অপেক্ষার প্রহর পর্ব-১৮

0
629

অপেক্ষার প্রহর(পর্ব- ১৮)
অপর্ণা আর প্রত্যয় এসেছে সুদীপ্তদের বাসায়। প্রত্যয়কে আগেও দেখেছে সুদীপ্ত। বেশ ভাল লেগেছিল সেদিন। আজও ভাল মনে হয়েছে। ব্যবহারে কোন জড়তা বা আড়ষ্টতা যেমন ছিলনা তেমনি নিজেকে জাহির করার কোন তাগিদও ছিলনা। ইয়াসমিনের প্রতি প্রত্যয়ের ব্যবহারও বেশ সপ্রতিভ ছিল। সুদীপ্ত- ইয়াসমিন দুজনেরই বেশ পছন্দ হয়েছে প্রত্যয়কে। এক ফাঁকে সুদীপ্ত অপর্ণাকে ডেকে বলল, “তোর বৌমনি বাঙ্গালী সংস্কৃতি নিয়ে একটা লেখা লিখেছে। আমি পড়ে দেখেছি। ভাল লেগেছে আমার কাছে। তুই ইয়াসমিনকে সাথে নিয়ে লেখাটা ইউনিভার্সিটির হিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের কোন এক টিচারকে দেখাস তো। ইয়াসমিন চাচ্ছিল এই বিষয়ে পড়াশুনা করা কেউ তার এই লেখাটা দেখুক। ”
“তুই চিন্তা করিস না দাদাভাই, আমি কালই বৌমনিকে নিয়ে যাব।”
সারাদিন সুদীপ্ত-ইয়াসমিনের সাথে সময় কাটিয়ে সন্ধ্যার দিকে অপর্ণা- প্রত্যয় বিদায় নেয়। দুজনে হাত ধরে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতে থাকে। সুদীপ্ত বারান্দা থেকে দেখছিল দুজনকে। ভাল মানিয়েছে দুজনকে পাশাপাশি। ইয়াসমিন ঘরের কাজ শেষে বিশ্রাম নিচ্ছিল। সুদীপ্ত ঘরে ঢুকে ইয়াসমিনের পাশে গিয়ে বসল, “মিনু একটা কথা জিজ্ঞেস করব?”
“কি?”
“তুমি চাচ্ছিলে এই বাচ্চাটা পৃথিবীতে আসুক, তাই কোন পদ্ধতি নাওনি তাইনা?”
ইয়াসমিন অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। সুদীপ্ত কখনও বাবা হতে চায়নি, ইয়াসমিন কয়েকবার বললেও না করে দিয়েছিল। ইয়াসমিন ভয় পেয়ে গেল। সুদীপ্তর চোখ এড়াল না। ইয়াসমিনের হাত ধরে বলল, “ভয় পাচ্ছ কেন?”
ইয়াসমিনের ভয় কমল না। ভয়ে ভয়ে বলল, “তুমি অনেক রাগ করেছ তাইনা?”
“না, রাগ করিনি, শুনে প্রথমে ভয় পেয়েছিলাম। এখন আর ভয় লাগে না। তোমার মনে আছে তুমি একদিন বলেছিলে সৃষ্টিকর্তা সবাইকে সন্তান দেন না। সেদিন মনে হয়েছিল ঠিকই তো।পৃথিবীতে প্রতিটি নারীই মা হতে চায় কিন্তু সৃষ্টিকর্তা সব নারীর মধ্যে মা হবার ক্ষমতা দেন না। একটা বাচ্চার জন্য কত মানুষ কত কষ্ট করে আর সেখানে তোমার মা হওয়ার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও আমি তোমাকে মা হতে বারন করেছিলাম। ভুলটা আমিই করেছিলাম। তুমি খুব সুন্দর করে সেই ভুলটা আমার ভাঙ্গিয়ে দিলে। থ্যাংকস মিনু।”
ইয়াসমিন সুদীপ্তর বুকে মাথা রেখে বলল, “তুমি সত্যি রাগ করনি তো?”
“নারে পাগলি, রাগ করিনি।বরং অপেক্ষা করে আছি আমার মেয়েটাকে দেখার জন্য।”
“মেয়ে?”
“শুধু তোমারই মেয়ের শখ,আমার বুঝি থাকতে পারে না মেয়ের শখ? তুমিই তো বলেছিলে সৃষ্টিকর্তা চাইলে সবকিছু দিতে পারে, তাহলে চাওয়ার মধ্যে কিপটামি করব কেন?”
“সে তো আমি এমনি কথার কথা বলেছিলাম। সত্যিই বলছি, আমি চাইছি একটা সুস্থ বাচ্চা হোক আমাদের।”
সুদীপ্ত ইয়াসমিনকে শক্ত করে ধরে বললেন, “আমি জানি পাগলি, আমি ও তাই চাই। আচ্ছা তুমি বাচ্চাটার সাথে কথা বল? কি নামে ডাক ওকে?”
“কি নামে ডাকব বুজতে পারি না, তবে আমি আমাদের বাচ্চার জন্য নাম ঠিক করেছি।”
“তাই বুঝি? কই, আমায় বলনি তো। কি নাম শুনি?”
“মেয়ে হলে অলি আর ছেলে হলে অরুন। তুমি ঠিক করেছ নাম?”
“হুম করেছি, কিন্তু তোমার নামগুলোর পাশে আমার নামটা অনেক বেমানান তাই বলতে ইচ্ছে করছে না।”
“আহ বলনা।”
“আমি আলাদা আলাদা করে নাম ঠিক করিনি। একটা নামই ঠিক করেছি। ছেলে হোক, মেয়ে হোক একটাই নাম হবে। পুটু নাম।”
ইয়াসমিন অবাক হয়ে বলল, “পুটু? মনে হচ্ছে কোন বিড়ালের নাম। আমি কি বিড়ালের মা?”
“বললাম না, তোমার নামগুলোর পাশে আমার নামটা বেমানান।” সুদীপ্ত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইয়াসমিনের হাত ধরে বলল, “জান, আজকে অপু আর প্রত্যয়কে দেখলাম হাত ধরাধরি করে যেতে। অপুটা বিয়ের পর চলে যাবে ভাবতেই কেমন লাগছে। অপুর একটা অদ্ভুত অভ্যাস ছিল জান। ও আমাদের সবার কাছে একই কারনে আলাদা আলাদা ভাবে টাকা চাইত আর বলত ব্যপারটা খুব গোপনীয়। আমরা চারজনই সরল বিশ্বাসে ওকে টাকা দিতাম। চিন্তা কর একই কথা বলে ও চারজনের থেকে টাকা নিচ্ছে।কয়েকবার এরকম করার পর ধরা পড়ে বন্ধ হয় ওর এই অভ্যাস। ” ইয়াসমিন শুনে হাসতে লাগলো। একটু চুপ থেকে সুদীপ্ত আবার বলতে লাগলো, “ওদেরকে দেখে আমার একটা কথা মনে হল। আমাদের ছেলেমেয়েরা বড় হলে ওদের যখন নিজের নিজের সংসার হবে, তখন আমরা বুড়ো- বুড়ি এভাবে হাত ধরে সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়াব।”
“বুড়ি হয়ে গেলে কি এত হাঁটতে পারব?”
“সমস্যা কি? তোমাকে কোলে নিয়ে হাঁটব।”
“আমি বুড়ি হব আর তুমি ইয়ং থাকবে, তাইনা? তুমিও তো তখন বুড়ো হবে।”
“আস্তে আস্তে হেঁটে দেখব।”
“যতসব অদ্ভুত কথা। পা টা সোজা করতো। আমার ঘুম পাচ্ছে। ঘুমাব।” এই বলে ইয়াসমিন সুদীপ্তর কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ল। সুদীপ্ত ইয়াসমিনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। ইয়াসমিনের পেটে হাত রাখল। বাচ্চাটা এখন বেশ নড়াচড়া করে। সুদীপ্তর খুব মজা লাগে। প্রায়দিন মধ্যরাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলে সুদীপ্ত ইয়াসমিনের পেটে হাত রেখে বাচ্চাটাকে অনুভব করে। মনে মনে বাচ্চাটার সাথে কথা বলে, “কিরে পুটু, কেমন আছিস? এখনও ঘুমাসনি? তোর মা তো ঘুমাচ্ছে। আচ্ছা এখানে থাকতে তোর কেমন লাগে? তুই সারাদিন কি করিস? শুধু খাওয়াদাওয়াই করিস? ঘুমাস না, খেলাধুলা করিস না। জানিস, সকালে অফিসে যাওয়ার সময় যখন বাবাদের দেখি তাদের বাচ্চাদের স্কুলে নিয়ে যেতে তখন মনে হয় আমিও এক সময় আমার পুটুকে নিয়ে স্কুলে যাব। তুই কি স্কুলে গিয়ে অনেক দুষ্টামি করবি? স্কুল থেকে তোর নামে কমপ্লেইন আসবে? আমরা ছুটির দিনে বাইরে ঘুরতে যাব দেখিস। আমরা তিনজনে মিলে অনেক মজা করব। তুই কবে আসবি?জানিস তুই সবার মধ্যমণি হয়ে থাকবি।সবাই তোকে অনেক ভালবাসবে।”
অপর্ণা আর ইয়াসমিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ডঃ হারুনুর রশিদের রুমের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। হারুন সাহেব ক্লাস শেষে রুমের সামনে ওদেরকে দেখে অবাক হয়ে গেলেন। অপর্ণা পরিচয় দিয়ে বলল, “স্যার আপনার সাথে কিছু কথা ছিল।”
“বল মা।”
“আমার বৌমনি একটা লেখা লিখেছে। লেখাটা আপনাকে দেখাতে চাচ্ছে।” বলে ইয়াসমিনের দিকে ইঙ্গিত করল।
ইয়াসমিন তার লেখাটা প্রফেসর সাহেবকে দিল। প্রফেসর সাহেব লেখাটা একটু দেখে জিজ্ঞেস করল, “তোমার লেখাটা ভালই মনে হচ্ছে। অনেক পড়াশুনা করে তুমি লেখাটা তৈরি করেছ বোঝাই যাচ্ছে। কোথা থেকে পড়াশুনা করেছ মা।” ইয়াসমিনকে দেখে সত্যিই অবাক হয়ে গিয়েছিলেন হারুন সাহেব।

ইয়াসমিন একটু চুপ থেকে বলল, “স্যার, পড়াশুনার সুযোগ আমার হয়নি। আমি একজন পতিতা ছিলাম। আমার স্বামী তিন বছর আগে আমাকে বিয়ে করেন। আমি তিন বছর পড়াশুনা করেছি বাঙ্গালী জাতির ইতিহাস- সংস্কৃতির উপর। অনেক বই-পত্র পড়ে আমি এই লেখাটা লিখেছি। আপনি পড়লে আমার খুব ভাল লাগবে স্যার।”
“অবশ্যই পড়বো মা। অনেক বড় তো। আমি সময় নিয়ে পড়ে দেখব। তোমাদের একটা কন্টাক্ট নম্বর দিয়ে যাও। আমি পড়ে তোমাদের জানাব।”হাতের ঘড়িতে সময় দেখে বললেন, “লাঞ্চের সময় হয়ে গেছে। চল লাঞ্চ করে নিবে।”
“না না স্যার, আপনি লাঞ্চ করেন, আমরা গেলাম। আমাদের আরেক জায়গায় যেতে হবে তো।” অপর্ণার বুড়োকে মোটেও সুবিধার মনে হচ্ছে না। বুড়ো ড্যাবড্যাব করে ইয়াসমিনের দিকে তাকিয়ে আছে, আবার লাঞ্চের অফারও জানাচ্ছে। বুড়োভাম কোথাকার।
ক্যাম্পাস থেকে আসার পর থেকে হারুন সাহেব তার মেয়ে নিশির ছবির সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। হারুন সাহেবের স্ত্রী রাবেয়া এসে জিজ্ঞেস করলেন, “আসার পর থেকে দেখছি নিশির ছবির সামনে দাঁড়িয়ে আছ যে? নিশির কথা মনে পড়ছে বেশি?”
“রাবেয়া, তুমি কি বিশ্বাস কর একই চেহারার মানুষ পৃথিবীতে সাতজন আছে?”
“হঠাৎ এই কথা?”
“আজকে ক্যাম্পাসে আমার সাথে দেখা করার জন্য একটা মেয়ে এসেছে। মেয়েটা হুবুহু নিশির মত দেখতে। শুধু নিশির গায়ের রঙ কাল ছিল আর মেয়েটার গায়ের রঙ ফর্শা। একই চোখ, একই নাক, একই ঠোঁট।রক্তের সম্পর্ক ছাড়া একজন মানুষের আরেকজন মানুষের চেহারায় এত মিল থাকে কি করে?”
রাবেয়া দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। অয়নের মা ফোন করেছে আজকে। আয়নের জন্য মেয়ে পছন্দ করা হয়েছে। এই খবর জানার পর থেকে অয়ন বাসায় ফিরছে না। বাইরে বন্ধুর বাসায় থাকছে। ভদ্রমহিলা অনেক কান্নাকাটি করেছেন।
হারুন সাহেব বলে যাচ্ছেন,“সব চেয়ে অবাক করা ব্যাপার কি জান? নিশি বাচ্চা ডেলিভারির সময় মারা গেছে, এই মেয়েটাও প্রেগন্যান্ট। আর কয়েক মাস পর হয়ত মেয়েটার বাচ্চা হবে।” রাবেয়া অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। (চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here