বালির নীচে জলের শব্দ
পর্ব ৬
নিকশ কৃষ্ণ আধারে ঢাকা সিঁড়ি। এদিকের আলো এখনো জ্বালানো হয়নি। সন্ধ্যার পর কেউ মনে হয় এখনো সিঁড়ি বেয়ে ছাদে ওঠে নি অথবা তিন তলা থেকে নামেনি। তাই আলোটা জ্বালানো হয়নি। মোবাইলের আলোটা জ্বালিয়েই খুব সন্তর্পণে সিঁড়ি বেয়ে উঠছিল কুমু। উপর তলা থেকে ধুপধুপ পায়ের আওয়াজে সেখানেই থেমে গেলো। কেউ খুব ব্যস্ত ভঙ্গীতে নেমে আসছে। আর কয়েকটা সিঁড়ি মাড়িয়ে উঠলেই আলোটা জ্বালাতে পারতো। কিন্তু ব্যস্ত পায়ের আওয়াজে সেই দায়িত্বটা নিজের কাঁধে নিলো না। পায়ের শব্দে বুঝতে পারলো মানুষটা খুব কাছাকাছি চলে এসেছে। পা জোড়া থেমে সুইচ চাপতেই চারিদিকে আলোকিত হয়ে উঠলো। বেখেয়ালিভাবে মানুষটার দিকে চোখ ফেরাতেই হৃদপিণ্ডের গতি বেড়ে গেলো কয়েকগুন। চোখ গুলো অক্ষিকোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। এই তো সেই মানুষ যাকে সে গত দুইদিন ধরে খুঁজে বেড়াচ্ছে। দেখার তৃষ্ণায় ভেতরটা খা খা করছে। চোখ জোড়া একে অপরের উপরে স্থির। কুমুর দৃষ্টি অনুভুতিসম্পন্ন। কিছুটা গোলমেলে, কিছুটা অস্থির। কিন্তু হিমেলের দৃষ্টি স্বাভাবিক। অনুভুতিশুন্য। হাত পা অল্প বিস্তর কাঁপতেই হিমেল কুমুর সেই তীব্র অনুভূতি সম্পন্ন দৃষ্টিকে সম্পূর্ণ রুপে উপেক্ষা করে অপরিচিতের মতো চোখ নামিয়ে চলে গেলো। মোবাইলের আলোটা নিভিয়ে দেয়ার কথা ভুলে গেলো কুমু। পুরো দৃশ্যটাই তার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হল। প্রতিদিনের মতো স্বপ্ন দেখছে না তো? হুট করেই আবার ঘুম ভেঙ্গে দেখবে না তো সে তার ঘরে শুয়ে আছে আর সেই মানুষটা বাস্তবে নেই? নিস্তব্ধ সিঁড়িতে পায়ের শব্দটা ক্রমশ কমে যেতেই মেইন গেট লাগানর জোরালো শব্দে কেঁপে উঠলো। ঘোরটা কেটে গেলো কুমুর। অপরিচিত কিন্তু ভীষণ মহনীয় সুগন্ধির রেশটা এখনো মো মো করছে। সেই সুঘ্রান নাকের মধ্য দিয়ে প্রবেশ করতেই নিউরন জানিয়ে দিলো পুরো ঘটনাই সত্যি। সেটা মস্তিস্ক ধরে ফেলতেই মন খারাপটা গায়েব হয়ে গেলো। ফিকে স্বপ্ন গুলো প্রাণ ফিরে পেলো। সাথে সাথেই জন্ম নিলো আরও কয়েক গুচ্ছ স্বপ্ন। নতুন উদ্যমে অনুভূতিগুলো জেগে উঠতেই দ্রুত পা ফেলে ছাদের দিকে গেলো। আজ মনে হচ্ছে জ্যোৎস্না বিলাসটা সার্থক!
————
একটা খামখেয়ালি রাত। কাজ কর্মে অমনোযোগী। শহর জুড়ে অন্ধকারের মাতম চলছে। সব কয়টা জানালা খোলা। বাতাসে পর্দা গুলো ফড়ফড়িয়ে উড়ছে। শুকনো ঝড়ে পুরো শহর এলোমেলো। দূর আকাশে মেঘের আড়ালে চলছে আলোক সজ্জা। থেমে থেমে খানিকবাদে তীব্র শব্দে কেঁপে উঠছে ধরণী। অম্বর জুড়ে চলছে আঁকা বাকা নকশা। নির্মল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কুমু। চোখ জোড়া এই অপার্থিব দৃশ্যে আটকে থাকলেও অক্ষিপটের প্রতিচ্ছবি কিন্তু ভিন্ন। সেই স্বপ্ন পুরুষের ছবি। ঠোঁটের কোণে হাসির রেশটা লেগেই আছে সেই সন্ধ্যা থেকে। চোখের সামনে তাকে দেখার পরেও বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে সেটা সত্যি। বৃষ্টি এখনো নামেনি। তবে তোড়জোড় চলছে বেশ। আশেপাশেই কোথাও বাজ পড়লো। কুমু চমকে ঘুমিয়ে থাকা মৌয়ের দিকে তাকাল। কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠে আবারো ঘুমিয়ে গেলো সে। চোখ মেললো না। তবে আগের থেকে হাত পা আরও একটু গুটিয়ে নিলো। ঠাণ্ডায় না ভয়ে বোঝা গেলো না। অনেক হয়েছে আর জেগে থাকার সাধ্য নেই। জানালার পর্দা টেনে দিয়ে উঠে গেলো বিছানায়। ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে তার। মৌকে জড়িয়ে ধরে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই চোখে ঘুম ভর করলো। হালকা ঘুমের মাঝেই কানে এলো প্রিয় গানের কিছু লাইন।
হৃদয়ের জানালায় চোখ মেলে রাখি
বাতাসের বাঁশীতে কান পেতে থাকি
তাতেই কাছে ডেকে, মনের আঙিনা থেকে
বৃষ্টি তোমাকে তবু ফিরিয়ে দিলাম
আমার সারাটি দিন
মেঘলা আকাশ
বৃষ্টি তোমাকে দিলাম
চোখ খুলে গেলো। সদ্য আসা ঘুমটা মস্তিস্কে কিছুটা প্রভাব ফেললো। বুঝে উঠতে সময় লাগলো কয়েক সেকেন্ড। আবারো শব্দ তরঙ্গ কানে বাজতেই ঘুম ছুটে গেলো নিমেষেই। কান আরও খাড়া করে ফেললো সে। সেই কণ্ঠস্বর। আশ্চর্য! গত দুইদিন ধরে কুমু তার সেই স্বপ্ন পুরুষের বিরহে গানের কথা ভুলেই বসেছিল। সেই কণ্ঠস্বর মাঝরাতে কোন গান গেয়েছিল কিনা সেটাও খেয়াল করে নি। আজ স্পষ্ট কণ্ঠ শোনার পর সে বুঝতে পারলো এই দুইদিন কোন গান শুনতে পায়নি। নিস্তব্ধ রাত্রিতে ঝঙ্কার তুলে বেজে উঠলো সেই খালি গলায় ধরা সুরটা। ঘরে থাকতে পারলো না কুমু। নিঃশব্দে বেরিয়ে ফোনের আলো জ্বালিয়ে ধির পায়ে সিঁড়ি বেয়ে ছাদের দিকে গেলো। শেষ সিঁড়িটা অতিক্রম করতেই চোখ পড়লো ছাদের এক কোণায় দাঁড়িয়ে থাকা এক অন্ধকার ছায়ামূর্তি। ভয়ে কেঁপে উঠলো। এই সময় তো কাউকে এতদিনে সে ছাদে উঠতে দেখেনি। তাহলে এটা কে? ভয়ে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলো। ঠিক সেই সময় হিমেল নিজের ফোনের দিকে তাকিয়েই দরজার দিকে ধির পায়ে এগিয়ে আসছে। ফোনের আলোটায় তার চেহারা স্পষ্ট। চেহারাটা চোখের সামনে স্পষ্ট হতেই কুমু নিশ্বাস আটকে দাঁড়িয়ে গেলো। এতক্ষন যার কথা ভাবছিল তাকে চোখের সামনে দেখছে। অবিশ্বাস্য কোন ঘটনার সাক্ষী হয়ে গেলো যেন। মনটা খুশীতে নেচে উঠলো। আটকে রাখা দমটা ফেলতেই ভুলে গেলো সে। হিমেলের মনে হল কেউ তার সামনে দাঁড়িয়ে থেকে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। চোখ তুলে তাকাতেই আচমকা এমন একটা মেয়েকে নিস্পলক চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভয় পেলো। ফোনটা হাত থেকে নীচে পড়ে গেলো। শব্দ হতেই কুমু সম্ভিত ফিরে জোরে জোরে কয়েকবার শ্বাস ছাড়ল। নিজের হাতের ফোনটা হিমেলের দিকে তাক করতেই দেখল সে গোল গোল চোখে তাকিয়ে আছে। কুমু বুঝতে পারল সে ভয় পেয়েছে। নিজের বোকামির জন্য নিজেকে কয়েকটা গালি দিলো। চোখের পলক ফেলে হিমেলের দিকে তাকিয়ে থেমে থেমে বলল
–আমি…আমি দো তলায় থাকি।
হিমেল লম্বা একটা শ্বাস ছাড়ল চোখ বন্ধ করে। সামনের জন যে মানুষ সেটা নিশ্চিত হতেই ভয়টা কেটে গেলো। ঢোক গিলে ফোনটা তুলে নিলো হাতে। ভ্রু কুচকে এদিক সেদিক ঘুরিয়ে ফোনটা ভালো করে দেখে নিলো কোন ক্ষতি হয়েছে কিনা। ক্ষতি হয়নি নিশ্চিত হতেই আরেকটা শ্বাস ছেড়ে কুমুর দিকে তাকাল। কুমু পুরো দরজাটা ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। নিস্পলক দৃষ্টি হিমেলের দিকে স্থির। হিমেল কিছুটা বিরক্ত হল। কিছুটা অপ্রস্তুত হল। সেটা অসস্তিতে গড়াতেই বলল
–নীচে যাবো।
পলক ফেললো কুমু। একটা সিঁড়ি নীচে নেমে দাঁড়ালো। হিমেল আবারো নিচের দিকে তাকিয়ে কুমুকে পাশ কেটে নেমে গেলো। সাথে সাথেই নাকে আসলো সেই সুগন্ধির ঘ্রাণ। কুমু চোখ বন্ধ করে ঠোঁটের কোন প্রসারিত করে লম্বা শ্বাস টানল। অনুভূতিটা আরও গাড় হল। ঠিক সেই সময় কানে এলো তখনকার থেমে যাওয়া সুরটার বাকি অংশ।
তোমার হাতেই হোক রাত্রি রচনা
এ আমার স্বপ্ন-সুখের ভাবনা
চেয়েছি পেতে যাকে, চাইনা হারাতে তাকে
বৃষ্টি তোমাকে তাই ফিরে চাইলাম
চোখ খুলে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল পেছনে। বুকটা কেঁপে উঠলো। প্রশ্নবধক তির্যক চাহুনি তার। সেই কণ্ঠ! সেই মানুষ! গোলমেলে অস্থির দৃষ্টি। হিমেল তিন তলায় বাড়িটার ভেতরে ঢুকে যাওয়া অব্দি কুমুর বিস্ময় কাটল না। দরজাটা লাগিয়ে দিতেই কুমু বুকে হাত রাখল। হৃদপিণ্ডের তীব্র আঘাতে রন্ধ্রে রন্ধ্রে বহমান রক্তের স্রোতটাও বেড়ে গেল কয়েক গুন হারে। হাত পা কাঁপছে তার। মস্তিস্ক জানিয়ে দিলো তার সেই স্বপ্ন পুরুষ আর মাঝরাতে গান গাওয়া সেই নেশাল কণ্ঠস্বরের মালিক একজনই। ভেতরটা তীব্র অস্থিরতায় নিস্তেজ হয়ে গেলো। এমন অস্থির অনুভুতির ভার বহন করা তার পক্ষে আর সম্ভব হচ্ছে না। কিছুতেই না।
চলবে….