বালির নীচে জলের শব্দ
পর্ব ২৮
কাক ডাকা ভোরে শিকদার বাড়ির সকল পুরুষ মানুষ বাইরে বেরিয়েছে। উদ্দেশ্য পরীকে খোঁ’জার। কাল রাত থেকে সে বাড়ি ফিরেনি। এই পর্যন্ত ঝুমকে এই নিয়ে অনেকবার প্রশ্ন করা হয়েছে। কিন্তু সে বারবার একই জবাব দিয়েছে। কিছুই জানে না। জবাবটা মিথ্যা না হলেও পুরোপুরি সত্য নয়। কারণ পরী যে কাল রাতে শামিমের সাথে দেখা করতে যাবে সেটা ঝুম জানত। আর এরকম সে প্রায়ই যায়। সময় মতো ফিরেও আসে। কিন্তু কাল রাতে এমন কি হয়েছে যে আর ফিরে এলো না। ঝুমের স’ন্দেহ গাড় হল। পরী শামিমের সাথে পা’লিয়ে যায়নি তো? কিন্তু পা’লাতে যাবে কেন? যদিও বা তাদের প্রেমের সম্পর্ক কেউ জানত না। তবুও শামিম যথেষ্ট ভালো ছেলে বলে পরিচিত গ্রামে। পরীর সাথে তার বিয়ের প্রস্তাব আসলে কেউ আপত্তি করার কথা না। কারণ তার বাবা মতি মেম্বার খুব সৎ মানুষ। নানা রকম উদ্ভট চিন্তা যখন মস্তিস্কে ঘুরপাক খাচ্ছে তখন সেগুলোকে হাওয়া দিতেই গ্রামের এক মহিলা এসে হাজির হল। রেহানার অশ্রুসিক্ত চোখ জোড়া দেখে বললেন
–কাইন্দনা। অল্প বয়সী মাইয়া। দেখো কোন পোলার সাথে প’লা’ইয়া গেছে গা। খুই’জ্জা আইনা বিয়া দিয়া দেও। মাইয়া মানুষ একটা ভু’ল কইরা ফা’লাইছে। এইসব ব্যাপারে মাই’য়াগো দো’ষ বেশী হয়। ক’ল’ঙ্ক শরিলে লাগলে আর মু’ছা যায়না। খোঁ’জ নিয়া দেখো। আমরা তো আর তোমাগো খা’রাপ চাইনা।
রেহানা কোন প্রতিউত্তর না করলেও নাজমা চুপ করে থাকতে পারলেন না। কঠিন গলায় জবাব দিলেন
–আমাগো বাড়ির মাই’য়ারা এমন নয় চাচি। আপনে এইসব কইবার আসলে এই’হান থেকে চইলা জান। আমাগো এহন এইসব শোনার মন মা’নসিকতা নাই। দেখতাছেন তো আমাগো অ’বস্থা।
নাজমার এমন জবাব শুনে মহিলাটি মুখ বেকিয়ে ফেললেন। গ্রামে মুরুব্বীদের সাথে এমনভাবে কেউ কথা বলে না। যথেষ্ট সম্মান করা হয় তাদেরকে। আর নাজমার কাছে তো এমন আচরন কিছুতেই আশা করা যায়না। নাজমা তার আচরণের জন্য কোনভাবেই অনু’তপ্ত নয়। রেহানা নিঃশব্দে শরীর দুলিয়ে কাঁদছে। মুখে আচল চেপে ধরে আছে। অল্প সময় পরেই সে কান্না জড়িত কণ্ঠে বলল
–বুবু এতো বেলা হইয়া গেলো কোন খবর আইল না কেন? আমার মাইয়াডা কি ভা’লো আছে?
নাজমা স্থির দৃষ্টিতে তাকাল। রেহানার কথা শুনে তারও মনে ভ’য় তৈরি হল। এই গ্রামের ঘটনা কারো অজানা নয়। যু’বতি মেয়ে হারিয়ে যাওয়া মানেই খারাপ কিছু। ভ’য়ংক’র কিছু। তবুও সে সৃষ্টিকর্তার কাছে মনে প্রাণে প্রার্থনা করছে তাদের মেয়ে যেন স’হি সালামতে ফিরে আসে। নাজমার মাথায় আরও অনেক বিষয় ঘুরপাক খাচ্ছে। সহি সালামতে ফিরে আসলেই কি সব বি’পদ কেটে যাবে। যুবতি মেয়ে পুরো একটা রাত বাইরে কাটিয়ে আসবে। এরপর কি গ্রামের মানুষ তাকে মে’নে নেবে? বি’য়ে হবে তার? নানা রকম আ’শঙ্কায় যখন নাজমার বুক ভারী হয়ে আসলো ঠিক তখনই পরীর নিখো’জ সংবাদ তুলোর মতো ছড়িয়ে পড়লো সারা গ্রামে। আর হুড়হুড় করে গ্রামের মানুষ ভিড় করলো শিকদার বাড়িতে। কেউ শুভাকাঙ্ক্ষী হয়ে এলো কেউ বা আবার কথার ছলে খোটা দিতে এলো। নানা মানুষের নানা কথায় শিকদার বাড়ির পরিবেশ অ’তিস্ট হয়ে উঠেছে। মেয়ের চি’ন্তায় ভারী হয়ে আসা হৃদয়ে এসব কথার ভার আরও যেন পাহাড় সমান লাগছে রেহানার কাছে। ঠিক সেই সময় খবর এলো। পরীকে পাওয়া গেছে। কিন্তু এমন সুখের খবরটা যে অনা’কাঙ্ক্ষি’ত হতে পারে সেটা হয়তো কারো ধারনা ছিল না। বাবা মিরাজ শিকদারের কোলে চড়েই সেই ছোট্ট বেলার মতো বাড়িতে এলো পরী। পার্থক্য শুধু একটাই। তখন সে ছিল সদ্য জন্ম নেয়া ফুটফুটে পরীর মতো শিশু। আর বর্তমানে এক বী’ভ’ৎ’স লা’শ। বি’ব’স্ত্র, বি’দ’ঘুটে দেখতে। মিরাজ মেয়ের লা’শ’টা এনে বারান্দায় বিছান পাটির উপরে শুয়ে দিলেন একদম রেহানার সামনে। কয়েক মুহূর্ত থম’থমে, নিস্তব্ধ পরিবেশ। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো সেদিকে সবাই। এরপরেই শুরু হল গগন বি’দারি চিৎ’কার। শো’কে’র মা’ত’ম। রেহানা মূ’র্ছা গেলো। নাজমার নিজেরও হাত পা কাঁপছে এমন দৃশ্য দেখে। এমন দৃশ্য কখনো যে দেখতে হবে সেটা ধারনাতেও আসেনি। সে বারবার মনে প্রাণে চেয়েছে পরী ফিরে আসুক। ভালভাবে ফিরে আসুক। মাহিন লা’শে’র পাশেই বসে পড়লো। সে দেখতে চাইছে পরীকে ভালভাবে। বুকে ভে’ঙ্গে কা’ন্না আসছে তার। কিন্তু একজন ছেলে হয়ে চিৎ’কার করে কা’দার শক্তিটা বোধহয় নেই। ঝুমের মুখে কোন কথা নেই। হাত পা জমে আছে তার। চোখের পানিও যেন কৌতুক করছে তার সাথে। রফিক শিকদার ছোট ভাইকে সামলাতে শুরু করেছেন। এক পর্যায়ে তিনি একজনকে বললেন
–চেয়ারম্যান রে খবর দেও। এর শ্যাষ পর্য’ন্ত আমি যামুই। যারা এই কাম করছে তারা শা’স্তি পাইবই।
চেয়ারম্যান কে খবর দিতে গিয়ে জানা গেলো তিনি শহরে গেছেন। আসতে দেরি হবে। কিন্তু কেউ থেমে থাকলো না। চেয়ারম্যানের কানে খবর পৌঁছে দেয়ার ব্যাবস্থা করা হল। কয়েকজন চলে গেলো শহরে। সেলিমের কানে খবর পৌছা মাত্রই সে আর দেরি না করে পু’লি’শ নিয়ে চলে এসেছে। সেলিম হন্তদন্ত করে শিকদার বাড়িতে ঢুকেই দেখল পরিস্থিতি ভ’য়া’বহ। হওয়াটাই স্বাভাবিক। সে নিজেও শোনার পর থেকে বিশ্বাস করতে পারছে না। কালকেই পরীর সাথে তার কথা হয়েছে। আর রাতের মধ্যেই মেয়েটা খু’ন’ হয়ে গেলো? পরীর লা’শ দেখে সেলিমের আ’ত্মা কেঁপে উঠলো। বী’ভ’ৎস দৃশ্য। ইন্স’পে’ক্টর সেলিমকে উদ্দেশ্য করে বলল
–দেখে যতদূর মনে হচ্ছে এটা রে’প’ ‘কে’স। সিওর হওয়ার জন্য পো’স্ট’ ম’র্টে’ম করতে হবে। আপনাদের যদি অনুমতি থাকে তাহলে আমরা লা’শ শহরে নিয়ে যেতে পারি?
সেলিম চেয়ারম্যান হলেও পরিবারের অনুমতি ছাড়া এই সিদ্ধান্ত সে নিতে পারবে না। তাই এগিয়ে গিয়ে রফিক শিকদারকে বলল
–চাচা আপনার সাথে একটু জরুরী কথা ছিল।
রফিক সেলিমের সাথে ইন্স’পেক্ট’রের কাছে এলো। ইন্স’পেক্ট’র রফিককে সব বুঝিয়ে বললেন। তিনি কিছুটা সময় নিয়ে ভাবলেন। মিরাজের অবস্থা অনুযায়ী এই কথা তাকে কিভাবে বলবে। তবে যা করার সেটা দ্রুত করতে হবে। সে মনে প্রাণে চায় খু’নি’ ধ’রা পড়ুক। তাই মিরাজকে গিয়ে সবটা বললেন। মিরাজ প্রথমে রাজি হল না। ভাইয়ের হাত ধরে অসহায়ের মতো বলল
–ভাইজান ওরা আমার মেয়েরে নিয়ে কাঁ’টা ছে’ড়া করবো। আমি কেমনে মানে নেই। আমার মেয়েটা খুব ক’ষ্ট পাইবো যে।
কিন্তু রফিক কিছুতেই মিরাজের কথা মেনে নিতে পারলো না। তিনি এই আবেগে সায় দিয়ে কে’স’টা কিছুতেই ব’ন্ধ করে দিতে চান না। তাই অনেকটা সময় নিয়ে ভাইকে বোঝালেন। তার সাথে সেলিমও অংশ নিলো। সবার কথা শুনে মিরাজ নিজের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে ফেললো। কারণ সেও চায় তার মেয়ের এই প’রি’নতি যে করেছে সে শা’স্তি’ পাক। কিন্তু রেহানাকে কিভাবে বোঝাবে ব্যাপারটা। রফিক সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়ে বললেন
–ছোট বউরে সামলানোর ভার তোর ভাবীরে দিছি। হেয় সামলে নিবো। তুই চিন্তা করস না। আমি দেখতাছি।
কিছু জটি’লতা কাটিয়ে লা’শ’ শহরে নেয়ার ব্যাবস্থা করা হল। আর ইন্স’পেক্ট’র পরিবারের লোকজন আর যারা প্রথমে লা’শ দেখেছেন তাদের কিছু স্টে’টমে’ন্ট’ রেক’র্ড করে নিলেন। তাদের স্টে’ট’মেন্ট অনুযায়ী রাত থেকে যখন পরীকে খুঁ’জে পাওয়া যাচ্ছে না তখন ভোর হতেই মিরাজ আর রফিক আশে পাশের বাড়ির কয়জনকে নিয়ে বের হয়ে যায়। সব সম্ভাব্য জায়গায় খুঁ’জে বেড়ায় কিন্তু কোথাও পায়না। ঠিক সেই সময় তাদের কানে আসে। একজন মহিলা নাকি শাল বাগানে লা’শ’ দেখতে পায়। কম বয়’সী মেয়ের। বিবরণ শুনে সবার স’ন্দে’হ হয়। তবে প্রথমেই কেউ মানতে চায়না যে পরীর লা’শ’ পাওয়া যেতে পারে। এটা সবার কাছে অবি’শ্বাস্য ছিল। কিন্তু তবুও সেখানে যায় তারা। কিন্তু গিয়েই পরীর বি’ব’স্ত্র লা’শ’ দেখতে পেয়ে সবাই আঁ’তকে ওঠে।
পরীর লা’শ’ পু’লি’শের গাড়িতে তোলা হয়। শহরের উদ্দেশ্যে রওনা হয় পরী। রেহানা জ্ঞা’ন ফিরতেই আবার মূ’র্ছা যাচ্ছেন। মিরাজ বা’ক্রুদ্ধ হয়ে গেছেন। সেলিমের উপরে দায়িত্ব পড়েছে পরিবারের পক্ষ থেকে থা’না’য় কাউকে নিয়ে গিয়ে একটা কে’স’ ফা’ই’ল করার। সেলিম রফিককে নিয়ে শহরে যাবে। তার আগে চারিদিকে চোখ বুলিয়ে নিলো কারো খোঁজে। কিন্তু খুঁজে না পেয়ে মাটির দো তলার দিকে তাকাল। মাঝের ঘরের দরজাটা বন্ধ। সবাই নিজ নিজ শো’কে’ ব্যস্ত। তাই সকলের চোখের আড়াল হয়ে চলে গেলো দো তলায়। মাঝের ঘরটার সামনে দাঁড়িয়ে একটা শ্বাস ছেড়ে মৃদু আওয়াজ করে ডাকল
–ঝুম।
দরজা খুলে গেলো। সেলিম স’স্তির নিশ্বাস ফেললো। আশে পাশে ভালো করে দেখে নিলো কেউ দেখছে কিনা। কেউ দেখেছে না নিশ্চিত হতেই দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকে পড়লো। দরজাটা ভিড়ে দিয়ে এগিয়ে গেলো। জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আছে ঝুম। থেমে থেমে তার শরীর কেঁ’পে উঠছে। সেলিম বুঝল সে নিঃশব্দে কাঁ’দছে। এগিয়ে গিয়ে পেছনে দাঁড়িয়ে আদুরে কণ্ঠে বলল
–ভে’ঙ্গে পড়লে চলবে না ঝুম। এখন শ’ক্ত থাকতে হবে। সব ঠিক হয়ে যাবে।
ঝুম ঘুরে তাকাল সেলিমের দিকে। তার চেহারা দেখেই সেলিমের বুকের ভেতরটা কেমন চি’ন’চিন করে উঠলো। এলোমেলো চুল। চোখ গুলো লা’ল টকটকে। হতাশ শ্বা’স ছেড়ে ছোট্ট করে বলল
–নিজের খেয়াল রাখো। আমি শহরে যাচ্ছি। তাড়াতাড়ি আসবো।
–আমারে একলা রাইখা পরী কেন চইলা গেলো? এহন আমি কার লগে কথা কমু?
খুব ক’ষ্ট করে কথাটা বলেই কান্নায় ভে’ঙ্গে পড়লো ঝুম। সেলিম দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ঝুমকে এমন অবস্থায় দেখে তার খুব খা’রাপ লাগছে। বুকের ভেতরে চি’নচি’নে ব্যা’থা শুরু হল। নি’ষি’দ্ধ ইচ্ছা জেগে উঠলো। সেটাকে প্রশ্রয় দিয়েই নিঃ’সং’কোচে বুকে টেনে নিলো ঝুমকে। ঝুমও আবেগের ব’শ’বর্তী হয়ে দুই হাতে খা’মচে ধরল সেলিমের শার্ট। এখন তার হি’তাহি’ত জ্ঞা’ন নেই। অন্য সময় হলে সেলিমের এই আচরণে সে বি’ব্র’ত হতো। কিন্তু এখন সেসব বোঝার মতো অবস্থায় ম’স্তিস্ক নেই। সেলিম মাথায় হাত বুলিয়ে বলল
–শান্ত হও ঝুম। কথা দিচ্ছি যারা পরীর এমন অ’ব’স্থা করছে তাদের সবার শা’স্তি’র ব্যাবস্থা করবো। কেউ ছাড় পাবে না।
সেলিমের কথা কানে যেতেই ঝুমের মস্তিস্ক সচল হল। আবেগি ঝুম কঠিন হয় উঠলো। আলগা হয়ে গেলো হাতের বাধন। এক ঝটকায় সেলিমের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে তার চোখে দৃষ্টি স্থপন করলো। হিং’স্র’ রুপ নিয়ে বলে উঠলো
–কেডা এমন করছে আমি জানি।
চলবে…
(রিচেক করা হয়নি। ভুল থাকলে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। পেজের রিচ কম। দয়া করে একটু গঠন মূলক কমেন্ট করে রেসপন্স করার চেষ্টা করবেন।)