#চুপকথারা_বিষন্ন
#জেরিন_আক্তার_নিপা
|পর্ব ১৬|
সকালের চা-টা এখন নাহিদ চৌধুরী বৌমার হাতের বানানোই খান। মেয়েটা তার অভ্যাস বিগড়ে দিচ্ছে। এমন অনেক কিছুই আছে যা কথার হাতে না হলে তার মেজাজ খারাপ হয়। যেমন তিনি খাবার সময় কথা পাশে বসে রাজ্যের আলাপ করবে। নাহিদ চৌধুরী কথার ছেলেমানুষী কথাবার্তা উপভোগ করবেন। মুগ্ধ হয়ে এই বাঁচাল মেয়েটাকে দেখবেন। কথা যখন তাকে বাবা ডাকে তখন মনে হয় এই বাবা ডাকটা শোনার জন্য হলেও নীড়কে তিনি জোর করে এই সম্পর্কে বেঁধে রাখবেন। আজও কথা শ্বশুরকে সকালের চা দিতে এসেছে। নাহিদ চৌধুরী চায়ের কাপ হাতে নিয়ে ওকে বসতে বলল।
-ওই চেয়ারটায় বসো।’
কথা বসলো। ওড়নার কোণা হাতে পেঁচিয়ে নিজের মনে মনেই কিছু ভাবছে সে।
-তোমার কলেজ খোলা না?’
-খোলা।’
-যাচ্ছ না?’
কথা শ্বশুরের দিকে তাকাল। যাই না বললে যদি বকা দেয়। আবার সে যে শ্বশুর আব্বার অনুমতি ছাড়া কলেজে যাচ্ছে না এটা কীভাবে বলবে? দোটানায় পড়ে গেল কথা। ভয়ে ভয়ে বলল,
-না।’
-কেন?’
-আসলে বাবা,,, আমতা আমতা করছে কথা। নাহিদ চৌধুরী ওকে অভয় দিয়ে বলল,
-হ্যাঁ বলো।’
-আপনি তো বলেননি কবে থেকে যাব।’
নাহিদ চৌধুরী চায়ের কাপে ঠোঁট ছুঁইয়েছিলেন। বৌমার এমন কথা শুনে অন্যমনস্ক হয়ে ঠোঁটে গরম লেগে গেল। সামনের ছোট্ট টেবিলের উপর চাপটা রাখলেন তিনি৷ কথার দিকে পূর্ণ দৃষ্টি দিয়ে বললেন,
-আমার অনুমতির জন্য কলেজে যাচ্ছ না তুমি?’
মাথা নীচু করে ক্ষীণ গলায় জবাব দিল কথা।
-হু।’
নাহিদ চৌধুরী মানুষটা কঠিন গড়নের। অন্তত মানুষ তাকে এমনটাই মনে করেন। কিন্তু এই মেয়েটার জন্য প্রথম দিন থেকেই তার মনে কোমল একটা জায়গা তৈরি হয়েছে। ওর স্পষ্টভাষিতা, ওর নিষ্পাপ চেহারা, ছেলেমানুষি আচরণ সব মিলিয়ে মেয়েটিকে তার কাছে ছোট্ট বাচ্চাই মনে হয়।
-আজ থেকেই কলেজে যেও তুমি। আমি ড্রাইভারকে বলে দিব।’
খুশিতে আত্মহারা হয়ে বাবা দিকে তাকাল কথা। মুখে হাসি নিয়ে বলল,
-সত্যি!’
-হুম।’
-আপনি অনেক ভালো মানুষ বাবা। শ্বশুর সম্পর্কে আমার ধারণাই ভুল ছিল। অনুর শ্বশুরের কথা শুনতে শুনতে ভয়ে ছিলাম আমার শ্বশুরও যদি এমন হয়। কিন্তু না। আপনি অনেক ভালো মানুষ।’
নাহিদ চৌধুরী হাসলেন।
-শ্বশুর সম্পর্কে তোমার কেমন ধারণা ছিল?’
-বলব? শুনে রাগ করবেন না তো?’
-না। তুমি নিঃসংকোচে বলো।’
-শ্বশুররা অনেক রাগী হয়। বদমেজাজি হয়। বজ্জাত, বদ বুইড়া খাটাশ। আপনি কিন্তু বলেছেন রাগ করবেন না। অনুর শ্বশুর ওকে… বলতে বলতে থেমে গেল কথা। উঁহু, এই কথা বলা যাবে না। অনুর শ্বশুর ওকে বাজে ভাবে ছুঁতে চায়। অনু লোকটার আশেপাশে যেতে চায় না বলেই ওর সাথে সবার সামনে খারাপ ব্যবহার করে।
-কী বলো।’
-কিছু না। আপনি অনেক ভালো। আমার নিজের বাবা যেমন ভালো ছিল তার থেকেও ভালো। আপনার একটা মেয়ে থাকলে সে অনেক ভাগ্যবতী হতো।’
-তুমি আমার মেয়ে নও?’
-মেয়েই তো৷ ছেলের বউ তো মেয়ের মতই।’
—————-
কতগুলো দিন পর আজ কথা কলেজে এসেছে। ভীষণ মিস করেছে সবাইকে। তার যে বিয়ে হয়ে গেছে ইতোমধ্যে এটা অনেকেই জেনে গেছে। তার ক্লাসের হিংসুটে কয়েকটা মেয়ে তাকে অভিনন্দনও জানিয়েছে। কথাকে দেখে কেমন মিটমিট করে হাসছে। কথা ওদের থেকে ভালো স্টুডেন্ট। সেই কারণেই কথার সাথে ওদের সম্পর্ক ভালো না। ওরা হয়তো ভেবেছে বিয়ে হয়েছে এখন আর কথা পড়াশোনা করতে পারবে না। কিন্তু ওরা কি জানে তার শ্বশুর মানুষটা কেমন।
-কথা। কথা।’
ক্যান্টিনের দিকে যাচ্ছিল কথা। অনেকদিন ধরে ক্যান্টিনে বানানো সিঙ্গাড়া খায় না। এই সিঙ্গাড়ার স্বাদ পৃথিবীর কোথাও পাওয়া যাবে না। ক্যান্টিনের পাশ দিয়ে গেলেই সিঙ্গাড়ার ঘ্রাণে ক্ষিধে পেয়ে যায়। পেছন থেকে চেনা একজন মানুষের কন্ঠে নিজের নাম শুনেও দাঁড়াল না কথা৷ মানুষটার সাথে মরে গেলেও কথা বলবে না সে। ভীষণ রাগ করেছে। নুড়ি দৌড়ে এসে কথাকে ধরল।
-এই কথা, ডাকছি তোমাকে। দাঁড়ালে না কেন?’
-কে তুমি?’
নুরি প্রথমটা অবাক হলেও পরে হেসে ফেলল। এই ব্যাপার তাহলে! কথা তার উপর রেগে আছে।
-সরি গো তোমার বিয়েতে যেতে পারিনি। আমার যাওয়ার খুব ইচ্ছে ছিল। কিন্তু আমার বাড়ির পরিবেশ…
-আমি তোমাকে চিনি না। তুমি আমার সাথে কথা বলবে না।’
-রাগ করে না লক্ষী বোন। তুমি তো সবই জানো। আমাকে তুমি না বুঝলে আর কে বুঝবে বলো।’
নুড়ির কাতর অনুনয় শুনে কথা রাগ বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারল না।
-ক্যান্টিনে যাচ্ছিলে?’
-হু।’
-চলো। আজ তোমার থেকে ট্রিট নিব। শুনেছি শ্বশুরবাড়ি নাকি হেব্বি বড়লোক।’
ওরা দু’জন একসাথে হাঁটছে। কথা এখন স্বাভাবিক আচরণ করছে।
-তুমি বিয়েতে আসোনি আমি অনেক কষ্ট পেয়েছি। সোহান ভাই কথা দিয়েছিল তুমি আসবে।’
-আমার নিজেও ইচ্ছে ছিল। কিন্তু, তুমি কি এখন শ্বশুরবাড়ি থেকে এসেছ?’
-হ্যাঁ।’
-মানুষ কেমন ওরা?’
-খুব ভালো। বিশেষ করে আমার শ্বশুর মশাইয়ের মত লোক পৃথিবীর আর একটা নেই।’
-বাবাহ এত প্রশংসা! যাক ভালো হলেই ভালো। আর তোমার বর! সোহান পিক পাঠিয়েছিল। দেখতে তো মাশা-আল্লাহ।’
কোণার একটা টেবিলে বসল ওরা। কথা এসেই গরম গরম এক প্লেট সিঙ্গাড়ার অর্ডার দিয়ে ফেলেছে।’
-সোহান ভাইয়ের কী খবর?’
নুড়ি কিঞ্চিৎ ভ্রু কোঁচকালো। সোহানের খবর কথা তার কাছে জিজ্ঞেস করছে! কথা নিজেই তো সোহানের পার্সোনাল সেক্রেটারির ভূমিকা পালন করে। ওর সব খবর তাকে এনে দেয়। নুড়িকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে কথা লজ্জা পেল। অপরাধী মুখে বলল,
-শ্বশুরবাড়ি গিয়ে সোহান ভাইয়ের খবর রাখতে পারিনি।’
-ভীষণ ব্যস্ত বুঝি। হুম, একমাত্র বউ বলে কথা। অনেক দায়িত্ব। সোহান ভালোই আছে। তোমাকে মিস করে খুব।’
-আমিও করি। সোহান ভাইটা কেমন দেখেছ! একটা দিনও আমার শ্বশুরবাড়িতে আমাকে দেখতে আসেনি। ওর সাথেও আমি কথা বলব না।’
অভিমানে কথার গলা ধরে এসেছে। নুড়ি ওর কাঁধ নাড়িয়ে বলল,
-কেঁদে ফেলবে নাকি? আমার কাছে কিন্তু টিস্যু নেই।’
————–
আজ ভীষণ গরম পড়েছে। গরমে জান বেরিয়ে যাচ্ছে। কথা কলেজ গেট থেকে বের হয়েই রিকশা খুঁজতে লাগল। বারবার কপালের ঘাম মুছছে সে। এসেছিল তো শ্বশুরের বড় গাড়িতে। যাবার সময় গাড়ি নেই দেখে রিকশাই নিল। কথার অবশ্য গাড়ি থেকে রিকশাতে চড়াই ভালো লাগে। ওসব বড়লোকী কারবার তার জন্য না।
-এই রিকশা। মামা দাঁড়ান।’
-তুমি কথা?’
হঠাৎ করে পেছন থেকে অচেনা কোন পুরুষ কন্ঠ পেয়ে চকমে উঠল কথা। প্রায় লাফিয়ে ফিরে তাকাল।
-কে! কে আপনি?’
সৌভিক কথাকে ভালো করে দেখছে। তার যদি ভুল না হয় তাহলে এটাই কথা। নীড়ের বউ। কথা ভয় পেয়েছে দেখে সৌভিক হাসল।
-ভয় পাবেন না। আমি আপনার কোন ক্ষতি করব না।’
-হ্যাঁ, কিন্তু আপনি কে?’
-পরিচয় দিলেও আমাকে আপনি চিনবেন না।’
কথা হাঁটতে লাগল। পরিচয় দিলেও চিনবে না এমন মানুষের সাথে কথা বলারও কোন দরকার নেই। কে জানে কার মনে কী আছে! কোন উদেশ্যে এই লোক তার সাথে যেচে পড়ে কথা বলতে এসেছে। সৌভিক কথার পেছনে আসছে। কথা দ্রুত পা চালাচ্ছে।
-কথা, আমাকে তোমার ভয় পাওয়ার কোন কারণ নেই।’
আপনি থেকে সোজা তুমি! এই লোকের তো মতলব ভালো না। কথা তাকে চিনবে না আবার সে কথার নামও জানে! আশেপাশে দেখল কথা। রাস্তায় অনেক মানুষ। তেমন কিছু বুঝলে চোখ বন্ধ করে জোরে চেঁচালেই হবে। মানুষজন মেরে এর হাড্ডিগুস্ত আলাদা করে দিবে।
-আমরা কি কোথাও বসে কথা বলতে পারি না?’
-না। দেখুন আমি কিন্তু চেঁচাব। দয়া করে আপনি আমার পিছু ছেড়ে দিন।’
সৌভিক বুঝল এভাবে হবে না। পরিচয় দিতেই হবে।
-আমি তোমার বরের বন্ধু।’
কথা দাঁড়িয়ে সন্দেহের চোখে সৌভিককে দেখছে। বরের বন্ধু! তাহলে বিয়েতে এলো না কেন?
-বিশ্বাস হচ্ছে না! আমি আর নীড় এক সময় খুব ভালো বন্ধু ছিলাম।’
-ছিলেন? এখন নেই?’
-না।’
-কেন?’
-চলো কোথাও বসে কথা বলি।’
-না। আমি এখনও আপনাকে চিনি না। আপনার সাথে কোথাও বসব কেন?’
-বললাম তো আমি তোমার বরের বন্ধু। আর কী জানতে চাও বলো।’
-আপনাদের বন্ধুত্ব নেই কেন?’
-বলব। আমাকে তুমি বিশ্বাস করতে পারব।’
-আমি যাকে তাকে বিশ্বাস করি না।’
-তুমি ভীষণ স্পষ্টবাদী। তোমাকে দেখে আমার বোনের কথা মনে পড়ে গেল। সে-ও ঠিক তোমার মতই ছিল।’
-ছিল! এখন কোথায় সে?’
দীর্ঘশ্বাস চাপল সৌভিক। রাগটা ভেতরেই চেপে রাখল। মনে মনে বলল,
-তোমার কুলাঙ্গার বরের জন্যই সে আজ আমাদের চোখের সামনে নেই। নীড়কেও আমি শান্তিতে থাকতে দিব না৷ ওর সংসারে খুব দায়িত্ব নিয়ে ভালোবেসে আগুন লাগাব। যা কিছুই হয়ে যাক নীড় কখনও কারো সাথে সুখী হবে না এটা আমার নিজের কাছেই প্রতিজ্ঞা। তুমি মেয়েটা ভীষণ ভালো কথা। কিন্তু কী আর করা? তোমার ভাগ্যটা ওই কুলাঙ্গারের সাথে জুড়ে গেছে। তাই না চাইতেও ওর পাপের ফল তোমাকেও ভোগ করতে হবে। কথা দিচ্ছি তোমাকে খুব বেশি কষ্ট দিব না। শুধু তোমার মাধ্যমে তোমার বরটাকে শেষ করে দিব।’
কথা তীক্ষ্ণ চোখে লোকটার দিকে তাকিয়ে আছে। একটা প্রশ্ন করেছে। উত্তর দিতে ভুলে গেছে নাকি? মনে মনে কী অত ভাবছে? কথা ওর দিকে তাকিয়ে আছে দেখে সৌভিক গলা ঠিক করে নিয়ে বলল,
-আছে। দূরে কোথাও। কাছে নেই।’
-দূরে কোথায়?’
-তোমার বিয়েটা তো অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ, না?’
-হ্যাঁ।’
-বাড়িতে কে কে আছে?’
ওরা হাঁটতে হাঁটতে কিছুদূর এগিয়ে এলো। একটা খালি রিকশা দেখে কথা ওটাকে থামালো। সৌভিক কিছু বলতে বলতেই কথা রিকশায় উঠে পড়ল।
-আমার বাড়ি ফিরতে হবে। কলেজ ছুটি হয়েছে অনেকক্ষণ। উনাকে আপনার কথা বলব।’
সৌভিক বারণ করতো নীড়কে তার কথা না বলার জন্য। কিন্তু তার আগেই রিকশা ছেড়ে দিল।
-দিন গুনতে থাক নীড়। তোর খারাপ সময় এলো বলে। তুই যা যা করেছিস তার সবই সুদে আসলে ফেরত পাবি। তোর বউটা বড্ড বোকা৷ ওকে হাত করতে আমার বেশি সময় লাগবে না।’
কথা রিকশায় বসে ভাবতে লাগল,
-ইশ, লোকটার নামটাই তো জানা হয়নি। উনাকে কীভাবে বলব। চেহারার বর্ণনা দিলে চিনবে? এক সময় ওরা ভালো বন্ধু ছিল। তাহলে এখন নেই কেন?’
চলবে_
মায়ামহল (নিপা’র গল্প)