বালির নীচে জলের শব্দ
পর্ব ৩৬
পরের দিন সকাল থেকেই চেয়ারম্যানের নির্দেশে মেম্বারকে সাথে নিয়ে রুশা আর হিমেল গ্রামের মোটামুটি প্রভা’বশা’লীর প্রতিটা বাড়িতে যায়। পরিবারের সব সদস্যের ডি’টে’ইল নিতে। কিন্তু কোন যুক্তিযুক্ত কারণ ছাড়া কেউই এভাবে নিজেদের প্রয়োজনীয় ত’থ্য আর ছ’বি দিতে রাজি হয়নি। মেম্বার শেষে মিথ্যের আশ্রয় নিয়ে সবাইকে রাজি করায়। বলে গ্রামের উন্নয়নের লক্ষ্যে শহর থেকে এ’ন জি ও’র লোকজন এসেছে জ’রি’প করতে। আর উন্নয়নের কথা শুনেই কেউ আর দ্বিমত পোষণ করেনি। প্রায় সারাদিনের অক্লান্ত পরিশ্রমের পর কাজটা মোটামুটি শেষ করতে পেরে রুশা আর হিমেল খুব খুশি। তারা সন্ধ্যার দিকে ফিরে এলো চেয়ারম্যান বাড়িতে। ফিরে এসেই ফ্রেশ হয়েই চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বসে পড়লো সেই বারান্দায়। সেলিম ঝুম কে দেখতে গেছিলো। একটু আগেই ফিরে এসেছে। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে রুশা সেলিমকে জিজ্ঞেস করলো
— ঝুম এখন কেমন আছে?
সেলিম চায়ের কাপটা হাতে ধরে আছে। এখন অব্দি একটা চুমুকও দেয়নি। সামনের দিকে তার দৃষ্টি স্থির থাকলেও মস্তিষ্ক জুড়ে অন্য চিন্তার বিচরণ। রুশা বিষয়টা খেয়াল করলো। তাই প্রসঙ্গ পাল্টে বলল
— সেলিম সাহেব কোন সমস্যা?
সেলিম নড়েচড়ে বসল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল
— না না সমস্যা নেই। আপনি কিছু বলছিলেন?
রুশা অপেক্ষা না করে বলতে শুরু করল
— আমরা যথেষ্ট তথ্য সংগ্রহ করেছি। এখন কুমুকে দেখানো বাকি। সেটা দেখালেই কুমু নির্ধারণ করবে অ’প’রা’ধীকে।
কথাটা শুনেই সেলিম বেশ উৎফুল্ল হয়ে বলে উঠলো
— তাহলে কুমুকে ডাকেন। আমাদের হাতে খুব বেশি সময় নেই।
হিমেল এতক্ষণ চুপ করে ছিলো। সেলিমের কথা শুনে কুমুকে ডাকতে গেলো ভেতরে। ঘরের ভেতরে ঢুকেই দেখলো জানালায় মাথা ঠেকিয়ে কুমু কাদঁছে। হিমেল কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো। তারপর এগিয়ে গিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল
— কি হয়েছে তোমার? কাদছ কেনো?
কুমু চমকে উঠলো। ভীত চোখে তাকাল হিমেলের দিকে। শুকনো ঢোক গিলে বলল
— আপনি কখন এসেছেন?
হিমেল বুঝলো কুমু তার অতীতের কথা ভাবছিল এতক্ষণ। তার মনের ভ’য়’টা এখনো জীবন্ত। সেটা থেকে কিছুতেই সে বের হতে পারছে না। হিমেল এর উচিৎ এখন কুমুকে সময় দেয়া। তাকে আগলে রাখা। যাতে এই অতীতের কথাগুলো সে সহজে ভুলে যেতে পারে। কিন্তু ব্যস্ততার কারণে সেরকম ভাবে সময় দিতে পারছে না সে। নিজেকে হিমেলের ভীষন অসহায় লাগছে। কুমু চোখের পানি মুছে হিমেলের দিকে তাকিয়ে বলল
— কোন সমস্যা হয়েছে নাকি?
হিমেল আলতো করে কুমুর মাথাটা বুকে চেপে ধরে বলল
— কোন সমস্যা হয়নি। তুমি কাদছিলে কেনো?
কুমু কথা বলতে পারলো না। তার বুক ভেংগে কান্না আসছে। সে হিমেলকে দেখাতে চায়না। তাই নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে কান্না আটকাবার বৃথা চেষ্টা করলো। চোখের কোন বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে হিমেলের শার্টে লেগে গেলো। কুমু কাদঁছে বুঝতে পেরেই হিমেল বলল
— শেষবার কেঁদে নাও কুমু। আর তোমাকে কাদতে দেবো না।
কুমুর কান্না এবার বাঁধ মানলো না। ফুপিয়ে উঠলো সে। হিমেল বাধা দিলো না। মেয়েটার মনের অবস্থা ভালো না। ভেতরে ভেতরে সে ভীষন কষ্ট পাচ্ছে। সেই কষ্টটা চোখের পানির সাথে বের হয়ে যাওয়াই ভালো।
———–
নিরব দর্শকের মতো তাকিয়ে আছে সবাই। উৎসুক দৃষ্টি তাদের। রুশা একের পর এক ছবি দেখাচ্ছে কুমুকে। নিশ্চুপ কুমু সচেতন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কোথাও যেনো কোন কিছু বাদ না পড়ে। সব ছবি দেখেও কুমুর প্রতিক্রিয়ার কোন পরিবর্তন হলো না। সবাই হতাশ হলো। এই একটা উপায় ছিলো অ’প’রা’ধীকে ধরার। সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রম শেষে তারা এতদূর এসেছে। কিন্তু কোন লাভ তো হলো না। রুশা কিছুটা উত্তেজিত হয়ে বলল
— তুমি কাউকেই চিনতে পারলে না?
কুমু মাথা নাড়িয়ে উত্তর দিলো। মিনমিনে কণ্ঠে বললো
— এদের মধ্যে কেউ নয়।
রুশা হতাশ হয়ে বলল
— তুমি কি সিওর কুমু? তুমি দেখলে চিনতে পারবে তো?
কুমু জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলছে। উত্তেজিত হয়ে বলল
— আমি ভালো করে সবাইকে দেখেছি। আমার চিনতে ভুল হবে না। ওই চেহারা গুলো আমি কি করে ভুলে যাই।
বলতে বলতেই আবারও কেঁদে ফেললো সে। হিমেল মাথায় হাত দিয়ে সান্তনা দেয়ার চেষ্টা করে বলল
— কেঁদো না কুমু। সব ঠিক হয়ে যাবে।
কুমুর কথা শুনে সবাই হতাশায় ডুবে গেলো। শেষ একটা উপায় ছিলো। সেটাও কোন কাজে দিলো না। এখন কিভাবে সমাধান হবে। কোন কুল কিনারা পেলো না কেউ। সব থেকে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো গ্রামের মধ্যে কেউ যদি নাহয় তাহলে সেই ডা’কা’ত দল কোথায় থাকে। কুমুর ভাষ্যমতে তারা এই গ্রামের লোকজন। তাদের কথোপকথন থেকে এতটুকু ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছে সে। রুশা হতাশ একটা শ্বাস ছেড়ে বলল
— তুমি কি কোনভাবেই আর কোন ক্লু দিতে পারবে না কুমু? একটু মনে করবে আর কোন কিছু শুনতে পেয়েছো কিনা। যেকোন একটা ক্লু পেলেই আমরা এগিয়ে যেতে পারতাম।
কুমু নিজের মস্তিষ্কে চাপ প্রয়োগ করেও কোন লাভ হলো না। সে অল্প কয়েকটা কথা ছাড়া কিছুই বলতে পারছে না। সেসব পূর্বেও বলেছিলো। কিন্তু সেগুলো মিলিয়ে আসলে কোন গুরুত্বপূর্ণ কিছুই খুঁজে পাওয়া যায়নি। সবাই ভীষন চিন্তিত। এতদূর এসে হতাশ হয়ে ফিরে যেতে হবে ভাবতেই রুশার খারাপ লাগছে। পরিবেশটা থমথমে নিরব হয়ে গেলো। কেউ কোন কথা বলছে না। থেমে থেমে শুধু কুমু কেপে উঠছে। নিঃশব্দে কাদছে সে। হিমেল নিরব দর্শকের মতো কুমুর চোখের পানির দিকে তাকিয়ে আছে। তার ভেতরটা কষ্টে ফেটে যাচ্ছে কিন্তু দাতে দাত চেপে সহ্য করছে। সে কুমুকে থামাতে চায়না। কারণ কাদলে কিছুটা হালকা হবে সে। নয়তো ভেতরে ভেতরে এভাবে কষ্ট পেতে থাকলে মানসিক ভাবে বি’ধ্ব’স্ত হয়ে পড়বে। এই নিরব শীতল সান্ধ্য পরিবেশে একটা খবর হুট করেই সব উত্তপ্ত করে দিলো। খবরটা শুনেই সবাই স্তব্ধ হয়ে বসে থাকলো কিছুক্ষণ। বিশেষ করে সেলিম কি করবে বুঝতে পারলো না। তার এক ভৃত্য এসে জানিয়ে দিলো মেম্বারের ছেলে শামীম মা’রা’ গেছে। নদীর ঘাটে তার হা’ত পা বাঁ’ধা লা’শ ভেসে উঠেছে। কেউ একজন সেটা দেখেই খবর পাঠায় চেয়ারম্যানের কাছে। সেলিম খবরটা শুনে কিছুক্ষণ চুপ করেই বসে থাকলো। মস্তিষ্ক খবরের সত্যতা খুঁজে পেতেই দৌড়ে চলে গেলো লা’শ দেখতে। সেলিম নদীর পাড়ে পৌঁছানোর আগেই পুরো গ্রাম হুড় হুড় করে সেখানে উপস্থিত হয়। মুহূর্তেই খবরটা ছড়িয়ে পড়ে সারা গ্রামে। ভীড় ঠেলে সেলিম লা’শে’র’ কাছে যাওয়ার পর দেখলো মেম্বার ছেলের ‘লা’শ জড়িয়ে ধরে কাদছে চিৎকার করে। ‘লা’শে’র অবস্থা বি’ভ’ৎ’স। হা’ত পা বাঁ’ধা। শরীরে কা’প’ড় ঠিক নেই। জায়গায় জায়গায় ক্ষ’ত’। সেলিমের পিছু পিছু হিমেল আর রুশাও এসে পড়েছে। রুশা এগিয়ে একদম লা’শে’র কাছে গিয়ে দাড়ালো। আলো জ্বালিয়ে খুব ভালোভাবে ‘লা’শ’টা পর্যবেক্ষণ করলো। উপস্থিত সবাই রুশার কর্মকাণ্ড দেখে অবাক হচ্ছে। যেখানে এই বি’ভ’ৎ’স লা’শে’র চেহারা দেখে পুরুষ মানুষের ভ’য়ে আ’ত্মা কে’পে উঠছে। সেখানে একটা মেয়ে মানুষ কিভাবে এসব স’হ্য করছে। রুশা অনেকটা সময় নিয়ে দেখে উঠে এলো সেলিমের কাছে। কিছুটা হতাশ হয়ে বলল
— মা’রা’র আগে নি’র্যা’ত’ন করা হয়েছে। চো’খ তু’লে ফে’লা হয়েছে। হা’তে’র র’গ কে’টে দিয়েছে। আ’ঙ্গু’ল গু’লোও গু’ড়ি’য়ে দিয়েছে। গ’র’ম শি’ক শ’রী’রে প্র’বে’শ করা’নো হয়েছে। নি’র্যা’ত’নে’র চূ’ড়া’ন্ত প’র্যা’য়ে যখন জ্ঞা’ন হারি’য়ে ফে’লেছে তখন গ’লা কে’টে জ’বা’ই করেছে।
সেলিম শুকনো ঢোক গিলে ফেললো। এর আগে মেয়েদের বি’ভ’ৎ’স লা’শ’ প্রায়শই দে’খা গেলেও কোন পুরুষের এম’ন লা’শ এই প্রথম। এরকম কেনো হচ্ছে? ভীড়ের মধ্যে থেকে কেউ একজন বলল
— চেয়ারম্যান সাব। এখন তো আমাগো ভ’য় লাগতাছে। এমনে ম’র’তে থাকলে আমাগো কি হইবে। কোনদিন না জানি আমা’গো লা’শ এমনে ভা’ই’সা ওঠে।
কথাটা শুনেই ভেতরটা কেপে উঠলো সেলিমের। এক অজানা ভ’য়ে’র আ’শং’কা। উত্তর দিতে পারলো না সে। এই মুহূর্তে তার ক’ন্ঠ’না’লী থেকে কোন আওয়াজ বের হচ্ছে না। এখন তার সত্যিই ভ’য় হচ্ছে। গ্রামের মানুষদের নিয়ে। নিজেকে নিয়ে। ধীরে ধীরে গ্রামের পরিবেশ ভ’য়ং’ক’র হয়ে পড়ছে। এ থেকে নিস্তার পাওয়া কি আদৌ সম্ভব? গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলো সেলিমের। হিমেল লা’শে’র দিকে তাকিয়ে হতাশ কণ্ঠে বললো
— আর কতো? এবারও কি প্র’শা’স’ন হস্তক্ষেপ করবে না? এবার আমার মনে হয় উপর থেকে প্র’শা’স’নে’র উপরে চাপ প্র’য়ো’গ করা উচিৎ। নাহলে অ’প’রা’ধী’রা আ’স্কা’রা পেয়ে যাবে। আর আরো জ’ঘ’ন্য কাজ করতেই থাকবে।
সেলিম একেবারেই বা’করু’দ্ধ। তার কথা বলার শক্তি সে হারিয়ে ফেলেছে। শামীমের এমন মৃ’ত্যু তাকে ভেতর থে’কে বি’দ্ধ’স্ত করে ফেলেছে। শামীম তার খুব কাছের একজন ছিলো। বয়সের অল্প ব্যবধান তাদের মাঝে। তাই এটা মানতে সেলিমের খুব কষ্ট হচ্ছে। মেম্বার ছেলের লা’শ আ’ক’ড়ে ধরে কেঁ’দে’ই যাচ্ছে। পুরো গ্রামের বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। কেউ একজন বলল লা’শ’ টা নদীর পাড় থেকে গ্রামের ভেতরে নিয়ে যাওয়া দরকার। সবাই সায় দিতেই কয়েকজন শামীমের নি’থ’র দে’হ’টা তুলে নিলো। আর দুইজন মেম্বারকে ধ’রে নি’য়ে এলো। ধীরে ধীরে তারা গ্রামের ভেতরে একদম চেয়ারম্যান বাড়ির সামনে এসে দাড়ালো। কুমু তখন ঘরে শুয়েছিল। সেও লা’শে’র কথা শুনে কিছুটা ঘা’ব’ড়ে গেছে। বাতাসে হা’হা’কা’র ভে’সে কানে আসতেই বিছানা ছাড়লো সে। জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। পর্দাটা হালকা সরিয়ে তার আড়ালে দাড়িয়ে উকিঝুকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করলো। প্রথমেই চোখ পড়লো হিমেলের উপরে। তাকে দেখেই কিছুটা সস্তি পেলো। কিন্তু পরক্ষণেই তার পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা এক ব্যক্তির উপরে চোখ পড়তেই আ’ত’কে উঠলো কুমু। উত্তেজিত হয়ে গেলো স্না’য়ুত’ন্ত্র। মস্তিষ্ক অতিরিক্ত উত্তেজনার ভার বহন করতে না পেরে শরীরের সাথে সং’যো’গ বি’চ্ছি’ন্ন করলো। চোখের সামনে ঝাপসা হয়ে আসতেই লু’টি’য়ে পড়লো সে।
চলবে…..