#অপূর্ণতায়_পূর্ণতা
#তানজিলা_তিহা (লেখনীতে)
#পর্ব_২০
‘ইশান তুমি আজও হোমওয়ার্ক করো নি কেন?’ কড়া আওয়াজে ইশানকে প্রশ্ন করলাম।
‘ভুলে গেছি ম্যাডাম। সরি।’ ঠোঁট উল্টে বললো ইশান। মুখটা একদম মলিন হয়ে আছে। ছেলেটার মায়া ভরা চোখের দিকে তাকিয়ে আর কিছু বলতে পারলাম না। এই চোখ জোড়া একজনের সাথে খুবই মিলে। হয়তো সে একসময় আমার ছিলো এখন নেই! তাই ছেলেটার চোখের দিকে তাকালে আর কিছু বলতে পারি না তাকে। কিন্তু আজ কঠোর হবো আর ছাড় দিবো না ছেলেটা দিন দিন খুব দুষ্টু হচ্ছে। একটা দিনও হোমওয়ার্ক করছে না।
‘প্রতিদিন তুমি এতো অযুহাত কোথায় পাও ইশান?’
ইশান চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। আমি এখনো কঠিন দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছি।
ছুটির ঘন্টা বাজতেই ছোটাছুটি শুরু করলো সবাই। ইশান আস্তে করে আমার সামনে দিয়ে ব্যাগটা নিয়ে চলে গেলো। কিছু বললাম না। দুষ্টু হলেও ছেলেটা আমায় খুব ভয় পায়।
আমি বেঞ্চ থেকে হ্যান্ডব্যাগটা তুলে ক্লাস রুম থেকে বেরিয়ে গেলাম। সময়ের স্রোতে পাঁচটা বছর কেটে গেছে। পেরিয়ে গেছে হাসি, খুশি, বা বিষন্নতায় কাটানো সময় গুলো। সময় জিনিসটাকে কেউ ধরে রাখতে পারে না। সময় আমাদের কাছ থেকে অনেক কিছু কেড়ে নেয়। আবার দাতা রূপে দান করে অনেক কিছু। এর মাঝে খানে আমার কাছ থেকে আমার বাবাকে কেড়ে নিয়েছে। আমার বাবা আর নেই! ভাবতেই আমার শ্বাস আটকে আসে। তিনি আমাদের ছেড়ে তার রাজ্যে চলে গেছেন। বাবার মৃত্যুর দুটো বছর পেরিয়ে গেছে। সময়ের সাথে সব কিছুর পরিবর্তন হয়েছে। এখন আমি একটা প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছি। সামনে এগোতে পেরেছি। কিন্তু এর পিছনে যার অবদান যার কারণে এতোটা দূর এসেছি তাকে আর পাই নি! আমাকে একা করে দূর এক অজানা শহরে চলে গেছেন তিনি। না একটা বার দেখা, না একটা বার যোগাযোগ। তিনি লাপাত্তা! কেউ জানে না তিনি কোথায়! একটা বারও আমার কথা শুনেন নি। আমার কথা কি তার মনে হয় না? জানতে ইচ্ছে হয় না আমি কেমন আছি? আমার তো চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হয় আমি ভালো নেই! আপনাকে ছাড়া আমি ভালো নেই অরিদ্র!
স্কুল মাঠে বসে আছে ইশান। ছেলেটার চেহারায় বিষন্নতার ছাপ। একা একা বসে আছে সে। স্কুলে জয়েন করেছি মাত্র অল্প কয়েকদিন। কিছুদিন আগেই বদলি হয়েছি। ইশানের পাশে গিয়ে বসে পড়লাম।
‘ইশান এখানে একা কি করছো? বাসায় যাবে না তুমি?’
‘দাদুভাই তো এখনো আসে নি।’
‘দাদুভাই নিতে আসে তোমাকে?’
‘হ্যাঁ, রোজ দাদুভাই এসে আমাকে নিয়ে যায়। দাদুমণি আমাকে স্কুল দিয়ে যায়।’
‘তাহলে তোমার বাবা মা? তারা কি ব্যস্ত?’
ইশানের মুখটা কালো হয়ে গেলো। বললো, ‘আমার মা নেই ম্যাডাম। দাদুমণি বলেছে বাবা দূরে থাকে।’
এই বাচ্চা ছেলেটা নিজের বাবা মাকে ছাড়া থাকে? এতোটুকু ছেলেটার মা নেই! বাবা দূরে থাকে! কি অবাক করা কাণ্ড! ছেলেটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম। বললাম,
‘তোমার বাসা কোথায় বাবা?’
ইশানের উত্তর দেওয়ার আগেই এক বৃদ্ধ সেখানে উপস্থিত হলো।
‘কই গো দাদুভাই? আসো চলো বাড়ি যাই।’
তাকে বেশ পরিচিত লাগছে। ইশান গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলো। আমি অপলক তাকিয়ে আছি। এ তো শুভ্রের বাবা। বৃদ্ধ একবার আমার দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে ফেললেন। বললেন,
‘তুমি এখানে?’
‘আমি এই স্কুলের টিচার।’
বৃদ্ধ হেসে বললেন, ‘কেমন আছো মা?’
‘জ্বি ভালো চাচা। আপনি?’
বৃদ্ধ এবার কেঁদে ফেললেন। বললেন, ‘আমি ভালো নেই মা। তোমার সাথে করা পাপের শাস্তি আমি পাচ্ছি। তোমার বাবার প্রতিশোধ তোমার উপর নিতে গিয়ে আমি শেষ হয়ে গেছি। ক্ষমতার লোভ আমায় শেষ করে দিয়েছে।’
‘এভাবে বলবেন না চাচা। আপনার উপর কোন অভিযোগ নেই আমার। আপনার জন্যই আমি শক্ত হতে পেরেছি। হয়তো জীবন থেকে অনেক কিছু হারিয়ে ফেলেছি। কিন্তু নতুন জীবন পেয়েছি। বাস্তবতা শিখেছি।’
বৃদ্ধ দু হাতে চোখ মুছে ইশানকে দেখিয়ে বললেন, ‘এই হচ্ছে ইশান। শুভ্র আর পায়েলের একমাত্র ছেলে।’
আমি মিষ্টি হাসলাম। ‘ওহ্। খুব মিষ্টি ছেলে। তারা কোথায় চাচা?’
বৃদ্ধের মুখটা কালো হয়ে গেলো। বললো, ‘পায়েল নেই মা। ইশানের জন্মের সময় এই দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছে। আর শুভ্র তো থেকেও নেই।’
‘মানে কি চাচা?’
‘ও মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে।’
তার কথায় থমকে গেলাম। যে যেমন করবে তার কর্মফল ভোগ তাকে করতেই হবে। কথাটা আজ মিলিয়ে নিলাম। কিন্তু কষ্ট হয়ে ইশানের জন্য। এতো ছোট বাচ্চাটা এই বয়সেই বাবা মাকে ছাড়া থাকছে। ছেলেটার কত কষ্ট হচ্ছে!
‘শুভ্র কিন্তু তোমায় পাগলের মতো ভালোবাসতো মা। আজ আমার জন্য! শুধু আমার জন্য সব নষ্ট হয়ে গেলো। সব শেষ করে দিলাম আমি। তোমার নামের সাথে মিলিয়ে ইশানের নাম রেখেছে ও। ও কখনোই তোমাকে ভুলতে পারে নি।’
আমার চোখের নোনাজল বাঁধা মানলো না। টুপ টাপ ঝরতে লাগলো। ইশানের চেহারাটা ঠিক শুভ্রের মতো মায়া জড়ানো। একবার শুভ্রকে আমি বলেছিলাম আমাদের ছেলে মেয়ে হলে ছেলের নাম রাখবো ইশান আর মেয়ের শুভ্রতা। আমার ইচ্ছেটাকে সে পূর্ণ করেছে। কিন্তু ব্যাতিক্রম ভাবে। এসব এখন ভেবে আর কি লাভ হবে? যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। এখন তো আর সব ঠিক হবে না। ভিন্ন রাস্তা আর কোনদিন এক হবে না। আমাদের পথ চলা এখন আলাদা। শুভ্রের জন্য এখন আর ভালোবাসা কাজ করে না আমার। তাকে মন থেকে পুরো মুছার চেষ্টা করেছি। কিন্তু মানুষটাকে দেখতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে।
‘চাচা শুভ্র কোথায়?’
‘এখানে নেই মা। ও হাসপাতালে।’
‘চাচা একবার দেখতে চাই ওকে!’
বৃদ্ধ হেসে বললেন, ‘কাল বিদেশ থেকে ডাক্তার আসবে। শুভ্রকে দেখবে। কাল আমি যাবো। আমার সাথে যাবে মা?’
‘ঠিক আছে চাচা।’ একবার ইশানের দিকে তাকালাম। এরপর বললাম, ‘চাচা ইশানও আমাদের সাথে যাবে।’
__________________________
হাসপাতালের করিডোরে দাঁড়িয়ে আছি। লোহার শিকের ওপাশের ব্যক্তির দিকে তাকিয়ে আছি। কতগুলো বছর পর তাকে দেখছি। একদম আর আগের মতো নেই সে। তার চেহারাটা হয়ে গেছে ফ্যাকাসে। উজ্জ্বল গায়ের রং এখন ছাই। শরীর শুকিয়ে কাঠ। সামনে একটা ছবির দিকে তাকিয়ে একা একাই কিছু একটা বলছে সে। শব্দ আমার কানে আসছে না। বৃদ্ধ তাকে কয়েকবার ডাক দিলো। বিরক্তি নিয়ে সে আমাদের দিকে তাকালো। বললো,
‘আমাকে বিরক্ত করবি না। যদি একবার রাগ উঠে তাইলে তোরে কামড়ায়া দিমু বুইড়া।’
সে আবার তার কাজে মগ্ন হলো। বৃদ্ধ চোখের জল ফেলতে লাগলেন। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে সেখান থেকে চলে এলাম।
‘মামণি আমি তোমাকে পেয়ে গেছি।’
খুব মিষ্টি কণ্ঠস্বর শুনে পিছন ফিরলাম। অর্ণ দাঁড়িয়ে আছে! অর্ণকে দেখে বেশ খুশি হলাম। সাথে সাথেই অর্ণকে কোলে তুলে নিলাম। সিহা আপুর ছেলে অর্ণ। আমি তাকে কোলে নিয়ে চুমু খেতে শুরু করলাম।
‘আমার মামণি এখানে কি করে?’
‘চাচ্চুর সাথে এসেছি মামণি।’
অর্ণের কথা শুনে শকড হলাম। চাচ্চুর সাথে মানে? অভ্র ভাইয়ার কোন ফ্রেন্ড না তো? নাকি অরিদ্র এসেছেন?
‘কোন চাচ্চুর সাথে মামণি?’
‘কেন? অরিদ্র চাচ্চুর সাথে।’
বিস্মিত হয়ে বললাম, ‘তোমার চাচ্চু কোথায়?’
অর্ণ হাতের ইশারায় আমায় দেখিয়ে দিলো। আমি অর্ণকে কোলে নিয়েই সেদিকে রওয়ানা হলাম। সামনে আসতেই থমকে গেলাম। সাদা এপ্রোন পড়া যুবকটিকে দেখে থমকে গেলাম। কত্ত দিন পর দেখা হলো তার সাথে। আমার চোখ দুটো জলে টইটুম্বর। তাকে প্রাণ ভরে দেখতে ইচ্ছে করছে। অস্ফুটিত স্বরে বললাম,
‘অরিদ্র!’
জানি না এ আওয়াজ তার কুর্ণকহরে পৌঁছালো কিনা! তার কাছাকাছি যেতেই একটা ছোট্ট মেয়ে এসে তাকে জরিয়ে ধরলো। অরিদ্র তাকে কোলে তুলে নিলেন। কয়েকটা চুমুও খেলেন।পাশে এসে দাঁড়ালো আরেক রমণী। তাদের মধ্যে চলছে মিষ্টি আলাপন। তাহলে কি অরিদ্র বিয়ে করে ফেললেন? মাথাটা ঘুরিয়ে যাচ্ছে। অর্ণকে কোল থেকে নামিয়ে দিলাম। আর এক মুহুর্তও এখানে দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি আমার মধ্যে নেই! তার সামনে যেতে চাই না আমি। সে সুখে আছে সুখে থাক! আমি অজানায় থাকি না হয়!
চলবে….
(অনুগ্রহ করে ভুলত্রুটি গুলো ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)