#চুপকথারা_বিষন্ন
#জেরিন_আক্তার_নিপা
|পর্ব ৪|
আজ সকালে নীড়কে কেউ ডাকল না। না রমিজা আর না মতিন চাচা। পনে বারোটায় এমনিতেই ওর ঘুম ভেঙে গেল। মাথা ব্যথায় ছিড়ে যাচ্ছে। উঠে বসতে পারছে না। সাথে মাথাটা ভীষণ ভাড়ী ভাড়ী লাগছে। নীড় বেডে বসে দু’হাতে মাথা চেপে ধরে কতক্ষণ বসে রইল। বাড়ির সব আজ গেল কই? কেউ চা দিতে এলো না! মতিন চাচাও ডাকল না তাকে। আজব বাড়িঘর! সেখানে বাস করা আজব লোকজন।
-রমিজা! রমিজা আমার চা কই?’
নীড় নিজেই ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। রমিজাকে আশেপাশে দেখা যাচ্ছে না। মতিন চাচাকে যাও দেখা যাচ্ছে কিন্তু নীড়ের দিকে তাকাচ্ছেও না সে।
-চাচা। আমাকে এক কাপ চা দাও তো।’
মতিন চাচা নীড়ের কথা না শোনার মত করে অন্য কাজে চলে গেল। নীড় কপালে ভাঁজ ফেলে ভাবছে, চাচার আবার কী হয়েছে?
-কি গো, চা দিবে না?’
-অন্য কাউরে দিতে কও।’
-তুমি কি আমার উপর রেগে আছো?’
-না। তোমার উপর রাগ করা, অভিমান করা, তোমারে শাসন করা এমনকি তোমারে ভালোবাসার অধিকারও আমার নাই। আমি তো তোমার কেউ হই না। এই বাড়ির কাজের লোক আমি। অনেক বছর আগে তোমার মা’র সাথে আসছিলাম। তোমার মা তো চলে গেল কিন্তু আমার এহনও থাকা লাগতেছে। আমি কোথাও যাইতে পারি নাই। এখন মনে হয় চলে গেলেই বোধহয় ভালো হইত।’
নীড় হতভম্ব। চাচার মনে এত কষ্ট দিয়ে ফেলেছে সে! চাচা এই বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার কথা ভাবছে! যে মানুষটা ঊনত্রিশ বছর ধরে এই বাড়িতে আছে, কখনও যাওয়ার কথা ভাবেনি। আজ সে বলছে চলে গেলেই বোধহয় ভালো হতো!
নীড় মাথা নিচু করে ডাইনিং টেবিলে বসে আছে। কিছু বলার নেই তার। নিজের উপরই লজ্জিত সে।
সে সত্যিই একটা অপদার্থ। মতিন চাচা নীড়ের সামনে চায়ের কাপ রাখল। নীড় মাথা তুলে দেখল।
তার চোখে অসহায়ত্ব।
-তুমি এই বাড়ি থেকে যেও না। এটা তো তোমারও বাড়ি।’
-যাওয়ার ইচ্ছা থাকলেও উপায় নাই। আমার আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নাই। এই বাড়ি আর বাড়ির মানুষ গুলোর উপর এত মায়া বসে পড়ছে যে জায়গা থাকলেও যাইতে পারতাম না।’
মতিন চাচা নীড়ের পাশে বসল।
-এহন তো আর সকাল নাই। কী খাইবা?’
-যা আছে। আজ তোমার বড় সাহেব বাড়ি নেই?’
-না।’
-কাল তাহলে কেন ছিল?’
-দরকারে।’
-আহা খুলে বলো না। একটু একটু করে বলছো কেন?’
-সাহেব তোমার জন্য মেয়ে দেখতে গেছিল।’
নীড়ের কাশি উঠে গেল। কাশি থামিয়ে হাসতে লাগল সে।
-মেয়ে! আমার জন্য! কেন?’
-মেয়ে কেন দেখে? বিয়া করবা না তুমি?’
-আমি বিয়ে করব এই কথা তোমার বড় সাহেবকে কে বলেছে? তাও আবার তার পছন্দ করা মেয়েকে! আল্লাহ! হাসালে তোমরা।’
-এইটা হাসির কথা না। মেয়ে আমারও পছন্দ হইছে। সাহেব সত্যই তোমার বিয়ে ঠিক করছে।’
নীড় এবার হাসি থামিয়ে সিরিয়াস হলো। সোজা হয়ে বসে গম্ভীর মুখে বলল।
-সকাল সকাল ফাঁপর নিচ্ছ নাকি সত্যিই?’
মতিন চাচা উঠে গেল। যেটুকু বলে ফেলেছে সেটাই অনেক হয়ে গেছে। বাকিটা বড় সাহেব বললেই হবে। নীড়ের কপালের শিরা দপদপ করছে। তার রাগ উঠছে। কিন্তু রাগটা প্রকাশ করার মাধ্যম পাচ্ছে না। নাহিদ চৌধুরী কী চাইছে? হঠাৎ তার বিয়ে নিয়ে পড়েছে কেন? সে ভাবল কীভাবে নীড় তার পছন্দ করা মেয়েকে বউ করবে!
———–
ওই দিনের পর থেকে আশা কথাকে কোন কাজ করতে দিচ্ছে না। কথা কিছু করতে নিলেই ধমকে উঠছে।
-তোকে এসব করতে কে বলেছে? অনেক কাজ দেখাচ্ছিস! যা ঘরে যা। বিয়ের আগে আগুনের তাপে আসিস না। এমনিতেই তো চেহারার যে সুরত করে রেখেছিস। মানুষটা যে তোকে পছন্দ করেছে।
জীবনে মুখে একটা স্নো পাউডার লাগাস না।’
কথা মুখ মুচড়ে মনে মনে বলেছে,
-স্নো পাউডার কখনও এনে দিয়েছ তুমি? আগুনের তাপে যাস না! উমহু, তক নষ্ট হয়ে যাবে গেলে? চামড়া পুড়ে যাবে? তাহলে এত বছর যে রান্না করিয়েছ তার বেলা! হুহু।’
আশা কথাকে বিড়বিড় করতে দেখে ঝাঁঝালো গলায় বলল,
-এখনও দাঁড়িয়ে আছিস! এই তুই মনে মনে কী কথা বলিস।’
-কিছু না।’
কথা তবুও যাচ্ছে না। তার মনে একটা কথা খচখচ করছে। কীভাবে মা’কে বলবে ভাবছে। আশা কথার উপর বিরক্ত হচ্ছে। মেয়েটা আস্ত ত্যাঁদড়।
-কথা! কী চাস তুই? না, কী চাস তুই? আমি মরে যাই?’
-তুমি কেন মরবে?’
-তাহলে আমাকে রাগাচ্ছিস কেন?’
-একটা কথা…
-কী কথা? বলে এখান থেকে বিদায় হ। আমাকে আর জ্বালাস না।’
কথা আর কিছু ভাবল না। দু-হাত শক্ত করে মুঠো করে বলেই ফেলল,
-যার সাথে আমার বিয়ে হবে তাকে তুমি দেখেছ?’
আশা হাতের কাজ রেখে তীক্ষ্ণ চোখে কথাকে দেখছে। কিছুটা সময় যাওয়ার পর আশা ফের কাজে মন দিল। স্বাভাবিক গলায় বলল,
-হু।’
-সত্যি তুমি দেখেছ?’
-মিথ্যা বলব কেন তোর সাথে?’
কথা মেঝের দিকে তাকিয়ে পায়ের আঙুল দিয়ে মেঝেতে খুঁটতে খুঁটতে মিনমিনে গলায় বলল,
-মানুষটা দেখতে কেমন?’
আশা এই মেয়ের নির্লজ্জতা দেখে হতভম্ব হয়ে যাচ্ছে। ঠাস করে দুই গালে দু’টা চড় দিতে ইচ্ছে করছে। কোন মেয়ে মানুষ এতটা বেশরম হয়! আল্লাহ, আল্লাহ! জামাই কেমন সেটা জানার জন্য মরে যাচ্ছে। আশা নিজেকে সামলে নিল। এখন এই মেয়েকে আদর সোহাগ দিয়ে হাতে রাখতে হবে। কপাল নিয়ে এসেছে মেয়েটা। বিয়ের আগে মারধর গালাগালি করলে তারই ক্ষতি। মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেলল আশা।
-ভালো। বুড়া বেডা না। জোয়ান ছেলে। দেখতেও সুন্দর। উঁচা লম্বা। তোর সাথে ভালোই মানাবে।’
কথার মাথা আরও ঝুঁকে গেল। লজ্জা লাগছে তার। গাল যে লাল হয়ে গেছে তা বেশ বুঝতে পারছে।
-আরও কিছু জানার আছে?’
-উঁহু।’
-তাহলে যা এখান থেকে।’
কথা চলে গেলে আশা হাতে থাকা খুন্তিটা সজোরে শব্দ করে রাখল।
-বেশরম মেয়েছেলে! ভালো জামাই চায় তার! তোর বাপ কী রেখে গেছে রে? ভালো ছেলে টাকা দিয়ে কিনতে হয়। তোরে যে লোকে নিচ্ছে এটাই তো তোর মরা বাপের ভাগ্য। ছেলে বুড়ো হলেও আমার কিছু করার নাই।’
—————
নাহিদ চৌধুরী ছেলের মুখোমুখি দাঁড়ালেন। তার সিদ্ধান্ত সে জানিয়ে দিয়েছে। মেয়ে তার পছন্দ হয়েছে। এই মেয়েকেই সে ঘরের বউ করে আনবে।
কথাগুলো শুনে রাগে নীড় হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। চিৎকার চেঁচামেচি করছে সে।
-আমার জীবনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আপনি কে? আমি কাকে বিয়ে করব, কে আমার বউ হবে এটা ঠিক করার আপনি সে? আমি বিয়ে করব না। আপনার ইচ্ছে হলে আপনি করেন। বুড়ো বয়সে নাকি ছুঁকছুঁকানি বেশি থাকে। ঘরে যুবতী মা নিয়ে এলেও আমার কোন আপনি থাকবে না। আপনারও তো কিছু চাওয়া পাওয়া থাকতে পারে।’
নাহিদ চৌধুরী এতদিনেও যা করেননি আজ তা করে বসলেন। জীবনে এই প্রথম ছেলের গায়ে হাত তুলেছেন তিনি। চড় খেয়ে নীড় আরও ক্ষেপে গেল।
-আপনার ভণ্ডামি আমি সব বুঝি। আপনাকে আমার হাড়ে হাড়ে চেনা হয়ে গেছে।’
-আমার কথা না শুনলে এই বাড়িতে তোমার জায়গা হবে না।’
হাসতে লাগল নীড়। লাল লাল চোখে বাবাকে দেখছে সে। তার চাহনিতে তাচ্ছিল্য ঝড়ে পড়ছে।
-আমি জানি। জানি তো আমি। আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিলেই তো আপনার রাস্তা পরিষ্কার। তখন নিশ্চিন্তে আরেকটা বিয়ে করে ছেলেমেয়ে পয়দা করবেন। ওরাই তো তখন আপনার উত্তরাধিকারী হবে। আমি কে?’
হুংকার ছাড়লেন নাহিদ চৌধুরী। ছেলের অসভ্যতা দেখে সে রীতিমতো বাকরূদ্ধ।
-তুমি তোমার বাবার সাথে এভাবে কথা বলছো? পৃথিবীর কোন ছেলে তার বাবাকে এসব কথা বলে! এই শিক্ষা দিয়েছি তোমাকে! আমার কষ্টের এই প্রতিদান দিচ্ছ তুমি!’
হো হো করে হাসছে নীড়। তার চোখের কোণ বেয়ে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল।
-হাসালেন মিস্টার চৌধুরী। হাসলেন আপনি। সময়! কে কাকে কোনদিন সময় দিয়েছে মিস্টার চৌধুরী? আর শিক্ষার কথা বলছেন? আপনি! হা হা হা… প্রচুর হাসালেন। আপনি তো টাকা দিয়ে নিজের দায়িত্ব পালন করেছেন। ব্যস। তার বেশি কিছু না। শিক্ষা, সময়, ভালোবাসা এসব শব্দ অন্তত আপনার মুখে মানায় না।’
দূর থেকে দাঁড়িয়ে রমিজা, মতিন চাচা বাবা ছেলের যুদ্ধ দেখছে। রমিজা ফিসফিস করে বলল,
-চাচা মিয়া, ছোড স্যার এইরাম করে ক্যান? নিজের বাপেরে এত কষ্ট কেউ দেয়!’
মতিন চাচা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
-বাপই ছেলেরে পৃথিবীর সবচে বড় কষ্টটা দিছে। ছেলে সেটাই ফেরত দিচ্ছে। যেমন বাপ তার তেমন রক্ত। কেউ হার মানতে রাজি না।’
-বড় স্যার কী এমন কষ্ট দিছে নিজের ছেলেরে!’
-যে কষ্ট কোনোদিনও ভুলা যায় না। সাহেব যদি ছেলের খুশি দেখত তাইলে আজ এই সংসার ভরা থাকত। খুশির কোন অভাব থাকতো না। সাহেব বুঝলো না। কিসে ছেলের সুখ সেটা দেখল না সাহেব। সমাজের কথাই ভাবল।’
———————
সেদিন কথা কাটাকাটি করে বাড়ি ছাড়ার পর তিনদিন নীড় বাড়ি ফিরল না। কোথায় আছে সে তা-ও জানা গেল না। এদিকে বিয়ের দিন এগিয়ে আসছে। কাল বাদে পরশু বিয়ে। নাহিদ চৌধুরী টেনশনে দিন কাটাচ্ছেন। মেয়ের বাড়িতে হলুদের তত্ত্ব পাঠিয়ে দিয়েছেন তিনি। উনার মানুষজন নেই তাই ছেলে পক্ষের কেউ যাবে না। বিয়ের আয়োজন চলছে অথচ যার বিয়ে তারই খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। ছেলেটা এই জীবনে তাকে শান্তি দিল না।
-ম্যানেজার, কোন খোঁজ পেয়েছ?’
-জি না স্যার। তবে আমি চেষ্টা করছি।’
-চেষ্টা না। শুধু চেষ্টা করলে হবে না। যেভাবেই হোক ওকে খুঁজে পেতেই হবে।’
-আমি দেখছি স্যার।’
কল কেটে দিলেন তিনি। ব্লাড প্রেশার বেড়েছে। ডায়াবেটিসও কন্ট্রোলে নেই আজকাল। সকাল থেকে যথেষ্ট অসুস্থ বোধ করছেন তিনি। তারপরও বিছানায় যেতে ইচ্ছে করছে না। হঠাৎ হঠাৎ চোখের সামনে একঝাঁক কালো মেঘে ছেয়ে যাচ্ছে। নিজেকে বড্ড অসহায় লাগে। এতকিছু থেকেও কিছুই নেই তার। মানুষ তাকে সুখী ভাবে। কেউ যদি এটা বুঝত টাকা দিয়ে সুখ আসে না।
চলবে_
গ্রুপ—- মায়ামহল (নিপা’র গল্প)