বালির নীচে জলের শব্দ
পর্ব ৩৪
সল্প পরিসরে কুমু আর হিমেলের বিয়েটা সম্পন্ন হয়ে গেলো। রুশা সেলিম আর সেখানে কর্মরত লোকজনের সহায়তায় খুব একটা কষ্ট হয়নি সব কিছু ঠিকঠাক করতে। এতো কিছুর মাঝে কুমু কোন কথা বলতে পারেনি। কারণ হিমেল তাকে কথা বলার সুযোগ দেয়নি। যখনি কোন কথা বলার চেষ্টা করেছে তখনই হিমেল স্পষ্ট করে বলেছে ‘ তোমার সব কথা শুনবো কিন্তু বিয়ের পর।’ তাই আর কথা বলা সম্ভব হয়নি। কাজী ডেকে শেষমেশ বিয়েটা ভালোভাবে দিতে পেরে সেলিমও এক প্রকার সস্তি অনুভব করছে। অনেকদিন হলো মেয়েটা তার বাড়িতে এসেছে। যখন এসেছিলো তখন বিদ্ধস্ত অবস্থায় ছিলো। সে অবস্থায় একটা মেয়েকে দেখে সবার মনে তার জন্য সহানুভূতি কাজ করবে ঠিকই কিন্তু তাকে এভাবে সম্মান দিয়ে নিজের জীবনের সাথে জড়িয়ে নেয়ার সাহস কেউ করবে না। হিমেল কে দেখে বারবার শ্রদ্ধায় তার মাথা নিচু হয়ে আসছে। এই দুঃসাহস হয়তো সেও করতে পারতো না। কিন্তু হিমেল সত্যিই অমায়িক একজন মানুষ। সে নিজের মনের সুপ্ত ভালোবাসাকে সবার উপরে অগ্রাধিকার দিয়েছে। সেই ভালোবাসাকে শ্রদ্ধা জানাতে যে কারো মাথা নত হয়ে যাবে তার সামনে। মেয়েটার কথা ভেবে এতদিন সেলিমের খারাপ লাগতো। কিন্তু আজ মনে কোন আক্ষেপ নেই। সে খুব খুশি। কুমু এখনো পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠেনি বলেই একটুতেই হাপিয়ে ওঠে। অনেকটা দুর্বলতা এখনো রয়েই গেছে। সকাল থেকে বিয়ের ব্যস্ততায় আজ আরো বেশি হাপিয়ে উঠেছে। তাই এখন রেস্ট নিচ্ছে। হিমেল তার ঘরে কুমুকে শুয়ে দিয়েছে। কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নিবে। বিকেল গড়াতেই সব কাজ শেষ করে দো তোলার বারান্দায় সবাই হাফ ছেড়ে বসলো। রুশার কিছু কাজ থাকায় সে নিজের ঘরে চলে গেছে। হিমেল আর সেলিম বসে গল্প করছে। কথা বলার এক পর্যায়ে হিমেল জিজ্ঞেস করলো
— কুমুর সাথে যে ইনসিডেন্ট হয়েছিলো সেটা নিয়ে কতদূর এগিয়েছেন সেলিম সাহেব?
সেলিম হতাশ শ্বাস ছাড়লো। আকাশের দিকে উদাসীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল
— এখনো তেমন প্রগ্রেস নেই। তবে আমি এটা বুঝে গেছি যে কুমুর সাথে যে বা যারা এমনটা করেছে তারাই পরীকে খু’ন করেছে। তাই একটা সুরাহা হলেই ওদের হদিশ পাওয়া যাবে। পু’লি’শ বিষয়টা নিয়ে এখনো তদন্ত করছে। এখনো তেমন কোন ক্লু পেয়েছে বলে মনে হয়না।
হিমেল হতাশ হলো সাথে বিরক্ত। কিছুটা কাঠিন্য বজায় রেখে বলল
— আমার কেনো জানি মনে হচ্ছে পু’লি’শ ঠিক ভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করছে না। যদি করতো তাহলে কখনোই এতো সময় লাগতো না। কারণ গ্রামটা অনেক ছোট। আর এখানকার প্রতিটা লোকের স্বভাব চরিত্র সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা করা যায়। সেক্ষেত্রে পু’লিশে’র জন্য এসব খুঁজে বের করা কঠিন কিছু নয়। একটা খু’ন হয়ে গেলো অথচ পু’লি’শ এখনো কোন ক্লু পেলো না এটা আমি মানতে পারছি না।
সেলিম মাথাটা নিচু করে ফেললো। নত কণ্ঠেই বলল
— আপনার ধারণাটা ঠিক। দায়িত্ব গ্রহণ করা আমার বেশিদিন হয়নি। এর আগে আমি বাইরেই থেকেছি। তাই গ্রাম সম্পর্কে এতো বিস্তারিত ধারণা আমার নেই। তবে দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে এটা বুঝতে পেরেছি যে সাধারণ মানুষ বিষয়টা যতটা সহজ ভাবে ততটা সহজ নয়। ভেতরে অনেক কিছুই আছে যা অজানা। হয়তো গ্রামের মানুষের কাছে জানা। কিন্তু আমার কাছে অজানা। ভয়েই হয়তো কেউ মুখ খুলে না। আর একটা খু’নে’র ব্যাপার কিন্তু নয় হিমেল সাহেব। এর আগেও এমন ভাবেই অনেক খু’ন হয়েছে। এই গ্রামে কোন কিশোরী মেয়ে হা’রি’য়ে গেলেই বাবা মা তার আশা ছেড়ে দেয়। হয় সে ফিরে আসবে না আর আসলেও তাকে স’মা’জে গ্রহণ করার মতো কোন অবস্থা থাকবে না।
হিমেল ভ্রু কুঁচকে ফেললো। কিছুটা অবাক হয়েই বলল
— যারা বেচেঁ থাকে তারা তো সব কিছুই জানে। তারাই তো পু’লিশ’কে সাহায্য করতে পারে। তাহলেই তো সহজ হয়ে যায়।
সেলিম হেসে উঠলো। বলল
— বিষয়টা দুঃখজনক হলেও সত্যি যারা বে’চেঁ ফিরে তাদের হ’দিশ আজ অব্দি পাওয়া যায়নি। কেনো পাওয়া যায়নি সেটা নিয়ে পরিবারের সাথে কথা বলেও লাভ হয়নি। তারা কিছু জানে না বলেই বিষয়টাকে বাড়তে দেয়না। আর সরাসরি এভাবে না বললে আর কি বলার থাকে সেখানে।
— স্ট্রেঞ্জ!
ভীষন অবাক হয়ে বলল হিমেল। এমন আচরনের কারণটা ঠিক কি হতে পারে। এরকম পরিস্থিতিতে বাবা মায়ের মেয়ের পাশে দাঁড়ানো কর্তব্য। কিন্তু সবাই এভাবে এড়িয়ে যায় কেনো হিমেল কিছুতেই বুঝতে পারলো না। অনেক ভেবে বলল
— তাহলে কি এসবের পেছনে গ্রামের প্রভা’ব’শালী কোন পরিবার….
কথাটা শেষ করার আগেই সেলিমের ফোন বেজে উঠলো। সে পকেট থেকে ফোন বের করে স্ক্রিনে নাম্বার টা দেখে নিয়ে হিমেলের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল
— হিমেল সাহেব পু’লিশ’কে ম্যানেজ করা সহজ ব্যাপার না। সে থেকেই বোঝা যায় আপনার ধারণা কতোটা যুক্তিযুক্ত।
সেলিমের আর ফোনটা ধরা হলো না। তার কথার রেশ ধরেই হিমেল বলল
— তাহলে তো খুঁজে বের করা খুব কঠিন কিছু নয়।
সেলিম ফোনটা পুনরায় পকেটে রেখে বলল
— কিন্তু আমার জন্য বেশ কঠিন।
হিমেল কিছুটা সময় নিয়ে ভাবলো। মুচকি হেসে বললো
— আমার জন্য তো নয়। আমি তো চাইলেই বের করতে পারি। আপনার একটু হেল্প দরকার। তাহলেই খুব একটা কঠিন হবে না বিষয়টা।
সেলিম হিমেলের আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠের উপরে ভরসা করে উঠতে পারলো না। সন্দিহান কণ্ঠে বলল
— কিন্তু ঠিক কি করবেন আপনি?
হিমেল কিছু বলার আগেই আবারও ফোন বেজে উঠলো সেলিমের। ব্যস্ত হয়ে ফোনটা ধরার আগে বলল
— আমাকে যেতে হবে হিমেল সাহেব। আপনারা রেস্ট নেন। রাতে দেখা হচ্ছে। একসাথে রাতের খাবার খাবো।
হিমেল মুচকি হেসে বিদায় জানালো। সেলিম উঠে চলে গেলো নিজের কাজে। হিমেল লম্বা একটা শ্বাস ছেড়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে সিগারেট জ্বালালো। সেটা অর্ধেক শেষ না হতেই ফোন বেজে উঠলো। হাতে নিতেই ঠোঁটে ফুটে উঠলো মুচকি হাসি। ফোনটা ধরতেই ওপাশ থেকে ভেসে উঠলো শ্রাবণের গুরুগম্ভীর চেহারা। সে মনোযোগ দিয়ে ক্যামেরার এপাশে থাকা হিমেলের দিকে তাকিয়ে আছে। হিমেল এর হাস্যোজ্জ্বল চেহারা দেখেই বলল
— ভাইয়া তোমার কোন খবর নাই কেনো? কোথায় আছো?
হিমেল হেসে উঠে বলল
— যেখানে থাকার কথা ছিল সেখানেই আছি।
হিমেল কে এভাবে হাসতে দেখে শ্রাবণ অবাক হয়ে গেলো। কিছুটা বিরক্ত হয়েই বললো
— এভাবে হাসছো কে…
কথাটা শেষ করতে পারলো না। তার আগেই চোখ পড়লো হিমেলের পেছনে দাড়িয়ে থাকা রমণীর উপরে। প্রথম দেখায় চিনতে পারলো না শ্রাবণ। সেই মেয়েটা যে রুশা নয় সেটা অন্তত বুঝেই সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকাল। মেয়েটি এলোমেলো পা ফেলে এগিয়ে একদম হিমেলের পেছনে দাড়াতেই প্রতিচ্ছবি টা স্পষ্ট হয়ে গেলো। শ্রাবণ চোখ বড়ো করে চেয়ে অস্পষ্ট আওয়াজে বলল
— কুমু।
হিমেল শুনতে পেলো। পেছন ঘুরে দেখলো সদ্য ঘুম থেকে জেগে ওঠা কুমু অনেক কষ্টে চোখ মেলে তাকিয়ে আছে। ঘুম জড়ানো এমন চেহারা দেখেই হিমেল হেসে ফেলে বলল
— ঘুম হলো?
কুমু উপর নীচে মাথা নাড়িয়ে উত্তর দিলো। হিমেল পাশের চেয়ারটা এগিয়ে দিয়ে বলল
— বসো এখানে।
কুমু বসতে চেয়েও ফোনের দিকে সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকাল। হিমেল তার দৃষ্টির অর্থ বুঝেই বলল
— শ্রাবণ। কথা বলবে?
কুমু চেয়ারে বসে ফোনের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকাল। অনেকদিন পর শ্রাবণকে দেখে হেসে উঠে বলল
— কেমন আছেন শ্রাবণ ভাইয়া?
শ্রাবণ নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। অনেকটা সময় হা করে তাকিয়ে থেকে বলল
— তুমি কি সত্যিই কুমু?
কুমু হিমেল দুজনেই হেসে ফেললো। হাসি থামিয়ে কুমু বলল
— আমি সত্যিই কুমু। বিশ্বাস হয়না।
শ্রাবণ এবার কৃত্রিম রাগ করে বলল
— এই মেয়ে এতদিন তুমি কোথায় ছিলে? তোমাকে খুঁজতে খুঁজতে আমরা সবাই হয়রান। আর আমার ভাই তো তোমার খোঁজ না পেয়ে মরার মতো সারাদিন ঘরে পড়ে থাকে। কি একটা অবস্থা। চারিদিকে শুধু হাহাকার আর কষ্ট। ভাই আর বউকে সামলাতে আমার বারোটা বেজে যায়।
শ্রাবণের কথা বলার ভঙ্গি দেখে কুমু হেসে ফেললো। শ্রাবণ বিরক্ত হয়ে বলল
— তুমি এতদিন কোথায় ছিলে? হুট করেই আবার কোথা থেকে আসলে? ভাইয়া কোথায় পেলো তোমাকে? এবার হারিয়ে যাবে না তো? এবার হারালে কিন্তু..
হিমেল শ্রাবণকে থামিয়ে দিয়ে বলল
— এতো প্রশ্ন একবারে করলে কোনটারই উত্তর পাবিনা। শুধু শুনে রাখ আর হারাবার কোন চান্স নেই। একবারেই পেয়ে গেছি কুমুকে।
শ্রাবণ কথার অর্থ ধরতে পারলো না। বলল
— একবারেই মানে?
হিমেল হেসে উঠে বলল
— বিয়ে করে ফেলেছি। এখন আর চাইলেও হারাতে পারবে না।
ক্যামেরার ওপাশে নিশ্চুপ শ্রাবণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলো কয়েক সেকেন্ড। তারপর বলল
— বিয়ে করে ফেলেছো তুমি?
হিমেল মাথা নাড়তেই শ্রাবণ চিৎকার করে উঠে বসে গেলো। অস্থির হয়ে বলল
— কি বললে ভাইয়া? সত্যিই বিয়ে করেছো?
হিমেল ধমকে উঠে বলল
— চিৎকার করিস না একদম। এখনই কাউকে বলবি না। পরে আমি সব বুঝে বলবো।
শ্রাবণ চুপ তো হয়ে গেলো। কিন্তু হিমেল তার উপরে কিছুতেই ভরসা করতে পারছে না। তার পেটে একদম কথা থাকে না। সে কাউকে না বললেও সৌরভ কে অন্তত বলবেই। সৌরভ কে বললে তেমন সমস্যা নেই। তাই আর কথা বাড়ালো না। আরো কিছুক্ষণ চলল কথাবার্তা। এর মাঝেই রুশা কোথা থেকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে বলল
— হিমেল ঝুম সু’ইসা’ইড এটে’ম্পট’ করেছে।
চলবে….