অপূর্ণতায় পূর্ণতা পর্ব-১৪

0
1879

#অপূর্ণতায়_পূর্ণতা
#তানজিলা_তিহা (লেখনীতে)
#পর্ব_১৪

পূর্ব আকাশের বুক ফেটে উঠেছে সোনার থালার আকৃতির সূর্যটা। সূর্য্যি মামার আগমনে শুরু হয়েছে আরেকটা নতুন দিনের। প্রভাতের মিষ্টি কিরণ ছড়িয়েছে অন্যরকম আলোড়ন। ঘড়ির কাঁটা গিয়ে পৌঁছেছে নয়টার ঘরে। চোখ জোড়া মেলে উঠে বসলাম। মাথাটা বেশ ভার হয়ে আছে, ঝিমঝিম করছে। গতকাল রাতের জ্বরটা বেশ ভালো ভাবেই কাবু করতে পেরেছে আমাকে। এতো জ্বর হয়তো আমার কস্মিনকালেও হয় নি। রাতে যদি নূর কাকা এসে ঔষধ না দিতেন তবে আমাকে হয়তো আর খুঁজে পাওয়া যেতো না। কাকার ঔষধ খেতেই রাতে ঘুমাতে পেরেছি না হলে আমার খবর ছিলো।

বিছানা ছেড়ে উঠে গেলাম। ফ্রেশ হয়ে বাবার কাছে গিয়ে বসলাম। বাবা রোজগার মতোই খবরের কাগজ হাতে বসে আছেন। পাশে বসতেই আমার দিকে নজর দিলেন। মা হাতে এক কাপ কফি ধরিয়ে দিলেন। বিনিময়ে একটা মিষ্টি হাসি উপহার দিলাম। বাবা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,

‘এখন কেমন লাগছে মা?’

‘হুম, ভালো।’

জ্বর আছে শরীরে?

না। তবে মাথা ঝিমঝিম করছে।

‘এই ঝড় বৃষ্টিতে কেন বের হতে গেলি বল তো।’

আমি নিশ্চুপ। মা বললেন,

‘তোমার জন্যই তো গেছে। কতবার বললাম ওকে টিউশনি করতে দিয়ো না আমাদের কি টাকা পয়সার অভাব আছে নাকি। কিন্তু শুনলে না মেয়ের ইচ্ছে মতো যা খুশি তাই করতে দিলে।’

‘উফ্ মা টাকার জন্য কেউ পড়ায় নাকি? আমার তো পড়াতে ভালো লাগে। তাছাড়া আমি টিচার হতে চাই। তাই এখন থেকেই প্রেক্টিস‌ করি।’

‘ওত শত বুঝি না। আমার সাথে ওসব চলবে না। তুই আর পড়াতে যাবি না ব্যাস। একদম পরিষ্কার কথা।’

আমি হেসে ফেললাম। মা খুব রেগে আছে। এই মুহূর্তে কিছু না বলাই ভালো। পরে মাকে পটিয়ে নিবো।

‘বাবা তুমি ফাহাদ নামের কাউকে চিনো?’

বাবার দৃষ্টি ফের আমার দিকেই নিবন্ধ হলো। বললেন,

‘কোন ফাহাদের কথা বলছিস তুই?’

‘আনোয়ার আলম ফাহাদ। তুমি তাকে ছিলো?’

‘আনোয়ার আলম ফাহাদ নামটা বেশ চিনা চিনাই লাগছে কিন্তু মনে করতে পারছি না কে। বল তো কে?

‘আমি কি করে জানবো? চিনি না দেখেই তো তোমাকে বলা!’

‘মনে করতে পারছি না রে।’

‘চিনতে পারছো কিন্তু মনে করতে পারছো না?’

বাবা চিন্তিত অবস্থায়ই বললেন, ‘এই নামটা বেশ পরিচিত লাগছে। আমি চিনি মনে হচ্ছে।’

আমি কথা না বলে কফিতে চুমুক দিলাম।‌ হঠাৎ বাবা বললেন, ‘হ্যা হ্যা মনে পড়ছে। আমার চাচাতো ভাই মনোয়ারের ছেলে আনোয়ারের কথা বলেছিস। অনেক ভালো ছেলে। ছোট বেলা কত আমাদের বাড়িতে এসেছে। অনেক ব্রিলিয়ান্ট ছেলে। গত বছরই তো ওর রেজাল্টের খবর শুনালো ফাস্ট ক্লাস ফাস্ট হয়েছে। এখন ছেলেটা শহরে। খুব বড় কোম্পানিতে চাকরি করে। গতবার গ্রামে এসেও আমার সাথে দেখা করে গিয়েছে। বেশ ভালো ছেলে। তুই হঠাৎ ওর কথা জিজ্ঞেস করছিস কেন?’

‘গতকাল দেখা হয়েছিলো।’

‘সে কি! ছেলেটাকে নিয়ে আসতে পারলি না? কত দিন দেখি না। অনেক ভালো ছেলেটা।’

‘আমি তো আসতে বলেছি আসে নি। আমি কোলে তুলে আনবো নাকি?’

‘তা কি বলেছি তোকে? আসলে ভালো হতো।’

‘হুম।’

বাবার কাছ থেকে এসে নাস্তা করে ব্যাগপত্র নিয়ে ভার্সিটির উদ্দেশ্য রওয়ানা দিলাম। ভার্সিটির গেটের সামনে আসতেই রুদ্র স্যারের সাথে দেখা হলো। স্যারকে দেখে মিষ্টি হেসে সালাম জানালাম।

‘আসসালামু আলাইকুম স্যার।’

‘ওয়া আলাইকুম আসসালাম। কেমন আছো?’

‘আলহামদুলিল্লাহ ভালো স্যার। আপনি?’

‘আমি ভালো আছি। তোমার শরীর ঠিক আছে তো? জ্বর কমেছে?’

স্যারের কথা শুনে আশ্চর্য হলাম। স্যার কিভাবে জানলেন আমার জ্বর হয়েছে?

‘জ্বি ভালো স্যার।’

নিজের যত্ন নাও না কেন বলো তো? জ্বর হয়েছে তোমার আর মরে যাচ্ছে আরেকজন। তা কি তুমি জানো?

স্যারের কথা শুনে অবাক হলাম। সে কি বলতে চাইছে আসলে? সন্দেহ নিয়ে জিজ্ঞাস করলাম,

মানে? বুঝলাম না স্যার।

সময় হলেই বুঝবে। এখন যাও ক্লাসে যাও।

স্যার চলে গেলেন। স্যারের কথাটা আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে আমার জ্বরে কে মরবে? বেশ অবাক করার বিষয় এটা!

‘ওই হারামি এতোবার ডাকতেছি কানে যায় না তোর?’

রুম্পির আকস্মিক হামলায় হতভম্ব হয়ে গেলাম। ভয়ার্ত কন্ঠে বললাম,

‘এমন কেউ করে? কতটা ভয় পেয়েছি জানিস?’

‘হ তুমি ভয় পাও মাইনষেরেও ভয় পাওয়ায়। তোর জ্বর আইছে এই খবর আগে বললি না তো।’, হাঁপাতে হাঁপাতে বললো নির্ঝর।

‘আরে তেমন কিছু না। ভালো হয়ে গেছে।’

হ তেমন কিছু না কইলেই হইলো? নূর কাকা না গেলে সারতি? (নির্ঝর)

হুম।

‘ওই রুদ্র স্যার কি বললো রে?’ (রুম্পি)

‘কেমন আছি জিজ্ঞেস করলেন আর…’

আর কি? (রুম্পি)

আর আমাকে একটা ধাঁধায় ফেলে গেলো। বড্ড কঠিন ধাঁধা।

‘তোর ধাঁধার গুষ্টি কিলাই। কত্ত গুলা ফোন দিছি ধরছ না কেন? তোরে মোট নয়টা কল দিছি।’

অর্পণের চেঁচানো সুরে পিছন ফিরে তাকালাম। বেশ রেগে আমার দিকে তাকিয়ে আছে অর্পণ। আমি ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করলাম‌। মিস কলের বন্যা বয়ে গেছে যন্ত্রটিতে। অর্পণ মোট নয়টা কল করেছে। তবে বাকিগুলো কে করলো? লক খুলে স্ক্রিনের দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। একটা নাম্বার থেকেই এসেছে শ’খানেক কল। নামটা দেখে চমকে উঠলাম। ইংরেজি অক্ষরে ‘অরিদ্র’ নামটা দেখা যাচ্ছে। হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। এতো গুলো কল করেছেন উনি? ফোনটা যে কখন সাইলেন্ট হলো বুঝতে পারলাম না!

_________________

গোধূলি লগ্ন সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। ক্লান্ত পথিকের বাড়ি ফেরার সময় হয়ে এসেছে। শ্রমিকেরা সারাদিন পরিশ্রম শেষে বাড়ি ফিরছে। রাজধানীর সর্বত্র লোক সমাগম বিদ্যমান। এ লোক সমাগম সর্বদাই দেখা যায়। বাস স্ট্যান্ডের এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে অরিদ্র। সময় কাটাতে মোবাইল ফোন স্ক্রল করতে ব্যস্ত সে। চারপাশের কাণ্ডকলাপে তার নজরদারি নেই। কিন্তু কে জানে এই গাঢ় বাদামি রঙের শার্ট আর কালো প্যান্ট পরিহিত গম্ভীর যুবকটিকে চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছে আরেক প্রাণী!

‘আপনি অরিদ্র না?’

কারো কণ্ঠস্বর পেয়ে সামনে তাকালো অরিদ্র। সামনেই এক রমণীকে দেখতে পেলো। স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই সে জবাব দিলো, জ্বি।

‘আমাকে চিনতে পেরেছেন? আমি অরুনি। খালার বাড়িতে আপনার সাথে দেখা হয়েছিলো। এক সাথে অনেকক্ষণ গল্প করেছিলাম আমরা।’

‘আপনি কি সিহা ভাবির বোন?’

‘হ্যা হ্যা।’

‘জ্বি বাড়িতে চলুন।’ বলেই পা চালানো শুরু করলো অরিদ্র। পিছন পিছন অরুনিও চলতে লাগলো।

‘আপনি কি করে জানলেন আমি আজ আসবো?’

‘জ্বি ভাবি বলেছে।’

‘ভাবি থেকে শুনে আমায় নিতে চলে আসলেন?’

‘ভাবি বলেছে।’

আর আপনি?

আমি কি?

‘আপনি বুঝি ভাবির কথায় এসেছেন?’

জ্বি।

‘আমার তো অন্যকিছু মনে হয়।’

অরিদ্র থমকে দাঁড়ালো। মেয়েটা দুকদম বেশি বোঝে। অরিদ্র শান্ত ভাবেই বললো,

‘দেখুন মিস অরুনি, ভাবি আপনাকে নিতে পাঠিয়েছে তাই আমি নিতে এসেছি।’

আর একটা কথাও বললো না সে। অরুনি মনে মনে বলতে লাগলো, এই লোক কি হিসেব করে কথা বলে নাকি?

অরুনিকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়েই বেরিয়ে পড়লো অরিদ্র। এক বিষন্নতার ছায়া ঘিরে ধরেছে তাকে। গতকাল রাত থেকেই ইশারাকে কতগুলো কল দিলো কিন্তু একটা কলও ধরলো না সে। বড্ড চিন্তায় পড়ে গেলো সে। ইশারা কেন তার ফোন ধরছে না? ইশারা কি তার উপর রেগে আছে? কোন কারণে কি তার উপর অসন্তুষ্ট মেয়েটা? আর ভাবতে পারছে না সে। মেয়েটার জ্বরের খবর তাকে পাগল করে দিয়েছে। একবার মেয়েটার সাথে কথা বলার জন্য আকুল হয়ে উঠেছে সে। এখন কেমন আছে মেয়েটা? অস্থির হয়ে উঠলো সে। অস্থিরতা বেড়েই চলেছে ক্রমশ। তার ভাবনার মাঝেই হঠাৎ করে মোবাইল ফোনটা বেজে উঠলো। তাতে চোখ বুলিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলো সে। ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠেলো হাসির রেখা!

চলবে…..

( অনুগ্রহ করে ভুলত্রুটি গুলো ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here