অপেক্ষার প্রহর পর্ব-১০

0
646

অপেক্ষার প্রহর (পর্ব- ১০)
“Wow বৌমনি wow, you are just wow।” অপর্ণা ইয়াসমিনকে বলল।
“হঠাৎ এত wow?” ইয়াসমিন জিজ্ঞেস করল।
“মা তো তোমার উপর পুরোপুরি ফিদা হয়ে গেছে।”
“মানে?” ইয়াসমিন- সুদীপ্ত দুজনেই সত্যি অবাক হয়ে গেল। সেদিনের ঘটনার পর অঞ্জনা ইয়াসমিনের উপর ফিদা হয়ে যাবেন এটা বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না দুজনের কার কাছে।
“মা তোমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। তোমার আর দাদাভাইয়ের ছবি বড় করে বাঁধাই করে দেয়ালে টাঙ্গিয়েছে।”
কি কি প্রশংসা করেছে জানতে ইচ্ছে করল ইয়াসমিনের। কিন্তু অপর্ণাকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করল না। সেদিনের কথা ইয়াসমিন মনে করতে চায় না। মেয়ের সাথে মায়ের মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার স্যাপার নিয়ে আলোচনা করতে মন চাইল না। “তোমরা কথা বল।আমি আসছি। আজান দিয়েছে। আমি নামাজ পরে আসছি।” বলে সেখান থেকে সরে আসল ইয়াসমিন। ইয়াসমিন আসলেই অবাক হয়েছে। অঞ্জনা ইয়াসমিনকে থাপ্পড় মেরেছে আবার তার আর সুদীপ্তর ছবি দেয়ালে টাঙ্গিয়েছে। হিসেবটা কেন জানি মেলাতে পারছে না। এটা ঠিক বিয়ের পর ইয়াসমিনের ও মনে হচ্ছিল তাকে বিয়ে করার কারনে সুদীপ্তকে তার পরিবারের কাছ সরে আসতে হয়েছে। সেজন্য নিজেকে দোষারোপও করেছে ইয়াসমিন। সুদীপ্ত বলেছিল, “কেন এভাবে ভাবছ? তুমি তো আমাকে বাসা থেকে বের হতে বলনি। আর আমিও চাইনি বাসা ছেড়ে আসতে। বাবা বলেছেন বাসা থেকে বেরিয়ে যেতে। তাই বাসা ছেড়ে এসেছিলাম। অবশ্য বাবার দোষও দেয়া যায়না। যে কোন বাবাই এ কথা বলবেন। এটাই স্বাভাবিক। যা ঘটেছে তা ভাগ্যে লেখা ছিল তাই হয়েছে। ” তারপর ও নিজেকে প্রতিনিয়ত অপরাধী মনে হয় ইয়াসমিনের। তবে নিজের যাই মনে হোক না কেন কথাটা অঞ্জনার মুখ থেকে শুনতে ভাল লাগেনি ইয়াসমিনের।
অপর্ণারও মনে হয়েছে ইয়াসমিন অপ্রস্তুত হয়ে গেছে। ব্যাপারটা এড়াতে চাইছে। অবশ্য অপর্ণাই জানে দেয়ালে ছবিটা টাঙ্গানো এতটা সহজে হয়নি। অঞ্জনা অপর্ণাকে না বলেই এই বাসায় চলে এসেছিলেন। অঞ্জনা আসবে জানলে অপর্ণা মায়ের সাথে একসাথেই আসত। অঞ্জনা সেদিন বাসায় ফিরে অপর্ণাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “সত্যি করে বল, মেয়েটার পেটে যে বাচ্চাটা ওইটা আমার খোকার তো?”
“মা তুমি আবার এসব বৌমনিকে এসব কথা জিজ্ঞেস করনি তো?” অঞ্জনা চুপ করে রইলেন।
“মা তুমি এটা কি করেছ? তুমি বৌমনিকে সন্দেহ করেছ?”
“কেন? ওর মধ্যে কি সন্দেহ করার মত কিছু নেই?”
“না নেই। কারন বৌমনি অনেক ভাল একটা মেয়ে। তুমি জান আমি গেলে বৌমনি আমাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তোমাদের সবার কথা জিজ্ঞেস করে। তোমাদের কোন সমস্যা হচ্ছে কিনা।এমনকি বাসায় কে কি খেতে পছন্দ করে বৌমনি সব জানে। আর তুমি কিনা বৌমনির সাথে এ ধরণের ব্যবহার করলে?”
“কুশল জিজ্ঞেস করলেই ভাল মেয়ে হয়ে যায় না।”
“হয়তো। কিন্তু একটা কথা জেনে রেখ মা তুমি বা আমরা যতই খুঁজতাম না কেন দাদাভাইয়ের জন্য বৌমনির চেয়ে ভাল মেয়ে খুঁজে পেতাম না।”
“হ্যাঁ হ্যাঁ দেশে তো মেয়েদের আকাল পড়েছে। শুধু পতিতা মেয়েরাই ভাল। আর তোমার দাদাভাই তো সমাজ সংস্কারে নেমেছে।” এই বলে অঞ্জনা রুম থেকে চলে গেলেন। অপর্ণার খুব খারাপ লাগছে। কিন্তু ব্যাপারটা এতটাই নোংরা যে অপর্ণার আর সাহস হল না সুদীপ্ত বা ইয়াসমিন কারও সাথে এই ব্যাপারে কথা বলতে।তবে পরদিন সকালে অপর্ণা সত্যিকার অর্থেই অবাক হল। অঞ্জনা অপর্ণাকে পুজোর প্রসাদ দিতে এসে জিজ্ঞেস করলেন, “তোর কাছে খোকা আর বৌমার ভাল কোন ছবি আছে?”
অপর্ণা অবাক হয়ে বলল, “তুমি তো কাল রাত পর্যন্ত বৌমনিকে খারাপ বলছিলে, আজ একদিনেই মানুষটা বৌমা হয়ে গেল?”
“তার জন্য কি এখন তোর কাছে কৈফিয়ত দিতে হবে?” অপর্ণা চুপ করে গেল।
অপর্ণা সুদীপ্তর কাছে এগিয়ে গিয়ে বলল, “দাদাভাই আমি আসলে জানতাম না মা ঐদিন হুট করে তোর বাসায় চলে আসবে।”
“বাদ দে। সংসারে এমন অনেক ঘটনা ঘটে।সবকিছুকে বড় করে দেখলে সব কিছু জটিল হয়ে যায়। কিন্তু আমি অবাক হচ্ছি এটা ভেবে যে মা আমাদের ছবি দেয়ালে টাঙ্গিয়েছে? বাবা কিছু বলল না?”
“না, বাবা কিছু বলেনি। একদিন দেখলাম অনেকক্ষন ধরে ছবিটার দিকে তাকিয়ে আছে।”
“দাদাভাই, প্রত্যয়ের স্কলারশিপটা হয়ে গেছে।” একটু চুপ থেকে অপর্ণা বলল।
“ওয়াও গ্রেট। কোন দেশে যাচ্ছে?”
“কানাডা।” একটু চুপ থেকে অপর্ণা বলল, “দাদাভাই ওর বাসা থেকে চাচ্ছে আমাদের আশীর্বাদটা সেরে ফেলতে।”
“ভালতো। সেরে ফেল। ডেট ফিক্সড হয়েছে?”
“না, দাদাভাই ওর ব্যাপারে বাসায় তো কিছু জানেনা শুধু তুই ছাড়া। তুই একটু মাকে বলবি প্রত্যয়ের ব্যাপারে।”
“ঠিক আছে। আমি মায়ের সাথে এ ব্যাপারে কথা বলব।” একটু চুপ থেকে সুদীপ্ত জিজ্ঞেস করল, “কৌশিকের খবর কিরে? ও কেমন আছে? ওর পড়াশুনা কেমন চলছে?”
“ছোড়দা জানি কেমন হয়ে গেছে। বাসায় তেমন থাকে না। প্রায়ই হলে থাকে। বাসায় কারও সাথে তেমন কথাও বলে না। ও একটু কেমন জানি অস্বাভাবিক হয়ে গেছে দাদাভাই।”
একটু না, কৌশিক অনেকখানি অস্বাভাবিক হয়ে গেছে। নইলে যে ছেলে সারাক্ষণ বই পড়া, খেলাধুলা এসব নিয়ে মেতে থাকতো সে কিনা ড্রাগস নেয়, ছিনতাই করে। সেদিন কৌশিক ছুরি ধরার পর সুদীপ্ত বলে ফেলেছিল, “কৌশিক তুই?”
সুদীপ্তর গলার আওয়াজটা কৌশিক ও চিনতে পারে। তাই অজান্তেই ছুরিটা হাত থেকে পড়ে যায়। কৌশিককে চিনতে পারায় অন্য ছেলেরাও সেখান থেকে পালিয়ে যায়। বোঝা যায় পেশাদার ছিনতাইকারী না এরা। সুদীপ্ত কৌশিককে রিক্সায় উঠতে বলে।কৌশিকও কোন রকমের অবাধ্যতা না করে রিক্সায় উঠে বসে। কিছুক্ষণ কোন কথা হয়না দুজনের মাঝে।
“রাতের খাবার খেয়েছিস?” সুদীপ্ত জিজ্ঞেস করে।
“না।” কৌশিক জবাব দেয়। সুদীপ্ত একটা হোটেলের সামনে রিক্সা থামায়। প্রচণ্ড ক্ষুধা পেয়েছে কৌশিকের। দুই প্লেট এক্সট্রা ভাত নিয়েছিল। খাওয়ার পর সুদীপ্ত জিজ্ঞেস করল, “এসব কি করছিস?”
“খাওয়ানোর জন্য ধন্যবাদ। গেলাম আমি।” কৌশিকের জবাব।
“কৌশিক আমি তোর কাছ থেকে ধন্যবাদ শুনতে চাইনি। তুই কেন ছিনতাই করে বেড়াচ্ছিস তা শুনতে চাচ্ছি।”
“আমি তো তোর কাছ থেকে কখনও শুনতে চাইনি মা তোকে কেন এত ভালবাসে।” তিন ছেলেমেয়ের মধ্যে সুদীপ্তর প্রতি অঞ্জনার স্নেহের পাল্লাটা একটু বেশি। অপর্ণার এই নিয়ে কোন অভিযোগ না থাকলেও কৌশিক কখনও এই ব্যাপারটা মেনে নিতে পারেনি। সেজন্য ছোটবেলা থেকে সুদীপ্তর ওপর একটা চাপা রাগ রয়েছে কৌশিকের। “তোর ছিনতাই করার সাথে মায়ের ভালবাসার কি সম্পর্ক?” সুদীপ্ত জিজ্ঞেস করল।
“সম্পর্ক আছে দাদাভাই। ছোটবেলা থেকে এমন কোন কাজ করিনি যাতে বাবা-মা কষ্ট পায়। কিন্তু তারপরও কি পেলাম? তুই সবসময় সেরা ছিলি বাবা-মার কাছে। সংসারের সব সিদ্ধান্ত মা তোর সাথে কথা বলে নেয়। এমনকি ঘরের পর্দাটা কি রঙের হবে তার ডিসিশনটাও মা তোর কাছ থেকে নেয়। তুই একটা অস্বাভাবিক বিয়ে করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলি তারপরও ঘরে তোর ছায়া ঘুরে বেড়াচ্ছে মনে হয়। দিনের পর দিন বাবা- মার মধ্যে কোন কথা হয়না। তুই জানিস বাবা ব্যবসার ২০% শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছে নরেশ কাকুর কাছে। পুরো বাসাকে তুই এলোমেলো করে দিয়েছিস দাদাভাই।”
বাবা শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন। কই মা বা অপর্ণা তো তাকে কিছু জানায়নি। বিনয় বাবু ছাত্রজীবন শেষে বন্ধু নরেশ মণ্ডলের সাথে ইলেকট্রনিক্স গুডসের ব্যবসা শুরু করেন। নরেশ কাকুর সাথে তো সেই দিন দেখা হল, নরেশ কাকু তো এই ব্যাপারে কিছু বলেনি। অথচ একটা সময় নরেশ কাকু তার মেয়ের সাথে সুদীপ্তর বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। বন্ধুত্বকে আত্মীয়তায় পরিবর্তিত করতে চেয়েছিলেন।
“অস্বাভাবিক বিয়ে মানে?”সুদীপ্ত জিজ্ঞেস করল।
“অস্বাভাবিক বিয়ে না? দেখ দাদাভাই হিন্দু-মুসলিম বিয়ে নিয়ে আমার কোন আপত্তি নেই। কিন্তু তাই বলে তোর মত এত ওয়েল এডুকেটেড আর এতো বড় অফিসে চাকরি করা একটা ছেলে একটা অশিক্ষিত পতিতাকে বিয়ে করবে? আজ যদি মেয়েটা দেখতে খারাপ হত তুই মেয়েটাকে বিয়ে করতি?”
“তোর সাথে আমার বিয়ে নিয়ে কপচাতে ইচ্ছে করছে না। তারপরও বলছি ইয়াসমিনের সাথে কথা বলে আর ওকে দেখে আমার কোনভাবেই মনে হয়নি ও আমার উপযুক্ত না। আর বাকি থাকে পড়াশুনা। সেটুকু আমি সামলে নিতে পারব বলে মনে হয়েছিল। কিন্তু এর সাথে তোর ছিনতাইয়ের কি সম্পর্ক?”
একটু চুপ থেকে কৌশিক উত্তর দিল, “দাদাভাই ঘরের মধ্যে তোর প্রভাবটা মানতে পারিনি আমি। হলে থাকা শুরু করলাম। মনে করেছিলাম মা এটা মেনে নিবেন না। আমাকে জোর করবেন বাসায় থাকার জন্য। কিন্তু মা আমার ব্যপারে নিরুত্তাপ ছিল। হলে একদিন প্রচণ্ড জ্বরে ভুগছিলাম। মা বা বাবা কেউ একবার আমাকে দেখতেও আসল না। শুধু রুটিন মাফিক কিছু খবর নিল। প্রচণ্ড একা লাগছিল দাদাভাই। দেখলাম এক রুমমেট ড্রাগস নিচ্ছিল। মনে হল এটা নিয়ে তো কিছুটা সময় তো কষ্টটা ভুলে থাকতে পারব। তারপর থেকে শুরু। নেশাটা ধরে গেছে। কিন্তু এগুলোর অনেক দাম। তারপর কখন যে নেশার টাকা যোগাড় করার জন্য ছিনতাই শুরু করলাম বুঝতেই পারলাম না।” সুদীপ্ত অবাক হয়ে কৌশিকের দিকে তাকিয়ে রইল। কৌশিক ড্রাগস নেয়?(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here