মায়াবন বিহারিনী 🌻পর্ব-২০

0
1621

#মায়াবন_বিহারিণী 🌻
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান (ছদ্মনাম)
#বিংশ_পর্ব

৫০.
ঘন্টা খানেক পরেই বড় বড় পায়ে উপমার রুমে প্রবেশ করলেন আমেনা বেগম। উপমা তখন খাটের সঙ্গে হেলান দিয়ে আনমনে বসে ছিল। চেহারা খানিকটা ফ্যাকাশে; ঠোঁটের কোণটাও‌ কেটে ফুলে আছে। তাতে রক্ত ও জমে আছে কিছুটা। আমেনা বেগম ঘরে প্রবেশ করতেই ভ্রু কুঁচকে ফেললেন।
বিছানায় একটু আগেই যে শাড়িটা ছুঁড়ে ফেলে গিয়েছেন সেই শাড়িটা এখনও সেভাবেই পড়ে আছে। আর বাদবাকি কিছু সাজ সামগ্রী ছিল তাও এলোমেলো হয়ে মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। উপমার এমন গা ছাড়া ভাব দেখে মুহূর্তেই তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন তিনি। দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে হুট করে উপমার খোলা চুলের মুঠি চেপে ধরতেই হকচকিয়ে যায় উপমা। সাথে ব্যাথায় কুঁকড়ে গিয়ে চোখ দুটো বন্ধ করে ফেলে সে।

– “মুখপুড়ী ন্যাকামি করিস? গতবার ও একই নাটক সাজাইয়া বিয়ে ভাইঙা দিছিলি‌। মুখে বড় বড় কথা; পড়াশোনা করুম, ডাক্তার হমু! অ্যাহ্, ন্যাকামি কইরা বিয়ে ভাইঙা শহুরে পোলার লগে ঘুইরা ঘুইরা প্রেম করতেছিলি!
একখান কথা কান খুইলা শুইনা রাখ‌, এইবারের বিয়েতে যদি মত না দিস তাইলে তোদের দুই বোনের এই বাড়ির অন্ন বন্ধ কইরা দিমু আমি।”
চুলের মুঠি ধরা অবস্থাতেই জোর গলায় শাসিয়ে বলে উঠেন আমেনা বেগম। অন্যদিকে অতিরিক্ত টান খাওয়াতে ব্যাথায় চোখের কার্নিশ বেয়ে টপটপ করে পানি ঝরছে উপমার; কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলে না সে।‌ বেশ কিছুক্ষণ পরেই আমেনা বেগম উপমার চুল ছেড়ে দেন। অতঃপর কর্কশ কন্ঠে গর্জে উঠেন,
– “আর মাত্র আধঘন্টা সময় দিলাম তোরে; সুন্দর কইরা শাড়ি পইড়া তৈরি হইয়া নে। তোর আব্বা কাজী সাহেব আর সজল আইলেই তোগো বিয়া পড়ানো হইব। গতবারের মতোন ভুল করার চিন্তাও করিস না, উপমা।”

বলেই তিনি গটগট করে রুমের বাইরে বেরিয়ে পড়েন। অন্যদিকে উপমা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। সবকিছু তার মাথার উপর দিয়েই যাচ্ছে একপ্রকার। কিন্তু যত যাই হোক; কোনোমতেই এই বিয়েতে মত দেয়া যাবে না। কিন্তু উপমা জানে না এর পরিণতি কি। তার একটা সিদ্ধান্তে কতকিছু পরিবর্তিত হয়ে যেতে পারে।

অপরদিকে ত্রিমোহিনীর সাথে সংযুক্ত মেঘনা নদীর শাখা যেখানে যোগাযোগের মাধ্যম হয়। ইফতেখার সাহেব ও বর্তমানে সেখানেই উপস্থিত হয়েছেন। পাশে সজল ও উপস্থিত আছে। কিছুক্ষণ বাদেই দূর হতে ধেয়ে আসা মোটর বোটে করে একজন মধ্যবয়স্ক লোক এসে নামে নদীর পাড়ে। ইফতেখার সাহেবকে চোখে পড়তেই মুখে হাসি হাসি ভাব নিয়ে ইফতেখার সাহেবের দিকে এগিয়ে যান তিনি। ইফতেখার সাহেব বসে বসে তামাক চিবোচ্ছিলেন আর পাশেই বসে থাকা সজলকে বাহবার সাথে বলে উঠেন,

– “বুঝলা সজল তোমার মধ্যে দিন দিন আমি নিজেরেই দেখবার পারতাছি। তোমার যা কুটনৈতিক বুদ্ধি তাতে এমনিতেই যেকোনো বাজি চোখ বন্ধ কইরাই জিতন‌ যায়। তাছাড়াও শেষ সময়ে যদি এই কৌশল কইরা ভালোই হইছে; সাপও মরব লাঠিও ভাঙব না। খুন খারাবি ছাড়াই যে উপমারে সহজে হাতের মুঠোয় আনোন যাইব তুমি না থাকলে বুঝতাম ই না।”

ইফতেখার সাহেবের মুখে নিজের প্রশংসা শুনে শয়তানি হাসি দেয় সজল। বিড়বিড় করে ধীর গলায় বলে উঠে,
– “ঠিকই কইছেন চেয়ারম্যান সাহেব। সবতো আপনার কাছ থেইকাই‌ শিখা। আর উপমা যে এত সহজেই পাওন যাইব তা আমিও ভাবি নাই।”
– “কিছু কইলা সজল?”
জিজ্ঞেস করেন ইফতেখার সাহেব। সজল কিছু বলতে যাবে তার পূর্বেই সেখানে উপস্থিত হয় সেই মধ্যবয়স্ক ব্যক্তি। লোকটিকে দেখে ইফতেখার সাহেব হেসে উঠে দাঁড়ান। অতঃপর কিছুক্ষণ আলাপচারিতা করে নিজের হাতে থাকা একটা কালো ব্যাগ সেই লোকটিকে ধরিয়ে দেন। লোকটিও ব্যাগ খুলে ভালোমতো দেখে নেয় সবকিছু ঠিক আছে কিনা। গুনে গুনে ২৫ টা ড্রাগস এর প্যাকেট পেতেই তিনি মুচকি হেসে নিজের পকেট হতে দুটো মোটা বান্ডিল টাকা এগিয়ে দেয় ইফতেখার সাহেবের দিকে। ইফতেখার সাহেব ও বিনিময়ে মৃদু হেসে সেই টাকাটা নিয়ে নেন আর লোকটিও বিদায় নিয়ে সেখান থেকে প্রস্থান করেন।

৫১.
নববধূর গায়ে বিয়ের কোনো সাজ সামগ্রী নেই বললেই চলে। উদাসীন মুখশ্রীতে চড়ের দাগ স্পষ্ট ফুটে আছে। হ্যাঁ, একটু আগেই ইফতেখার সাহেব দ্বিতীয় দফায় হাত তুলেছেন উপমার গালে। আর সেটার কারণ হলো উপমা বিয়েতে রাজি হয়নি বলে। উপমার নিস্তেজ শরীরে বিন্দুমাত্র শক্তি নেই যে এখন এতকিছুর প্রতিবাদ একা করতে‌ পারবে। নিজের প্রাণ ও যদি উৎসর্গ করে দিতে হয় তাও সে করবে কিন্তু এ বিয়ে কোনোমতে করবে না বলে ঠিক করেছে সে। আর এজন্যই তাকে এসব অমানবিক নির্যাতন সহ্য করতে হচ্ছে। উপমাকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ইফতেখার সাহেব ক্রুদ্ধ মেজাজ নিয়ে উপমার দিকে তেড়ে যান।
– “এই, কানে কি কথা যায় নাই? মূর্তির মতোন এইখানে দাঁড়াইয়া আছিস কেন? আমি যহন একবার কইছি সজলের লগে তোর বিয়া হইব তার মানে হইবই‌। আর যদি না হয় আজ এই বাড়িত থেইকা তোর লাশ ও খুঁইজা পাইব না কেউ!”

ইফতেখার সাহেবের কথা শুনে মুহুর্তেই সেই পুরনো উপমা জেগে ওঠে। চুপচাপ সহ্য করছে বলে এতটাই দুর্বল ভেবে তার উপর নিজের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিচ্ছে ইফতেখার সাহেব। না এভাবে চুপ থাকা আর সম্ভব না।
– “হ্যাঁ, যেইভাবে‌ আমার অয়ন্তিকা মা’কে খুন করছিলেন তাই তো? কি এমন অপরাধ করছিল আমার মা যার জন্য আমার মা’কে খু’ন‌ কইরা ফেলছেন আপনে। আর আমি এমন কোনো ভুল করিনাই যে তার মাশুল দেয়ার লাইগা আমার সজল ভাইরে বিয়া করতে হইব।”

শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করা উপমার প্রশ্ন ইফতেখার সাহেবকে কিঞ্চিৎ পরিমাণ বিব্রত করে দেয়। মেয়েটা মোটেও ভয় পাচ্ছে না তাকে বরং তাকে উল্টো প্রশ্ন করছে। বাকি কথা এড়িয়ে যেতে চাইলেই উপমা ফের দৃঢ় কন্ঠে জিজ্ঞেস করে ওঠে,
– “কি হইলো বলেন, কেন খু*ন করছিলেন আমার মাকে? এই কারণে যে সে আপনার অপকর্মে বাঁধা দিছিল বইলা? তাইলে শুইনা রাখেন অয়ন্তিকা মায়ের মতোন আমারেও যদি খুন কইরা ফালান তবুও আমি সজল ভাইরে বিয়া করব না!”

উপমার প্রশ্নে ইফতেখার সাহেবের রগচটা মেজাজ আরো একধাপ বিগড়ে যায়। মেয়েটা আসলেই হয়েছে অয়ন্তিকার মতো। কথায় কথায় অযথা প্রশ্ন করে বসে থাকে।

– “হ্যাঁ, হ্যাঁ; আমিই খু*ন করছি অয়ন্তিকারে। আমিই খু*ন করছি। আর যদি দরকার পরে আইজকা তোরেও খু*ন করমু।”
উপমার প্রশ্নোত্তরে‌ ইফতেখার সাহেব প্রায় চেঁচি‌য়েই বলে উঠেন উক্ত বাক্য। তার কথা শুনে উপমা‌ও স্থির হয়ে যায়। যেন এই মুহূর্তে আরো কোনো কথা তার শ্রবণ হচ্ছে না। এরই মাঝে পুনরায় ইফতেখার সাহেব তার মুখ খুলেন,

– “অয়ন্তিকারে যখন প্রথম বিয়া কইরা আনলাম তখন এত জমি, ভিটা কিছুই ছিল না। ফাঁকা গোরস্থা‌নের মতো জায়গায় একখান ছনের ঘর ছিল যেইখানে খুব অভাবের সংসার চলতাছিল‌। আর যার ভিটায় কাজ করতাম সেও তেমন একখান পয়সা কড়ি দিত না। এইভাবেই যখন দিন যাইতেছিল‌ তখন হরিবাবুর‌ সঙ্গে দেখা হয় আমার। সদরে নাকি তার বিরাট ব্যবসা আছে; এই কথা কইয়া আমারেও তার ব্যাবসায় যোগ দিতে কইল। আর এইটাও কইলো যে ব্যবসায় লাভ হইলে মেলা টাকা দিব। সংসারের কথা ভাইবা তখন হাত মিলাই হরিবাবুর‌ লগে। মেলা দিন যাওয়ার পর যখন সে আমারে সদরে নিয়া গেল প্রথমবারের লাইগা তখন তার ব্যাবসাখানা‌ দেইখা ভয় পাইয়া যাই আমি। বিভিন্ন ছুরি, বন্দুক থাকে প্রতি লোকজনের কাছে। আমি গেলে আমারেও তা ধরাইয়া দেয়; সাথে কইরা হরেক রকমের নেশাপানির জিনিস। এইসব এক জায়গা থেইকা অন্য জায়গায় পারাপারের কাজে নাকি কখনও কখনও খু*ন খারাবিও করতে হয়।”

এইটুকু বলেই থামলেন ইফতেখার সাহেব আর উপমা সবকিছু অবিশ্বাস্য হয়ে কর্ণপাত করছে। তার মায়ের হত্যাকারীর এমন বর্ণনা তার পুরো শরীরে কাঁটা ধরিয়ে দেয়।

অন্যদিকে ভরা প্লাটফর্মে বহুকষ্টে ভীড়ভাট্টা ঠেলে সায়ান আর আবেগ ট্রেনে প্রবেশ করেছে। বের হতে একটু বেশিই দেরি হয়ে গিয়েছিল বোধহয়। অবশ্য ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে আধঘন্টা আগেই। সায়ান আর আবেগ নিজ নিজ সিট খুঁজে নিয়ে সেখানেই অবস্থান করেছে। আরেকটু পরেই হয়তো ট্রেন সিলেট ছেড়ে বেরিয়ে পড়বে। সিটের সাথে হেলান দিয়ে বসে রইলেও আবেগের দৃষ্টি সম্পূর্ণ বাইরের দিকে। ধীরে ধীরে এক জায়গার প্রতি দূরত্ব বেড়েই চলেছে তার। এইতো কিছুদিন আগেই তো কাজের জন্য এসেছিল সে ত্রিমোহিনীতে‌। কিন্তু এখানে এসে যে সে বাজেভাবে মায়ায় আটকে যাবে তা কে জানতো? বিশদিন‌ যেন চোখের নিমিষেই কেটে গিয়েছে। মহৎ লোকেরা একটা কথা ঠিকই বলে যে ভালো লাগার, ভালোবাসার সময়গুলো খুব তাড়াতাড়িই ফুরিয়ে যায়। আবেগ যখন বাইরে তাকিয়ে এক ধ্যানে মগ্ন হয়ে এসব ভাবছিল তখনই তার পকেটে থাকা মুঠোফোন বেজে উঠে নিজস্ব রিংটোনে।
পকেট হতে ফোনটা বের করতেই ইশিতা মা নামটা স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করতে থাকে। কল রিসিভ করতেই অপরপাশ‌ থেকে স্নেহের কন্ঠস্বর ভেসে আসে,
– “কেমন আছিস আবেগ?”
মায়ের কন্ঠ শুনে সেকেন্ড কয়েক চুপ থাকে আবেগ। অতঃপর মৃদু হেসে প্রত্যুত্তরে বলে উঠে,
– “আমি আসছি মা। আমি তোমার কাছে ফিরে আসছি।”…………………

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here