বালির নীচে জলের শব্দ পর্ব ১২

0
1370

বালির নীচে জলের শব্দ
পর্ব ১২

নিস্তব্ধ প্রহরে দমকা হাওয়া এসে সেই ছড়িয়ে থাকা চুলগুলোকে আরও এলোমেলো করে দিলো। হিমেলের কথাটা বজ্রপাতের মতো শোনালো কুমুর কাছে। চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে গেলো। হুট করেই এমন তুমি সম্বোধনে পুরো শরীরে শিহরণ জেগে উঠলো। হিমেলের দিকে বিস্ময় নিয়ে তাকাতেই সে জিহ্বা দিয়ে শুকনো ঠোঁট জোড়া ভিজিয়ে বলল
–এতো রাতে ছাদে? তাও আবার খোলা চুলে?

কুমু ঢোক গিলে নিচের দিকে দৃষ্টি নামিয়ে নিলো। কয়েক সেকেন্ডের মাথাতেই চুলটা শক্ত করে হাত খোপা করে নিয়ে মাথায় ওড়নাটা টেনে দিলো। হিমেল শান্ত দৃষ্টি ফিরিয়ে আকাশের চাঁদের দিকে তাকাল। মন বলে উঠলো “কোনটা বেশী সুন্দর? আকাশের বুকে জ্বলে ওঠা আস্ত চাঁদটা নাকি তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সাধারণ রমণীর অসাধারণ চাঁদমুখটা।” আবারো দৃষ্টি ফেরাল সেই রমণীর মুখশ্রীর সর্বত্র। কোন উত্তর খুঁজে পেলো না। তবে অদ্ভুত প্রশান্তি অনুভুত হল মনের মাঝে। কুমু নিচের দিকে তাকিয়ে ভাবছে কি করবে। দাঁড়িয়ে থাকবে নাকি চলে যাবে। মাথার ওড়নাটা আরও টেনে দিতেই হিমেল বলল
–মেয়েদের এভাবে রাতে ছাদে ওঠা একদম ঠিক না। আর খোলা চুলে তো নয়ই।

কুমু নিচের দিকে তাকিয়ে মিনমিনে কণ্ঠে বলল
–ঠিক আছে। আর আসবো না।

হিমেল পায়ের দিকে তাকিয়ে বলল
–পায়ের ব্যাথা কমেছে?

কুমু আলতো করে মাথা নাড়ল। হিমেল কোন উত্তর দেয়ার আগেই কুমু সেখান থেকে দ্রুত চলে গেলো। হিমেল কিছুই বলল না। তবে কুমু পুরোপুরি দৃষ্টির আড়াল না হওয়া পর্যন্ত সেদিকে তাকিয়েই থাকলো। কুমু চলে যেতেই তার মস্তিস্ক সজাগ হয়ে উঠলো। ভাবল এভাবে বলাটা কি ঠিক হল? মেয়েটা কিছু মনে করলো না তো?

————
হিমেল নিজের ঘরে বিছানায় বসে চেনা একটা রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনছিল। এইসব গান তাকে ভীষণভাবে আকর্ষণ করে। সে সব সময়ই এ ধরনের গান শুনতেই পছন্দ করে। বিশেষ করে যখন সে ছবি আঁকে। আজ অনেকদিন পর সে মনস্থির করেছে ছবি আকবে বলে। সব ধরনের ছবি আঁকলেও প্রকৃতির ছবিটা হিমেলকে অদ্ভুতভাবে ভেতর থেকে টানে। কেমন একটা প্রশান্তি অনুভব করে মনের মাঝে। তাই ঠিক করে ফেললো তার জানালা থেকে বাইরে যে ধানক্ষেত দেখা যায় তার ছবি আঁকবে। রঙ তুলি নিয়ে আর্ট পেপারের দিকে এগিয়ে গেলেও মন কিছুতেই সেদিকে স্থির করতে পারছে না। কারণ বাইরে থেকে গলার আওয়াজ আসছে। হিমেল ছবি আঁকার জন্য নিরিবিলি পরিবেশটা সব সময় বেছে নেয়। সে হিসেবে বলতে গেলে এই সময়টা এখন ছবি আঁকার জন্য উপযুক্ত নয়। বারবার বাধা গ্রস্ত হওয়ায় বিরক্ত চলে আসলো। ভীষণ বিরক্ত হয়ে ছবি আঁকা বন্ধ করে দিলো সে। ফুস করে একটা শ্বাস ছেড়ে আবারো বসে পড়লো। কিন্তু হুট করেই মনে হল খোলা হাওয়ায় ছবিটা আঁকতে পারলে ভালো হতো। প্রকৃতির স্পর্শে প্রকৃতির ছবি। আর এই পরিবেশ এই মুহূর্তে ছাদের থেকে ভালো আর হতেই পারে না। মুচকি হেসে প্রয়োজনীয় সবকিছু নিয়ে ছাদে উঠে গেলো। যেদিক থেকে ধান ক্ষেত স্পষ্ট দেখা যায় সেদিকেই দাঁড়ালো। ধান ক্ষেতটা ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে নিয়ে তুলি হাতে তুলে নিলো। আশ্চর্য জনকভাবে ধান ক্ষেতের ছবি আঁকতে শুরু করলেও মাথায় এলো গত রাতের দৃশ্য। আস্ত চাঁদের নীচে দাঁড়িয়ে আছে আরেক মায়াবী চাঁদ। সেই অপার্থিব দৃশ্যের দেখা সচরাচর পাওয়া যায় না। চোখে ভেসে উঠলো সেই সাধারণ রমণীর প্রতিচ্ছবি। প্রতিচ্ছবিটা স্পষ্ট হতেই আপনা আপনি রঙ তুলি নিজেই রুপ দিতে লাগলো। কিছুটা আঁকার পর এক পর্যায়ে থেমে গেলো হাত সজাগ হল মস্তিস্ক। এটা তো আঁকার কথা ছিল না। এমন কেন হল? কোমরে হাত রেখে সেদিকে স্থির তাকিয়ে ভাবল। কিছুটা বিরক্ত হয়েই পেপারটা ক্লিপ বোর্ড থেকে খুলে মুড়িয়ে এক পাশে ছুড়ে ফেলে দিলো।

–এই, তুমি ওটা ফেললে কেন? নোংরা যেখান সেখানে ফেলতে হয়না জানো না?

হিমেল ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। মৌ কোমরে হাত রেখে ভ্রু কুচকে তার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখে মুখে ভীষণ রাগ তার। এমন চেহারা দেখে হিমেল হেসে ফেললো। মৌ রাগান্বিত কণ্ঠে বলল
–আবার হাসছ কেন?

হিমেল হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো। মৌয়ের হাত ধরে বলল
–আমি নোংরা ফেলেছি বলে তুমি রাগ করেছো? আচ্ছা ঠিক আছে সরি। আর ফেলবো না। তবুও রাগ করো না প্লিজ!

মৌয়ের কপালের গভীর ভাঁজ কিছুটা শিথিল হল। তবুও রাগটা ধরে রাখার চেষ্টা করেই বলল
–আর এমন করবে না। নোংরা ফেললে পরিবেশ নোংরা হয়।

হিমেল মুচকি হেসে মাথা নাড়ল। মৌ এদিক সেদিক তাকাতেই পেছনে চোখ পড়লো ক্লিপ বোর্ডের উপরে। সেদিকে আঙ্গুল তাক করে বলল
–ওটা কি?

হিমেল ঘাড় ফিরিয়ে সেদিকে তাকিয়ে বলল
–ওটা ছবি আঁকার বোর্ড। ওখানে কাগজ রেখে ছবি আঁকতে হয়।

মৌ মনোযোগ দিয়ে সেদিকে তাকাতেই কোথা থেকে কুমু এসে তাকে হাত ধরে ঝাঁঝালো গলায় বলল
–ছাদে কেন আসছ? তোমাকে মানা করছি না একা একা ছাদে আসতে। কথা শোন না কেন? একটা থাপ্পড় দেবো।

মৌ মুখটা ভার করে নিচের দিকে তাকাল। এখনই কেঁদে দেবে এমন একটা অবস্থা। হিমেল পুরোটা এতক্ষন চুপ করে দেখছিল। কুমু থেমে যেতেই বলে উঠলো
–ছোট বাচ্চাদের সাথে এভাবে কথা বলে?

কুমু পাশ ফিরে তাকাল। অস্থির হয়ে উঠলো দৃষ্টি। এতক্ষন সে রাগের মাথায় হিমেলকে খেয়াল করেনি। হিমেল আছে জানলে এতো জোরে কথাই বলতো না। কুমু দৃষ্টি নত করে ফেলতেই হিমেল মৌকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে আদুরে কণ্ঠে বলল
–মন খারাপ হয়েছে?

মৌ নিচের দিকে তাকিয়েই মাথা নাড়ল। হিমেল একটা শ্বাস ছেড়ে বলল
–মন খারাপ করে না। তুমি একা একা ছাদে আসো যদি পড়ে যাও তখন? তুমি ছোট তাই বুঝতে পারো না। কিন্তু বড়রা বুঝতে পারে। তাই তোমাকে নিয়ে চিন্তা করে। কথা না শুনলে তখন বকে। বড়দের কথা শুনতে হয়।

মৌ তার দিকে তাকাল। হিমেলের কথা সে বুঝতে পেরেছে। তার মন ভালো হয়ে গেছে। মুচকি হেসে বলল
–ঠিক আছে। আর আসবো না।

হিমেল অবাক হয়ে তাকাল। কাল রাতে কুমুও ঠিক এভাবেই বলেছিল। দুই বোনের কথার এমন মিল দেখেই কুমুর দিকে তাকাল। কুমু তার দিকেই তাকিয়ে ছিল চোখে চোখ পড়ায় দৃষ্টি নত করে ফেললো। হিমেল মুচকি হেসে মৌয়ের দিকে তাকাতেই সে হিমেলের পেছনে গিয়ে তুলি নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগলো। বেশ মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে সে। হিমেল তার দিকে একবার তাকিয়ে মুচকি হেসে কুমুর দিকে ঘুরে তাকাল। বলল
–একটু কথা বলা যাবে?

কুমু ভীষণ অবাক হয়ে তাকাল। উত্তর দিতে পারলো না তৎক্ষণাৎ। কিছুটা সময় নিয়ে বলল
–জি বলুন?

–কাল রাতে ছাদ থেকে নেমে যেতে বলেছিলাম। তার জন্য খুবই দুঃখিত। কিছু মনে করো নি তো?

হিমেলের কথা শুনে কুমু আরেক দফা অবাক হল। কাল রাতের কথা বলার ধরণ আর এখন কার কথা বলার ধরনের মাঝে রাত দিন তফাৎ। কাল রাতে হিমেলের কথার মাঝে কোথাও একটা অধিকার বোধ খুঁজে পেয়েছিল কিন্তু আজ শুধুই ভদ্রতা। মনটা অজানা বিষণ্ণতায় ভরে উঠলো। জোর করে হাসার চেষ্টা করে বলল
–না না। এতে মনে করার কি আছে?

হিমেল অবিশ্বাসের সুরে বলল
–সত্যি তো?

কুমু হাসল। তার হাসির অর্থ সে সত্যিই কিছু মনে করে নি। হিমেল কুমুর নত দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বলল
–শুধু ছাদে কেন মেয়েদের রাতে একা একা চলফেরা করাই উচিৎ নয়। অনেক কিছুই হতে পারে। সাবধানে থাকতে হবে। আর এমনিতেই রাতে খোলা চুলে ঘোরাফেরা করতে হয় না।

কুমু অবাক হয়ে হিমেলের দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকলো। মনে আসা কথাটা অজান্তেই বলে ফেললো
–আপনার কথা শুনে মনে হয়না আপনি বিদেশে পড়ালেখা করেছেন। এতো বছর বিদেশে পড়ালেখা করার পরও কি চমৎকার বাংলা বলেন।

কুমুর কথা শুনে হাসল হিমেল। বলল
–বিদেশে ছিলাম বলে কি আমি বাঙালী নই? আমার চেহারা, আমার ভাষা সবকিছুই আমার সংস্কৃতিকে ফুটিয়ে তোলে। আমি রবীন্দ্রনাথের ভক্ত। আমি শরৎচন্দ্রের প্রেমের উপন্যাস পড়ি। গ্রাম প্রকৃতির ছবি আঁকি।

থেমে যেতেই কুমু বিস্ময় নিয়ে বলল
–আপনি ছবি আঁকেন?

হিমেল তাকাল। মুচকি হেসে বলল
–হ্যা। আঁকি।

–কিসের ছবি আঁকেন?

হিমেল হাত ভাঁজ করে দাঁড়ালো। গভীর দৃষ্টি ফেলে বলল
–সবকিছুর। অনুমতি পেলে তোমারও ছবি আঁকতে পারি।

কথাটা শেষ হতেই কুমুর মুখভঙ্গি পরিবর্তন হয়ে গেলো। এতক্ষন সবকিছু ঠিক থাকলেও এখন পরিবেশটা কেমন অসস্তিতে ভরে গেলো। হিমেল খেয়াল করলেও কিছু বলল না। কুমুর উত্তরের অপেক্ষায় থাকলো। কুমু লাজুক হেসে মিনমিনে কণ্ঠে বলল
–আমার ছবি?

হিমেল হেসে ফেলে বলল
–আপনার ছবি। কবে অনুমতি পাবো?

কুমু মুচকি হেসে নত দৃষ্টিতে বলল
–আমার অনুমতি কি খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু?

–অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। বিনা অনুমতিতে কারো ছবি আঁকাটা অপরাধ। আর তোমার কাছে আমি অন্তত কোন অপরাধ করতে চাই না। সেই অপরাধের ভার আমি যে বইতে পারবো না।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here