বালির নীচে জলের শব্দ
পর্ব ৩৭
‘ এই মাইয়ারে ছা’ইড়া দিলে আমাগো বিপদ। হেরে মা’ইরা দে।’
‘ নাহ!’
চিৎকার করে উঠলো কুমু। সাথে সাথেই হিমেল বুকে জড়িয়ে ধরে অস্থির কণ্ঠে বললো
— কি হয়েছে কুমু? ভয় পেয়েছো?
হিমেল এর কথা গুলো কানে বাজলেও মস্তিষ্ক সেগুলোকে ধরতে পারলো না। তাই সময় মত উত্তরটাও দিতে পারলো না। সচল হতে বেশ কিছুটা সময় নিলো মস্তিষ্ক। ঘেমে নেয়ে একাকার অবস্থা। জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলছে সে। হিমেল মাথায় হাত বুলিয়ে বলল
— তুমি ঠিক আছো?
কুমু কিছুটা নড়েচড়ে উঠলো। হিমেল মুখটা আলতো করে তুলে বলল
— কি হয়েছিলো? তুমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলে কেনো?
কুমু সচেতন দৃষ্টিতে হিমেলের দিকে তাকাল। অল্প কিছু সময়ের ব্যবধানে মনে পড়ে গেলো সেই কথা। জানালা দিয়ে সেই ব্যাক্তির চেহারা দেখার পরেই সে তার দুর্বল স্নায়ুর উপরে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। আর জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যায়। আবারও চোখের সামনে সেই বি’ভ’ৎস দৃশ্য ভেসে উঠতেই হাপাতে শুরু করে কুমু। কুমুকে এমন উত্তেজিত হতে দেখে হিমেল তাকে আগলে নেয়। মাথায় হাত রেখে অসহায় কণ্ঠে বলে
— ভয় পেওনা কুমু। সব ঠিক হয়ে যাবে। সময়ের সাথে প্রতিটা ক্ষ’ত নিরাময় হয়ে যায়।
কুমু শান্ত হলো না। বরং আরো অস্থির হয়ে উঠলো। হিমেল এবার কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়লো। এই মাঝরাতে কুমু যদি অসুস্থ হয়ে পড়ে তাহলে ডাক্তার কোথায় পাবে। আর গ্রামের ডাক্তারের উপরে তার বিন্দুমাত্র ভরসা নেই। এই সময় তো শহরেও নেয়া যাবে না। কুমুকে একা রেখে গিয়েছিলো বলেই সে বাইরে খুব একটা সময় নষ্ট করে নি। সেখান থেকে ফিরে এসে দেখে
কুমু মেঝেতে পড়ে আছে। প্রথমে একটু ভয় পেয়ে গেলেও পরে বুঝতে পারে দুর্বলতার জন্য এমনটা হয়েছে। তাই তাকে আর ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়নি। কুমু প্রচন্ড কেপে উঠে বলল
— আমি তাকে দেখেছি।
হিমেল প্রথমেই কথাটা ধরতে পারলো না। চুপ করে থাকলো। কুমু আবারও উত্তেজিত হয়ে বলল
— আমি ওই লোকটাকে দেখেছি।
এবার হিমেলের মস্তিষ্ক সজাগ হলো। কথাটা ধরতে পেরেও নিস্তেজ কণ্ঠে বললো
— কোন লোকটাকে দেখেছো?
— ওই যে ডা’কা’ত দ’লের স’র্দা’র।
হিমেল থমকে গেলো। কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলো
— কোথায় দেখেছো? কিভাবে দেখেছো?
কুমু বড়ো করে একটা নিশ্বাস ফেললো। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল
— বাইরে আওয়াজ শুনে আমি জানালায় দেখছিলাম। সেখান দিয়ে আপনাকে দেখতে পাই। আর আপনার পাশেই লোকটা ছিলো। ওই যে মাঝ বয়সী লোকটা। যিনি…
কুমু কথা শেষ করার আগেই দরজায় করাঘাত শোনা গেলো। প্রচন্ড ভ’য়ে হিমেলের বুকে মুখ লুকালো কুমু। হিমেল মাথায় হাত বুলিয়ে বলল
— ভয় পায়না। আমি দেখছি। তুমি এখানেই বসো।
হিমেল দরজা খুলতেই রুশা অস্থির হয়ে বলল
— কুমু কেমন আছে?
হিমেল কিছুটা অবাক হলো। এই সময় রুশাকে সে কোনভাবেই আশা করেনি। কিছুটা ভাবুক কণ্ঠে বললো
— ভালো আছে। তুমি এই সময়? কি হয়েছে?
রুশা সচেতন দৃষ্টিতে একবার কুমুর দিকে তাকাল। তার শারীরিক অবস্থার কথা বিবেচনা করে পরের কথাটা তার সামনে বলা ঠিক হবে কিনা সেটা নিয়ে একটা দ্বিধা চলছে মস্তিষ্কে। হিমেল হয়তো বুঝতে পারলো। তাই এক পলক কুমুকে দেখে নিয়ে বলল
— বাইরে চলো।
রুশা দরজা থেকে সরে দাঁড়ালো। হিমেল বাইরে এসে দরজাটা একটু ভিড়িয়ে দিতেই রুশা একদম নামানো গলায় বলল
— ঝুমের বাবাকে পু’লি’শ নিয়ে গেছে। উনি নাকি শামীমের খু’নী।
হিমেল এর কপালে গাঢ় ভাঁজ পড়ল। ঘটনা কোথা থেকে কোথায় রূপ নিচ্ছে। ধীরে ধীরে পুরোটাই জটিল হয়ে পড়ছে। এর আসলে শেষ কোথায়। ঝুমের বাবার মতো মানুষ এমন নৃ’শং’স ভাবে কাউকে মা’র’তে পারে সেটাই বিশ্বাস হচ্ছে না। হিমেল চোখ বন্ধ করে একটা নিশ্বাস ফেলে বলল
— এটা কি কোন অথেনটিক নিউজ? আসলেই কি প্র’মা’ণ হয়েছে? নাকি আন্দাজে বলছে?
— শামীমের হাতের ঘ’ড়ি’তে ওনার স্প’ষ্ট ছা’প পাওয়া গেছে।
রুশার কথা এবার হিমেলের গোছানো সমস্ত ভাবনা এলোমেলো করে দিলো। একদম অগোছালো ভাবেই বলল
— তাহলে তো এখানে আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। তাহলে কি উনিই সব খু’নে’র সাথে জ’ড়ি’ত? এমন যদি হয় তাহলে ওনাদের বাড়ির মেয়েকে কেনো মা’র’লে’ন? শুনেছি শামীমের সাথে পরীর সম্পর্ক ছিলো। শুধু কি এই কারণে?
রুশাও বিষয়টা নিয়ে গভীর ভাবে ভাবছিলো। হিমেল এর কথার যুক্তি আছে। আসলেই তারা নিজেদের বাড়ির মেয়েকে কেনো মা’র’তে যাবে। আর এই কথা কি পরীর বাড়ির অন্য সদস্যরা জানে? আর ঝুমের সু’ই’সা’ই’ড এর কারণটাই বা কি হতে পারে। সব কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে। হুট করেই হিমেলের কুমুর কথা মনে পড়ে গেলো। সে একটু আগেই বলছিলো লোকটাকে দেখেছে। তার পাশে দাড়িয়ে ছিলো। চোখ বন্ধ করে ফেললো। মস্তিষ্কে চাপ দিয়ে পুরো ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটানোর চেষ্টা করলো। তার পাশে কে দাড়িয়ে ছিলো? কিছুতেই মনে পড়ছে না। সেভাবে খেয়াল করেনি। সেটা কি ঝুমের বাবা? নাহ্! তার পাশে ঝুমের বাবা ছিলো না। তাহলে কে ছিলো? মস্তিষ্কে তীব্র চাপ পড়ায় মাথাটা চিনচিন করে ব্যাথা করে উঠলো। হিমেল চোখ খুলে ফেললো। মনে করতে না পেরে ভীষন বিরক্ত হলো। কিছুটা বিরক্ত হয়েই বললো
— এতো তাড়াতাড়ি আপডেট কিভাবে পেলো? ফ’রে’ন’সি’ক রি’পো’র্ট ছাড়া কিছুই বলা সম্ভব না। আর মাত্র সন্ধ্যা বেলায় লা’শ’ পাওয়া গেছে। এখনই কিভাবে ফি’ঙ্গা’র প্রি”ন্ট ম্যাচ হলো?
রুশা উত্তেজিত হয়ে বলল
— একদম তাই। আমারও এটাই মাথায় এসেছিলো। আমি সেলিম সাহেব কে ফোন দিয়েছিলাম। উনি ঘটনার সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত করলেন। ফ’রে’ন’সি’ক রি’পো’র্ট নাকি তৈরি হয়েছে।
হিমেল অবিশ্বাসের সুরে বলল
— কিসব বলছো? মানলাম রি’পো’র্ট তৈরি হয়েছে কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি ফি’ঙ্গা’র প্রি’ন্ট ম্যাচ করলো কিভাবে? গ্রামে তো লোক আর কম না। এই দেখো আমরাই তো কয়েকদিন ধরেই খুঁজে বেড়াচ্ছি। তবুও পাচ্ছি না। তাহলে ধরে নিতে হবে ওনারা আগে থেকেই জানতো খু’ন’ হবে। তাই সব রেডি করে রেখেছিল। বিষয়টা কি হাস্যকর না? তুমি কিভাবে এটা বিশ্বাস করছো?
রুশার ভাবনা এবার ঘোলাটে হলো। এতক্ষণ বিষয় গুলো মাথায় থাকলেও নিজেকে সান্তনা দিয়েছিলো। কিন্তু হিমেলের কথাগুলো তার ভাবনায় পানি ঢেলে দিল। সব ঘটনা ঘোলাটে হয়ে গেলো। দূর দূরান্ত পর্যন্ত কোন হদিস পেলো না। হিমেল কিছু একটা ভেবে বলল
— সেলিম সাহেব কোথায়? ওনার সাথে একটু কথা বলা দরকার।
— উনি একটু পরেই আসবেন। ওদিকে কি যেনো কাজ করছেন।
হিমেল ভীষন চিন্তিত হয়ে পাশের চেয়ারে বসে পড়লো। তার চোখের সমস্ত ঘুম ছুটে গেছে। এখন র’হ’স্যে’র খোলাসা হওয়ার অপেক্ষা। অনেক্ষণ পর সেলিম আসলো। বি’দ্ধ’স্ত অবস্থায় এসেই বসে পড়লো চেয়ারে। মাথাটা দুই হাতে চেপে ধরে বলল
— রফিক কাকা এমন একটা কাজ করতে পারে কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না। উনি নি’র্দো’ষ। ওনাকে ফাঁ’সা’নো হয়েছে।
হিমেল কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল
— এতো দ্রুত ফ’রে’ন’সি’ক রি’পো’র্ট কিভাবে আসলো?
সেলিম মাথাটা চেপে ধরেই বলল
— মেম্বার চাচার দুর সম্পর্কের কোন এক আত্মীয় ও’সি। ওনার নি’র্দে’শে’ই সব হয়েছে। উনিই ফ’রে’ন’সি’ক বি’ভা’গে’র লোকজন নিয়ে আসেন আর দ্রুত এর সু’রা’হা করেন। কিন্তু রফিক কাকাকে কে ফা’সা’বে? তার মতো ভালো মানুষের সাথে কার এমন শ’ত্রু’তা থাকতে পারে?
হিমেল গভীর ভাবে ভাবলো। তার মাথাটাও যন্ত্রণা করছে। এখন আর কোনভাবেই এই দুশ্চিন্তা নেয়া সম্ভব না। তাই ক্লান্ত গলায় বলল
— আপনি অনেক ক্লান্ত। শুয়ে পড়ুন। কাল দেখা যাবে। অবশ্যই ভালো কিছু হবে।
সেলিম মাথা নাড়িয়ে চলে গেলো। রুশাও নিজের ঘরে চলে গেলো। হিমেল আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। ওই অদূরে জ্বলতে থাকা তারা দেখেই চোখ দুটোতে প্রশান্তি নেমে এলো। এখন কিছুটা ভালো লাগছে। ঘরের ভেতরে ঢুকেই কুমুর দিকে চোখ পড়লো। এলোমেলো হয়ে শুয়ে আছে বিছানায়। কাছে গিয়ে তাকিয়ে থাকলো। ঘন নিশ্বাস পড়ছে। মেয়েটা ঘুমিয়ে পড়েছে। পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। কপালে একটা চুমু দিয়ে নিজেও পাশে শোয়ার প্রস্তুতি নিলো। ঘরের আলো নিভিয়ে দেয়ার জন্য সুইচ বোর্ডের কাছে যেতেই মস্তিষ্ক জানান দিলো সেই মানুষটার প্রতিচ্ছবি। যাকে তার পাশেই দেখেছিল কুমু। হিমেল এর টনক নড়ল। তীব্র রা’গ আর ঘৃ’ণা’য় শরীর কেপে উঠলো। দাতে দাত চেপে বলল
— এটা কিভাবে মাথা থেকে বেরিয়ে গেলো? সবার চেহারা কুমুকে দেখানো হয়েছে। বাকি ছিল শুধু এই কা’ল’প্রি’ট!
চলবে….