#চুপকথারা_বিষন্ন
#জেরিন_আক্তার_নিপা
|পর্ব ১১|
অনুর চোখ কপালে উঠল। কথার মাথায় চাটি মেরে বলল,
-‘সেকি রে! তুই একা এসেছিস! কেন?’
কথা বিরক্তি নিয়ে অনুর দিকে দেখল। মুখ বাঁকিয়ে মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল,
-‘তুই গাধার মত প্রশ্ন করছিস কেন অনু। কেউ না এলে আমি তাকে জোর করে আনব নাকি?’
অনুকে চিন্তিত দেখাচ্ছে।
-উনি তোর সাথে আসেনি কেন? সত্যি করে বল তো, তোদের মধ্যে সব ঠিকঠাক আছে তো। নাকি প্রথম রাতেই গণ্ডগোল পাকিয়ে দিয়েছিস। নিশ্চয় উনার কথা শুনিস নি তুই। বরের সাথেও ত্যাঁড়ামি করেছিস। যেমনটা সবসময় করিস।’
কথা বলেই ফেলছিল, কাল তো লোকটা বাড়িতেই ছিল না। সকালে কোত্থেকে ফিরেছে। সেই প্রথমই একটু কথা হয়েছে ওদের। তাছাড়া আর কোন কথাই হয়নি। ঝগড়া হবে কী করে? বা সে মানুষটাকে রাগাবেই কী করে? উঁহু, এই কথা অনুকে বলা যাবে না। অনুর বিয়ের সময় সে অনুর মুখ থেকে শুনেছিল, বাসর রাতে অনুর বর ওকে স্বর্ণের আংটি দিয়েছে। ওর বর তো কিছুই দেয়নি।
কথা যে মনে মনে কিছু ভাবছে তা অনুর চোখ এড়ালো না।
-‘কথা সত্যি করে বল তো, লোকটা কি বিয়েতে রাজি ছিল না?’
-‘আমি কী করে জানব রাজি ছিল কি ছিল না।’
-‘তোদের মধ্যে সব ঠিক আছে তো? উনি তোকে ভালোবাসে? তোর যত্ন নেয়?’
কথার বিরক্তির সীমা রইল না। এই গাধী অনুটা এত প্রশ্ন করে কেন।
-‘একটা রাত আর বেশি অর্ধেকটা দিন মাত্র ওখানে ছিলাম। এই এতটুকু সময়ে মধ্যে কীভাবে বুঝব কে আমাকে ভালোবাসে, কে আমার কেয়ার করে।’
-‘কে! এই ‘কে’ র কথা আমি জানতে চেয়েছি? আমি নির্দিষ্ট করে তোর হাজবেন্ড এর কথা জানতে চাইছি।’
-‘জানি না।’
-‘কেন জানবি না? আজব কথা তো!’
কথা রাগ করে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল।
-‘গেলাম আমি। তোর সাথে দেখা করতে আসাই আমার ভুল। প্রশ্ন করে করে মাথা খারাপ করে দিচ্ছিস।’
-‘যাস না। এই কথা যাস না। দাঁড়া। আচ্ছা আর কিচ্ছু জিজ্ঞেস করব না। বোস তুই।’
কথা বসল না। অনু ওর হাত টেনে বসাল।
-‘রাগ করছিস কেন? অত বড় ঘরে বিয়ে হয়েছে তাই একটু ভয় পাচ্ছি। তুই যা পাগল! শ্বশুরবাড়ির লোকেদের মন বুঝে চলতে হয় রে। নইলে আমার মতন…
-‘জি না। আমার শ্বশুর অনেক ভালো। তোর শ্বশুরের মত বুইড়া খাটাশ না। এখন বল তোর পা কেমন আছে?’
-‘ভালোই ব্যথা কমেছে।’
-‘শ্বশুরবাড়ি কবে যাবি?’
-‘ও কাল নিতে আসবে। আরও আগেই আসত। তোর বিয়ের জন্য আমি মানা করেছি। আমাকে ছাড়া থাকতে পারে না। কয়দিনে অবস্থা খাবার হয়ে গেছে। কাল আসছে।’
কথা লক্ষ্য করল অনুর মুখটা কেমন পাকা টমেটোর মত লাল হয়ে গেছে। লজ্জা পেল নাকি? কিন্তু এই কথায় লজ্জা পাওয়ার কী আছে সে বুঝল না।
-‘কিরে তুই লাল হয়ে গেছিস কেন?’
-‘কিছু না৷ তুই বুঝবি না গাধী।’
-‘হ্যাঁ আমি তো গাধীই। তুই অনেক চালাক।’
-‘এই কথা, তোর উনাকে কী বলে ডাকিস? ওগো, হ্যাগো নাকি জান কলিজা। নাকি বাবু, সোনা!’
অনু হাসছে। কথা কপাল কুঁচকে মুখ বাঁকিয়ে বলল,
-‘খেয়ে কাজ নেই। অত বড় দামড়া বেডারে আমি বাবু ডাকব! আর আমি ওসব ডাকতে যাব কেন? আমি আপনি করেই বলি।’
-‘সেকি! স্বামীকে কেউ আপনি বলে! আপনি তো দূরের ডাক। তুমি করে বলতে পারিস না।’
-‘আপনি দূরের ডাক হলে তুমি মাঝামাঝি। তুই সবথেকে আপন। সেদিক দিয়ে স্বামীকে তুই ডাকতে হয়।’
-‘একটা দেব। স্বামীকে তুই ডাকলে পাপ হবে না!’
কথা ঠোঁট কামড়ে কতক্ষণ ভাবল।
-‘তুই তুমি ডাকিস?’
-‘শুধু তুমি! আমি তো এখন থেকেই ওকে বাবুর আব্বু ডাকি।’
-‘বাবুটা তো আগে হতে দিবি বোন।’
অনু খিলখিল করে হাসছে। কথা মুগ্ধ হয়ে অনুকে দেখছে। হাসিটা কী সুন্দর! অনু ওর জীবনে কত খুশি! মাশাআল্লাহ, গাধীটার খুশিতে কারো নজর না লাগুক। করুণাময় তুমি এই মেয়েটাকে সব সময় এরকমই হাসি খুশি রেখো।
————-
ফেরার পথে আলম ভাইয়ের ফার্মেসির সামনে দিয়ে আসার সময় আলম ভাই কথাকে ডেকে উঠল। তার গলাতে খুশি উপচে পড়ছে। চোখ মুখও ঝলমল করছে।
-কথা শুনে না। তোর ভাতিজা হয়েছে রে। আয়, আয় মিষ্টি খেয়ে যা।’
ইশ কথার খেয়ালই ছিল না। ভাবির ডেলিভারির ডেট এসে পড়েছিল।
-কখন হয়েছে আলম ভাই?’
-তোর বিয়ের দিনই। তোকে নিয়ে গেল না, তারপরই তোর ভাবির পেইন উঠল। আমি তো বুঝতেই পারিনি। ভেবেছি তোর বিদায়ে কাঁদছে। পরে দেখি সে তোর বিদায়ে কাঁদছে না, আমাদের কুটুসের আগমনে কাঁদছে।’
আলম ভাইয়ের মুখে কুটুস নামটা শুনে খিলখিল করে হেসে ফেলল কথা। মুখে আস্ত একটা জাম মিষ্টি পুরে দিয়ে বলল,
-নামটা তোমার মনে আছে?’
-থাকবে না কেন? তোর দেওয়া নাম। ছেলে পেটে আসার আগে থেকেই তুই আমাকে কুটুসের বাপ ডাকতি।’
কথা হাসতে হাসতেই বলছে,
-এখন কি কুটুস নামই রাখবে নাকি?’
-তুই বললে নাহয় এটাই থাকবে। তোর ভাবিরও আপত্তি নেই। কুটুস নামটা তো ভালোই। হেলদি নাম।’
কথা নাক সিটকে বলল,
-এ্যাহহ! লোকে আমাকে কুটুসের ফুপু বলবে! উঁহু। না,না। ভাবতেই কেমন লাগছে। তুমি আলম, ভাবি আঁখি। তোমাদের ছেলের নাম আয়ান,আজান, আহান একটা হলেই সুন্দর হবে।’
-আচ্ছা। ছেলে দেখতে যাবি তো। তখন নাম রেখে আসিস। তোর বর আসেনি রে?’
-না।’
-আসেনি!’
আলম ভাইও যে অনুর মত ব্যাপারটা সহজ ভাবে নিতে পারছে না তা কথা বেশ বুঝতে পারছে।
-অত বড় ঘরের ছেলের সাথে বিয়ে দিয়েছ। এটা জেনে দাও নি ওদের কত কাজ! কাজ ছাড়া এক দণ্ড সময় পায় না। বাপের একমাত্র ছেলে, ওকেই তো সব দেখতে হয়। শ্বশুর মশাইয়ের বয়স হয়েছে।’
কথা নিজেই অবাক হয়ে গেল। কত সুন্দর করে মিথ্যা কথা বলে ফেলল সে। আচ্ছা বিয়ের পর আশেপাশের মানুষগুলো এমন পাল্টে যায় কেন? তার বাবার বাড়িতে সে বর ছাড়া এসেছে বলে সবার কত প্রশ্ন। অথচ এতগুলো বছর সে এখানেই ছিল। তখন কারো কোন প্রশ্ন ছিল না।
—————
কথা বাড়ি ফেরার সাথে সাথে আশা ওকে বকাবকি করতে লাগল। কথা বুঝতে পারছে না এখন আবার সে কী করেছে।
-কী হয়েছে? বকছো কেন তুমি?’
-বকবো না! তোকে চুমু খাবো? এই সন্ধ্যা বেলায় পাড়া বেড়াতে গিয়েছিলি। ওইদিকে তোর শ্বশুরের ড্রাইভার এসে হাজির। ড্রাইভার যদি গিয়ে বিয়াইয়ের কানে লাগায় সন্ধ্যাবেলায় তার বাড়ির বউ পাড়া চক্কর দিতে বেরিয়েছে। তখন আমার মুখ কোথায় থাকবে?’
-আমার শ্বশুরের ড্রাইভার আবার কেন এলো?’
-কপাল নিয়ে এসেছিস দেখেই কদর নেই। আমার মত পোড়া কপাল হলে ঠিকই বুঝতি। তোর শ্বশুর তোর জন্য ড্রাইভারকে দিয়ে মোবাইল ফোন পাঠিয়েছে। তোর সাথে কথা বলবে।’
-তোমার ফোনে কল করলেই তো পারত। কথা বলার জন্য নতুন ফোন কিনে দেওয়ার কী মানে? আমি তো কাল ফিরেই যাব। তখন তো আর ফোনে কথা বলব না।’
আশা মেয়েটার গাধামি দেখে রীতিমতো অবাক। বিয়ের দ্বিতীয় দিনই শ্বশুর নিজে ছেলের বউকে মোবাইল কিনে দিয়েছে। কত ভাগ্য হলে এরকম শ্বশুর পাওয়া যায়। আর এই বেক্কল মেয়ে বলছে সে ফোন দিয়ে কী করবে।
-কই দেখি। দিয়েছেই যখন তখন কাজে লাগাই।’
কথা ফোনটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছে। দেখে তো বেশ দামী মনে হচ্ছে। সোহান ভাইও এরকম মোবাইল চালায় না। তার মানে অনেক দামী। ফোনটা চালু করাই। সিমও আছে দেখা যাচ্ছে। কথা তার শ্বশুরের ফোন নাম্বার জানতো না। সে চিন্তা দূর হলো যখন দেখল সবার নাম্বার সেভ করা। সে কল করতেই ওপাশ থেকে তুলে নিল।
-আসসালামু আলাইকুম বাবা। কেমন আছেন আপনি? আমি কাল চলে আসব। আমার মনে আছে আপনি চলে আসতে বলেছেন। আমার তো ফোন লাগবে না বাবা।’
নাহিদ চৌধুরী ফোনের এপাশে নিঃশব্দে হাসলেন। মেয়েটা এত সহজসরল কেন? একজন বলেছিল মেয়েটা খাটি সোনা। এখন তিনি বুঝতে পারছেন, সে একটু কমই বলেছে। তার বউমা খাটি হীরা।
-তোমার দরকার ভেবে দিয়েছি। রেখে দাও। এখন বলো কী করছিলে তুমি?’
-জানেন বাবা, আলম ভাইয়ের ছেলে হয়েছে। ওর না, ওর বউয়ের। এই প্রথম আমি ফুপু হয়েছি। ছেলেটা যে কী মিষ্টি দেখতে! আমাকে দেখেই কেমন মিটমিট করে হাসছিল। ও আমাকে চিনেছে, আমি ওর ফুপু। আমি ওর নাম দিয়েছি আলিফ। নামটা সুন্দর না? আমার বিয়ের দিনই ওর জন্মদিন।’
নাহিদ চৌধুরী মুগ্ধ হয়ে শুনছেন। মাঝে মাঝে তিনি ভাবেন নীড়ের সাথে বিয়ে দিয়ে মেয়েটার সাথে তিনি অন্যায় করে ফেলেননি তো? নীড় কখনও এই খাটি হীরার কদর বুঝবে না। নীড় ওকে না কষ্ট দিয়ে ফেলে। সেই চিন্তাই উনাকে কুঁড়ে খায়।
শ্বশুরের সাথে কথা বলার পর কথা নীড়ের নাম্বারটাও দেখল। নীড় লিখেই সেভ করা। কথা কী যেন ভাবল। তারপর কল দিয়েই ফেলল। মানুষটার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে। অনুর বলা কথাগুলো মনে হয়ে গেল কথার। নিজে নিজেই হেসে ফেলল সে। এখন যদি সে নীড়কে বাবুর আব্বু বলে ডাকে তাহলে কি সে রাগ করবে?
-দূর,দূর! বাবুর আব্বু! আপনিই ঠিক আছে।’
রিং হয়েই যাচ্ছে। কল তুলছে না কেউ। কয়েকবার চেষ্টা করার পর কথার মন খারাপ হয়ে গেল।
-মানুষটা এমন কেন? উনাকে বুঝতে পারি না আমি। সারাজীবন আমি যাকে না দেখে, না চিনে কল্পনায় নানা রঙে সাজিয়ে এসেছি। আজ মানুষটা আমার সামনে আসার পর উনাকে মোটেও চিনতে পারছি না। আমি কি তাহলে ভুল কাউকে চেয়েছি? অনুর বর ওকে নিতে আসবে। উনি আমার সাথে এলেনও না। কাল হয়তো নিতেও আসবে না। যে লোক বিয়ের প্রথম রাতেই বাড়িতে ফিরেনি, সে কি আমাকে ভালোবাসে?’
চলবে_