেছে। এই নিয়ে আজ দ্বিতীয়বারের মত বাচ্চাটা নড়ে উঠল। সুদীপ্তকে কি একটা ফোন দিবে? বলবে বাচ্চা নড়ার কথা? না, বলবে না ইয়াসমিন। কেন বলবে? একে তো আজ তাদের বিবাহবার্ষিকী তা ভুলে গেছে, তার উপর ঝগড়া করে বেরিয়েছে বাসা থেকে।বাজার থেকে এলাচ আর কিসমিস আনতে ভুলে গেছে। কাল রাতে বলেছে, সকালে বাজারে যাওয়ার সময় বলেছে, তারপরও আনতে ভুলে গেছে।
“এত করে বললাম এই দুইটা জিনিষের কথা, তাও আনতে ভুলে গেলে?”
“হ্যাঁ ভুলে গেছি, তো কি হয়েছে?কি হবে এলাচ আর কিসমিস দিয়ে?”
নিজেদের বিবাহবার্ষিকীর কথা মনে করিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে না ইয়াসমিনের। কেন মনে করিয়ে দিবে সে? বিয়ে কি সে একা করেছে? সুদীপ্ত তাকে বিয়ে করেনি? এটা মনে রাখার দায়িত্ব শুধু ইয়াসমিনের একার?ভেবেছিল একটু ভাল মন্দ রান্না করবে আজ। সাথে পায়েস করবে। সুদীপ্ত পায়েস পছন্দ করে খুব।
“আমার একটা রান্না করতে ইচ্ছে করছিল।”
“গরমের সময় এত রান্না করতে ইচ্ছে করে কেন তোমার? সকালবেলা নাস্তা বানাও আর রাতে রান্না কর। দুইজন মানুষের জন্য ভোজ রান্না করার দরকারটা কি?”
“আমার রান্না করতে ইচ্ছে করেছে।”
“এত কিছু ইচ্ছে করলে তো হবে না। দুইদিন পরপর তোমার উদ্ভট উদ্ভট রান্না করতে ইচ্ছে করবে আর আমাকে সে অনুযায়ী বাজার করতে হবে কেন শুনি?”
“উদ্ভট উদ্ভট রান্না মানে?”
“ঐদিন কি করলে? ডাবের পুডিং। তার আগে একদিন করলে সবজি আচার। পুডিংটা যাও ছিল, সবজি আচারটা তো পুরাই ফালতু।”
“ঠিকই তো গপগপ করে খাও।”
“খাব না তো কি করব? সামনে রেখে পূজা করব? কথা সেটা না কথা হচ্ছে এত রান্না বান্না করার দরকারটা কি? তুমি তো কোন রান্নার ইস্কুলে ভর্তি হওনি। তোমাকে পাঠানো হয়েছিল সেলাই শেখার ক্লাসে। সেলাই এর কোন নাম-গন্ধ নাই, উনি আছেন রান্না-বান্না নিয়ে। কোনদিন তো একটা রুমাল ও সেলাই করতে দেখলাম না।”
“রুমাল দিয়ে কি করবে? মানিব্যাগের সাথে পকেটে রেখে দিবে? আর রুমালে কি লেখা থাকবে? ভুলো না আমায়।”
“তোমার কি ধারণা আমি তোমার সাথে ফাজলামো করছি? তোমার সাথে আমার ফাজলামোর সম্পর্ক?”
“না না তা হবে কেন? তোমার সাথে তো আমার ঝগড়াঝাঁটির সম্পর্ক। আমার রান্না তোমার ভাল লাগবে না, আমার ভালবাসা প্রমাণ করার জন্য ভুলো না আমায় মার্কা রুমাল সেলাই করতে হবে, আরও কত কি করতে হবে।”
“কিছু করতে হবে না তোমায়। খাও-দাও আর ইন্টারনেট দেখে ঐসব বিশ্রী বিশ্রী রান্না কর।আমি গেলাম অফিসে।”
“নাস্তা তো শেষ করে যাও।”
“না খাব না। তুমি খাও।রান্না কর আর খাও বসে বসে। ”এই বলে সুদীপ্ত অফিসে চলে গেল।
সুদীপ্ত চলে যাবার পর ইয়াসমিন অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইল। সুদীপ্ত মনে হয় কোন দুশ্চিন্তার মধ্যে আছে। নইলে তাদের বিয়ের দিনের কথা তো ভুলে যাবার কথা না।ইয়াসমিনের এখন নিজের উপর রাগ হচ্ছে। এটুকু তো সে নিজেই নিচের দোকান থেকে কিনে নিয়ে আসতে পারে।
বড্ড অদ্ভুত মানুষটা। ইউনিভার্সিটিতে অনেক ভাল রেজাল্ট করেছে। ভাল বেতনের একটা চাকরী নেয় বিদেশী কোম্পানিতে। অফিসের কাজ-বন্ধুবান্ধব নিয়ে ভালই দিন কাটছিল সুদীপ্তর। কাজের মাঝে ছুটি পরলেই বন্ধুদের নিয়ে এখানে-সেখানে ঘুরতে চলে যেত।বিভিন্ন বিষয় নিয়ে জানার খুব আগ্রহ সুদীপ্তর। চঞ্চল সুদীপ্তর হঠাৎ জানতে ইচ্ছে করল পতিতাবৃত্তি সম্পর্কে জানার।একটা মেয়ে কেন পতিতাবৃত্তি পেশায় আসে তা এক পতিতার মুখ থেকে জানার ইচ্ছে হল। ইচ্ছেটা হুট করেই বলে ফেলে বন্ধু রাকিবকে। রাকিব ওকে একটা ফোন নম্বর দেয়।বলে, “এই নম্বরে ফোন কর। মেয়ে যোগাড় হয়ে যাবে। পেয়ারিবানু নামে এক মহিলার নম্বর এটা।”
সুদীপ্ত ভয়ে ভয়ে ফোন দেয়।“হ্যালো” ওপাশ থেকে জবাব আসে।
“পেয়ারিবানু বলছেন?”
“জি, আপনে কে?”
“জি আমাকে আপনি চিনবেন না। আমার নাম সুদীপ্ত। আমার বন্ধু রাকিবের কাছ থেকে আপনার নম্বর পেয়েছি।”
“কোন রাকিব?”
“টাঙ্গাইল বাড়ি।”
“ওহ হ চিনছি। তা আমার কাছে কি দরকার?”
“জি কিভাবে বলব বুঝতে পারছি না। আমার আসলে একটা মেয়ে দরকার।” কথাটা বলেই বুজতে পারল ভুল হয়ে গেছে বলাটা। কিন্তু বলা কথা তো আর ফেরত নেয়া যায় না।
“এসব কথা তো টেলিফোনে বলা যায় না। আমি আপনারে ঠিকানা বলছি। আপনে রাত ৮টার দিকে চলে আসেন।”
সুদীপ্ত রাত ৮টার দিকেই ঐ ঠিকানায় চলে আসে। পেয়ারিবানুর সাথে দেখা হয়,“আসলে সকালে কথাটা ঠিক মত বলতে পারিনি। আমি একটা মেয়ের কাছ থেকে শুনতে চাচ্ছি সে এ ধরণের পেশায় কেন আসে, কিভাবে তার জীবন কাটে এইসব।”
“আপনে কি পুলিশ বা খবরের কাগজের লোক?”
“না না আমি পুলিশ ও না, খবরের কাগজের লোক ও না। আমার এমনিতেই জানার ইচ্ছে হল।”
“জ্ঞান অর্জনের লাইগা?কেন? আমার মাইয়ারা কি খোলা বই যে যহন আসব তহন পড়ব? টাকা দেন। ঐ রুমে যান। মেয়ে যাবে। সে কেন এই পেশায় আসছে, কিভাবে তার জীবন কাটে সব হাতে- কলমে বুঝায়ে দিবে।”
সুদীপ্ত বুঝল এই মহিলার সাথে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। জিদটাও চেপে গেছে নিজের মধ্যে। বাইরে এটিএম বুথ থেকে টাকা তুলে আনে। রুমে যাওয়ার পর কাউকে দেখতে পায় না । কিছুক্ষণ পরই একটা মেয়ে ঢুকে। মেয়েটাকে দেখে সুদীপ্ত অবাক হয়ে গেল। এত সুন্দর একজন মানুষ কি করে হয়? সুদীপ্তর মনে হচ্ছে মেয়েটার চারপাশটা সব অসচ্ছ। শুধু মেয়েটাই সত্যি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে।
ইয়াসমিনের উপর নির্দেশনা ছিল খদ্দেরের সামনে যাওয়া মাত্র কাপড় চোপড় খুলে ফেলতে হবে। অনেক রুপ নিয়ে এই পৃথিবীতে এসেছে সে। শরীর বিক্রি করেই তাকে খেতে হবে। খদ্দেরের সাথে সুখদুঃখের আলাপ করা যাবে না।তাদের সামনে বোবা সেজে থাকতে হবে।তাই রুমে ঢুকেই ইয়াসমিন শাড়ি খুলে ফেলে। সুদীপ্ত অপ্রস্তত হয়ে পড়ে। “প্লিজ আপনি জামাকাপড় খুলবেন না।আমি শুধু আপনার সাথে কথা বলতে এসেছি। আপনি প্লিজ শাড়ীটা পড়ে নিন।” এই বলে সুদীপ্ত পেছন ফেরে।
ইয়াসমিন এত অবাক জীবনে কোনদিন হয়নি। জীবনে কেউ কোনদিন তাকে আপনি করে বলেনি।তুই তোকারি করেছে। এমনকি কেউ কোনদিন কথাও বলতে চায়নি।সবার শুধু শরীরটাকে দরকার ছিল।ইয়াসমিন শাড়ি পড়ে নিয়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে পড়ে।
পেয়ারিবানু দৌড়ে আসে।“কি হইছে? ঘর থেইকা বাইর হইলি কেন?”
“শরীর খারাপ করছে”
“মাগী। শরীর খারাপের আর সময় পাইলি না।” বলে ইয়াসমিনকে ধাক্কা দেয়।
সুদীপ্ত পেছন ফিরে কাউকে দেখতে না পেয়ে রুমের বাইরে চলে আসে।পেয়ারিবানু দৌড়ে এসে বলল, “আপনি ভিতরে যান। ওর শরীর খারাপ তো কি হইছে আমি আরেকজনরে পাঠাইতেছি। ওর থেকে হাজার গুনে সুন্দরী।”
“ওর থেকেও সুন্দরী?”
পেয়ারিবানু থতমত খেল। এটা ঠিক ইয়াসমিনের চাইতে সুন্দরী মেয়ে ওর কাছে আর নাই। ওর কাছে কেন পেয়ারিবানুর ধারণা পুরো বাংলাদেশে ইয়াসমিনের মত সুন্দরী মেয়ে আর নেই।
“ওর নাম কি?”
“ইয়াসমিন।”
“ওর বাসা কোথায়?”
“মেয়ে আমার বড় অভাগী। তিন কুলে কেউ নাই।আমার কাছেই থাকে।আপনার যদি ওরে বেশি পছন্দ এক সপ্তাহ পর আইসেন। আমি ওরে রেডি রাখব।” পাছে সুদীপ্ত টাকা ফেরত চায় কিনা সেই ভয়টাই করছিল পেয়ারিবানু।না, টাকা সুদীপ্ত ফেরত চায়নি। দিশেহারা ভাব নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল সেখান থেকে।
দিশেহারা ভাব সেদিন ইয়াসমিনের মধ্যেও ছিল।ঘরে ফিরে আসে।কল্পনা শুয়ে ছিল।একটু আগেই ইয়াসমিনকে পরিপাটি হয়ে খদ্দরের রুমে যেতে দেখেছে।“কিরে ফেরত চইলা আসলি যে?”
“শরীর খারাপ করছে।”
কল্পনা হো হো করে হেসে উঠল। “শরীর খারাপ করছে নাকি ব্যাটার সুরুত খারাপ। চেহারা পছন্দ না হইলে আমিও মাঝে মাঝে এই টেকনিক খাটাই। বেশ্যা হইছি বইলা কি পছন্দ-অপছন্দ নাই নাকি?”
“না বুবু, মানুষটার সুরুত খারাপ না। সে যেমন সুন্দর তার কথাগুলাও তেমন সুন্দর।”এই বলে ইয়াসমিন কল্পনার পাশে শুয়ে পড়ে। কল্পনা অবাক হয়ে যায়। অবশ্য ইয়াসমিন অবাক করার মত মেয়ে।ইয়াসমিনের মাও এই লাইনে ছিল।এক দালালের সাথে সম্পর্ক গড়ে উঠে।ইয়াসমিনের জন্ম হয়।কিন্তু ইয়াসমিনের মায়ের আর সংসার করা হয়না।দেহব্যবসা করেই দিন যাপন করতে হয়। ইয়াসমিনের যখন সাত বছর বয়স তখন ওর মা মারা যায়। দশ বছর বয়স থেকে ইয়াসমিনকে এই পেশায় নামতে হয়।ইয়াসমিনকে কেউ কখনও কোন অভিযোগ করতে দেখেনি।যখন যার সাথে শুতে বলেছে শুয়েছে। পাড়ার অন্যদের সাথেও কোন ঝামেলা করতে দেখেনি কেউ।নিজের মধ্যে ডুবে থাকতো যেন। একমাত্র কল্পনার সাথেই তার সখ্যতা ছিল। টিভিতে সবাই যখন সিরিয়াল দেখত সবার চোখ থাকতো সিরিয়ালের ঘটনা, নায়িকাদের সাজপোশাকের দিকে আর ইয়াসমিন দেখত ওদের কথা বলার স্টাইল, চলাফেরা এগুলো।এসবই ওকে টানত বেশি।নিজের টাকায় পেপার রাখত।প্রতিদিন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পুরো পেপার পড়ত।কল্পনাকে বলত, “জান বুবু আমার খুব ইচ্ছে করে মানুষ সম্পর্কে জানতে, পৃথিবী সম্পর্কে জানতে। এত এত মানুষ পৃথিবীতে, ওরা কেমন, ওদের পূর্বপুরুষরা কেমন ছিল, কি করত সব কিছু আমার জানতে ইচ্ছে করে।”
কল্পনা অবাক হয়ে বলল, “কি কস এইসব পাগলের মত?” ইয়াসমিন লজ্জা পেয়ে চুপ করে গেল।কল্পনার মাঝে মাঝে মনে হয় ইয়াসমিন ওদের মত কেউ না।শুধু কপালদোষে এখানে চলে আসছে।ওদের মত ইয়াসমিনকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে খদ্দের ডাকতে হয়না।পেয়ারিবানু খদ্দেরকে রুমে পাঠায়, কিছু সময় পর ইয়াসমিন রুমে যায়। মাঝে মাঝে মেয়েটা খুব কান্নাকাটি করে। সে তো ওরা সবাই করে।কিন্তু কখনো কারো কাছে জীবনের কাঁদুনি গাইতে দেখেনি তাকে।সেদিন আর কথা হয়নি দুজনের মধ্যে।
তিনদিন পর সুদীপ্ত আবার আসে।পেয়ারিবানুর সাথে দেখা করে।
“আমি ইয়াসমিনের সাথে দেখা করতে চাই।”
“কেন?কি দরকার?”
“সেটা আমি ওকেই বলতে চাই।” ছেলেটাকে অসহ্য লাগতেছে পেয়ারিবানুর। বেশ্যা মেয়ের সাথে তোর এত কিসের দরকার?আসবি, ফুর্তি করবি, চইলা যাবি-এত কিসের দরকার তোর? “দেখা হইব না। আপনারে তো বললাম আগামী সপ্তাহে আসতে। তখন কথা কইয়েন।”
“আমি ওর সাথে কথা বলতেই পারি। ভুলে যাবেন না সেদিনের টাকাটা কিন্তু আপনি আমাকে ফেরত দেননি।” সুদীপ্ত কড়া সুরে বলল।
পেয়ারিবানু ভয় পেয়ে গেল।“এই রত্না যা তো। ইয়াসমিনরে ডাইকা আন।”
“আমি ওর সাথে একা কথা বলতে চাই।”সুদীপ্ত স্বর নরম করল না।
পশ্চিম দিকের এই বারান্দাটা একটু নিরিবিলি। সুদীপ্ত সেখানে অপেক্ষা করতে থাকল। দশ মিনিট পর ইয়াসমিন আসল বারান্দায়। সুদীপ্ত সেদিনের মত মুগ্ধ হয়ে তাকিয়েছিল কিছুক্ষণ।(চলবে)

পরের পর্ব: https://www.facebook.com/groups/Anyaprokash/permalink/1362489107599446/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here