বালির নীচে জলের শব্দ পর্ব ৯

0
1526

বালির নীচে জলের শব্দ
পর্ব ৯

মৌকে স্কুলে দিয়ে প্রতিদিনের মতো নিজের গন্তব্যের দিকে চলছে কুমু। কাছাকাছি যেতেই শ্রাবণকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। দেখে মনে হচ্ছে তার জন্যই অপেক্ষা করছিলো। চোখে মুখে হাজারও কথার ছড়াছড়ি। কিন্তু কোন আড়ষ্টতার কারণে বলে উঠতে পারছে না। এক পলক তাকিয়ে দেখে আবারো পা বাড়াল। শ্রাবণ ইতস্তত করে ডাকল
–কুমু।

দাঁড়িয়ে গেলো কুমু। ঘাড় ফিরিয়ে কঠিন দৃষ্টিতে তাকাল। শ্রাবণ একটু ঘাবড়ে গেলেও এগিয়ে এলো। সামনে দাঁড়িয়ে অপ্রস্তুত হেসে বলল
–তোমরা আমাদের বাড়ির দো তলায় ভাড়া এসেছ আমি জানতাম না।

–জানলে কি করতেন?

কুমুর সোজা সাপটা কথায় একটু ভড়কে গেলো শ্রাবণ। কুমুর স্থির কঠিন দৃষ্টির কাছে হার মেনে দমে নিচের দিকে তাকাল। নিজেকে ধাতস্থ করে নিয়ে বলল
–কিছুই করতাম না। তুমি খামাখা রাগ করছ আমার উপরে। আমি কিন্তু বখাটে ছেলে না।

কুমু হাত গুঁজে দাঁড়ালো। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে কঠিন গলায় বলল
–বখাটের নতুন কোন সঙ্গা হয়েছে নাকি? জানা নেই তো আমার। এখন পর্যন্ত আমি জানতাম মেয়েদের পেছনে ঘুরঘুর করা মানেই উত্যক্ত করা। আর উত্যক্তকারিকেই বখাটে বলে।

শ্রাবণ লজ্জা পেলো। দৃষ্টি নামিয়ে একটা শ্বাস ছেড়ে বলল
–এটা তো পুরাতন কৌশল। কোন মেয়েকে ভালো লাগলে আগে তার পেছনে ঘুরতে হবে। জানতে হবে। তারপর প্রপোজ করতে হবে। তোমার বান্ধবি সম্পর্কে না জানলে তাকে প্রপোজ করবো কিভাবে? তুমি শুধু শুধু ছেলেদেরকে ফ্রিতে বখাটে উপাধি দাও।

কুমু কয়েক সেকেন্ড চুপ থাকলো। শ্রাবণ চোখ তুলে দাঁত বের করে অপ্রস্তুত হেসে বলল
–আমি বাড়িতে তোমাকে দেখে ভয় পেয়েছিলাম।

–ভেবেছিলেন আমি আপনার বিরুদ্ধে নালিশ করতে গেছি তাই তো?

কুমুর কথায় শ্রাবণ মাথা নাড়ল। কুমু হেসে উঠলো তখনই। তার হাসি দেখে শ্রাবণ কিছুটা সস্তি পেলো। একটা তপ্ত শ্বাস ছেড়ে হাসার চেষ্টা করে বলল
–আসলে আমি মাকে একটু ভয় পাই তো। তাই আর কি।

কুমু ঠোঁট চেপে হাসল। বলল
–মাকে ভয় পান অথচ প্রেম করতে নেমেছেন রাস্তায়। প্রেম করতে সাহস লাগে জানেন তো?

শ্রাবণ সরল হেসে বলল
–জানি। মাকেই জা একটু ভয় পাই। বাকি আর কিছুতেই ভয় পাই না। একবার তোমার বন্ধুর দিক থেকে পজিটিভ রিয়াকশন পেলেই সেটাও দূর হয়ে যাবে।

কুমু আবারো হাসল। সরল হাসি তার। হাসি থামিয়ে বলল
–আমি জানতাম না আসলে আপনি বাড়ীওয়ালা আঙ্কেলের ছেলে। যাই হোক জেনে ভাল লাগলো। আমরা একই বাড়িতে থাকি।

শ্রাবণ মুচকি হেসে বলল
–চলো ক্যাম্পাসে যাই। তোমারও হয়তো ক্লাস আছে।

কুমু মাথা নেড়ে হাঁটতে শুরু করলো। শ্রাবণ সামনে তাকিয়ে বলল
–শুভ্রা তোমাদের বাড়িতে একবারও আসেনি তাই না?

কুমু মাথা নেড়ে জানিয়ে দিলো আসেনি। শ্রাবণ বলল
–কবে আসবে?

কুমু অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে হেসে উঠে বলল
–আপনার কবে দরকার?

কুমুর কথা শুনে শ্রাবণ লাজুক হাসল। বলল
–আমার ক্লাস আছে। পরে কথা হবে। এখন তো আমরা একই বাড়িতে থাকি। প্রতিদিন দেখা হবে।

কুমু হেসে বিদায় জানালো। শ্রাবণ চলে গেলো। একটু এগিয়ে যেতেই কুমু শুভ্রার কঠিন দৃষ্টির মুখোমুখি হয়ে গেলো। অমন ভাবে তাকিয়ে থাকা দেখে বলল
–তোর আবার কি হল?

শুভ্রা এগিয়ে এসে কঠিন গলায় বলল
–ঐ বখাটে ছেলেটার সাথে হেসে হেসে কি কথা বললি?

কুমু মুচকি হেসে বলতে গিয়েও থেমে গেলো। শ্রাবণ যে তার বাড়ীওয়ালার ছেলে সেটা এখনই শুভ্রাকে জানানো যাবে না। তার মনের ভাবটা বুঝে নিয়ে তারপর জানাবে। মুচকি হেসে বলল
–শ্রাবণ ভাইয়া আমার খোঁজ খবর নিচ্ছিল।

শুভ্রা সন্দিহান চোখে তাকাল। বলল
–শ্রাবণ ভাইয়া! কয়দিন আগেই তো বখাটে ছেলে ছিল। এখন আবার ভাইয়া। কিভাবে হল?

–সারাজীবন বখাটে থাকবে নাকি? তাছাড়া ভাইয়া ভালো মানুষ। সেদিন ফার্স্ট ইয়ারের একটা ছেলেকে কয়েকজন ছেলে মিলে মারছিল। ভাইয়া তাকে উদ্ধার করে সেখান থেকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। ট্রিটমেন্ট শেষ না হওয়া পর্যন্ত তার সাথে থাকে। তাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে তারপর নিজে বাড়িতে যায়। ভালো মানুষ না হলে কি এমন কাজ করে?

কুমুর কথা শুনে ভ্রু কুচকে তাকাল শুভ্রা। বলল
–তোকে এতো কিছু কে বলল?

–ঐ যে আমাদের জাহিদ আছে না ও বলেছে। পুরো সময়টা ও নিজেও ভাইয়ার সাথে ছিল। আর ছেলেটার ট্রিটমেন্টের খরচ নাকি ভাইয়াই দিয়েছে। ছেলেটার ফোন নাম্বার নিয়ে তার খোঁজ খবর নিচ্ছে নিয়মিত।

কুমু কথা শেষ করে শুভ্রার দিকে তাকাল। সে উদাসীন চোখে ঘাসের দিকে তাকিয়ে আছে। কিছু একটা ভাবছে গভীর ভাবে। কুমু একটু জোরেই বলল
–কি ভাবছিস?

শুভ্রা মুচকি হেসে বলল
–কিছু না। চল ক্লাসে যাই। দেরি হয়ে যাচ্ছে।

শুভ্রা এগিয়ে গেলো। কুমু তার দিকে তাকিয়ে আছে। শ্রাবণ গত ১ বছর যাবত শুভ্রার পেছনে ঘুরছে। এই সময় এসে মেয়েটার মনটা একটু গলেছে। কুমু বেশ বুঝতে পারছে তার ভোঁতা অনুভুতিতে হাওয়া লেগেছে। যে কোন সময় আগ্নেয়গিরির মতো অগ্নুৎপাত ঘটাতে পারে। প্রথম প্রথম শ্রাবণকে বখাটে ছেলেদের কাতারে ফেললেও এখন তার সম্পর্কে কুমুর ধারনা পরিবর্তন হয়েছে। তার মাঝেও যে একটা ভালো মানুষ আছে সেটা বুঝতে পেরেছে সে। বড় ভাইয়ের ভালো মানুষী গুনটার প্রতিচ্ছবি তার মাঝেও বিদ্যমান। ঠোঁট প্রশস্ত করে হাসল সে। কিছুদিন আগে হলেও শুভ্রার অনুভূতি বুঝতে তার কষ্ট হতো। কিন্তু এখন আর হচ্ছে না। কারণ তার মাঝেও যে ঠিক তেমনই অনুভূতি রয়েছে অন্যকারও জন্য।

———–
সকাল বেলা নাস্তা সেরেই দরজা খুলে সিঁড়ির উপরে দাঁড়ালো কুমু। সেখানে দাড়িয়েই ভেতরের দিকে তাকিয়ে মৌকে বলল
–তাড়াতাড়ি আসো। দেরি হয়ে যাবে।

মৌ মাত্র খাওয়া শেষ করলো। স্কুলের জন্য রেডি হয়েছে অনেক আগেই। ব্যাগটা ঘাড়ে নিয়েই বেরোবে সে আপার সাথে। রাফি ব্যস্ত ভাবে বেরিয়ে আপাকে দেখতে পেয়েই বলল
–আপা আমি আসি। আমার দেরি হয়ে গেছে।

কুমু সম্মতি দিতেই সে দ্রুত নেমে গেলো। তার কলেজ উল্টা পথে। আর কুমু ভার্সিটি যাওয়ার সময় মৌকে স্কুলে দিয়ে তারপর যায়। হাতের ঘড়িটায় চোখ বুলিয়ে নিতেই সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসা পায়ের আওয়াজ কানে আসলো। কুমু দরজার সাথে ঘেঁষে দাঁড়িয়ে উপরের দিকে তাকাল। হিমেল আর শ্রাবণ উপর থেকে নেমে আসছে সিঁড়ি বেয়ে। হিমেলকে দেখেই কুমুর নিশ্বাস ভারী হয়ে এলো। তার পায়ের তালে তালে হৃদপিণ্ডের গতি বেড়ে যাচ্ছে ক্রমশ। কুমু তার দিকে তাকাতেই চোখে চোখ পড়লো। হিমেল তার দিকে তাকিয়ে আছে। বুকের ভেতরটায় তুমুল ঝড়ের আভাস পেতেই চোখ নামিয়ে নিলো সে। হিমেলের গম্ভীর দৃষ্টি তার পুরো মুখেই বিচরন করছে। এই প্রথমবার হিমেল ভালো করে দেখছে মেয়েটাকে। গৌরশ্যাম বর্ণ। ঠোঁটের ঠিক উপরে একটা কুচকুচে কালো তিল তার সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে। চোখের পাপড়ি গুলো ঘন লম্বা। মৌ এসে দাড়িয়েই বলল
–চলো আপা।

হিমেল কুমুর সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেলো। তার হৃদপিণ্ডের গতি দিগুন হারে বাড়ছে। গাল ভারী হয়ে কান গরম হয়ে গেলো। নিচের দিকে তাকিয়ে অস্থির শ্বাস ফেলছে সে। দৃষ্টি অস্থিরভাবে বিচরণ করছে এদিক সেদিক। তীব্র অপরাধবধ ধাওয়া করছে ভেতরে ভেতরে। যেন কোন নিষিদ্ধ আকাঙ্খা ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়। হিমেল আলতো করে মৌয়ের মাথায় হাত রেখে চমৎকার হেসে বলল
–নাম কি তোমার?

এতো কাছ থেকে মানুষটার আবেগময় কণ্ঠস্বর আর মাতাল করা সুগন্ধির ঘ্রানে নিজেকে সামলে নিতে বেশ কষ্ট হল কুমুর। অস্থিরতা বেড়ে গেলো। মৌ হিমেলকে ভালো করে দেখে নিয়ে বলল
–মৌ।

স্বাভাবিক ভাবেই কৌতূহল থেকে জিজ্ঞেস করলো
–তোমার নাম কি?

তার কোমল কণ্ঠ শুনেই হিমেলের মনে অদ্ভুতভাবে আদুরে ভাব চলে এলো। এক হাত গালে রেখে বলল
–হিমেল।

নামটা শুনেই কুমুর ভেতরটা কেমন যেন করে উঠলো। চোখ বন্ধ করে ফেললো সে। মৌ উতফুল্য কণ্ঠে বলল
–তুমি হিমেল?

কুমু মৌয়ের হাতে হালকা চেপে ধরে চাপা ধমকের সুরে ফিস ফিসিয়ে বলল
–ভাইয়া বলো।

মৌয়ের হাস্যজ্জল মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। সে যে ভুল করেছে সেটা বুঝতে পেরেই তার খারাপ লাগা শুরু হয়ে গেলো। হিমেল পুরোটা খেয়াল করলো। মৌয়ের মাথায় হাত রেখে কুমুর দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বলল
–ইটস ওকে। ওর যা ইচ্ছা বলতে পারে। সমস্যা নেই তো।

কুমু কোন উত্তর দিলো না। এমন কি চোখ তুলে তাকাতেও পারলো না। তার অনুভূতি যদি হিমেলের কাছে ধরা পড়ে যায় তাহলে সে আর লজ্জায় তার সামনে কোনদিন আসতে পারবে না। হিমেল কয়েকটা সিঁড়ি পেরিয়ে নীচে নামতেই শ্রাবণ কুমুর সামনে দাঁড়িয়ে প্রশস্ত হেসে বলল
–ক্লাস আছে না? কখন যাবে?

কুমু হেসে বলল
–আছে। এখনই যাবো।

কথোপকথন কানে আসতেই হিমেল ঘাড় ঘুরিয়ে সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকাল। তাদের কথা শুনে আন্দাজ করে ফেললো তারা পূর্ব পরিচিত। কিন্তু কিভাবে চেনে এই মেয়েকে? তাহলে কি এই মেয়েকেই শ্রাবণ পছন্দ করে?

চলবে…

(রিচেক করা হয়নি। ভুল থাকলে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here