#মায়াবন_বিহারিণী 🌻
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান (ছদ্মনাম)
#ত্রয়োবিংশ_পর্ব (অন্তিম খন্ডাংশ-৩)
৫৯.
– “আচ্ছা তারপর কি হলো?”
অল্পস্বল্প উৎসুক কন্ঠস্বর। চোখ দুটোও তার উত্তর খুঁজতে মহাব্যস্ত হয়ে পড়েছে। মেয়েটির এমন আগ্রাসী কন্ঠস্বর অনুসরণ করে তার দিকেই দৃষ্টি ফেরালো আবেগ। মেয়েটাও তার দিকেই চেয়ে আছে উত্তর জানার আশায়। কিন্তু এ উত্তর তো বিভীষিকাময়, ভয়ঙ্কর! কিভাবে মুখ ফুটে বলবে সে এরপর কি হয়েছিল? কিভাবে বলবে সে তার প্রিয়তমার হারিয়ে যাওয়ার বেদনা সম্পর্কে।
সময় গড়িয়েছে বহুদূরে। মুখে আগের মতো খুব একটা মলিনতা নেই, নেই কোনো উজ্জ্বলতা। চোখের নিচে কালসিটে দাগ স্পষ্ট, আগের চশমার বদলে যুক্ত হয়েছে নতুন মোটা ফ্রেমের চশমা। বয়স ও তার পঁচিশ পেরিয়ে চল্লিশের কোঠায় এসে দাঁড়িয়েছে। তবুও এসবের সাথে আবেগের ডাক্তারি জীবনের কোনো বিশেষ যোগসূত্র নেই বললেই চলে।
ডাক্তারি ক্যারিয়ারে একের পর এক সফলতা আর কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে সে আজ বিখ্যাত এক কার্ডিওলজিস্ট হিসেবে পরিচিত হয়েছে আজ সবার কাছে। তবে আজকে নতুন করে অবন্তীর সাথে পরিচয়টা তার জীবনের পুরনো পাতাগুলোকে তার সামনেই মেলে ধরেছে।
মাঝখান থেকে পেরিয়ে গিয়েছে পনেরো বছর। বদলেছে প্রত্যেকটি মানুষের জীবন গতি। আজ এত বছর পর আবারও একই প্রসঙ্গে কথা উঠবে তা ভাবেনি আবেগ। সেই ঘটনার পর থেকে আবেগ প্রতিবারই তার একান্ত কিছু অবসর সময়ে ত্রিমোহিনীতে এসে কাটায়। আবার কখনো বা অফিশিয়াল কিছু কাজ হলেও আসে। এবার ও ত্রিমোহিনীতে এসেছে পাঁচদিন হলো সবেমাত্র। এরই মধ্যে তার পরিচয় অবন্তী নামক মেয়েটার সঙ্গে। মেয়েটার স্বভাব একটু বেশিই কৌতুহলী। শুনেছে মেয়েটা নাকি কোনো প্রচলিত পত্রিকার জার্নালিস্ট এবং এখানে কোনো স্টোরি কভার করতে এসেছে। তবে স্টোরি কভার করার বদলে গত তিনদিনদিন যাবৎ তার পেছনেই পড়ে রয়েছে মেয়েটা। দেখা গেল খুব ভোরে হাঁটতে বের হয়েছে আবেগ তখনও রাস্তায় শাল জড়িয়ে কোথা থেকে যেন মেয়েটা তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। আবার কখনো বা খোলা টংয়ের চায়ের দোকানে। দুদিন কোনো না কোনোভাবে এড়িয়ে চললেও আজকে মেয়েটা সরাসরি বলেই ফেলেছে তার আগ্রহ সম্পর্কে। আরশান শাহরিয়ার আবেগের টোটাল লাইফস্টোরি সম্পর্কে অবন্তীর জানার আগ্রহ দেখে আবেগ ভ্রু কুঁচকায়। তার নিজস্ব ভাষ্যমতে সে কোনো বিখ্যাত লেখক কিংবা সুপারস্টার কিংবা কোনো বড় জ্ঞানী মনীষীও নয় যার জীবনী সম্পর্কে জানতেই হবে। তবুও মেয়েটার জেদের কাছে হার মানতে হয়েছে তাকে। আজ দুপুরের দিকেই বের হয়েছিল আবেগ, পূর্ণার আজ শ্বশুড়বাড়ি থেকে আসার কথা। হয়তো এতক্ষণে এসেও পড়েছে। পথিমধ্যে পুনরায় অবন্তীর সঙ্গে দেখা হয় তার। আর তখন থেকেই এ পর্যন্ত আবেগের পিছু পিছু অনেকটা পথই হেঁটে এসে পড়েছে অবন্তী। সাথে করে জেনেছেও অনেক কিছু। আবেগের কথা শুনে মাঝে মাঝেই চমকে উঠেছিল সে কেননা আবেগের মতোন এমন গুরুগম্ভীর মানুষকে দেখলে বোঝাই যাবে না তার পেছনে এত এত কাহিনী লুকিয়ে আছে।
– “আচ্ছা তারপর কি হলো স্যার? উপমা, পূর্ণা ওরা কোথায়? আর ইফতেখার সাহেবের ই বা কি হলো?”
এতক্ষণ যাবৎ পুরনো অতীত ঘেঁটে তা বর্তমানে ফের নিয়ে আসার মধ্যে ব্যস্ত ছিল আবেগ। তবে অবন্তীর শেষোক্ত প্রশ্ন শুনে তার টনক নড়ে ওঠে। মেয়েটাকে প্রয়োজনের তুলনায় অনেকটাই বলে ফেলেছে। সেজন্য প্রসঙ্গ এড়াতে সে গলা খাঁকারি দিয়ে বলে উঠে,
– “তুমি তো এখানে স্টোরি কভার করতে এসেছ তাই না? তাহলে আমার লাইফ সম্পর্কে এত জেনে কি হবে? কোনোভাবে কি তুমি আমার স্টোরিই কভার করতে আসো নি তো?”
আবেগের প্রশ্ন শুনে থতমত খেয়ে যায় এক মুহূর্তের জন্য অবন্তী। সাথে সাথেই মাথা দুদিকে নাড়িয়ে বলে উঠে,
– “নো স্যার। ইউ আর টোটালি রং। আমি এখানে স্টোরিই কভার করতে এসেছি বাট সেটা আপনার নয়। আমি তো এসব জানতে চাচ্ছি কারণ পার্সোনালিভাবে আমি আপনার ব্যক্তিত্বের অনেক বড় ফ্যান।”
এটুকু বলেই একটু থামে অবন্তী। অতি পরিমাণে নার্ভাসনেস কাজ করছে তার মাঝে। এই স্টোরিটা যদি কভার না করতে পারে তাহলে জার্নালিস্টের চাকরিটা হয়তো আর বেশিদিন স্থায়ী হবে না তার কপালে। যে করেই হোক এত বড় একটা সুযোগ পেয়েছে সে; তাহলে সেটা হাতছাড়া করে কিভাবে? তবুও আবেগ সন্দিহান চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল মেয়েটার দিকে।
– “ঠিক আছে। সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে। এখন ওঠা যাক। আমার পার্সোনাল কিছু কাজ আছে।”
বলেই বসা থেকে উঠে পড়ে আবেগ। ত্রিমোহিনীর রূপ রং ও আগের চেয়ে বেশ খানিকটা পাল্টিয়েছে। আশেপাশের চিত্র, যোগাযোগ ব্যবস্থা আগের থেকে হয়েছে উন্নত। আবেগ উঠে চলে যেতে নিলেই অবন্তী হন্তদন্ত হয়ে উঠে গিয়ে আবেগের সামনে দাঁড়ায়।
– “কিন্তু স্যার, বাকিটুকু? বাকিটুকু বললেন না যে!”
– “সরি মিস অবন্তী। আজকের মতো এতটুকুই। বাকিটুকু না হয় কাল শোনা যাবে।”
বলেই আর এক মুহূর্তও দাঁড়ালো না আবেগ। বড় বড় পা ফেলে সোজা পিচঢালা রাস্তায় হাঁটা শুরু করে সে। আর তার যাওয়ার পানে ড্যাবড্যাব করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল অবন্তী। অতঃপর একপ্রকার চিল্লিয়েই বলে উঠলো,
– “ঠিক আছে স্যার! মনে থাকে যেন; আগামীকাল এই জায়গাতেই বিকেলে আমি অপেক্ষা করব।”
আবেগ শুনলো অবন্তীর কথা। কিন্তু কোনোরূপ প্রতিক্রিয়া না করেই হাঁটতে থাকলো নিজের মতো করে।
৬০.
রাতের আকাশে আজ নক্ষত্রের দল একটু বেশিই উজ্জ্বল। তার উপর পূর্ণিমা তিথি। সবকিছু মিলিয়ে আজ চারপাশ ঝকঝকে পরিষ্কার। ব্যালকনিতে বসেই অবন্তী ল্যাপটপে পেনড্রাইভের সাহায্যে রেকর্ড করা ভিডিও প্রসেসিং করায় ব্যস্ত। এবারের কভার টা ঠিকঠাক করে কমপ্লিট করতেই হবে নাহলে বসের সামনে দাঁড়ানো যাবে না। তবে ভিডিও ফুটেজ গুলো পুনরায় একবার ভালো করে শুনে নিল অবন্তী। যেটুকু শুনেছে তাতেই একজন স্বাভাবিক মানুষের শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠবে। ঘড়ির দিকে একবার তাকিয়ে দেখতেই খেয়াল করে রাত দেড়টার মতো বাজে। বেশি রাত জেগে থাকার অভ্যেস নেই অবন্তীর তবুও এই জার্নালিস্ট এসোসিয়েশনের সাথে যুক্ত হওয়ার পর থেকেই চোখের ঘুম উবে গিয়েছে।
উঠে গিয়ে কিচেন থেকে এক কাপ কফি নিয়ে পুনরায় ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালো সে।
অবন্তী। পুরো নাম জিন্নাত আরা অবন্তী। পঁচিশ বছরের একজন জার্নালিস্ট। ত্রিমোহিনীতে আসার মূল উদ্দেশ্য হলো একমাত্র আবেগ। অনেকদিন যাবৎ কোনো স্টোরি কভার কিংবা আর্টিকেল না করতে পারায় চাকরি তার এখন হুমকির মুখে। তাই ভালো একটা স্টোরি কভার করার জন্য সার্চ করতেই আবেগের সন্ধান পায় অবন্তী। আর তখন থেকেই উদ্দেশ্য আরশান শাহরিয়ার আবেগের জীবনীর উপর একটি স্টোরি কভার করা যা অনেকটাই পূর্ণ হতে চলেছে।
ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বের হতেই দরজায় খটখট শব্দ পড়ে। পাশ ফিরে তাকায় আবেগ। মৃদু গলায় কে এসেছে জিজ্ঞেস করতেই অপর পাশ থেকে পূর্ণার মোলায়েম কন্ঠস্বর ভেসে আসে তার কানে।
– “ভেতরে আসতে পারি ভাইয়া?”
– “পূর্ণা, তুমি? বাইরে দাঁড়িয়ে কেন? ভেতরে এসো।”
পূর্ণা ভেতরে আসতেই আবেগ ইশারায় তাকে বসতে বলে। পূর্ণাও চুপচাপ বসে পড়ে। মিনিট কয়েক পরে আবেগ এসে চেয়ার টেনে বসে পড়ে পূর্ণার সামনে।
– “কেমন আছো পূর্ণা? সবকিছু ঠিকঠাক চলছে তো? রাজীব তোমার আর হৃদির খেয়াল রাখছে তো ঠিকঠাক?”
আবেগের প্রশ্ন শুনে উত্তর দেয় না পূর্ণা। তার চোখের কোণে জল জমা শুরু করে দিয়েছে ইতোমধ্যে। আর তা পরিলক্ষিত হতেই খানিকটা নড়েচড়ে বসে আবেগ। ব্যাতিব্যস্ত হয়ে পড়ে পূর্ণার কান্নার কারণ জানতে।
– “কি হয়েছে পূর্ণা? সব ঠিক আছে তো? রাজীব কিছু বলেছে?”
তবুও পূর্ণার কান্না থামে না। অনেকটা কান্না করার ফলে হেঁচকি উঠে গিয়েছে। আবেগ কিছু বলতে যাবে তার আগেই ধরা গলায় পূর্ণা বলে উঠে,
– “আইজ যদি উপমা থাকত তাহলে দেখতে পারত তার পূর্ণা কতটা সুখে আছে। তার ও একটা সংসার হইছে, সে পড়াশোনা কইরা অনেক বড় হইছে। উপমা তো এইটাই চাইছিল। তার দেখানো পূরণ হইছে, কিন্তু? উপমা? সে কোথায়? নিয়তি এমন নিষ্ঠুর ক্যান হইলো তার সাথে? কি এমন দোষ করছিল মেয়েটা?”
পূর্ণার কথা কর্ণপাত হতেই না চাইতেও মুখের রং উড়ে যায় আবেগের। আহত দৃষ্টিতে শুধু পূর্ণার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সে। এরই মাঝে আবেগের রুমে এসে হাজির হয় ছোট চার বছর বয়সী হৃদি। গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে মায়ের সামনে দাড়াতেই পূর্ণার চোখের জল দেখতে পায় সে। কিছু বুঝতে না পারলেও আধো আধো হাত এগিয়ে নিয়ে পূর্ণার চোখের জল মুছে দেয় হৃদি। মর্মাহত আবেগের দিকে দৃষ্টি যেতেই পূর্ণা বুঝতে পারে নিজের অজান্তেই সে আবেগের পুরনো ক্ষতে আবারো আঘাত দিয়ে ফেলেছে সে। তাই সে প্রসঙ্গ এড়িয়ে চলতে পূর্ণা বলে উঠে,
– “দেখছেন ভাইয়া, কথায় কথায় কটা বাজে সেই খেয়াল ই ছিল না। আমিও যে কি করি না! আইজ আপনের পছন্দের খাবার রান্না করছি। আসেন কয়টা খাইয়া নিবেন।”
– “থাক তোমাকে কষ্ট করতে হবে না পূর্ণা। আমার খাওয়ার ইচ্ছে নেই। তুমি বরং হৃদিকে নিয়ে ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নাও। এমনিতেই রাত হয়েছে অনেক।”
পূর্ণাও তেমন কথা বাড়ালো না আর। হৃদিকে নিয়ে উঠে ধীর পায়ে বেরিয়ে গেল রুমের বাইরে। আর অন্যদিকে পূর্ণা বেরিয়ে যেতেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবেগ। উপমার কথা মনে পড়তেই মন বিষাদে ভরে উঠে; মনের কোণে শুধু একটা কথাই বারবার বাজতে থাকে,
– “তুমি বড়ই স্বার্থপর মায়াবতী! নিজের মায়ার রেশ লাগিয়ে আবার ফের সেই আমাকে একা করেই চলে গেলে। তুমি বড্ড স্বার্থপর!”
এলার্মের তীক্ষ্ণ শব্দ কানে পৌঁছাতেই ঘুম ঘুম ভাব নিয়ে হাতড়ে হাতড়ে এলার্মটা বন্ধ করে অবন্তী। ভোরের আলো ফুটেছে বেশ কিছুক্ষণ আগেই। তবে চোখে লেগে থাকা ঘুমের রেশ এখনো কাটেনি। কিন্তু পরক্ষণেই কিছু একটা ভেবে হুড়মুড়িয়ে উঠে বসে অবন্তী। আজ তো তার আবেগের সাথে দেখা করার কথা। তবে তাতে বেশ খানিকটা সময় আছে। তাই আপাতত উঠে ফ্রেশ হয়ে পুনরায় ল্যাপটপ নিয়ে বসে সে। এরই মধ্যে ফোনে ছয়টা মিসড কল উঠে আছে। সাইলেন্ট থাকায় তা আর খেয়াল করে নি অবন্তী।
ল্যাপটপের ফাইলে নতুন করে আর্টিকেল লেখার জন্য টাইপ করতেই কিছুক্ষণের জন্য থমকে যায় অবন্তী। এভাবে একজন মানুষের বিশ্বাস ভঙ্গ করে তার অজান্তেই তাকে নিয়ে এতসব লেখার জন্য নিজের মাঝে খারাপ লাগা কাজ করে অবন্তীর। তবু সে নিরুপায়; তাইতো এত বড় একটা স্টেপ নিতে চলেছে সে।
গত দিনের মতো আজকেও সেই একই জায়গায় বসে অপেক্ষা করছে অবন্তী এই আশায় যে আবেগ কখন আসবে। যে করেই আবেগের মুখে পুরো কথা শুনতে হবে। কিন্তু বিকেল পেরিয়ে অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে। আবেগের আসার কোনো নাম গন্ধ ও নেই। তবে কি আজকে আবেগ আসবে না? ভেবেই বসা থেকে উঠে পড়ে অবন্তী। চায়ের দোকানে বিল পরিশোধ করে সামনের দিকে পা বাড়াতেই পেছন থেকে কারো মৃদু কন্ঠস্বর ভেসে আসে তার কানে। পেছনে ঘুরে তাকাতেই আবেগের গাম্ভীর্য মুখশ্রী চোখে পড়ে তার। যাক মানুষটা কথা রেখেছে তাহলে!……………..
#চলবে
( দুঃখিত। আমি গল্প আগেই দিতে চেয়েছিলাম। তবে আমার ফোনটায় রিসেন্টলি দেখা দেয়ায় আর ঠিকঠাক মতো লিখতে পারি নি। ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।
ধন্যবাদ ❤️)