অপূর্ব প্রাপ্তি
পর্ব-বিয়াল্লিশ
নাফিসা নীলয়া!
নীরা হুট করে মালিহার কাছে এসে পরাতে মালিহা একটু দুঃশ্চিন্তাতেই পরে গেলেন। নীরা যখন বিকেলবেলা হুট করে বাড়িতে আসলো। তিনি তখন খুব চমকে গিয়েছিলেন। মালিহা দরজা খোলার পর নীরা মালিহাকে কিছু বলতে না দিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। মালিহা অবাক হলেও অনেকদিন পর মেয়েকে কাছে পেয়ে নিজেও জড়িয়ে ধরলেন। নীরা হাসিমুখে ঘরে ঢুকলো। তারপর বললো।
-সারপ্রাইজ দিলাম। অনেকদিন পর আসলাম। আম্মা তোমাদের খুব মনে পরছিলো। দেখতে ইচ্ছে করছিলো। তাই এসেই পরলাম। কেমন লাগলো?
মালিহা নিজেকে দ্রুত স্বাভাবিক করে বললেন।
-কতোটাদিন পর আমার মেয়েকে কাছে পেয়েছি। ভালো লাগবো না আবার। আয় একদম ঘেমে গেছিস। জামাকাপড় তো আছেই।
নীরা ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললো।
-মিলা,আব্বা আর দাদী কই?
-তোর আব্বা আর দাদী ঘরেই আছে। মিলা ওর বন্ধুর বাসায় গেছে। ফোন করেছিলো। এসে পরবে একটু পরেই। ওকে কি ফোন করবো?
-না ফোন করতে হবে না। এসে দারুন একটা সারপ্রাইজ পাবে।
মালিহা আর কিছু না বলে হাসলেন।
নূরজাহান বেগম আর রেজাউল নীরা আর মালিহার কন্ঠ শুনে বাইরে এলেন। নূরজাহান বেগম নীরাকে দেখেই এক গাল হাসলেন। বললেন।
-নিজের সংসারে গিয়ে এখন আর আমার কথা মনে পরে না তাই না?
নীরা নূরজাহান বেগমের কথা শুনে আহ্লাদী কন্ঠে বললো।
-প্রতিদিন যে তোমাকে ফোন করি। প্রতি উইকেন্ডে যে আসি সেটা কি চোখে পরে না? হ্যা মানছি লাস্ট দুই সপ্তাহ আসিনি। তাই বলে এভাবে বলবে না দাদী।
নূরজাহান বেগম হাসতে হাসতে বললেন।
-তোর সাথে তর্ক করবো না। এসেছিস খুব খুশি হয়েছি। এবার ফ্রেশ হয়ে খেতে বস।
নীরা হেসে সায় দিয়ে রেজাউলের কাছে গিয়ে রেজাউলকে জড়িয়ে ধরলো। জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করে বললো।
-মনে হচ্ছে অনেকদিন পর তোমাকে জড়িয়ে ধরলাম।
রেজাউলও নীরাকে জড়িয়ে ধরে মাথায় আদর করে দিলেন। নীরাকে সোজা করে দাড় করিয়ে ভালোমতো দেখলেন। তারপর বললেন।
-এনিথিং রঙ মা?
নীরা হাস্যোজ্জ্বল মুখেই বললো।
-এভ্রিথিং ইজ অলরাইট আব্বা। চলো আজকে অনেক মজা হবে। মিলাকেও চমকানো যাবে।
রেজাউল নীরাকে আর কোনো প্রশ্ন করলেন না। নীরা ভেতরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলো। তারপর রোউল মালিহা আর নূরজাহানের সাথে গল্প করলো। মিলা সন্ধ্যাবেলা বাড়িতে এসে চমকে গেল। নীরাকে দেখেই চিৎকার করে ডেকে দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো। আবেগে প্রায় কেঁদেই ফেললো। নীরা মিলাকে ধমকে টমকে ঠিক করলো। বললো।
-আমার ছিচকাঁদুনে বোনটা কখনো বড় হবে না না?
মিলা মিছিমিছি নাক টানতে টানতে বললো।
-কখনো না।
নীরা মিলার কান্ড দেখে হাসলো। দুই বোন একসাথে হওয়ার পর অনেক মজা করলো। নীরা মিলাকে নিজে খাইয়ে দিলো। চুল বেঁধে দিলো। সবাই একসাথে অনেক গল্পও করলো। এরমধ্যে মালিহা শিহাবের কথা জিজ্ঞেস করলে নীরা বললো।
-শিহাব অনেক ব্যস্ত থাকে। এজন্য আসতে পারে না। আমার তোমাদের দেখতে ইচ্ছে হয়েছে তাই এসেছি।
তারপর মালিহা আর কিছু জিজ্ঞেস করেননি। সব আড্ডা,কাজ শেষ করে রাতের বেলা নীরা তিতলি আর রেহানের সাথে কথা বললো। তিতলি নিরাশ কন্ঠে বললো।
-আমাকে না নিয়েই চলে গেলে ভাবিমনি। আমি তো এখন তোমাকে ছাড়া থাকতেই পারি না। একটু বেড়ানোও হলো না।
তিতলির কথা শুনে নীরা বললো।
-যদি আসতে চাও তাহলে আগামী টেস্টে হান্ড্রেড মার্কস পেতে হবে। আর ভালো করে পড়তে হবে। এখন যাও খেয়েদেয়ে পড়তে বসো। এখন কোনো বেড়ানো চলবে না।
তিতলি মিষ্টি হেসেই বললো।
-সত্যি তো?
-একদম সত্যি।
নীরা রেহানকে কিছু বলার আগেই ভিডিও কলের ওপাশ থেকে আগেই রেহান বললো।
-আমি ভদ্র আমি খুব ভালোভাবে চলি। তুমি তো জানোই আমি অনেক ডিসিপ্লিন্ড হয়ে গেছি।
নীরা হেসে বললো।
-আচ্ছা এই দুই তিনদিন সব ঠিকঠাক ভাবে করবে।
নীরার কথা শুনে ফোনের ওপাশে তিতলি আর রেহান সহ এপাশে নীরার পাশে বসে থাকা মিলাও চমকে গেল। মিলা অবাক হয়ে বললো।
-এসে তো বলোনি আপা।
তিতলি আর রেহানও বললো।
-তুমি তো সকালে এটা বলোনি ভাবিমনি। বলেছিলে আগামীকাল সকালেই এসে পরবে।
নীরা হাসতে হাসতেই বললো।
-আমারও তো একটু বেড়াতে ইচ্ছে করে তাই না? আরে দুই তিন দিনই তো।
তিতলি আর রেহান এই কথার পর আর কিছু বললো না। ঠিকই তো নীরা তাদের সবার জন্যই সবকিছু করে যাচ্ছে। সেখানে নিজের বাবার বাড়িতে তো দুটো দিন নিজের ইচ্ছে মতো থাকতেই পারে। তিতলি আর রেহানের সাথে হাসিখুশি আরো কিছুক্ষন কথা বলে নীরা ফোন রেখে দিলো। তারপর মিলার দিকে হেসেই তাকিয়ে বললো।
-এখানে থাকতে হলে আমাকে বলে থাকতে হবে নাকি রে মিলা?
মিলা নীরার দুই হাত ধরে বললো।
-তোমার কিছু তো হয়েছে আপা। আর কেউ না বুঝলেও আমি বুঝতে পারছি।
নীরা মুখটাকে এমন করলো যেনো সে এই কথাটা শুনে প্রচন্ড বিরক্ত হয়েছে। সে বিরক্ত মুখেই বললো।
-আমার কি তোদের হুট করেই দেখতে ইচ্ছে করে না? আমার বিয়ের পর কি আমার ভালোবাসা দায়িত্ব সব চলে গেছে?
এই কথা শোনার পর মিলার নিজের কাছেই খারাপ লাগলো। সত্যিই তো,বিয়ে হওয়ার পরও নীরা সমানভাবেই দুই পরিবারের প্রতিই সব দায়িত্ব পালন করছে। এবং তা মন থেকেই। ভালোবাসা দায়িত্ববোধের জন্য এখন মানুষ বেগে গেছে। এটাই তো। মিলা এসব ভেবে অনুতপ্ত হয়ে বললো।
-স্যরি আপা।
নীরা পুনরায় হেসে বললো।
-স্যরি বলতে হবে না। তুই আমাকে কিছু বলতে চাইছিস বলে ফেল।
নীরার এই কথা শুনেই মিলা তড়াক করে সোজা হয়ে বসলো। তারপর বললো।
-তুমি তো জানো আমার সব কিছু সবার আগে আমি তোমাকেই বলি আপা। এটাও বলতে চাইছিলাম কিন্তু সুযোগ পাচ্ছিলাম না। না বলতে পেরে আমার পেটে ব্যথা হয়ে গেছে।
নিজের কথায় নিজেই ফিঁক করে হেসে ফেললো মিলা। নীরা নিজের বোনকে দেখলো। মিলা নীরাকে জড়িয়ে ধরে বললো।
-ফাইনালি আমি আমার স্বপ্নে দেখা রাজকুমারের খোঁজ পেয়েছি। তবে সে বাস্তবজীবনে প্রকাশ্যে আমার খুবই অপছন্দের।
নীরা মিলাকে সোজা করে নিজের দিকে ফেরালো। মিলাকে পর্যবেক্ষন করে বললো।
-তোকে মানুষ করেছি আমি। তোর রগেরগে সব চেনা আছে আমার। তোর অনুভূতি আচার ব্যবহার কখন কার প্রতি কেমন হয় সেটা আমি বুঝি। তাই বাকিটা আমাকে বলতে হবে না।
মিলা নীরার কথা শুনে নীরার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পরলো। নীরা মিলার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। মিলা বলে উঠলো।
-আম্মা আমার মা,তুমিও আমার মা আপা। বড় বোন মায়ের স্বরূপ এর জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ তুমি।
নীরা কিছু না বলে চুপ করে রইলো। মিলা আবার বললো।
-সবাই মানবে তো?
নীরা মিলার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো।
-তোদের জন্য আমি খুশি। তবে নিজেদের আগে নিজের পায়ে দাড়াতে হবে। আবেগকে প্রশ্রয় দেওয়া চলবে না। নিজেদের মধ্যে এতো মেলামেশা এখনই এতো জরুরি না। আগে ফোকাস নিজের ক্যারিয়ারে করতে হবে। তারপর সবাই অবশ্যই মানবে। আর আমার বোনের ওপর আমার সম্পূর্ণ বিশ্বাস আছে। আমার বোন আমার বোনই। আমার মিলা জেনেশুনে কখনো ভুল বা অন্যায় করতে পারে না।
মিলা মুচকি হেসে বললো।
-আপা তোমার জন্য তো আমার জানও কোরবান করে দিবো। আর সামান্য বিশ্বাসটা রাখবো না!
নীরাও এই পর্যায়ে মুচকি হেসে বললো।
-ফিল্মি ডায়লোগ কম। পড়ালেখা বেশি।
মিলা হাসতে হাসতেই বললো।
-আজকে কোনো পড়ালেখা না। আজকে শুধুই মজা মাস্তুি।
শিহাব অনেক রাতে বাড়িতে পৌছে নীরাকে বসে থাকতে না দেখে খুব অবাক হলো। তারপর ভাবলো হয়তো আজ টায়ার্ড আছে। তাই সে নিজের ঘরে চলে গেল। নিজের ঘরে গিয়েও নীরাকে না দেখে হতভম্ব হয়ে গেল। তারপর নিজের ফোন বের করে নীরাকে ফোন করতে গেলে জহুরা এসে দরজায় নক করলেন। শিহাব ফোন রেখে জহুরাকে ভেতরে আসতে বললো। জহুরা ভেতরে এসে বললেন।
-নীরা ওই বাড়িতে গেছে আজ। সকালে বলেই গিয়েছিলো যে স্কুল থেকে সোজা ওখানেই যাবে।
শিহাব অবাক হয়ে বললো।
-আমাকে তো বলে যায়নি।
জহুরা স্বাভাবিক ভাবেই বললেন।
-তুই তো ব্যস্ততার কারনে ওর আগেই তাড়াহুড়ো করে বেড়িয়ে গেলি। এজন্যই বলতে পারেনি।
শিহাব তবুও মানতে পারলো না। বললো।
-তাই বলে একটাবার ফোনও করবে না?
জহুরা বললেন।
-গত কয়েকদিন যাবত তুই যে কতোটা ব্যস্ত থাকিস। তা কি নিজেই জানিস না? ও হয়তো এজন্যই ফোন দেয়নি। তাছাড়া ও সবাইকে বলেই গেছে। সব ঠিকঠাকও করে গেছে।
শিহাব আবার বললো।
-তাই বলে একটাবার আমাকে জানাবে না? আর গেছে কেন ও? দরকার কি এখন যাওয়ার? আশ্চর্য!
এবার জহুরা প্রচন্ড বিরক্ত হলেন। বললেন।
-আমিই আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি তোর কথা শুনে। মেয়েটা সারাটাদিন খাটাখাটনি করে। এই সংসার,নিজের বাবার বাড়ি,স্কুল,এনজিও। এতোকিছু একসাথে করে দুটোদিন নিজের ইচ্ছেমতো থাকতে পারবে না? দুই সপ্তাহ যাবত উইকেন্ডেও যায়নি বাবার বাড়ি। তুই কিরে শিহাব? দুজন সমানভাবেই সব করিস ওর মতে তোর মতেও। কিন্তু আমার চোখে নীরা নিজেই অনেক দায়িত্ব তোর থেকে নিয়ে নিয়েছে।
জহুরার এতো কথার পরও শিহাব ওই কথাতেই আটকে রইলো।
-তাই বলে আমাকে বলবে না?
জহুরা নিজের কপাল চাপড়ালেন।
-আরে বাপ এবার একটু খেয়ে নে। বাদ দে এখন এসব। ফোন করে জেনে নিস।
শিহাব কিছু না বলে নিজের আধখোলা শার্ট আবার পরলো। জহুনা হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। শিহাব জহুরাকে বললো।
-তিতলি,রেহান আর বাবা?
জহুনা বললেন।
-খেয়েছে। তিতলি অপেক্ষা করছিলো কিন্তু আমি জোর করে পাঠিয়ে দিয়েছি।
শিহাব পকেটে ফোন ঢোকাতে ঢোকাতে বললো।
-গুড আমি যাচ্ছি।
জহুরা অবাক হয়ে বললেন।
-কোথায়? আর এতোরাতে?
শিহাব হাটতে হাটতে বললো।
-ওই বাড়িতে।
জহুরা হতবাক হয়ে বললেন।
-কয়েকদিনের এতো প্রেশারে মাথা গেছে নাকি?
শিহাব হাটা থামিয়ে বললো।
-একদম না? তুমি খেয়েছো?
জহুরা মাথা নাড়িয়ে বললেন।
-হু।
শিহাব আর কিছু না বলেই চলে গেল। শিহাব যাওয়ার পর জহুরা একা একাই খুব হাসলেন।
নীরা আজ মিলার সাথে মিলার ঘরে শুয়েছে। মিলা নীরাকে একদম আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়েছে। নীরাও মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছে। কিন্তু এখন নিজেরই ঘুম আসছে না। কেন ঘুম আসছে না। সেই কারনটা স্পষ্ট কিন্তু নীরা মানতে চাইছে না।
নীরা শুয়ে শুয়ে এসবই ভাবছিলো। ঠিক তখনই নীরার ফোন বেজে উঠলো। ফোন ছিলো টেবিলের ওপর। নীরা বহুকষ্টে মিলাকে ছাড়িয়ে উঠে ফোন নিলো। শিহাবের নাম দেখে অবাক হলো না। রিসিভ করলো। করেই বললো।
-স্যরি না বলে আসার জন্য। আচ্ছা এখন ঘুমাও জহুরা খালা তো তোমাকে খেতে দিয়েছেনই।
শিহাব নীরার কথা শুনে শান্ত কন্ঠে বললো।
-এবার বিল্ডিং থেকে নিচে নামতে হবে না। শুধু একটু কষ্ট করে দরজাটা খোলো। আমি দরজার বাইরে।
শিহাবের কথা শুনে নীরা অবাক হলো। তবে এই অবাক ভাবটা বেশিখন থাকলো না। শিহাব নিজেই বললো।
-অবাক হওয়ার মতো তো কিছুই ঘটেনি। শুধু শুধু অবাক হয়ে লাভটা কি!
নীরা মনে মনে নিজেকে নিজেই বকলো। সে তো জানে শিহাবের স্বভাবের ব্যপারে। তবুও সে এই ভুল কি করে করতে পারলো। নীরাকে চুপ করে থাকতে দেখে শিহাব বললো।
-তুমি কি চাও রাতবিরেতে আমি বেল বাজাই?
নীরা এবার বললো।
-দুই মিনিট দাড়াও।
নীরা ফোনকল কেটে দিয়ে আস্তে করে বাইরে গেল। তারপর মেইন দরজা খুলে দেখলো শিহাব অফিসের ফর্মাল ড্রেস আপেই রয়েছে এলোমেলো ভাবে। শ্যামবর্ণের ক্লান্তিমাখা মুখটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে প্রচন্ড খিদে আর ক্লান্তি সাথে নিয়ে সামনের মানুষটা দাড়িয়ে আছে। শিহাবকে দেখে নীরার একটু খারাপ লাগলো। সে ইতস্তত করে বললো।
-ভেতরে এসো।
শিহাব ভেতরে গেল। নীরা দরজা আটকেই বললো।
-হাতমুখ ধুঁয়ে এসো আগে। খাওনি বোঝাই যাচ্ছে। আগে খেয়ে নাও।
শিহাব কটাক্ষ করে বললো।
-তোমার মনেও ছিলো যে আমি খেয়ে আসি না।
নীরার বলতে ইচ্ছা করলো নিজে না খেলে কি নীরার দোষ নাকি। কিন্তু বললো না। বললো।
-কথা না বাড়িয়ে যাও।
শিহাব বললো।
-কার ঘরে যাবো?
-আমার ঘরে যাও।
শিহাব ভ্রু কুঁচকে বললো।
-মিলা?
-মিলা মিলার ঘরে আমি মিলার ঘরে ছিলাম।
শিহাব আর কথা না বাড়িয়ে ঘরে চলে গেল। নীরা এবার চিন্তায় পরে গেল। সে বাড়িতে আসা উপলক্ষে মালিহা প্রচুর ঝাল দিয়ে নীরার সবরকম পছন্দের ভর্তা বানিয়েছেন। মালিহার কষ্ট হবে বলে আর অপচয় হবে বলে নীরা আর কিছু রান্না করতে দেয়নি যেহেতু এই বাড়ির সবাই ই এসব খেতে পারে। কিন্তু শিহাব তো সেসব খেতে পারবে না। এখন সে শিহাবকে কি রান্না করে দিবে। শিহাব তো এখনই এসে পরবে। তাছাড়া বেশি আওয়াজও তো করা যাবে না। নইলে সবার ঘুমের ব্যঘাত ঘটবে। নীরা দ্রুত রান্না ঘরে গেল। তারপর ঝটপট আলু কেটে পেঁয়াজ মরিচসহ ডিম দিয়ে একসাথে ভাজি করে নিলো। তবে শুধু এটা দিয়ে খেতে দিতেই কেমন যেনো লাগলো। নীরা তাড়াহুড়ো করে আরো কিছু করতে চাইছিলো। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে আবার ফ্রিজ খুলতে যাচ্ছিলো। কিন্তু শিহাব ততোক্ষনে এসে রান্নাঘরের দরজার কাছে এসে দাড়িয়েছে। সে নীরাকে এভাবে দৌড়াতে দেখে বললো।
-আমার জন্য এতোকিছু করতে হবে না। যা আছে তাই দাও।
নীরা আমতাআমতা করে বললো।
-মানে আর বাকিসব অনেকঝাল। তুমি খেতে পারবে না।
শিহাব গম্ভীরমুখে বললো।
-আমি ঝালই খাবো।
বলেই বেড়িয়ে গেল। নীরা কতোক্ষন ঠায় দাড়িয়ে থেকে তাড়াহুড়ো করে আবার বেগুন ভাজি করলো। শিহাব বসেই রইলো। নীরা তাড়াহুড়ো করে শিহাবের সামনে খাবার দিলো। শিহাব না বলার পরও নীরা এসব করেছে বলে শিহাব রেগে কিছু বলতে চাইছিলো। কিন্তু বললো না। নীরা বলে উঠলো।
-আই এম সো স্যরি। প্লিজ তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও।
শিহাব গম্ভীরমুখেই বললো।
-তুমি তো খেয়েছিলে?
নীরা আস্তে করে বললো।
-হু।
শিহাব আর কিছু না বলে খেতে শুরু করলো। নীরার হাতের রান্না তার কাছে সবসময়ই অমৃত মনে হয়। এখনো তাই মনে হচ্ছে। শিহাবের খিদে থাকার কারনে জলদিই খেয়ে নিলো। নীরা বসে বসে শিহাবের খাওয়া দেখলো। নিজের ওপর নিজেরই প্রচন্ড রাগ হলো। খাওয়া শেষে শিহাব আর কিছু না বলে ঘরে চলে গেল। নীরাও কিছু বললো না। সব গুঁছিয়ে রেখে সে নিজেও ঘরে গেল। শিহাব আলো জ্বালায়নি আলো না জ্বালিয়েই সে বিছানায় গিয়ে বসেছে। নীরা এসে দেখলো শিহাব আলো জ্বালায়নি নীরা এসে আলো জ্বেলে দিলো। তারপর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো রাত দেড়টা বাজে। সে ঘড়ি দেখে শিহাবকে বললো।
-আচ্ছা ঘুমাও এখন। আমি মিলার কাছে যাই।
নীরার কথা শুনে শিহাব তড়াক করে বিছানা ছেড়ে উঠে গেল। তারপর দ্রুত দরজা সশব্দে বন্ধ করে পুনরায় এসে বিছানায় বসলো। এসব এতো দ্রুত হলো যে নীরার বুঝতে একটু সময় লাগলো। সে হতবাক হয়ে বললো।
-এসব কি।
তারপর মাথা ঠান্ডা করে বললো।
-তুমি টায়ার্ড আছো ঘুমাও। সকালে আমি ডেকে দিবো। আমি মিলার কাছে যাচ্ছি।
বলেই নীরা আবার দরজা খুলতে গেল। কিন্তু শিহাব এবার সরাসরি নীরার হাত ধরে টেনে বিছানায় এনে ফেললো। নীরা এতে রেগে গেল। তার মনে এমনিতেই দুইদিন যাবত আগুন জ্বলছে। সে শুধু কাউকে দেখাচ্ছে না। মনের আগুন মনে চাপা দিয়ে এখানে এসেছে নিজের মনকে শান্ত করতে। নীরা কারো দ্বারা প্রভাবিত হতে চায় না। সব যাচাই বাছাই না করে হতবুদ্ধিতার পরিচয় দিতে চায় না বলেই তো সে তার মায়ের কাছে এসেছে নিজেকে শান্ত করতে। কিন্তু শিহাবের ব্যবহারের কারণে সেটাও হচ্ছে না। নীরা রেগে শিহাবকে কিছু বলতে চাইছিলো। কিন্তু শিহাব নীরার দিকে ঝুঁকে নীরার কাঁধ শক্ত করে ধরে রেগে বললো।
-হোয়াই আর ইউ এভোয়েডিং মি? গত দুইদিন যাবত দেখছি আমি। হোয়াই? তোমার সমস্যা কি? আমি ব্যস্ত আছি বলে আমি অন্ধ নই।
শিহাব রেগে যাওয়ার কারনে কপালের শিরা ফুলে উঠেছে। চোখ লাল বর্ণ ধারণ করেছে। সারা মুখ ঘেমে গেছে। গত দুইদিন নীরা নিজের সাথে নানা যুদ্ধ করছিলো বলেই শিহাবের সাথে ঠিক করে কথা বলছিলো না। অন্যমনস্ক থাকছিলো। নিজেকে শান্ত করতেই এখানে আসা। আর তারপর শিহাবকে সে যা বলার বলবে। সে ভেবেছে শিহাব ব্যস্ততায় এসব নোটিস করবে না। কিন্তু শিহাব ঠিকই সব নোটিস করেছে। কিন্তু নীরার শিহাবের এমন ব্যবহারে রাগও হচ্ছে। শিহাব এমনভাবে ধরেছে যে নীরা ব্যথা পাচ্ছে। নীরা দাঁতের ওপর দাঁত চেপে বললো।
-এরকম এবিউজিং হাজবেন্ডের মতো আচরণ করবে না। ছাড়ো। ব্যথা পাচ্ছি।
শিহাব নীরার এমন কথা শুনে হাতের বাঁধন আলগা করলো। কিন্তু ছাড়লো না। ওভাবে ধরেই তীব্র রেগে ধমকে বললো।
-তুমি আমার সাথে এরকম আচরণ করছো কেন? সেটা বলো।
শিহাব জোরে ধমকে বলার কারণে নীরার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে। সে নিজেও রেগে বললো।
-শিহাব চেঁচাবে না। সবসময় সবাই তোমার রাগ আর ধমক দেখার জন্য বসে নেই।
শিহাব তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো।
-ও আচ্ছা,এখন আমি সবসময় রাগ দেখাই ধমক দেই?
নীরা ত্যাড়াভাবে বললো।
-অফ-কোর্স। তোমার সমস্যা কি আমি সেটাই বুঝতে পারছি না। তুমি এরকম করছো কেন আমি সেটাই বুঝতে পারছি না।
শিহাব ওভাবেই নীরাকে বললো।
-আমি ব্যস্ত থাকি বলে আমার চারপাশে কি হচ্ছে তার খবর যে আমি নিবো না সেটা তুমি কি করে ভাবলে?
এবার নীরা কটাক্ষ করে বলে উঠলো।
-আচ্ছা কি খবর নাও তুমি?
শিহাব রেগে চিবিয়ে চিবিয়ে বললো।
-তিশার এক্স আসাদ তোমার এনজিওতে কি করে? ও কেন তোমার আর রুমার সাথে সবজায়গায় যায়? ও তোমাদের নিয়ে কেন এতো কনসার্ন বলতে পারো?
নীরা শিহাবের কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেল।
-মানে কার কথা বলছো?
শিহাব নীরাকে ছেড়ে দিয়ে বললো।
-চিনতে পারছো না? তোমাদের এনজিওর নতুন মেম্বার আসাদকে চেনো না? ও তোমাদের জন্য এতো কনসার্ন কেন?
নীরা সবসময়ই একজন আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন বুদ্ধিমতি মেয়ে ছিলো। শিহাবের কথা শুনে তার প্রচন্ড আঁতে লাগলো। যেখানে সে তিশার দেওয়া ছবি দেখেও কোনো বাজে রিয়্যাক্সন এখনো পর্যন্ত দেয়নি। সময় নিচ্ছে। নিজেকে শান্ত করছে। সত্য মিথ্যা যাচাই করছে। সেখানে শিহাবের এমন কথা সে কিছুতেই নিতে পারলো না। সে শিহাবকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বললো।
-হোয়াট ডু ইউ মিন? এতো চিপ মেন্টালিটি কেন তোমার? ইউ নো হোয়াট? তোমাকে চিনতে আমার খুব বড় ভুল হয়েছে।
যখন মানুষ রাগের বশবর্তী হয়। তখন কোনোকিছুর হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। আর এমন মুহূর্তে যদি দুজনই রেগে থাকে তাহলে সেখানে আরো ভয়াবহ কান্ডও ঘটার সমূহ সম্ভাবনা থাকে। শিহাব আর নীরার মধ্যেও ঠিক এই ব্যপারটাই ঘটলো। শিহাব নীরার কথা শুনে প্রচন্ড রেগে নীরার হাত ধরে উঠিয়ে বললো।
-অনেক শুনেছি। এবার চলো বাড়িতে। আমি তোমাকে ভালোবাসি বলে তোমাকে লিমিট ক্রস করতে দিবো না।
নীরা শিহাবের হাত থেকে নিজের হাত ঝাড়া দিয়ে বললো।
-আমি নিজের লিমিট ক্রস করছি না তুমি করছো। ডোন্ট ক্রস ইয়োর লিমিট। একদম আমার সাথে এমন ব্যবহার করবে না।
শিহাব নীরার কথা না শুনে আবার হাত ধরতে গেলে নীরা পিঁছিয়ে গেল। রাগের বশবর্তী হয়ে বললো।
-একদম আমার হাত ধরবে না। আমার কনসেন্ট ছাড়া একদম আমাকে ছোঁয়ার চেষ্টা করবে না। আই হেইট দিস।
এই কথা বলার পর শিহাবের ইগো হার্ট হওয়া উচিত। বেড়িয়ে যাওয়া উচিত। কিন্তু শিহাব তা তো করলোই না উল্টো নীরার হাত ধরে কাছে এনে নীরার কাঁধে পরপর এলোপাথাড়ি কতোগুলো স্পর্শ দিয়ে বললো।
-ইউ আর মাই ওয়াইফ। আই ক্যান ডু এনিথিং উইথ ইউ। এনিথিং। আমি চাইলেই পারি। চাইলেই। এজন্য তোমার কনসেন্ট লাগবে না। কিন্তু আমি তা করি না। আমি তোমার কনসেন্টের পরোয়া করি।
শিহাবের এমন ব্যবহারে আর কথায় নীরার চোখে পানি এসে গেল। সে নিজের চোখের পানি কাউকে দেখায় না। কিন্তু আজ শিহাবের ব্যবহারে নীরার চোখ থেকে পানি পরলো। সে শিহাবকে পুনরায় ধাক্কা মারলো। কিন্তু শিহাবকে এবার একবিন্দু নড়ানো গেল না। নীরা রাগে কষ্টে অশ্রুসিক্ত চোখে চেঁচিয়ে বললো।
-তোমার মতো নিচু মানসিকতার একজনকে বিয়ে করা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল। তিশাকেই তুমি ডিজার্ভ করো। দুইদিন আগে আমি তিশার আর তোমার এমন কিছু ফটোস দেখেছি। যেখানে তোমাদের পূর্বের সম্পর্ক আমার কাছে আরো ঘোলাটে হয়েছে। তবুও যাচাইয়ের অপেক্ষায় ছিলাম। নিজের অশান্ত মনকে শান্ত করার চেষ্টাতে ছিলাম। তোমার সাথে তিশার সম্পর্ক তুমি কখনো আমাকে ক্লিয়ার করোনি। তবুও আমি শান্ত থেকেছি তোমাকে বিশ্বাস করি বলে তোমার সাথে কথা বলে সব যাচাই করতে চেয়েছি। তার বদলে তুমি আমাকে কি দিলে শুধুই অসম্মান?
শিহাব তখনও রেগেই ছিলো। কিন্তু নীরার চোখের পানি দেখে তার বুক জ্বলতে শুরু করলো। নীরা শিহাবকে নিজের সর্বশক্তি দিয়ে ধাক্কা দিলে শিহাব দুই পা পিছিয়ে গেল। নীরা জীবনে এতোটা রেগে যায়নি। কখনো না।
ওদের চেঁচামেচি শুনে মালিহা, রেজাউল,আর মিলা ভয় পেয়ে দরজার বাইরে দাড়িয়েছে। ভেতর থেকে নীরার চেঁচানোর আওয়াজেই সবাই জেগে গেছে। কেউ দরজায় বাড়িও দিতে পারছে না। সবাই চিন্তিত হয়ে দাড়িয়েছে বাইরে।
নীরা শিহাবের দিকে তাকিয়ে বললো।
-আমার সত্যিই তোমাকে বিয়ে করা ঠিক হয়নি। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল। তুমি বের হও এখনই বের হও।
নীরার চোখের পানি দেখে শিহাব আর কিছুই বলতে পারলো না। আবার চলে যেতেও পারছে না। নীরা নিজেই দরজা খুলে দিলো। মিলা, মালিহা আর রেজাউল ওদের এই হাল দেখে আঁতকে উঠলো। নীরা ততোক্ষনে চোখের পানি মুছে নিয়েছে। দরজার দিকে ইশারা করে সে শিহাবকে উদ্দেশ্য করে বললো।
-বের হয়ে যাও।
নীরার কথা শুনে সবাই হতভম্ব হয়ে গেল। মিলা আর মালিহা বারবার নীরাকে জিজ্ঞেস করলো। কিন্তু নীরা কিছু বললো না। শিহাব আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে বেড়িয়ে গেল।
শিহাব যাওয়ার পর নীরা সবার উদ্দেশ্যে শান্ত কন্ঠে বললঁ।
-আমি একা থাকতে চাই। কেউ আমাকে বিরক্ত করবে না।
বলেই দরজা ভেতর থেকে লক করে দিলো। চোখের পানি মুছে নিয়েছে সে। তবুও গাল বেয়ে ঝরঝর করে চোখের পানি পরতেই থাকলো।
–চলবে!