বালির নীচে জলের শব্দ
পর্ব ২৯
নিস্তব্ধ ঘরটাতে ছোট রকমের একটা বিস্ফোরণ ঘটাল ঝুমের কথাটা। সেলিম অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো কয়েক সেকেন্ড। তারপর শান্ত কণ্ঠে বলল
–তোমার মানসিক অবস্থা ঠিক নাই ঝুম। রেস্ট নাও। আমি আসছি। শহর থেকে এসে আরেকবার দেখা করে যাবো।
সেলিম ঝুমের কথাটা এক বিন্দুও বিশ্বাস করেনি সেটা তার কথায় স্পষ্ট। ঝুম রেগে গেলো। কিছুটা গলা তুলে বলল
–আমার কথা আপনের বিশ্বাস হয়না? আমার কি মাথা খারাপ আছে যে আপনের লগে মজা করুম। আমি সত্যই জানি কেডা এমন করছে। আমি আরও অনেক কিছু জানি যা আর কেউ জানে না।
সেলিম স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো ঝুমের দিকে। বুঝতে চেষ্টা করলো সত্যি বলছে নাকি মন গড়া কোন কথা। কিছুক্ষন তাকিয়ে ঝুমের অভিব্যক্তি ঠিকঠাক ধরতে পারলো না। একটা শ্বাস ছেড়ে শান্ত কণ্ঠে বলল
–কি জানো তুমি?
ঝুম সেলিমের চোখে নিজের কঠিন দৃষ্টি স্থির করলো। নিস্পলক তাকিয়ে বলল
–মেম্বারের পোলা শামিমের লগে পরীর প্রেম আছিলো। রাইতে বড় দীঘির পাড় দুজন চুপ করে দেখা করবার জাইত। কাইল রাইতেও গেছিলো।
সেলিম বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকাল। বিচলিত হয়ে বলল
–শামিমের সাথে কাল রাতে পরী দেখা করতে গেছিল? তুমি জানতে?
–আমারে কইয়া গেছিল। আমি অনেক রাত পর্যন্ত দরজা খুইলা রাখছিলাম। সময় মতো হেয় আইয়া পড়ে। তাই দরজা খুইলাই ঘুমাইয়া গেছিলাম। মাঝরাতে ঘুম থেইকা উইঠা দেখি তহন পরী আসেনি। আমার খুব চিন্তা হইল। আমি গোটা বাড়ি খুইজ্জা পাইনি। তহনি আম্মারে কইছি। আম্মায় সবাইরে জানাইছে।
থেমে গিয়ে মাথাটা নিচু করে ফেললো সে। মনের মাঝে অপরাধ বোধ নিয়ে বলল
–আমি একটা মিছা কথা কইছি। কইছি ঘুম যাওয়ার আগে পরী আছিল। আমি ঘুমাইয়া যাওয়ার পর কি হইছে কইতে পারি না। সবাই হেইটাই বিশ্বাস করছে। তাই আমারে কিছু কয়নি।
সেলিম কথা গুলো শান্তভাবে শুনল। কিন্তু কোনভাবেই বিশ্বাস করতে পারছে না। শামিমের মতো ছেলেকে অবিশ্বাস করার মতো কোন কারণ নেই। ছোট বেলা থেকে একই সাথে খেলাধুলা করেছে গ্রামের মাঠে। বয়সের ব্যাবধান তাদের অল্প। শামিমকে ভালো মতো চেনে সেলিম। তার মতো ছেলে এমন কাজ করতে পারেই না। অসম্ভব! সেলিম পরীকে জিজ্ঞেস করলো
–কতদিন ধরে তাদের সম্পর্ক?
–১ বছর।
সেলিমের কপালে গাড় ভাঁজ পড়ে গেলো। ১ বছরের সম্পর্কে তারা প্রায় রাতেই দেখা করে। তাহলে কাল রাতে এমন কি হয়েছিলো? ঝুমের কথার সাথে বাস্তবতার কোন মিল নেই। ঝুম কি সত্যি বলছে নাকি আবেগে সেটা কিছুতেই ধরতে পারছে না সেলিম। সে এই গ্রামের চেয়ারম্যান। একটা অল্প বয়সী মেয়ের কথার উপর ভিত্তি করে কোনভাবেই শামিম কে সন্দেহ করা চলে না। এটা অন্তত তাকে মানায় না। কারণ তার দায়িত্তের জায়গাটা যে অনেক বড়। অনেক কঠিন। একটা শ্বাস ছেড়ে সমস্ত এলোমেলো চিন্তা মাথা থেকে বের করে দিলো। আপাতত কে’সটা ফাইল করা মুখ্য বিষয়। পরিস্থিতি শান্ত হলে নাহয় এসব নিয়ে ভাবা যাবে। আর তাছাড়া পু’লি’শ তো দায়িত্ব নিয়েছেই। তারাই খুঁজে বের করবে আসল অ’প’রাধী। তার এখন এসব ভেবে সময় নষ্ট করার কোন ইচ্ছা নাই। সে তার ভাবনা গুলো ঝুমকে বুঝতে দিলো না। ঠোঁট গোল করে একটা শ্বাস ছেড়ে বলল
–এই কথা আর কে জানে?
ঝুম ছলছল চোখে তাকাল। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল
–আমি ছাড়া আর কেউ জানে না। আমি কাউরে কইনি।
সেলিম সস্তির নিশ্বাস ফেলে বলল
–আমি না বলা পর্যন্ত কাউকে বলবে না কেমন? আমাকে যেতে হবে। নিজের খেয়াল রেখো। একদম চিন্তা করবে না। আমি ফিরে এসে দেখা করবো।
————
চেয়ারম্যান বাড়ি গ্রামের সবথেকে পুরাতন বাড়ি। উত্তরাধিকার সুত্রে প্রাপ্ত এই চেয়ারম্যান পদের কারণেই লোক মুখে এই নাম প্রচলিত। ধীরে ধীরে এই নামেই সবাই বাড়িটাকে চেনে। বিশাল বাড়ির এক পাশে কাচারি ঘর। যেখানে চেয়ারম্যান তার যাবতীয় কাজকর্ম করেন। আর মূল বাড়ির ভেতরে থাকে পরিবারের সদস্যরা। বাড়ির পেছনের দিকটা অতিথিদের জন্য বরাদ্দ। বেশ কয়েকটা ঘর আছে সেদিকে। চেয়ারম্যানের কাছে শহর থেকে অনেক লোকের আনাগোনা চলেই। তাদের থাকার জন্যই ওদিকে ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাই মূল বাড়ি থেকে ঐ দিকটায় দেয়াল তুলে দিয়ে আলাদা করে দেয়া হয়েছে। অতিথিদের সেবায় সম্পূর্ণ আলাদা লোকজন আছে। তারাও মূল বাড়ির ভেতরে আসে না। ওদিকে শুধু সেলিম থাকে। তার নিরিবিলি পছন্দ বলেই ওদিকটায় থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শহরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে সেলিম। শার্ট টা গায়ে জড়িয়ে বোতাম লাগানোর জন্য আয়নার দিকে তাকাল। শেষ বোতামটা লাগাতেই চোখে পড়লো দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা রমণীর দিকে। আয়না থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে এবার সরাসরি তার দিকে তাকাল। রমণীটি চোখ নামিয়ে নিলো। সেলিম স্বাভাবিক ভাবে বলল
–কোন সমস্যা?
রমণীটি মিনমিনে কণ্ঠে বলল
–আপনি শহরে যাচ্ছেন। আমাকে নিয়ে যাবেন? আমার কিছু দরকার ছিল।
সেলিম কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকলো। দায় সারা ভাবে বলল
–সাথে নিয়ে যেতে পারবো না। আমার অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে। তবে ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। সমস্যা হবে না।
রমণীটি মাথা নেড়ে চলে গেলো। সেলিম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বের হয়ে চলে গেলো নিজের গন্তব্যে।
————
রাত প্রায় ৩ টা বাজে। শান্তি নীড়ের দো তলায় এখনো আলো জ্বলছে। দক্ষিনের জানালার পাশে বসে ল্যাপটপে জরুরী কাজ করছে রুশা। বিছানাটা এমন ভাবে পাতানো জানালাটা একদম মাঝ বরাবর পড়ে। বাইরে ভরা জ্যোৎস্না। আকাশটা বেশ পরিষ্কার। ফুরফুরে হাওয়া। পুরো বিছানায় চিপস আর কোক ছড়ানো। ভ্রু জোড়ায় গভীর ভাঁজ তার। হাতের আঙ্গুল গুলো কি বোর্ডের উপরে উম্মাদের মতো চলছে। যেন থেমে গেলে অনর্থ হয়ে যাবে। এক পর্যায়ে কিছুটা বিরতি নিয়ে তপ্ত শ্বাস ছেড়ে চিপসের খোলা প্যাকেট থেকে কয়েকটা চিপস দুই আঙ্গুলে তুলে নিয়ে মুখে পূরে দিলো। কিছুক্ষন চিবিয়ে কোকের বোতলের ঢাকনা খুলে ঢেলে দিলো গলায়। বেশ অনেকটা পড়ে যাওয়ায় ঝাঁঝালো অনুভূতি হতেই চোখ বন্ধ করে গিলে ফেললো। ঠোঁট গোল করে একটা শ্বাস ছেড়ে ক্লান্ত চোখ জোড়া আবারো ল্যাপটপের উজ্জ্বল স্ক্রিনে নিবদ্ধ করলো। প্রচণ্ড ক্লান্ত সে। আবার কাল সকালে অফিসে যেতে হবে। ঘুমাতে যাওয়ার আগে সারাদিনের মেইল বক্সটা একবার চেক করা দরকার। মেইল বক্স ওপেন করতেই নতুন একটা মেইল চোখ পড়লো। সেটা ওপেন করে পুরো মেইলটা পড়েই সমস্ত ক্লান্তি দূর হয়ে গেলো। উড়ে গেলো ঘুম। স্থির দৃষ্টিতে সেদিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে ফোনটা নিয়ে একটা বিশেষ নাম্বারে ডায়াল করলো। অনেকক্ষণ রিং হওয়ার পর ওপাশে ফোনটা রিসিভ হতেই ব্যস্ত কণ্ঠে বলল
–ঘুমিয়ে পড়েছ? ডিস্টার্ব করার জন্য রিয়েলি সরি। তবে একটা জরুরী কাজ আছে। একটু ছাদে আসনা। প্লিজ!
ওপাশ থেকে ঘুমু ঘুমু কণ্ঠস্বর বলে উঠলো
–এতো রাতে ছাদে কেন? কাল কথা বলি?
রুশা ব্যস্ত হয়ে পড়লো। অস্থির কণ্ঠে বলল
–না না। এখনই। প্লিজ। না করো না। অনেক জরুরী।
ফোনটা কেটে গেলো। রুশা হতাশ শ্বাস ছাড়ল। কোন উত্তর দিলো না। ছাদে আসবে কিনা কে জানে। টেনশন হলে রুশা দাঁত দিয়ে নক কাটে। এখনো তাই করতে শুরু করেছে। ঠিক ১০ মিনিট বাদে ফোন বেজে উঠলো তীব্র শব্দে। চমকে ফোনটা ধরতেই ওপাশ থেকে গম্ভীর আওয়াজ কানে এলো
–আমি ছাদে।
রুশা এক দৌড়ে চলে গেলো ছাদে। উত্তেজনায় দরজা বন্ধ করতে ভুলেই গেলো। ছাদে উঠেই হাপাতে হাপাতে এক পাশে বসার জায়গাটায় বসে পড়লো। বুক ভরে শ্বাস টেনে বলল
–ঘুমিয়ে পড়েছিলে?
হিমেল সরু চোখে তাকাল। কণ্ঠে কিছুটা কৌতুক মিশিয়ে বলল
–মোটেই না। অপেক্ষা করছিলাম। এই মাঝরাতে ছাদে এসে ভরা জ্যোৎস্নার আলোয় তোমার সাথে প্রেম করবো। কি রোম্যান্টিক ওয়েদার বলো।
রুশা নিজের কাজে একটু লজ্জা পেলো। সে বুঝতে পারলো হিমেল রাগ করেই বলছে এমন কথা। সে এই মুহূর্তে রুশার উপরে খুবই বিরক্ত। রুশা মুখটা ভার করে বলল
–সরি।
হিমেল বিরক্ত হয়ে বলল
–নাটক না করে কি বলতে ডেকেছ তাড়াতাড়ি বলো। আমার ঘুম পাচ্ছে।
রুশা মোবাইলটা হিমেলের সামনে দিয়ে বলল
–মেইলটা পড়ে দেখো।
হিমেল ফোনটা হাতে নিয়ে মেইলটা মনোযোগ দিয়ে পড়ছে। রুশা বলল
–অনামিকা হাওলাদার নামে একজন পাঠিয়েছে। বিষয়টা আমার কাছে অন্যরকম মনে হচ্ছে।
মেইলটা পড়ে হিমেল তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। বলল
–তোমার এসব উদ্ভট চিন্তা ভাবনা নিজের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখো। আমার মাথায় ঢোকানোর চেষ্টা করবে না ভুলেও। তোমার এসব উল্টা পাল্টা কাজে সাহায্য করা ছাড়াও আমার অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে। আমাকে একদম বিরক্ত করবে না বলে দিলাম।
রুশা অসহায়ের মতো হাত জোর করে বলল
–প্লিজ হিমেল। শেষবার। আর কখনো জেদ করবো না। তোমার সাহায্য ছাড়া আমি কোনভাবে৫ই পারবো না।
হিমেল না বলেও লাভ হল না। রুশার জেদের আগে কোনভাবেই টিকতে পারলো না। তাই অগত্যা রাজি হয়ে গেলো তার কথায়।
চলবে…
(এই পর্ব পর্যন্ত বিষয়গুলো একটু অগোছালো মনে হবে। পরের পর্ব থেকে বিষয় গুলা ক্লিয়ার হবে ধীরে ধীরে। রহস্যের খোলাসা হতে শুরু করবে। তখন সবটাই বুঝতে পারবেন।)