অপূর্ব প্রাপ্তি পর্ব-২৭

0
839

অপূর্ব প্রাপ্তি
পর্ব-সাতাশ
নাফিসা নীলয়া!

জায়মা আর তিশা একটা রেস্টুরেন্টে বসে নীরার জন্য অপেক্ষা করছে। এক্সাইটমেন্টে তিশা জায়মাকে নিয়ে অনেক আগেই এসে পরেছে। জায়মা তিশার দিকে তাকিয়ে বললেন।

-কি মনে হয় নীরা আসবে?

জায়মার কথা শুনে তিশা হালকা হেসে বললো।

-অবশ্যই আসবে। চিন্তা করো না।

-আচ্ছা দেখা যাক কি হয়।

জায়মা আর তিশা কথা বলতে বলতেই নীরা এসে পরলো। তিশা দূর থেকে নীরাকে দেখতে পেয়ে জায়মাকে ইশারা করলো। জায়মা তাকিয়ে দেখলেন নীরাকে। নীরাকে দেখেই তার খুব কষ্ট লাগলো। এরকম ডিজেবল মেয়েই কিনা শিহাবের পছন্দ হলো। নীরা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাটছে। এটা দেখেই জায়মার চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। তিশা সেটা দেখতে পেয়ে মুচকি হাসলো। নীরাকে আসতে দেখে তিশা নিজেই এগিয়ে গেল। নীরা তিশাকে দেখে হাসলো। তিশা নীরার হাত ধরে বললো।

-তুমি এসেছো খুব খুশি হয়েছি। খালামনিও খুব খুশি হবেন।

নীরা জবাবে কিছু বললো না। তিশা আর নীরা জায়মার সামনে গেল। নীরা জায়মাকে দেখে হালকা হেসে সালাম দিলো।

-আসসালামু আলাইকুম আন্টি।

জায়মার অনিচ্ছাসত্ত্বেও হাসতে হলো।

-ওয়ালাইকুমুস সালাম। প্লিজ সিট। ভালো আছো তো?

জায়মার কথা শুনে তিশা আর নীরা দুজনেই বসলো। নীরা জায়মার প্রশ্নের জবাবে বললো।

-আলহামদুলিল্লাহ আপনি কেমন আছেন আন্টি?

-আমিও ভালো আছি। তিশা নিশ্চয়ই তোমাকে বলেছে আমি তোমার সাথে দেখা করতে চাই।

-হ্যা তিশা বলেছে আমাকে। আপনার সাথে দেখা করে ভালো লাগলো।

জায়মা হাসলেন। কোন কথা দিয়ে শুরু করবেন সেটাই ভাবছেন। তিশা বুঝলো জায়মাকে। সে কিছু খাবার অর্ডার করলো। তারপর নিজেই কথা শুরু করলো।

-জানো তো নীরা খালামনি আমার খুব ফেভারিট। খালামনি আমাদের সব আবদার রাখেন।

নীরা কিছু বললো না। শুধু হাসলো। জায়মা বললেন।

-আমার কাছে তো তোরাই সব। শুধু আমার ছেলে-মেয়েই আমাকে বুঝলো না। সারাজীবনের আক্ষেপ থেকে যাবে।

জায়মার বিষন্ন কন্ঠ শুনে নীরারও খারাপ লাগলো। তিশা মিটিমিটি হাসলো। জায়মা নীরাকে বললেন।

-তুমি নিশ্চয়ই সব জানো। এটাও নিশ্চয়ই জানো। আমার ছেলে তোমাদের বিয়ের ব্যপারে আমাকে কিছুই বলেনি। আমার কোনো গুরুত্বই নেই তাহলে।

জায়মার কথা শুনে নীরা ঠিক কি বলবে বুঝতে পারছে না। তবুও সে বললো।

-আন্টি আপনি নিজ থেকে শিহাবের সাথে কথা বললে ওকে বোঝালে ও নিশ্চয়ই আপনাকে বুঝবে।

-বুঝবে না নীরা। তুমিই বলো তোমরা তো এখনকার জেনারেশনের। বিতৃষ্ণা নিয়ে কি সংসার করা যায়? শিহাবের বাবার সাথে আমার বিয়েটা আমার পরিবার জোর করে দিয়েছিলো।

নীরা এসব ব্যক্তিগত বিষয় শুনতে চাইছে না। সে কখনোই চায় না কারো ব্যক্তিগত বিষয় শুনতে। নীরা তিশার দিকে তাকালো। তিশা চোখের ইশারায় বললো শুনতে। তবুও নীরা জায়মাকে বললো।

-এসব কথা থাক না আন্টি।

জায়মা নীরার কথা অগ্রাহ্য করে নীরার হাত ধরলেন।

-কেন থাকবে তোমারও শোনা উচিত নীরা। তুমিই বলো এতো বিতৃষ্ণা নিয়ে সংসার করলেই কি সেটা সংসার হতো। কখনোই না। অথচ এই বিষয়টাই আমার ছেলে-মেয়ে বুঝলো না। আমাকে সবধরনের অধিকার থেকে বঞ্চিত করলো। শেষমেষ তোমার সাথে বিয়ের ব্যপারটাও আমাকে জানানো হলো না।

নীরা চুপ করে শুনে যাচ্ছে জায়মার কথা। তিশা জায়মার কথা শুনে মনে মনে বাহবা দিচ্ছে। তার খালামনি যে এতো ইমোশনাল হয়ে কথা বলবে সে সেটা ভাবেইনি।

-সব মায়েরই ইচ্ছে থাকে নিজের রাজপুত্রের মতো ছেলের জন্য নিজে পছন্দ করে রাজকন্যা খোঁজা। অথচ দেখো আমার কপালটা। আমি শিহাবের সব ব্যপারে থাকতে চেয়েছি কিন্তু আমাকে থাকতে দেওয়া হয়নি। তুমিই বলো আমার কি কোনো অধিকার নেই আমার এতো ভালো সুদর্শন, ওয়েল এডুকেটেড,এস্টাবলিশ্ড ছেলের জন্য একজন স্বয়ংসম্পূর্ণ মেয়েকে পছন্দ করা।

এই পর্যায়ে জায়মার কথা শুনে নীরা অবাক হয়ে গেল। পাশাপাশি কোথাও একটা সূক্ষ যন্ত্রনা ও হলো। তবুও সে জায়মার কথা চুপচাপ শুনলো।

-প্লিজ নেভার মাইন্ড নীরা। তুমি খুব ভালো মেয়ে এডুকেটেড, এস্টাবলিশ্ড ওমেন। কিন্তু তুমিই বলো মায়েদের কি কোনো অধিকার নেই ছেলের জন্য একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ মেয়ে পছন্দ করা। মায়েরা সন্তানের জন্য সবসময় সেটাই চায় যেটা সন্তানের জন্য বেস্ট। যেটাতে কোনো খুঁত থাকবে না। আমিও আমার শিহাবের জন্য সবসময় বেস্টটাই চাই। সবসময় ওকে আমি টপ থাকতে দেখেছি। লেখাপড়ায় টপার ছিলো। এখন কাজের ক্ষেত্রেও ও এগিয়ে। তুমি জানো ও আর্মি তে জয়েন করতে চেয়েছিলো। সিলেক্ট ও হয়েছিলো। কিন্তু ওর বাবা ওকে ওর স্বপ্ন পূরণ করতে দেয়নি। জাস্ট বিকজ রেজার ব্যবসার জন্য। স্বার্থপরের মতো আমার ছেলেটার স্বপ্নটাকে খুন করে ফেললো। মা হয়ে আমি তখনও কিছু করতে পারিনি। এরচেয়ে ব্যর্থতার আর কি হতে পারে। আমার ছেলেটা জীবনে অনেককিছু হারিয়েছে। আমিও ছিলাম না। সেই ছেলেকে তো আমি আজীবন আফসোস করতে দেখতে পারবো না। ও নিশ্চয়ই আরো বেটার ডিজার্ভ করে। তুমি বুঝতে পারছো তো আমি কি বলতে চাইছি। দেখো নীরা নিজেকে আমার জায়গায় বসিয়ে দেখো। প্লিজ আমি জানি তোমার মতো ভালো মেয়ে নিশ্চয়ই আমার অবস্থান বুঝবে।

নীরার প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে জায়মার কথা শুনে। সে কি বলবে বুঝতে পারছে না। এরকম কখনো হয় না। যে সে কারো কথার জবাব দিতে পারেনি। আজ পারছে না। তিশা নীরার থমথমে মুখের দিকে তাকিয়ে হাসলো। জায়মার কথায় সে নিজেই ইমপ্রেস হয়ে যাচ্ছে। জায়মা নীরার হাত ধরে আবারও বলে গেলেন।

-দেখো নীরা তোমার প্রতি শিহাবের এই ইনফ্যাচুয়েশনটা হয়তো একদিন থাকবে না। ও হয়তো এখন তাড়াহুড়োয় সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। একটা সময় পর শিহাবের আফসোস হবে। আমি তো মা আমি বলতে পারি। একটা সময় ওর মনে হবে ও লাইফে ভুল করেছে। বড় একটা ভুল। নিজের স্বপ্নও পূরণ করতে পারেনি। আর লাইফ পার্টনার চয়েসের জন্যও ওর আফসোস থাকবে। কিছু বলবে না হয়তো। আমি তো আমার ছেলেকে চিনি। দায়িত্ববান কর্তব্যপরায়ন ছেলে ও। নিজের ভাই বোনকে সবটা দিয়ে আগলে রাখছে। ও এমনই শুধু চুপচাপ সব করে যায় কোনো অভিযোগ করে না। তখনও শুধু চুপচাপ দায়িত্ব পালন করে যাবে ও। তখন কিছুই থাকবে না শুধু আফসোস আর করুনা ছাড়া। তুমি ওর চোখে নিজের জন্য করুনা দেখতে পারবে? আমি তোমাদের দুজনের ফিউচারের কথা ভেবেই সব বলছি নীরা ভেবে দেখো আমার কথাগুলো।

নীরা চোখ তুলে জায়মার দিকে তাকালো। নিজেকে যথাসম্ভব শক্ত করে রাখলো। কারো সামনে ভেঙে পরার মতো মেয়ে সে না।

-আন্টি আমি কখনোই কারো চোখে করুনার পাএী হতে চাইনি। আমার নিজের যখেষ্ট যোগ্যতা আছে। আমি কারো ওপর বোঝাও হবো না।

-আই নো। আমি জানি সেটা। সেজন্যই তো বলছি তোমার মতো একজন কি করে কারো চোখে করুনার পাএী হবে। আমি আমার ছেলেকে জানি নীরা। আর আমার ছেলেটাকে সারাজীবন আফসোস করতে দেখতে পারবো না। কোনো মা ই পারে না। তোমাদের দুজনের ভালোর জন্যই বলছি আমি।

নীরা আর কিছুই বললো না। জায়মা আবার বললেন।

-শিহাব তোমাকে ওর আর তিশার ব্যপারে নিশ্চয়ই বলেছে?

তিশা এই কথা শুনে জায়মাকে থামতে বললো।

-আহ্ খালামনি এসব কোনো ইম্পর্টেন্ট বিষয় না। দরকার কি!

নীরা তখন তিশাকে বলে উঠলো।

-তিশা কি ইম্পর্টেন্ট না। আমি শুনতে চাই। আন্টি আপনি বলুন।

তিশা তারপর থেমে গেল। জায়মা বললেন।

-তিশা আর শিহাবের বিয়ের কথা চলছিলো। সব ঠিকঠাকই চলছিলো। শিহাব আর তিশার আন্ডার্স্ট্যান্ডিং খুব ভালো ছিলো। সেই ছোট থেকেই দুজন দুজনকে বুঝতো। আমিও তিশাকেই চেয়েছি শিহাবের জন্য। ইভেন হয়তো শিহাবও চাইতো। কিন্তু মাঝখানে শিহাবের যে কি হলো!

নীরা এবার পুরোপুরি স্তব্ধ হয়ে গেল। এতোসব শুনতে হবে সে কখনোই ভাবেনি। এখন তার মনে হচ্ছে জায়মার সব কথাই ঠিক। কষ্ট হচ্ছে। এরকম না হলেও পারতো।

এবার তিশা কথা বলে উঠলো।

-দেখো নীরা। আমি কখনোই তোমাদের মাঝে আসতে চাইনি। কখনো আসবোও না। সেজন্যই এই বিষয়টা তোমাকে বলিনি। তুমি প্লিজ ভুল বুঝো না। আর খালামনি তো আমাদের সবার ভালোই চান সেজন্যই এতো কথা বলেছেন। আফটার অল এটা তোমাদের সারাজীবনের ব্যপার। ভেবেচিন্তেই ডিসিশন নেওয়া উচিত। তাই না?

নীরার আর কোনো কথা শুনতে ইচ্ছে করছে না। সে স্বভাবিকভাবেই জায়মাকে বলে উঠলো।

-আন্টি আপনি তো মা। আই থিংক শত বাঁধার পরও প্রথম থেকেই আপনার সন্তানদের পাশে থাকা উচিত ছিলো। তাহলে এরকম দিন আসতো না। সবসময় নিজের কথা ভাবলে চলে না। আশেপাশের মানুষের কথাও ভাবতে হয়। নিজের সন্তানদের কথা ভাবতে হয়। আমি তিতলি আর রেহানকেও চিনি। ওদের মনে যেই শূন্যতাটা আছে সেটা কখনো পূরণ হবে না। তবুও আপনি চেষ্টা করবেন ওদের মনের কাছাকাছি যাওয়ার। একজন মায়ের নেক নিয়ত থাকলে কখনো কেউ কর্তব্য পালন করতে বাঁধা দিতে পারে না। আমাকেই দেখুন আমি শারীরিকভাবে অপূর্ণ। আমার একসময় লেখাপড়া বন্ধ হওয়ার উপক্রকম হয়েছিলো। কিন্তু আমার মা সেটা হতে দেননি। শত বাঁধা পেরিয়ে আল্লাহর ওপর ভরসা করে আমাকে এগিয়ে যাওয়ার সাহস দিয়েছেন। আজকে আমি যা তা শুধুমাএ আমার আল্লাহ আর আমার মায়ের জন্য। মায়েরা নেক নিয়ত থাকলে সব করতে পারে। এখন যা হওয়ার তা তো হয়েছেই। কিছু করার নেই। আমি আপনাকে সম্মান করি। আপনার কথাগুলো আমি ভেবে দেখবো। আর আমি কিছু ভুল বললে ক্ষমা করবেন। আসি আন্টি আসসালামু আলাইকুম।

জায়মার উদ্দেশ্যে নিজের কথা শেষ করে নীরা তিশাকে উদ্দেশ্য করে বললো।

-আসি তিশা ভালো থেকো।

বলেই ধীরে ধীরে হেটে চলে গেল।। জায়মা নীরার কথা শুনে চোখমুখ শক্ত করে ফেললেন। তিশার দিকে তাকিয়ে বললেন।

-কিভাবে বলে গেল দেখলি। দুই কলম পড়ে একটা সামান্য চাকরি করেই অহংকারী হয়েছে। যতো সহজ সরল ভেবেছি ততোটা ও না।

তিশাও একটু চিন্তিত হয়ে গেল। তবুও তার মনে হচ্ছে নীরার ওপর জায়মার বলা কথাগুলো যথেষ্ট এফেক্ট করেছে। সে জায়মাকে উদ্দেশ্য করে বললো।

-চিন্তা করো না খালামনি। ও জাস্ট বলার জন্যই বলেছে। আমি হান্ড্রেট পার্সেন্ট শিওর কথাগুলো ওকে যথেষ্ট এফেক্টেড করেছে। এখন শুধু দেখে যাও।

জায়মা আর কিছু বললেন না। তার মাথায় শুধু নীরার বলা কথাগুলোই ঘুরছে।

মিলা ড্রয়িং রুমে বসে টিভি দেখছে। রেজাউল পাশে বসে চা খাচ্ছেন। অনেকক্ষন যাবত মিলার থেকে টিভির রিমোট নিতে চাইছেন তিনি। তিনি খেলা দেখবেন আর মিলা দেখবে সাইন্স ফিকশন মুভি। রেজাউলের এসব একদম পছন্দ না। তিনি বিরক্ত মুখে মিলার দিকে তাকালেন। বললেন।

-টিভির রিমোট দে না আম্মা। খেলা শেষ হয়ে যাচ্ছে আজকে বাংলাদেশ বনাম পাকিস্তানের ম্যাচ আছে। দে না। পরেও তো মুভি দেখতে পারবি।

মিলা একধ্যানে টিভির দিকে তাকিয়ে আছে। সে তার বাবার কথা শুনলো কিনা বোঝা গেল না। রেজাউল মিলাকে একটা ধাক্কা দিলো।

-দে না মিলা, আমার আম্মা। ম্যাচ শেষ হয়ে গেল যে!

মিলা এবার বিরক্ত হয়ে বললো।

-উফ যাও তো আব্বা বিরক্ত করো না। পারলে আরেকটা নতুন টিভি কিনে নিয়ে এসো।

রেজাউল বুঝলেন মিলার কাছ থেকে তিনি আর রিমোট নিতেই পারবেন না। তিনি বিরস মুখে চা খেতে লাগলেন। মিলা দেখলো রেজাউলের মুখ বিষন্ন। তাই সে চ্যানেল চেঞ্জ করে স্পোর্টসে দিয়ে দিলো। রেজাউল সেটা দেখে উচ্ছাসিত হয়ে গেলেন।

-আরে তুই ই তো আমার আম্মা। দে রিমোট টা দে। উফ টানটান উওেজনা।

মিলা হাসতে হাসতে রেজাউলের সামনে রিমোট রেখে রান্নাঘরে মালিহার কাছে চলে আসলো। মালিহা মিলাকে দেখে বললেন।

-নীরা এখনো আসছে না কেন রে? বিকেল নাগাদই তো আসার কথা। অথচ সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে।

মালিহার কথা শুনে মিলাও চিন্তিত হয়ে গেল। সে বললো।

-দাড়াও একটা ফোন করে দেখি।

বলতে বলতেই বেল বেজে উঠলো। মিলা লাফিয়ে উঠলো।

-নিশ্চয়ই আপা এসেছে। আমি যাচ্ছি দরজা খুলতে।

মিলা দরজা খুলতে চলে গেলে মালিহা হাসতে হাসতে কাজ করতে লাগলেন।

মিলা দরজা খুলেই নীরাকে দেখলো। নীরা তাড়াতাড়ি ভেতরে ঢুকলো। মিলা বলে উঠলো।

-আমার জন্য কি মজা এনেছো?

নীরা ফিক্ করে হেসে ফেললো। মিলা অনেকদিন পর এভাবে বললো। ছোট বেলায় স্কুল কলেজ থেকে আসার পরও মিলা এভাবেই বলতো। আর নীরা ব্যগ থেকে বোনের জন্য মজা বের করে দিতো। কিন্তু আজ তো সে কিছুই নিয়ে আসেনি। সেজন্য সে একটু অনুতপ্ত হয়ে বললো।

-স্যরি ভুলে গেছি মিলা।

এবার মিলাও হেসে ফেললো। দুই বোন কথা বলতে বলতে ভেতরে চলে আসলো। নীরা রেজাউলকে দেখে বললো।

-বাহ্ ম্যাচ দেখা হচ্ছে। শরীর ঠিক আছে আব্বা?

রেজাউল এক পলক তাকিয়ে বললেন।

-একদম।

তারপর আবার টিভির স্ক্রিনে নজর দিলেন। নীরা আর মিলা একে অপরের দিকে তাকিয়ে খিলখিল করে হাসলো। তাদের আব্বা ক্রিকেট খেলা দেখতে বসলে দিন দুনিয়া সব ভুলে যায়। নীরা বাড়ির সবার সাথে দেখা করে ফ্রেশ হয়ে খাওয়া দাওয়া করে নিজের ঘরে চলে আসলো। সবার সাথে একদম স্বাভাবিক ছিলো সে। অথচ তার ভেতরে কষ্ট হচ্ছে। প্রচুর কষ্ট।

শিহাবের ফিরতে আরো চারদিন সময় লাগবে। মোট এক সপ্তাহ রাজশাহী তে থাকতে হচ্ছে তার। সারাদিনের ব্যস্ততায় নীরাকে আর ফোন করাই হয়নি। সেজন্য সে রাতে ভাবলো নীরাকে ফোন করবে। নীরা নিশ্চয়ই এখন ফ্রি আছে। ভেবেই সে নীরাকে ফোন করলো। কিন্তু ফোন রিসিভ হলো না। এভাবেই পরপর দশবার কল করে ফেললো শিহাব। কিন্তু নীরা ফোন রিসিভ করেনি। এবার শিহাবের প্রচন্ড দুঃশ্চিতা হচ্ছে। সে এবার মিলাকে ফোন করলো। তখন রাত বারোটা বাজে। মিলা ঘুমাচ্ছিলো। শিহাবের ফোনকলে জেগে গেল। ফোন হাতে নিয়ে দেখলো শিহাব ফোন করেছে। এতো রাতে কেন ফোন করেছে এটাই মাথায় আসছে না মিলার। সে ফোন রিসিভ করলো। শিহাব সাথে সাথে অস্থির বলে উঠলো।

-হ্যালো মিলা ভাইয়া বলছি।

মিলা একটু অবাক হলো শিহাবের এমন কন্ঠ শুনে। সে বললো।

-হ্যা ভাইয়া আপনার নাম্বার আমার ফোনে সেভ করাই আছে।

-নীরা কোথায় মিলা? ও ঠিক আছে তো? আমার ফোন রিসিভ করছে না কেন? জলদি গিয়ে দেখো।

শিহাবের কথা শুনে মিলা তড়াক করে বিছানা থেকে উঠে গেল। এর আগেও নীরা সারারাত জ্বরে পরে ছিলো। হুস ছিলো না। কাউকে ডাকেওনি। এজন্য মিলারও অনেক চিন্তা হলো। সে বললো।

-আপা তো ঠিকই আছে ভাইয়া। এগারোটার সময়েই ঘরে গেল। তবুও আমি দেখছি।

মিলা ফোন কাটতে গেলে শিহাব বলে উঠলো।

-ফোন কাটবে না মিলা। ফোন কানে নিয়েই যাও।

মিলা আর ফোন না কেটেই দৌড় দিলো। নীরার ঘরের দরজা খোলাই ছিলো নব ঘোরাতেই দরজা খুলে গেল। মিলা ঘরে ঢুকে আশেপাশে তাকিয়ে নীরাকে দেখতে না পেয়ে বার কয়েক ডাকলো। নীরা তখন বারান্দায় ছিলো। মিলার ডাক শুনে সে বারান্দা থেকে বের হয়ে আসলো। মিলা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো নীরাকে দেখে। ওদিকে শিহাব বলে উঠলো।

-ও ঠিক আছে মিলা?

-আপা একদম ঠিক আছে ভাইয়া।

মিলার কথা শুনে শিহাব ওকে বললো।

-তোমার আপাকে ফোনটা দাও।

নীরা এতোক্ষনে বুঝে গেছে মিলা কেন ফোন কানে নিয়েই তার কাছে চলে এসেছে। মিলা নীরার কাছে গিয়ে বললো।

-ভাইয়া ফোন করেছে ধরো।

নীরা মিলার কাছ থেকে ফোন নিলো। শিহাব সঙ্গে সঙ্গেই ধমক দিয়ে বলে উঠলো।

-কতোবার ফোন করেছি ফোন ধরোনি কেন? আশ্চর্য!

নীরা নির্লিপ্ত কন্ঠে বললো।

-ফোন সাইলেন্ট ছিলো। আমি বারান্দাতে ছিলাম। মিলার ঘুমের ব্যাঘাত হচ্ছে। আমি আমার ফোন দিয়ে তোমাকে কল ব্যক করছি রাখো।

বলেই নীরা ফোন কেটে মিলার কাছে দিলো। মিলা সন্দিহান চোখে নীরার দিকে তাকালো।

-আপা তুমি তো কখনো ফোন সাইলেন্ট করো না। আর এতো রাতে বারান্দাতে কেন?

নীরা স্বাভাবিক ভাবেই বললো।

-আরে উল্টাপাল্টা চাপ লেগে হয়তো সাইলেন্ট হয়ে গেছে। অনেক রাত হয়েছে। যা তো ঘুমা।

মিলা আর কিছু না বলে ফোন নিয়ে ঘুমাতে চলে গেল। মিলা যাওয়ার পরপরই নীরা নিজের ফোন হাতে নিলো।তৎক্ষনাত শিহাবের ফোন আসলো। নীরা রিসিভ করলো। শিহাব এবার কন্ঠস্বর নরম করে বললো।

-ঠিক আছো তুমি? আমার কতো দুঃশ্চিন্তা হচ্ছিলো জানো!

নীরা নির্লিপ্ত কন্ঠেই বললো।

-ঠিক আছি। ঘুম পাচ্ছে এখন ঘুমাবো রাখছি।

শিহাব নীরার কথা শুনে অবাক হয়ে গেল। নীরা অনেকদিন পর তার সাথে এভাবে কথা বললো। শিহাব একটু আহত হলো। বললো।

-আমাকে কিছুই জিজ্ঞেস করবে না?

নীরা ধমকে বলে উঠলো।

-কি বলবো আজব! রাতবিরেতে কি এখন আমি গল্প করবো তোমার সাথে।

শিহাব হতভম্ব হয়ে গেল। নীরা এর আগে কখনো এভাবে কথা বলেনি। এমনভাবে বললো যেন শিহাব নীরার কাছে ম্যাটারই করে না। শিহাব নিজেকে শান্ত রেখে বললো।

-এভাবে বলছো কেন? সত্যি করে বলো কি হয়েছে তোমার? কোনোকিছু নিয়ে খুব ডিস্টার্ব তুমি? আমি তো বলেছিই আমার কাছে সব বলতে পারো তুমি। এভরিথিং।

-হ্যা ডিস্টার্ব। এখন রাখছি ঘুমাবো।

বলেই ফোন কেটে দিলো নীরা। শিহাবের খুব খারাপ লাগলো। নীরার এমন ব্যবহারের কারন সে খুঁজে পেলো না। আহত মন নিয়ে সে ও শুয়ে পরলো। ভাবলো সকাল নাগাদ হয়তো সব ঠিক হয়ে যাবে।

নীরা বারান্দায় দাড়িয়ে ভাবছে শিহাব তাকে তিশার কথাটা কেন বললো না। সত্যিই কি সে একদিন শিহাবের আফসোসের কারন হবে! যার চোখে নিজের জন্য মুগ্ধতা,সম্মান, আর সবচেয়ে বড় কথা একসমুদ্র ভালোবাসা দেখতে পায়। তার চোখেই নিজের জন্য আফসোস আর করুনা কি করে দেখতে পারবে সে। এটা কখনোই সহ্য করতে পারবে না নীরা। কখনো না। এসব ভেবেই নীরার চোখে পানি এসে গেল।

–চলবে!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here