মায়াবন বিহারিনী 🌻পর্ব-১৫

0
1814

#মায়াবন_বিহারিণী 🌻
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান (ছদ্মনাম)
#পঞ্চদশ_পর্ব

৩৭.
– “আর আমি যদি বলি চাইলেই কাউকে নিজের মায়ার বাঁধনে আটকানো যায়? চাইলেই তাকে নিজের করে সারাজীবনের জন্য রেখে দেয়া যায়।”
আগ্রাসী সেই কন্ঠস্বর। পিলে চমকে উঠে উপমা। তড়িৎ গতিতে ঘুরে তাকাতেই কিছুটা থমকে যায় সে। এটা কি কোনো কল্পনা নাকি যা দেখছে তার সবটুকুই বাস্তব? ছুঁয়ে দিলে তা কর্পূরের ন্যায় মিলিয়ে যাবে না তো? সামনে দাঁড়িয়ে থাকা একটা অবয়বের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে উপমা। তার ভাবনার মাঝেই ছেদ পড়ে অবয়বটির দ্বিতীয় মুখ নিঃসৃত বাক্যে।
– “কি ব্যাপার এভাবেই একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকার পরিকল্পনা করে বসে থাকবে নাকি নিজের ডাক্তার মশাই‌কে একটু ছুঁয়েও দেখবে?”

নিসংকোচ আবেদন তার। আবেগের কথায় ভাবনার ঘোর কাটে উপমার। তাহলে তার ডাক্তার মশাই আসলেই যায় নি? দ্রুত পাটাতন থেকে নেমে পড়ে সে। তার থেকে ঠিক পাঁচ ছয় হাত দূরেই নির্লিপ্ত ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে আছে আবেগ। মুখশ্রী জুড়ে তার তৃপ্তির হাসি। দুদিনেই চেহারা, চুল উস্কখুস্ক‌ দেখালেও তার মাঝেও আবেগকে অদ্ভুত আকর্ষণীয় লাগছে উপমার নিকট; যেন এই মুহূর্তে আবেগের চেয়ে সুদর্শন পুরুষ উপস্থিত এখানে আর কেউ নেই। ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে আবেগের সামনে দাড়াতেই আবেগ মুচকি হাসে। চোখের ইশারায় তাকে ছুঁয়ে পরখ করে নিতে বললেই আচমকা হালকা শব্দ করে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে উপমা। আকস্মিক ঘটনায় কিছুটা হকচকিয়ে যায় আবেগ। ব্যা‌তি ব্যস্ত হয়ে পড়ে উপমার কান্না করার কারণ খুঁজতে। উপমার চিবুকে আলতো হাতে স্পর্শ করতেই আবেগের হাত তড়িৎ গতিতে সরিয়ে দেয় উপমা। অতঃপর চাপা অভিযোগ মিশ্রিত কন্ঠে বলে উঠে,

– “ছুঁবেন না আমারে। কেন আসছেন এইখানে? চইলা‌ই তো গিয়েছিলেন; ফেরত আসছেন ক্যান আবার? একবারও মনে পড়লো না আমার কথা? কিভাবে পারলেন না জানাইয়া চইলা যাইতে?”
চোখ জোড়া দিয়ে অশ্রু ক্রমাগত গড়িয়ে পড়ছে উপমার। আবেগও উপমার অভিযোগের কারণ বুঝতে পেরে মুহূর্তেই মুখটাকে চুপসে ফেলে। অতঃপর ক্ষীণ কন্ঠে উপমাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
– “যেতে আর পারলাম কই? শ্যামবতীর মায়ায় কেউ যদি একবার ভুল করেও আটকে যায় তাহলে তাকে রেখে ছুটে পালানো যায়?
যেতে তো চেয়েছিলাম সবকিছু পেছনে ছেড়ে; স্টেশন পর্যন্ত চলেও গিয়েছিলাম। তবে কি জানো তো শুধু এই ত্রিমো‌‌হিনী না এই ত্রিমোহিনী‌র চঞ্চল শ্যামবতীর মায়ায় ফিরে আসতে হয়েছে আমাকে। আর যদি নাই বা যেতাম তাহলে বুঝতাম কি করে যে এই ডাক্তার মশাইয়ের প্রেয়সী‌ও ডাক্তার মশাইয়ের প্রেমে পড়ে গিয়েছে?
তো বলো এই ডাক্তার মশা‌ইকে কি নিজের মায়ায় আটকে রাখবে না? রাখবে না নিজের করে চিরদিনের জন্য?”

আবেগের কথা মুগ্ধ হয়ে শুনতে থাকে উপমা। শেষো‌ক্ত আবেদনটি আর নাকোচ করতে পারে না সে। তার অর্থাৎ ডাক্তার মশাই আসলেই তাকে ভালোবেসে। আপ্লুত হয়ে মাথা নেড়ে সম্মতি দিতেই আবেগ বিশ্বজয়ের হাসি দেয়। নিজের বাহু দুটো উপমার উদ্দেশ্যে প্রসারিত করে দিতেই উপমাও সংকোচ না করে এগিয়ে গিয়ে আবেগের বক্ষে নিজের মাথা অতি সন্তর্পণে গুঁজে দেয়। আবেগও যত্নে আগলে নেয় নিজ প্রেয়সীকে।

৩৮.
গোধূলির শেষ লগ্ন। পশ্চিমা আকাশে লাল সূর্য প্রায় নিশ্চিহ্ন। পাখিদের আনাগোনা আর কিচিরমিচির নেই বললেই চলে। সবুজ ঘাসের উপর থাকা বড় গাছের ডালের উপর পাশাপাশি বসে আছে উপমা আর আবেগ। দুজনের দৃষ্টিই সামনে থাকা নদীর স্রোতে আবদ্ধ। বাতাসের তীব্র শো শো বাতাসের মধ্যে খোলা এলো‌কেশী চুলগুলো কপাল হতে সরিয়ে নিয়ে মৃদু কন্ঠে নীরবতা ভাঙে উপমা।

– “তাইলে কবে ফিরতেছেন‌ শহরে?”
উপমার হঠাৎ প্রশ্নে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় আবেগ। উপমার চোখে মুখে কেমন যেন অদ্ভুত বিষন্নতা পরিলক্ষিত করে সে। বিষন্ন হওয়ারই কথা। প্রিয় মানুষটির থেকে দূরে থাকার মতো বেদনা জগতে আর কোথাও নেই। তবুও ভারাক্রান্ত মন নিয়ে প্রত্যুত্তরে বলে উঠে,
– “এইতো পরশুদিন ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথেই ঢাকার ট্রেনে চলে যাব।”
আবেগের কথায় পরক্ষণেই উপমার মন মিইয়ে যায়। কি হতো যদি এমন কোনো উপায় থাকত; যা দিয়ে দুনিয়ার বাদবাকি সব নিয়মের উর্ধ্বে গিয়ে ভালোবাসার দুটো মানুষ একসঙ্গে থাকতে পারত আজীবন।

– “আর আসবেন না এইখানে? আসবেন না নিজের প্রেয়সীরে‌ দেখতে? আর কি দেখা হইব না আমাদের?”
উপমার সন্দিহান প্রশ্ন আবেগের হৃদয়কে আরো একধাপ বিষন্ন করে তুলে। ছোট এই তিনটি বাক্যের মধ্যেও যেন রাজ্যের বিশাল দুঃখ লুকিয়ে রয়েছে।
– “চিন্তা করো না, আমি শীঘ্রই ফিরে আসব। ফিরে আসব আবারো তোমার কাছে। কিছুদিন সময় লাগবে; তবে তোমার ভালোবাসার উপর বিশ্বাস রাখো। তোমার ডাক্তার মশাই তার প্রেয়সীর কাছে ফিরে আসবেই এবং তাকে সাথে করেও নিয়ে যাবে।”
আবেগের কথায় উপমা এক দৃঢ় বিশ্বাস খেয়াল করে। কিন্তু মন তার অজানা কু গাইছে। তবুও আবেগকে কোনো কিছু বুঝতে না দিয়ে মাথা নেড়ে সম্মতি জানাতেই বিনিময়ে মৃদু হাসে আবেগ।
– “সন্ধ্যে হয়ে যাচ্ছে তো চঞ্চল শ্যামবতী; চলো যার যার নীড়ে ফিরে যাওয়া যাক।”

আবেগের কথায় খিলখিল করে হেসে উপমা। আবেগকে মাঝেমধ্যে তার নিকট হাস্যরসাত্মক মনে হয়। তবে তার বলা কথাও ঠিক। বেশ দেরি করে ফিরলে বাড়িতে যে আমেনা বেগমের হাজারটা কটু কথা শুনতে হবে তা ভালো করেই জানে সে। শাড়ির আঁচল গুটিয়ে উঠে দাড়াতেই আবেগ খপ করে উপমার বাম হাত ধরে বসে। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে গেলেও তার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় উপমা।
শার্টের পকেট হতে একটা পেন্ডেন্ট‌ বের করে উপমার দিকে এগিয়ে দিতেই অবাক হয় সে।

– “এটা আমার মায়ের। মা যখন আমার কাছে থাকে না তখন এটা আমার সাথে সবসময় থাকে। আর এটা থাকলে মনে হয় যে মা আমার আশেপাশেই রয়েছে।
তাই এটা তোমাকে দিয়ে যাচ্ছি, যে কদিন আমি থাকব না ততদিন এটা তোমার কাছে থাকবে। আর এটা থাকলে নিশ্চয়ই আমার জন্য অতটাও‌ মন খারাপ হবে না।”
আবেগের দিকে কৃতজ্ঞতা মূলক দৃষ্টিতে তাকায় উপমা। একটা মানুষের কাছে ঠিক এতটাও গুরুত্ব পাওয়ার মতো সৌভাগ্য হয়েছে বলেই মন খুশিতে আপ্লুত হয় তার। বিনিময়ে নিশ্চুপ ভাবেই সেটা গ্রহণ করে সে। খানিকটা সামনে এগিয়ে যেতেই দুজনের পথ ক্রমশ আলাদা হতে থাকে। দুজন দুদিকে। মাঝখানের এই দূরত্ব কি আদৌ কমবে নাকি কে জানে?

৩৯.
বাড়িতে বেশ কিছুক্ষণ আগেই ফিরেছে উপমা। আমেনা বেগম ও কটুক্তি শোনাতে কোনো কমতি রাখেন নি। কিন্তু সেগুলো গায়ে মাখেনি সে। একা একাই বিড়বিড় করতে করতে টর্চ লাইট জ্বালিয়ে বাইরের দিকে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে যান আমেনা বেগম। এই অসময়ে কোথায় যেতে পারে এই নিয়ে ভাবনায় মগ্ন হয়ে পড়ে। টেবিলের উপর বসে বই পড়ায় ব্যস্ত পূর্ণা। পাশেই থাকা ড্রায়ারের ভেতরে থাকা ডায়েরী বের করে নেয় উপমা। কয়েক পাতা উল্টাতেই কিছু শুকনো ফুল আর পায়েল চোখে পড়ে তার। অতি সন্তর্পণে ‌আজকের দেয়া আবেগের সেই লকেটটাও সেটার মধ্যে লুকিয়ে রাখে। দিন দিন প্রিয় জিনিসের তালিকা গুলো ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর মধ্যে কোনো একটা হারিয়ে গেলে বড়ই বিপদ। তাই সেগুলো সাবধানে আবার পুনরায় ড্রয়ারে রেখে দরজার কাছে যেতেই চোখ পড়ে ইফতেখার সাহেবের উপর। গায়ে শাল জড়িয়ে কোথায় যেন চুপিসারে যাচ্ছেন তিনি? কিন্তু কোথায়? একটু আগে তো আমেনা বেগম ও বেরিয়ে গেলেন। কি হচ্ছে আজ এসব? ব্যাপারটা নিয়ে এগোতেই সকালের চাচীর কথা মনে পড়ে যায় তার। আচ্ছা এখন তো কেউ নেই বাড়িতে। একবার যদি ইফতেখার সাহেবের রুমে যাওয়া যায় তাহলে তো একটু খোঁজ করে অয়ন্তিকার মৃত্যুর ব্যাপারে কিছু একটা তো জানাও যেতে পারে।

যেমন ভাবা তেমন কাজ। ইফতেখার সাহেব বাড়ির চৌকাঠ পেরিয়ে যেতেই উপমাও চুপচাপ রুম থেকে বেরিয়ে পড়ে। কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে ইফতেখার সাহেবের রুমের দরজায় এসে দাঁড়ায়। অতঃপর আশপাশে একবার তাকিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে দরজা অতি সন্তর্পণে খুলে ভেতরে প্রবেশ করে সে। রুমের লাইটটা জ্বালানোই আছে; তাই আর কষ্ট করতে হয় নি। ঘরের কোণে একটা মাঝারি আকারের আলমারি আর অপর পাশে একটা বেশ পুরনো সিন্দুক আছে। প্রথমেই আলমারির কাছে চলে যায় সে। সচরাচর এই রুমে কেউ আসে না বলে আলমারির সাথে চাবি ঝোলানোই রয়েছে। চাবি ঘোরাতেই একপাশ খুলে যায় আলমারির।
ভেতরে একপাশে কয়েকটা দামি কাপড় চোপড়, গয়নার বাক্স আর অন্যপাশে কয়েকটা টাকার বান্ডিল। উপর থেকে নিচ পর্যন্ত ভালো করে খুঁজেও কিছু চোখে পড়ে না উপমার। তাই সেটা দ্রুত বন্ধ করে সিন্দুকের কাছে চলে যায় সে।
সিন্দুকের উপরিভাগ বেশ ভারি হওয়ার প্রথমে একটু কষ্ট হয় উপমার। কিন্তু পরক্ষণেই সেটা উপরে তুলতেই সাদা কাপড়ে বাঁধা গাট্টি বোঁচকা চোখে পড়ে তার। দ্রুত সেগুলো তল্লাশি করার জন্য গিট খুলতেই ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে ভয়াবহ জিনিস যা দেখতেই এক মুহূর্তের জন্য আঁতকে উঠে উপমা।
বিভিন্ন ধরনের ছুরি, বন্দুক, আর প্যাকেটে কিছু সাদা গুঁড়ার অংশ। তবে কি অফিসার আমানের বলা কথা কি সত্যিই?
কম্পিত হাত দিয়ে অপর পাশের বোঁচকায় গিট খুলতেই বেরিয়ে আসে রক্ত মাখা একটি বড় দা, সেখানেই এখনো রক্তের ছাপ লেগে আছে সাথে করে বাঁধা এক টুকরো কাপড়। যা দেখে অস্ফুট স্বরে উপমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে,
– “অ,অয়,অয়ন্তিকা মা!”……………….

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here