অপূর্ব প্রাপ্তি পর্ব-৩৪

0
735

অপূর্ব প্রাপ্তি
পর্ব-চৌত্রিশ
নাফিসা নীলয়া!

মোনাজাতে শিহাব আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করলো। এতোকিছুর পর সে নীরাকে পেয়েছে বলে। তার মনে এতোদিন অজানা ভয় বাসা বেধে ছিলো। যেই ভয়টা এখন আর নেই। মোনাজাত শেষ হওয়ার পর সাইফ শিহাবকে জড়িয়ে ধরে মোবারকবাদ জানালো। রেহানও জড়িয়ে ধরলো। সবার সাথে কুশল বিনিময়ের পরে শিহাব সাইফকে ফিসফিস করে বললো।

-নীরাকে এখনো নিয়ে আসছে না কেন?

শিহাবের কথা শুনে সাইফ হেসে ফেললো। বললো।

-আরেকটু সবুর করো।

শিহাব হতাশ হয়ে বসে রইলো।

একটু পরে মিলা, রুমা আর তিতলি মিলে নীরাকে নিয়ে আসলো। নীরা এগিয়ে আসছিলো। শিহাব নীরার দিকে তাকিয়ে থমকে গেল। তার চারপাশের সবকিছুই থমকে গেল। ভালো লাগার আবেশে চারদিক ঝলমল করে উঠলো। বউ সাজে যে কাউকে এতোটা অপরূপ দেখতে লাগে সেটা শিহাবের জানা ছিলো না। তার দেওয়া খয়েরী শাড়ি হালকা সাজে হালকা গহনায় নীরাকে স্নিগ্ধ, পবিএ লাগছে। শিহাব এর আগেও নীরাকে মুগ্ধ হয়ে দেখেছে। তবে আজকের দেখাটা ভিন্ন। নীরা শিহাবের দিকে তাকিয়ে একটুখানি হাসলো। সেই হাসিতে চারদিকে ভালো লাগার আবেশ সৃষ্টি হলো। শিহাব উপলব্ধি করেছে নীরা হুট করে চোখে লাগার মতো সুন্দর নয়। বরং ধীরে ধীরে মায়ার চোরাবালিতে টেনে নিয়ে যাওয়ার মতো সুন্দর। যেমনটা তার সাথে হয়েছে। শিহাব তাকিয়েই রইলো। স্নিগ্ধ আত্মমর্যাদাপূর্ণ উজ্জল মুখ, সরল হাসি অন্তর্ভেদী দৃষ্টি,ঝকঝকে বুদ্ধিদীপ্ত চোখের দিকে।

মিলা আর রুমা নীরাকে শিহাবের পাশে বসিয়ে দিলে শিহাবের ধ্যান ভাঙলো। সবাই ওদের নিয়ে হইহুল্লোড় করা শুরু করলো। শিহাব সবার অগোচরে নীরার হাত ধরে বললো। তারপর আস্তে আস্তে বললো।

-আমার জীবনের অমূল্য রত্ন আজ আজীবনের জন্য আমার হলো। এইযে হাত ধরেছি এই হাত আজীবন ধরে রাখবো।

নীরা শিহাবের কথা শুনে মিষ্টি করে হাসলো। শিহাব আবার তাকিয়ে দেখলো সেই হাসি।

রুমা নীরার হাসিখুশি মুখটা দেখছে। ওদের পরিচয় ইউনিভার্সিটি লাইফে হলেও ওরা এক আত্না দুই দেহ। সবসময় একসাথে থেকেছে। নীরারও যেমন রুমাকে ছাড়া চলে না। তেমনভাবে রুমারও নীরাকে ছাড়া চলে না। নীরার হাসিখুশি চেহারার দিকে তাকিয়ে অজান্তেই রুমার চোখে পানি এসে পরলো। সাইফ রুমার পাশে ছিলো। চোখে পানি দেখতে পেয়ে বললো।

-কাঁদছিস কেন? এটাই তো চেয়েছিলি। আমাদের নীরার বিয়ে হয়েছে। আর এই এতো আনন্দের দিনে তোর চোখে পানি কেন?

-তুই বুঝবি না। বুঝলে তুই ই নীরার বেস্টফ্রেন্ড হতিস।

রুমার কথা শুনে সাইফ একটু হেসে বললো।

-ও হ্যালো ম্যাডাম আমিও বেস্ট ফ্রেন্ডের থেকে কম কিছু না।

সাইফের কথা শুনে রুমাও হেসে ফেললো।

তিতলি আশেপাশে তাকিয়ে নির্বানকে খুঁজছে। কিন্তু পাচ্ছে না। সে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। কিন্তু কোথাও পাচ্ছে না। মিলা তিতলিকে এমনভাবে চারদিকে তাকাতে দেখে এগিয়ে গেল। বললো।

-কি খুঁজছো?

তিতলি চমকে গেল। মিলাকে দেখে মিথ্যে বললো।

-ছোট ভাইকে খুঁজছি। পাচ্ছি না।

-আরে ডাফারটা তো ওদিকেই গেছে। দাড়াও আমি দেখছি।

বলেই মিলা ওইদিকে চলে গেল। তিতলি হাফ ছেড়ে বাঁচলো। সে কি করে বলবে যে সে নীরাদের বাড়ির একটা অতিথি ছেলেকে খুঁজছে।

নির্বান তিতলি আর রেহানের নজর থেকে বাঁচার জন্য লুকিয়ে লুকিয়ে চলছে। সে এই মুহূর্তে যেতেও পারছে না। তার ম্যাম বলেছে,ওনার হাজবেন্ডের সাথে পরিচিত হয়ে, বিদায় পর্যন্ত থেকে তার পরে যেতে। সে ও তাই ই করবে ভেবেছিলো। কিন্তু কি হলো! সে দেখলো তার ম্যামের হাজবেন্ড তিতলির বড় ভাই। যদিও তিতলির বড় ভাই তাকে চিনে না। কিন্তু তিতলির ছোট ভাই আর স্বয়ং তিতলি তো তাকে চিনে। আর তিতলি তো তাকে দেখেও ফেলেছে। এবার কি হবে! সে এসব চিন্তা করতে করতেই হাটছিলো। হঠাত সে কারো সাথে প্রচন্ড জোরে ধাক্কা খেলো। সামনের মানুষটা কোনো লোহা না মানুষ খোদা জানে! নির্বান সামনের মানুষটাকে বকা দেওয়ার জন্য চোখ তুলে তাকাতেই ভয় পেয়ে গেল। সামনেই দাড়িয়ে আছে তিতলির ভাই রেহান। সে যাদের থেকে পালাতে চাইছিলো। তাদের একজনের সামনেই কিনা সে পরে গেল। নির্বান দ্রুত পেছন ঘরে চলে যেতে চাইছিলো তবে রেহান তার আগেই নির্বানকে নোটিস করে ফেলেছে। নির্বান চলে যেতে চাইলে রেহান তড়িঘড়ি করে নির্বানের সামনে চলে আসলো। সন্দেহপ্রবণ দৃষ্টি নিয়ে নির্বানের দিকে তাকালো। এদিকে নির্বানের ভয়ে হার্ট লাফাচ্ছে। হায় আল্লাহ! এবার যদি তিতলির ভাই তাকে মারে। যদি ভুল বুঝে। যদি মনে করে সে তিতলির পেছন পেছন এখানে এসেছে তখন কি হবে! এবং আনফরচুনেটলি সে যা ভাবছে তা ই হলো। রেহান তার পাঞ্জাবির কলার ধরে বললো।

-আমার বোনের পেছন পেছন এখানেও এসে পরেছিস তুই? এবার আমি শিওর হলাম সেদিনও তুই আমার বোনের ঘরে ঢিল ছুড়েছিলি। আজকে আমার ভাইয়ের বিয়ে বেশি সিনক্রিয়েট আমি করবো না তবে!

নির্বান ভয় পেয়ে বললো।

-ভাই সত্যি আমি তিতলির পেছন পেছন আসিনি। আমি তো ম্যামের বিয়ে খেতে এসেছি।

-কোন ম্যাম? কে ম্যাম? আজ তোর একদিন কি আমার একদিন।

রেহান কথা বলতে বলতেই মিলা রেহানকে খুঁজতে খুঁজতে এদিকে আসলো। এদিকে মানুষজন কম। কারন সবাই নীরা আর শিহাবের সাথে আছে। রেহানকে নির্বানের কলার ধরে রাখতে দেখে মিলা আঁতকে উঠলো। দ্রুত সেদিকে গেল। এবং রেহানকে ধমক দিয়ে বললো।

-রেহান হচ্ছে টা কি! ছাড়ো ওকে ছাড়ো।

রেহান মিলার কথা শুনে রেগে গিয়ে মিলাকে বললো।

-টিলা তুমি জানো না,এই ছেলে কেমন। এ আমার বোনের পেছন পেছন তোমাদের বাড়িতেও এসে গেছে। ও একটা বখাটে! তুমি ওকে চেনো না।

মিলা এবার রেহানের হাত থেকে নির্বানকে জোর করে ছাড়াতে ছাড়াতে বললো।

-ও কোনো বখাটে না। ও আমাদের অতিথি। আপার স্টুডেন্ট। প্লিজ ছাড়ো ওকে।

মিলার কথা শুনে রেহান নির্বানকে ছেড়ে দিলো। নির্বান হাপিয়ে গেছে। শক্ত হাতের থাবা খেয়ে। মিলা নির্বানকে ধরে বললো।

-তুমি ঠিক আছো নির্বান? এক্সট্রেমলি স্যরি। আমি খুবই দুঃখিত তোমার সাথে এরকম ব্যবহারের জন্য। প্লিজ কিছু মনে করো না।

নির্বান হাপাতে হাপাতে বললো।

-আই এম ওকে মিলা আপু। আমি ঠিক আছি। আপনি শুধু শুধু চিন্তা করবেন না।

মিলা এবার রেহানের দিকে চোখ গরম করে তাকিয়ে বললো।

-কিছু মানুষের স্বভাবই হলো, শুধু শুধু ঝামেলা করা। নইলে এতো ভালো ছেলেকে কেউ বখাটে উপাধি দেয়।

রেহান মিলার কথা শুনে রেগে গেল, তবে কিছু বললো না। আজ তার ভাইয়ের বিয়ে আর সে তার ভাইয়ের বিয়েতে কোনো উদ্ভট কিছু করবে না।

মিলা নির্বানকে বললো।

-চলো আপা তোমাকে যেতে বলেছে ভাইয়ার সাথে আলাপ করিয়ে দিবে।

তারপর রেহানকে বললো।

-আর এই যে তোমাকে তিতলি ডাকছে। এসে উদ্ধার করো আমাদের।

বলেই তিতলি নির্বানকে নিয়ে গেল। রেহানও আর কিছু না বলে তিতলিদের পেছনে গেল।

তিতলি নীরার পাশে পাশে ছিলো। সে এখন সবসময় নীরার সাথে সাথে থাকবে বলে ঠিক করেছে। শিহাব হাসলো বোনের কান্ড দেখে।

মিলা আর নির্বান নীরাদের কাছে গেলে নীরা নির্বানকে দেখে হাসলো। বললো।

-এতোখনে এদিকে আসার সময় পেলে?

নির্বান একটু হাসলো নীরার কথা শুনে। আড়চোখে তিতলির দিকে তাকালো। তিতলি এখনো নির্বানের দিকে সরু চোখে তাকিয়ে আছে। নীরা শিহাবকে বললো।

-ও হচ্ছে নির্বান, আমার টিউশন লাইফের ফার্স্ট স্টুডেন্ট ছিলো। ও আমার কাছে সবসময় স্পেশাল।

শিহাব নির্বানের দিকে তাকিয়ে হাসলো। হাত বাড়িয়ে দিলো হ্যান্ডশেক করার জন্য। নির্বান ভয়ে ভয়ে হাত মিলালো। ততোক্ষনে রেহানও এসে দাড়িয়েছে। নির্বান নীরাকে বললো।

-নতুন জীবনের জন্য অনেক অনেক শুভকামনা ম্যাম।

নীরা একটু বিরক্ত হয়ে বললো।

-ম্যাম ডাকা ছাড়বে না কখনো না!

সবাই হাসলো নীরার কথা শুনে।

তিতলির আর রেহানের তাকানো দেখে নির্বানের ভয় লাগছে। রেহান নির্বানের পাশে দাড়িয়ে ধীরে ধীরে বললো।

-তোমার সাথে আমি পরে কথা বলবো।

মিলা লক্ষ করলো সেটা। সে এগিয়ে গিয়ে বললো।

-বাচ্চা ছেলেটাকে আবার তুমি কি বলছো রেহান?

রেহান হতভম্ব হয়ে গেল। বললো।

-এতো বড় দামড়া ছেলেকে তুমি বাচ্চা বলছো টিলা?

মিলা ধমক দিলো রেহানকে।

-শাট আপ রেহান,ও বাচ্চা না তো কে বাচ্চা? তুমি? এতো বড় দামড়া ছেলে?

রেহান আর কিছু বললো না। এতোখন ভয় লাগলেও মিলার কথা শুনে নির্বানের হাসি পাচ্ছে। সে ফিক করে হেসে ফেললো। রেহান চোখ গরম করে তাকালে নির্বান হাসি আটকালো।

খাওয়াদাওয়ার সময় নীরা নিজেই সবাইকে সার্ভ করে দিলো। রেজা সাহেব জহুরাকে নিজে বসিয়ে খাওয়ালো। রেজা সাহেব আর জহুরা নীরার এতো অমায়িক আচরণ দেখে মুগ্ধ হলেন। খুব প্রশংসাও করলেন।

মালিহা, রেজাউল আর নূরজাহান বেগমকে ও নীরা নিজ হাতে খাওয়ালো। রেজাউলের চোখে বারবার পানি এসে পরছিলো। আজকের পরে আর নীরা এই বাড়িতে থাকবে না বলে তার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।

সবকিছুর শেষে বিদায়ের সময় আসলো। নূরজাহান বেগম নীরাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদা শুরু করলেন। নীরাও কাঁদছে। তবে সে যথেষ্ট স্ট্রং সেজন্য চাইলেও সে নিজের হাহাকার কাউকে দেখাতে পারে না। নূরজাহান বেগম কাঁদতে কাঁদতে বললেন।

-আমাকে ক্ষমা করে দিস আমি তোকে অনেক অবহেলা করেছি।

নীরা নূরজাহান বেগমকে এমনভাবে কাঁদতে দেখে অবাক হয়ে গেল। রেজাউল সহ সবাই অবাক হয়ে গেলেন। নীরা নূরজাহান বেগমকে বললো।

-আমি তোমার কোনো কথায় কষ্টই পাইনি ক্ষমার প্রশ্নই আসে না।

নূরজাহান বেগম আরো শক্ত করে নীরাকে জড়িয়ে ধরলেন। নূরজাহান বেগম ছাড়ার পর নীরা মালিহাকে খুঁজলো। কান্নামাখা কন্ঠে বললো।

-আমার আম্মা কই?

নীরার কথা শুনে রুমা আশেপাশে খুঁজে দেখলো মালিহা নীরার ঘরের দরজার পাশে দাড়িয়ে আছেন। রুমা এগিয়ে গেল মালিহাকে নিয়ে আসতে। মালিহার খুব কষ্ট হচ্ছে যেই মেয়ের জন্য সমাজের সাথে, পরিবারের সাথে এতো লড়াই করেছেন,এতো কষ্ট করে যাকে বড় করেছেন তাকেই কিনা আজ বিদায় দিতে হবে। কলিজাটা ছিঁড়ে যাচ্ছে তার। আচ্ছা বিদায় না দিলে কি হয় না। মালিহা যথাসম্ভব চেষ্টা করছেন নিজেকে শক্ত রাখার। কিন্তু পারছেন না। পারছেন না এগিয়ে যেতে। রুমা গিয়ে মালিহাকে ধরে নিয়ে আসলো। নীরা মালিহার দেখা যেয়েই ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো। নিজেকে এতোখন যেটুকু শক্ত রেখেছিলো। এখন তা সম্ভব হচ্ছে না। মালিহা কাছে আসলেই নীরা মায়ের বুকে ঝাপিয়ে পরলো। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকলো।

নীরার কান্না দেখে শিহাবের খুব খারাপ লাগছে। বিদায় শব্দটা কি এতোই কঠিন যে নীরা আর মালিহাও এভাবে কেঁদে ফেললো। নীরাকে কাঁদলেও তার চোখে সুন্দর লাগে দেখতে। তবে আজ নীরার কান্নামাখা মুখ দেখে তার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে অন্তর পুড়ছে।

নীরা মালিহাকে ছাড়তে চাইছে না। তার আম্মাকে ছাড়া সে কোনোকিছু কল্পনাও করতে পারে না। আম্মাকে ছাড়া সে কি করে থাকবে। নীরা কাঁদতে কাঁদতে বললো।

-আমি তোমাকে ছাড়া যাবো না আম্মা। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। আমাকে যেতে দিও না।

নীরার এমন কথা শুনে মালিহা কিছু বলতে পারলেন না। শুধু চুপচাপ চোখের পানি ফেলছেন। রেজাউল এগিয়ে গিয়ে নীরাকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো। নীরা তবুও ছাড়লো না মালিহাকে। মালিহা নিজেকে শক্ত করলেন। বললেন।

-যেতে তো হবেই আম্মা। তুই তো আবার আসবি বারবার আসবি। আমরাও যাবো। তাহলে এতো কাঁদছিস কেন? কাঁদিস না তুই। তুই কাঁদলে যে আমিও খুব কষ্ট পাই।

মালিহার কথা শুনে নীরা নিজেকে একটু শান্ত করলো। মালিহা নিজেকে জোর করে ছাড়ালেন নীরার থেকে। নীরা আবার জড়িয়ে ধরতে গেল। রেজাউল পাশেই ছিলেন। তিনি নীরাকে নিজেই জড়িয়ে ধরলেন। নীরা রেজাউলকে জড়িয়ে ধরে বললো।

-নিজেকে অপরাধী ভাববে না। তুমি আমার আব্বা। আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। আগের কোনোকিছু মনে রেখে কষ্ট পাবে না। দাদীর, আম্মার আর নিজের খেয়াল রাখবে। মনে রাখবে আমি সবসময় আসবো আর খোঁজ নিবো। যদি দেখি তুমি নিজেকে পুরনো কথা ভেবে কষ্ট দিচ্ছো। তাহলে খুব খারাপ হয়ে যাবে।

রেজাউল এবার কেঁদেই ফেললেন তার মেয়ের কথা শুনে। দিনি নীরার চোখের পানি মুছে দিয়ে কপালে চুমু একে দিলেন।

নীরা রুমা আর সাইফের দিকে তাকালো। তা দেখে রুমা কাঁদতে কাঁদতে নীরাকে এসে জড়িয়ে ধরলো। বললো।

-আমি কাঁদলেও আমি কিন্তু আজ খুব খুশি। আমার নীরার আজ বিয়ে হয়ে গেল। এরচেয়ে খুশির আর কি হতে পারে!

সাইফ নিজেও এগিয়ে গেল ওদের দিকে। রুমা আর নীরা দুজনকে একসাথে জড়িয়ে ধরলো। তারপর বললো।

-আমরা তিনজন বেস্টফ্রেন্ড ছিলাম। আর আজীবন থাকবো। তুই না থাকলে আমার কি হতো বল তো! আমি তো কিছু করতেই পারি না তোর সাহায্য ছাড়া। আর আজকে তোর বিয়ে হয়ে গেল।

নীরা রুমা আর সাইফকে বললো।

-শোন আমি আজীবন তোদের জ্বালানোর জন্য আছি। আর আমি জানি তোরাও আমাকে জ্বালানোর জন্য আজীবন থাকবি। দুজন একদম ঝগড়া করবি না। মিলেমিশে থাকবি। ঝগড়া মারামারি দেখার শখ আমার আর নেই। তো আমি যা বলেছি তাই ই করবি।

নীরার কথাতে দুজনেই মাথা নাড়লো। নীরা ওদের ছেড়ে দিয়ে রুমাকে বললো।

-আমি জানি আমার মিলা আমাকে ছাড়া থাকতে পারবে না। এজন্য আমার বিদায়ও ও দেখতে আসছে না। তোরা জানিস ও কোথায় আছে?

নীরার কথা শুনে সাইফ নীরাকে বললো।

-আমি খুঁজেছি কিন্তু পেলাম না।

নীরা বুঝে গেল মিলা ছাদে আছে। যখনই নীরা বকে বা কোনো বিষয়ে মিলার কান্না পায় তখনই মিলা ছাদে গিয়ে একাকী কাঁদে। এখনো হয়তো সেখানেই আছে। নীরা একবার সবার দিকে তাকিয়ে রুমাকে বললো।

-ও ছাদে আছে আমি জানি। ওকে নিয়ে আসতে পারবি আমার কাছে? ও আসতে চাইবে না। তুই বলবি না আসলে আপা আর ওর সাথে কথা বলবো না।

রুমা নীরার কথা শুনে আর অপেক্ষা না করে ছাদে গেল। ছাদে গিয়ে দেখলো মিলা হাটুতে মুখ গুঁজে সত্যিই কাঁদছে। রুমা কাছে গিয়ে মিলাকে ধরে উঠালো। তারপর বললো।

-নীরা চলে যাচ্ছে। তুই কি যাবি না?

মিলা কাঁদতে কাঁদতেই মাথা নাড়িয়ে না বললো। রুমা মিলার চোখের পানি মুছে বললো।

-বোকা মেয়ে কাঁদছিস কেন? নীরা তো সবসময়ই আসবে এখানে। তাছাড়া তুইও যখন খুশি যাবি। শিহাব ভাই তো বলেছেই।

মিলা তবুও কাঁদতে থাকলো। রুমা এবার বললো।

-তুই যদি নিচে না যাস তাহলে নীরা আর তোর সাথে কথা বলবে না বলেছে। এখন তুই কি চাস?

মিলা হিচকি তুলে বললো।

-আমার কষ্ট হচ্ছে। তুমি তো জানো আমি আপাকে কতো ভালোবাসি।

-জানি কিন্তু যেতে তো হবেই। চল আর জেদ করিস না। নীরা তো আসবেই আবার।

মিলা যেতে না চাইলেও নীরা ওর সাথে কথা বলবে না শুনে আর কথা না বাড়িয়ে রুমার সাথে নিচে নামলো।

নিচে নেমেই এক দৌড়ে গিয়ে নীরাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললো। মিলা এমনভাবে দৌড়ে এসে নীরাকে জড়িয়ে ধরেছে যে নীরা প্রায় পরে যেতো। শিহাব দেখতে পেয়ে দ্রুত পেছন থেকে নীরাকে ধরে ফেললো। নীরা সোজা হলে শিহাব আবার ছেড়ে দিলো। মিলা এমনভাবে কাঁদছে যে নীরা কিছু বলতেও পারছে না। শুধু মিলার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।
মিলা হিচকি তুলে কাঁদতে কাঁদতেই বললো।

-তোমাকে কেন যেতে হবে আপা? আমার বুঝি কষ্ট হচ্ছে না। এখন থেকে কে আমাকে খাইয়ে দিবে? কে চুল বেঁধে দিবে? কে ঘুম থেকে ডেকে তুলবে? বলো!

নীরা কাঁদতে কাঁদতেই বললো।

-আম্মা আছে তো পাগলি। আর আমি তো আবার আসবো।

নীরার কথায় মিলার মধ্যে কোনো প্রভাব পরলো না। সে দিন দুনিয়া ভুলে নীরাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। মালিহাও চোখের পানি ফেলছেন। মিলাকে কিছু বলতে পারছেন না। ছোট থেকে মিলা সবসময় নীরার গা ঘেষে থাকতো। মালিহা কাজে ব্যস্ত থাকলে নীরাই মিলার খেয়াল রাখতো। মিলা সবসময় সেটাই করেছে যেটা নীরা বলেছে। ছো বেলাতে মালিহা নিজে মিলাকে খাইয়ে দিতে চাইলে মিলা তার আঁধো কন্ঠে বলতো।
“আপার হাতে খাবো। নইলে খাবো না”।
মিলাকে সব কাজ নীরা নিজে করতো। একটামাএ বোন সেজন্য আরো বেশি আদরে রাখতো।
মিলার চোখের পানি বাধ মানছে না।

তিতলিও মিলার কান্না দেখে কেঁদে ফেললো। নির্বান শুধু দাড়িয়ে দেখছে তিতলিকে। এমন অবস্থা দেখে রুমা সাইফকে বললো।

-মিলাটা সত্যিই নীরাকে ছাড়া চলতে পারে না। নীরাকে ছাড়া কিছুই করতে পারে না এখনো। এতো বড় হয়ে গেল তবু বোনের ওপর ডিপেন্ডেট।

রুমা কথাগুলো বলে কাঁদছে দাড়িয়ে দাড়িয়ে। সাইফ ও অসহায় হয়ে দাড়িয়ে আছে। সে এগিয়ে গিয়ে মিলাকে নীরার থেকে ছাড়াতে চাইলো কিন্তু পারলো না।

রেহানেরও কষ্ট লাগলো মিলার কান্না দেখে। এতোদিন সে মিলার কান্না নিয়ে ব্যঙ্গ করেছে। তবে আজ মিলা যেভাবে কাঁদছে যে সে কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে।

শিহাব মিলার কান্না দেখে এবার নিজেই এগিয়ে গেল।
মিলাকে বললো।

-আমি বলেছিলাম তুমি আমার আরেকটা বোন। তোমাকেও আমার সাথে নিয়ে যাবো। আমাকে কি ভাই মনে করো না?

মিলা নীরাকে জড়িয়ে ধরেই কাঁদতে কাঁদতে মাথা দোলালো। শিহাব বললো।

-তাহলে কাঁদছিস কেন পাগলি? আমার কাছে তিতলি যেমন তুইও ঠিক তেমনই। আমার বোন এভাবে কষ্ট পেয়ে কাঁদছে আর আমি ভাই হয়ে তা দাড়িয়ে দাড়িয়ে দেখবো! কখনো না। মিলা তোর আপা তোর আপাই থাকবে আগের মতো সব হবে। আমাকে কি বিশ্বাস হয় না? দেখ তুই যদি এখনো কাঁদিস তাহলে কিন্তু আমি সত্যিই কষ্ট পাবো। আমাদের কিন্তু আগেই কথা হয়েছিলো। এবার তোর কান্না দেখে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।

শিহাবের কথা শুনে মিলার কান্না একটু থামলো। সে নীরাকে জড়িয়ে রাখা হাতের বাঁধন ঢিলে করলো। কিন্তু সোজা হয়ে দাড়িয়ে হিচকি তুলছে এখনো। শিহাব মিলার চোখের পানি মুছে দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। নীরার তা দেখে খুব শান্তি লাগলো।

রেজাউল শিহাবের হাতে নীরার হাত তুলে দিলেন। শিহাব ও রেজাউলের হাতসহ শক্ত করে ধরে আশ্বস্ত করলো।

বিদায় পর্ব শেষ হয়ে গেল এখানেই। বাড়ি থেকে বেড়িয়ে সবাই গাড়িতে উঠলো। নীরার গাড়িতে বসতেই ইচ্ছে করছিলো। কিন্তু যেতে তো হবেই তাই গাড়িতে উঠে বসতে হলো। গাড়ি চলতে শুরু করলো শিহাবের বাড়ির পথে।
নীরার কান্না থামলেও চোখমুখে আষাঢ়ের মেঘ বিরাজ করছে। শিহাব তবুও অপলক চেয়ে রইলো। নীরার হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিলো। বললো।

-মন খারাপ করো না। আমরা আবার আসবো। মিলা আসবে বাবা,মা আসবে। আচ্ছা তোমার বাবা মাকে আমি বাবা মা বলতে পারি?

এতো দুঃখের ভেতর এমন কথা বলার জন্য নীরা বিরক্ত হলো। বললো।

-আমাকে বলার কি আছে। বলতেই পারো।

শিহাব কিভাবে নীরার মন ভালো করবে বুঝতে পারছে না। সে কখনো কারো মন ভালো করার দায়িত্ব নেয়নি। কিন্তু এখন তো নিতে হবে। ইশ! নীরার মন ভালো তো তাকেই করতে হবে। কিন্তু কিভাবে করবে সে সেটাই বুঝতে পারছে না। তাই সে নীরাকে জিজ্ঞেস করলো।

-আচ্ছা তোমার মন ভালো করতে হলে আমার কি করা উচিত?

শিহাবের আবারও এমন কথা শুনে নীরা হতাশ হলো। সে কিছু না বলে চুপ করে রইলো। নীরা কিছু বললো না বলে শিহাব নিজের প্রতি নিজেই অসন্তুষ্ট হলো। সে নীরার দিকে তাকিয়ে দেখলো নীরা একমনে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। তার দিকে তাকাচ্ছে না। আশ্চর্য! সে কি এতোই বাজে দেখতে যে নীরা তার দিকে তাকায় না। সে ভাবলো এখন এই প্রশ্নটা করা যাবে না। বাড়িতে গিয়েই সে এই প্রশ্নটা নীরাকে করবে।

সে নীরার হাত আরো শক্ত করে ধরলো। নীরা বিরক্ত হয়ে বললো।

-আমার হাতটা ভেঙে দেওয়ার চিন্তা ভাবনা করছো নাকি তুমি?

শিহাব নীরার কথা আমলে না নিয়ে নীরার হাতে একাধারে পরপর নিজের ওষ্ঠের স্পর্শ একে দিলো। শিহাব এমন একটা কাজ করলো যে নীরা খানিকক্ষণ বিস্ময়ে কিছু বলতে পারলো না। কিছু সময় পর বললো।

-কি হলো এটা?

শিহাব আবার নীরার হাতে স্পর্শ একে দিয়ে বললো।

-এখন থেকে তুমি আর আমাকে বারবার হাত ছাড়ার কথা বলতে পারবে না।

নীরা কিছু না বলে হা করে তাকিয়ে রইলো শিহাবের দিকে। শিহাব নীরার দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বললো।

-আমি ভেবেছিলাম তুমি খানিকটা লজ্জ্বা পাবে।

নীরা বিরক্ত হয়ে বললো।

-তোমার দ্বারাই এসব ভাবা সম্ভব।

শিহাব নীরার হাত আরো শক্ত করে ধরে বললো।

-ঠিক বলেছো!

নীরা মুখে কিছু প্রকাশ না করলেও মনে মনে তার বসন্তের হাওয়া বইছে। প্রথম স্পর্শ চমৎকার অনুভূতি। ঘাড়ত্যাড়া শিহাবকে বোধ হয় তার খুব ভালো লেগে গেছে।

-চলবে!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here