বালির নীচে জলের শব্দ পর্ব ১৬

0
1506

বালির নীচে জলের শব্দ
পর্ব ১৬

হিমেল এর সামনে না যাওয়ার দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েই তিন দিন বাড়িতেই কেটে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল কুমু। নিজের অবাধ্য অনুভূতিগুলোকে লুকানোর অযাচিত প্রয়াস। সেসব কোনভাবেই যাতে হিমেলের সামনে না আসে। শুধু যে হিমেলের সামনে না যাওয়ার কারনেই বাড়িতে থাকা তা না। আরো একটি বিশেষ কারণ হলো নিজের ভাঙ্গা মনটাকে গুছিয়ে নেওয়ার জন্য কিছু সময় প্রয়োজন ছিল। নিজেকে কিছু সময়ের জন্য একা থাকতে দেয়ার দরকার ছিল। সব মিলিয়ে পুরো তিনটা দিন একেবারেই ঘরবন্দি হয়ে কাটিয়ে দিল সে। অবশ্য এই তিনটা দিন বাড়িতে থাকতে বেশ ঝামেলা পোহাতে হয়েছে তাকে। কেউ না কেউ কিছু সময় পর পর এসে জিজ্ঞেস করেছে কি হয়েছে। এসব হাবিজাবি প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েই কিছুটা বিরক্ত হয়ে উঠেছে সে। আর কোনভাবেই বাড়িতে থাকা সম্ভব হচ্ছিল না। আর দুই একদিন বাড়িতে থাকলে সে এসব প্রশ্নের চক্করে পাগল হয়ে যাবে। গোসল সেরে এসে ভেজা চুলগুলো তে তোয়ালে চেপে হালকা হাতে মুছে নিল। এর মাঝে মৌ এসে বলল তার মা ছাদে যেতে বলেছে শুকনো কাপড় গুলো তুলে আনতে। কুমু ভেজা চুলগুলো তোয়ালে দিয়ে একটা ঝাড়া মেরে সেই ভেজা তোয়ালে হাতে নিয়ে চলল ছাদের দিকে। সিঁড়ি বেয়ে তিন তলা পর্যন্ত উঠতেই পায়ের শব্দে থেমে গেল। হিমেল পাঞ্জাবির হাতা গোটাতে গোটাতে ব্যস্ত ভাবে সিঁড়ি দিয়ে নামছিল। সামনে চোখ পড়তেই কুমুকে দেখে থেমে গেল। চমকিত দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকালো সে। কিছুটা অবাক হয়েছিল এভাবে কুমুকে দেখে। পুরো তিনটা দিন পর মেয়েটা কে দেখতে পেল। এই তিনটা দিন তার যাওয়া-আসার সময় হিসেব করে হিমেল রাস্তায় অপেক্ষা করেছিল। কিন্তু কোনভাবেই মেয়েটার সাথে দেখা হয়নি তার। কেন হয়নি এই কারণটা সে এখনো বুঝতে পারছে না। কুমুর সাথে পরিচয় হওয়ার পর থেকে এমন কখনো হয়নি যে তাদের এক দিনে দুই থেকে তিনবার দেখা হয়নি। কিন্তু এই তিন দিনে মেয়েটার ছায়া দেখতে পায় না সে। বিষয়টা সত্যিই অন্যরকম মনে হয়েছে তার কাছে। আর এর কারণটা একমাত্র কুমুই বলতে পারবে। হিমেল এর এমন গভীর দৃষ্টিতে তাকানো দেখে কুমু চোখ ফিরিয়ে নিচের দিকে তাকালো। ভেজা চুলগুলো আলতো করে কানের পেছনে গুঁজে দিয়ে তোয়ালেটা শক্ত করে চেপে ধরল। যত কিছু হয়ে যাক এই মানুষটার সামনে তাকে অত্যন্ত স্বাভাবিক আচরণ করতে হবে। কোন ভাবে এমন কোন আচরণ করবে না যাতে মানুষটা অন্য কিছু ভেবে বসে। গত তিনদিন আগে হিমেল এর কথার উত্তরে যে ধরনের আচরণ করেছিল তার সাথে সেটা নিয়ে সে নিজের উপর খুবই বিরক্ত। হিমেল এর সাথে এমন কোন আচরণ করার যুক্তিযুক্ত কারণ নেই। বিষয়টি শুধুই বাড়াবাড়ি ছাড়া আর কিছুই নয়। না জানি তার সেই আচরনের কারণ হিসেবে হিমেল ঠিক কি ভেবে বসেছে। তাই এবার থেকে সে নিজেকে যথাসম্ভব সংযত রাখার চেষ্টা করবে। অনুভূতিগুলোকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করবে। আর হিমেলের সাথে আর দশটা মানুষের মতোই আচরণ করবে। দৃষ্টি নত করে হিমেল কে পাশ কাটিয়ে দুটো সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেল কুমু। আরো একটি সিঁড়ি মাড়াতেই গম্ভীর কণ্ঠ কানে এলো
–দাঁড়াও।

হৃদপিন্ডের গতিটা তীব্র ভাবে বেড়ে যেতেই থেমে গেল কুমুর পা। বুকের ভিতর লুকিয়ে রাখা গোপন অনুভূতিটুকু নড়েচড়ে উঠতেই চোখটা বন্ধ করে খুব জোরে একটা শ্বাস ফেলল সে। কোনভাবেই এই অনুভূতিকে আর হাওয়া লাগবে দিতে চায় না সে। গোপন অনুভূতিটা গোপন থাকাই শ্রেয়। এক তরফা এই অনুভূতিটা ভীষন জন্ত্রণা দায়ক সেটা অন্তত এই কয়দিনে বুঝেছে সে। এই যন্ত্রণা এভাবে সহ্য করে নেয়ার কোন কারণ নেই। তাই পিছন ফিরে খুব স্বাভাবিক ভাবে বলল
–জি?

হিমেল ততক্ষণে তার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। তার গভীর দৃষ্টি কুমুর চোখের দিকে নিবদ্ধ। সেই দৃষ্টি কুমুকে দুর্বল করে তুলছে ক্রমশই। ভেতরটা আবেগে টলমলে হয়ে ওঠার আগেই নিজেকে সামলে নিয়ে কোমল স্বরে বলল
–কিছু বলবেন?

–তুমি ঠিক আছো তো?

হিমেলের এমন অদ্ভুত প্রশ্নের ঠিক কি উত্তর দেবে সেটা কোনভাবেই বুঝে উঠতে পারল না সে। আর এমন প্রশ্নের কারণটাও অস্পষ্ট। কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে কুমু নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে ছোট্ট করে বলল
–হ্যাঁ।

হিমেল আপাদমস্তক ভালো করে কয়েকবার দেখে নিয়ে বলল
–কোন সমস্যা?

কুমু এবার হিমেলের দিকে তাকালো। এবার তাকানোর পরেই বিষয়টা খেয়াল করল এই সুদর্শন পুরুষের চোখের মাঝে তার সর্বনাশ। সেদিকে তাকিয়ে সে কোনভাবেই নিজের অনুভূতি গুলোকে গোপন করে রাখতে পারবে না। সাথে সাথে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। আবারও ছোট্ট কথায় উত্তর দিল
–না।

–তাহলে পুরো তিনটা দিন কোথায় ছিলে?

কুমু নিচের দিকে তাকিয়ে থাকলেও হিমেলের গম্ভীর কণ্ঠসর আর তীব্র অধিকারবোধ তাকে আরেকবার দুর্বল করতে সক্ষম হয়ে উঠল। হাতে ধরে থাকা ভেজা তোয়ালেটা শক্ত করে চেপে ধরলো। সে যে তিনদিন ধরে বাসা থেকে বের হয়নি মানুষটা সেটাও খেয়াল করেছে। অথচ এটা কুমুর কাছে অপ্রত্যাশিত একটা ব্যাপার। কিন্তু কেনো? এতো কিছু খেয়াল করার কারণটা ঠিক কি হতে পারে? কয়েক সেকেন্ডেই অনেক কিছু ভেবে বসলো সে। কিন্তু কোন উত্তর খুঁজে পেলো না। তাই নিচের দিকে তাকিয়ে উত্তরটা দিলো
–বাসায় ছিলাম।

–কারণটা জানতে পারি কি?

এবার কুমু নিজের ধৈর্য হারিয়ে ফেলল। হিমেলের এমন প্রশ্নের উত্তর দিতে থাকলে সে আর কোনভাবেই নিজেকে আটকাতে পারবেনা। তাই নিয়ে ফেললো একটা কঠিন সিদ্ধান্ত। হিমেল এর এভাবে সব প্রশ্নের উত্তর দেয়া সম্ভব না। তবে হিমেল যে অযথাই এসব প্রশ্ন করে তার উপরে অধিকার দেখাচ্ছে সেটাও তাকে বুঝিয়ে দিতে হবে। যাতে ভবিষ্যতে এমন আচরণ করার আগে সে একটু ভেবে দেখে। তাই কিছুটা অধৈর্য হয়েই কণ্ঠে কাঠিন্য বজায় রেখে হিমেলের চোখে চোখ রেখে বলল
–এত প্রশ্নের উত্তর আপনাকে কেন জানতে হবে? আমি কোথায় যাই কি করি কতক্ষণ কোথায় থাকি এই সবকিছুর প্রতি আপনার এত আগ্রহ কেন? আমি সেদিনও বলেছি আমার জীবন আমার ইচ্ছা। আর আমি আমার জীবনে খুব কাছের মানুষ ছাড়া কাউকে কৈফিয়ৎ দিই না। আর আমার মনে হয় না আপনার সাথে আমার এমন কোনো সম্পর্ক আছে যার জোরে এসব কৈফিয়ৎ আমি আপনাকে দিতে পারি। আশা করি আমার কথা বুঝতে পারছেন। আপনি যথেষ্ট ভালো মানুষ। তাই ভালোভাবেই বলছি। আমার কথা বুঝতে পারলেই ভালো হবে। আর একটা কথা বিশেষ ভাবে অনুরোধ করবো। যেখানে সেখানে আমাদের এভাবে কথা বলার ব্যাপারটা যদি কারো নজরে পড়ে তাহলে বিষয়টা খারাপ দেখাবে। প্রাপ্ত বয়স্ক ছেলে মেয়ে এভাবে কথা বললে সমাজ সেটাকে ভালো চোখে দেখে না। আশা করবো আপনি বিষয়টা খেয়াল রাখবেন।

কুমুর কথার প্রেক্ষিতে হিমেল আর কোন কথা খুঁজে পেল না। অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল তার দিকে। কুমুর চেহারা বেশ স্বাভাবিক থাকলেও ভেতর থেকে হিমেল এর অসহায় দৃষ্টি তাকে যন্ত্রণা দিচ্ছে। সে অসহনীয় যন্ত্রণা সহ্য করার ক্ষমতা হয়তো তার নেই। তাই দ্রুত সিড়ি দিয়ে ছাদে উঠে গেল। হিমেল আরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছাদের দিকে তাকিয়ে থাকলো। কুমুর এমন আচরণটা তার কাছে খুব একটা বিস্ময়কর ঠেকল না। কারনটা যে তার কাছে স্পষ্ট। হিমেল খুব ভালো করে বুঝতে পারছে তার ভুলের কারণে কুমুর এমন আচরণ তাকে মেনে নিতে হচ্ছে। কুমুর অভিমান কিভাবে ভাঙবে সেটাই বুঝে উঠতে পারছে না। ছাদে ওঠার মুহূর্তে কুমুর বারবার পেছন ফিরে দেখতে ইচ্ছা করছিলো হিমেলের দিকে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করতেই সেই অসহায় দৃষ্টি ভেসে উঠলো চোখের সামনে। বুকের ভেতরটা যন্ত্রণায় চিনচিন করে উঠলো। হিমেল যে তার আচরণে কষ্ট পেয়েছে। কিন্তু কুমুর তো তাকে কষ্ট দেয়ার উদ্দেশ্য ছিলো না। সে তো পরিস্থিতির চাপে বাধ্য। তীব্র বিষাদের ছায়া নেমে এলো তার চেহারায়। পুরো মনটাই পড়ে আছে সেই মানুষটার কাছে। আবারও যেতে মন চাইছে তার সামনে। কিন্তু যাকে নিষিদ্ধ বলে আখ্যা দিয়েছে তার কাছে আবার ছুটে যাওয়ার কোন কারণ নেই। সেই নিষিদ্ধ ইচ্ছাটাকে পুনরায় দমিয়ে রেখে চোখের পানি ফেলল।

————-
হিমেল এর সাথে আবারও দেখা হলো পরের দিন সকালে। মৌয়ের হাত ধরে রাস্তায় হাঁটছিলো কুমু। হিমেল সেখানেই দাড়িয়ে কুমুর অপেক্ষা করছিলো। সে জতই অপমান করুক না কেনো হিমেল কিছুতেই হার মানবে না। কুমুকে মানিয়েই ছাড়বে। কতদিন কুমু তাকে এভাবে এড়িয়ে যায় সেটাই দেখার পালা। দাড়িয়ে থাকা হিমেলকে দেখেও না দেখার ভান করে চলে যাচ্ছিলো কুমু। কিন্তু খুব বেশিদূর এগোতে পারলো না। তার আগেই ডাক পড়লো
–কুমুদিনী একটু দাড়াও। একটা কথা বলেই চলে যাবো।

এমন আকুল আবেদন নাকচ করে চলে যাবার ক্ষমতা কুমুর নেই। না চাইতেও থেমে গেলো পা। হিমেল সামনে এসে দাঁড়াতেই কুমু আবারও নিজের করা ভুলটার অনুশোচনায় জর্জরিত হয়ে উঠলো। বারবার একই প্রশ্ন মাথায় খেলছে কেনো দাড়াতে গেলো। কিন্তু কোন লাভ হলো না। নিজেকে ধাতস্থ করে বলল
–যা বলার তাড়াতাড়ি বলেন। আমার কাজ আছে। যেতে হবে।

হিমেল আবারও এমন ব্যবহারে বিস্মিত হলো না। সাভাবিক ভাবেই বলল
–কোন কারণে রাগ করেছো আমার উপরে? কারনটা জানালে বেশ উপকৃত হতাম।

কুমু তাকাল সুদর্শন পুরুষের চোখে। তীব্র অভিমান আর রাগে চোখে পানি টলমল করে উঠলো। কান্না গুলো কণ্ঠ নালিতে দলা পাকিয়ে সমস্ত শব্দগুলো আটকে দিল সেখানেই। সুদর্শন পুরুষটি ভীষন অসহায় কণ্ঠে বললো
–অভিমানের কারণটা জানতে পারি?

চমকে উঠলো কুমু। কোন ভয়ংকর চুরি ধরা পড়ার মতো অপরাধে ভেতরটা কেপে উঠলো। অভিমানটা ধরে ফেলেছে মানুষটা? তাহলে কি অনুভূতিটাও? শেষ গোপন অনুভূতিটুকু লুকিয়ে রাখার ব্যার্থ প্রচেষ্টা করতেই দ্রুত প্রস্থান করলো সেখান থেকে। কিন্তু পেছন থেকে ভেসে এলো ভয়ংকর অধিকার বোধ নিয়ে উচ্চারিত শব্দগুচ্ছ
–আমি কি তাহলে তোমাকে আমার উপরে অভিমান করার অধিকার দিয়ে দিলাম কুমুদিনী?

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here