#চুপকথারা_বিষন্ন
#জেরিন_আক্তার_নিপা
|পর্ব ২৯|
নীড় কথার পেছনে হেঁটে আসছে। কথা নীড়ের থেকে কিছুটা এগিয়ে আছে। কথা বারবার পেছন ফিরে নীড়কে দেখছে। নীড়ের হাবভাব কথা কিছুই বুঝতে পারে না। এই বলল, আমাকে এক কোটি টাকা দিলেও এখন কোথাও যাব না। তার এক সেকেন্ড পরই আবার কথার সাথে বেরুতে রাজি হয়ে গেল। নীড়ের চলতে কষ্ট হচ্ছে। তার পেট ছয় মাসের গর্ভবতী মহিলাদের মত দেখা যাচ্ছে। কথার হাঁটার গতির সাথে কিছুতেই তাল মেলাতে পারছে না সে। আর হাঁটতে না পেরে নীড় দাঁড়িয়ে পড়ে কথাকে ডাকল।
-কথা। দাঁড়াও একটু।”
কথা দাঁড়াল। নীড়ের দিকে ফিরে কপাল কুঁচকে বলল,
-কী হলো দাঁড়িয়ে পড়লেন কেন?”
হাঁপাচ্ছে নীড়। বেচারা আজকের মত ভোগান্তি এই জীবনে ভুগেনি। শ্বশুরবাড়িতে এসে কাজের কাজ কিছুই হলো না৷ মাঝখান থেকে সে নির্যাতিত হলো। শাশুড়ি মা মেয়ের জামাইয়ের প্রতি একটু বেশিই ভালোবাসা দেখিয়ে ফেলেছেন। যার ফল এখন তার ভোগ করতে হচ্ছে।
-আর কতদূর হাঁটতে হবে?”
-এটুকু এসেই এই কথা! আরও সাত/আট মিনিট হাঁটতে হবে।”
নীড়ের মনে হলো এই সাত/আট মিনিটেই ওর প্রাণবায়ু বেরিয়ে যাবে।
-আপনাকে বলেছিলাম ঘরে শুয়ে আরাম করুন। আপনি আমার কথা শুনলেন না। আসবেন না বলেও এলেন কেন?”
নীড় কীভাবে বোঝাবে কথার মুখে অন্য কারো নাম শুনে কীভাবে ঘরে শুয়ে থাকতো ও? আলম ভাইয়ের কাছে কথাকে একা ছেড়ে দিবে! প্রশ্নই আসে না। সোহানের মত সবাই যে কথাকে নিজের বোন ভাববে এমনটা তো না-ও হতে পারে।
কথা নীড়ের মুখের দিকে তাকিয়ে কী বুঝল কে জানে। নীড়ের জন্য মায়া হলো ওর। ফিরে এসে নীড়ের সামনে দাঁড়াল।
-আপনি কি একেবারেই হাঁটতে পারবেন না? আচ্ছা কী আর করার, চলুন ফিরে যাই। বলিহারি আপনিও আজব মানুষ। শাশুড়িকে খুশি করতে নিজের উপর অত্যাচার করতে হবে!”
-তুমি না বলেছিলে কোন ভাইয়ের বাড়িতে যাবে।”
-আজ আর না। আপনাকে রেখে কাল যাব একবার।”
নীড় মনে মনে বলল, আমাকে রেখে! আমাকে রেখে কেন? আমি সাথে গেলে তোমার সমস্যা কী? নাকি তোমার ওই ভাই আমাকে দেখে খুশি হবে না।
নীড় জেদি গলায় বলল,
-না। এতটা পথ এসেছি যখন তখন আজই যাওয়া যাক।”
-হাঁটতে পারবেন আপনি।”
-অবশ্যই।”
কথা বিরক্ত হলো। নীড় জেদি এটা সে-ও জানে। কিন্তু কারণে অকারণে জেদ কেন করতে হবে এটাই কথার বুঝে আসে না।
-চলুন তাহলে।”
কথা এবার নীড়কে ফেলে একা একা এগিয়ে যাচ্ছে না। নীড়ের পাশাপাশি হাঁটছে ও। হাঁটতে হাঁটতে নীড় কথার একটা ধরল। কথা অবাক হয়ে ওর দিকে তাকালেও কিছু বলল না। নীড়ের হাত ধরে হাঁটতে তার অস্বস্তি হচ্ছে না। বরং ভালোই লাগছে।
আলম ভাই বাড়িতেই ছিল। কথাকে দেখে উল্লাসিত গলায় বলে উঠল,
-আরে কে এসেছে এটা! আমাদের কথা রাণী নাকি? হায় কাণ্ড! কথা রাণী এই গরিবের বাড়িতে তার রাজাকেও নিয়ে এসেছে!”
আলম ভাইদের কথায় লজ্জা পেয়ে কথার কান গরম হলো। রাজা! নীড় ওর রাজা!
-কী এসব রাজা রাণী নিয়ে পড়লে কুটুসের বাপ!”
নীড় প্রথমে বুঝতেই পারল না এই মানুষটাই কথার সেই আলম ভাই। নীড় ভেবেছিল আলম ভাইও হয়তো সেহানের মত কোন যুবক হবে। কিন্তু লোকটার তো বয়স আছে মনে হয়। নীড় অনুমানেই বুঝতে পারছে এই লোক বিয়ে করে ফেলেছে। ছেলেপুলেও আছে হয়তো। তার পরেও নিশ্চিত হওয়ার জন্য সে কথার কানে কানে জিজ্ঞেস করল,
-ইনিই কি তোমার আলম ভাই?”
-আপনি আলম ভাইকে চিনেন!”
-না।”
আলম ভাই ব্যস্ত হয়ে স্ত্রীকে ডাকতে লাগলেন।
-কই গো দেখো কারা এসেছে! তুমি দেখে খুশি হয়ে যাবে। আমাকে শুধু বলতে না কথা কি ওর বরটাকে নিয়ে একটা বার আসতে পারে না। দেখো এসে কথা কাকে নিয়ে এসেছে।”
লোকটার কথা বলার আন্তরিকতায় নীড় মনে মনে লজ্জিত হলো। কথাকে নিয়ে এতটা জেলাস হওয়া উচিত হয়নি তার। তার জেলাসি মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। আলম ভাই কোন ছেলে না যে, কথার সাথে লাইন মারতে আসবে। লোকটা বিবাহিত। তার থেকে বড় কথা, কথাকে লোকটা যথেষ্ট স্নেহ করে বোঝা যাচ্ছে।
-কুটুস কই আলম ভাই? কতটুকু বড় হয়েছে ও?”
-ঘরে আয় না। বাইরে দাঁড়িয়েই কি সব জানবি। এসো ভাই। আজ প্রথম তুমি আমার বাড়িতে এলে। আমি জানতাম না তুমিও কথার সাথে এসেছ।”
নীড় বিনীত হাসল। ঘরে ঢোকার সময় ফের একবার কথার কানে কানে জিজ্ঞেস করল,
-কুটুসটা কে?”
-আমার একমাত্র ভাতিজা।”
-কিন্তু কুটুস আবার কেমন নাম!”
কথা উত্তর দেওয়ার আগেই আঁখি ভাবি ছেলে কোলে নিয়ে ওদের কাছে এলো। কুটুসকে দেখে কথার খুশির সীমা রইল না। ছেলেটা কত বড় হয়ে গেছে! সেদিন এতটুকু দেখে গেছিল।
-ওকে আমার কোলে দাও না ভাবি। কত বড় হয়ে গেছে তোমার ছেলে! আমি ভাবতেই পারিনি কুটুস এত সুন্দর হয়েছে। পুরো তোমার মত দেখতে হয়েছে।”
আলম ভাই আফসোসের সুরে বলল,
-এটাই প্রমাণ করে ছেলেটা ওর মা’কে বেশি ভালোবাসবে। ব্যাটা তুই বাপের মত না হয়ে মায়ের মত হলি কেন?”
কথা হেসে ফেলল। নীড় এই সুখী দম্পতির খুশিতে ভরা ছোট্ট সংসারটা দেখছে।
-এই কুটুস, ফুপুকে চিনিস না তুই! ও মা কীভাবে হাসে! তার মানে আমাকে চিনিস তুই? ভুলিসনি আমাকে। কুটুস বাপ কত্ত বড় হয়ে গেছে।”
আঁখি ভাবি কথার খুশি দেখছে। নীড়কে দেখে কথাকে কুটুস পেটে আসার পরের একটা কথা মনে করিয়ে দিল।
-তুই বলেছিলি আমার ছেলে হলে তোর মেয়েকে বিয়ে দিবি। আমাকে বিয়ান বানাবি। মনে আছে তো কথাটা?”
কথা কুটুসের হাত নেড়ে খেলতে খেলতে হেসে বলল,
-ফুপুর মেয়েকে বিয়ে করবি তুই! আমাকে শাশুড়ী বানাবি?”
নীড় যে এখানেই আছে তা এতক্ষণ কথার খেয়াল ছিল না। নীড় বোকার মত ওদের কথা শুনছিল। তার মেয়ের নামগন্ধ নেই। অথচ এরা এখন থেকেই তার মেয়েকে ছেলের বউ বানিয়ে নিয়েছে! কথাও এতে রাজি। মেয়ের বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে কিন্তু সেই মেয়েকে দুনিয়ায় আনার কোন পরিকল্পনা প্রস্তুতি তার বউয়ের মাঝে দেখা যাচ্ছে না। কথার খেয়াল হলো নীড় তার সাথে এসেছে। নীড়ের দিকে দেখল সে। নীড় কেমন চোখে তার দিকেই তাকিয়ে আছে দেখে লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করল ওর।
আলম ভাই হাসতে হাসতে বললেন,
-এইবার আমার ছেলের বউকে তাড়াতাড়ি আমাদের মাঝে নিয়ে আয় তো। আমরা অধীর আগ্রহে ওর আগমনের অপেক্ষা করছি।”
নীড় কথার লজ্জা বাড়িয়ে দেওয়ার এই সুযোগটা ছাড়ল না। আলম ভাইয়ের কথায় আত্মবিশ্বাসী গলায় হেসে জবাব দিল।
-ইনশাআল্লাহ শীঘ্রই আনব।”
নীড়ের মুখে এই কথা শুনে কথার বেহুশ হবার দশা। এই লোক কী বলছে এসব!
কথা এই মুহূর্তে এটাই চাইছে, মাটি তুই দুই ভাগ হয়ে যা আমি তোর ভেতর মুখ লুকাই। এত লজ্জা আমি রাখব কই।
আলম ভাই ওদের খাতিরযত্নের আয়োজন করতে চাইলে নীড় তাকে মানা করল। সেই ঘটনার পর থেকে কথাকে খুঁচিয়ে যাচ্ছে নীড়। আসলে কথাকে অপ্রস্তুত অবস্থায় ফেলে মজা পাচ্ছে ও।
ওদের চোখের আড়ালে কথার কানে ফিসফিস করে বলল,
-এটা কিন্তু তুমি ঠিক করলে না। আমার মেয়ের বিয়ে ঠিক করে ফেললে অথচ মেয়ের বাবা হিসেবে আমাকে জানানোর প্রয়োজন মনে করলে না! মেয়ে যদি এখন বেঁকে বসে, বাবা আমি এই ছেলেকে বিয়ে করব না। তখন আমি কী করব? আমি তো তখন নিরুপায় হয়ে পড়ব।”
কথাগুলো বলে তার লজ্জাবতী বউয়ের চেহারার রঙ পরিবর্তন হতে দেখে মনে মনে হাসল সে। কথার মুখে রক্ত জমে গেছে। চাপা গলায় সে বলল,
-চুপ করবেন আপনি!”
-কেন? আমার মেয়ের তো তোমার কুটুসকে পছন্দ না-ও হতে পারে।”
-দয়া করে চুপ করুন আপনি। আপনার মেয়ের প্যাঁচাল পেরে আমার কান খাচ্ছেন কেন?”
-কারণ তুমি আমার মেয়ের মা হবে।”
-এখনও তো হইনি।”
-যেদিনই হও হবে তো।”
-হলে পরে দেখা যাবে। এখন দয়া করে চুপ করুন। আপনাকে এখানে নিয়ে আসাই আমার সবচেয়ে বড় ভুল। আপনি ঘরেই থাকতেন সেটাই ভালো হতো।”
নীড় হাসছে। কথা এতটা লজ্জা পেতে পারে জানা ছিল না ওর। লজ্জা পেলে মেয়েদের একটু বেশিই মায়াবতী লাগে। যেমন এখন কথাকে লাগছে। ওর উপর থেকে চোখ সরানো দায় হয়ে পড়ছে। ফিরে আসার আগে নীড় কথার কাছ থেকে বাবুকে তার কাছে নিতে চাইল। তার জীবনে কোনোদিনও বাচ্চা কোলে নেয়নি সে। আত্মীয়দের কারো বাসায় যায় না নীড়। তাদের বাড়িতে বাচ্চা কোত্থেকে আসবে। এই বাচ্চাটা কত আনন্দ করে কথার কোলে হাতপা ছুড়ে খেলা করছে দেখে সত্যিই আদর করতে ইচ্ছে করছে। নীড় ওকে নিতে গেলে বাচ্চাটা ওর দিকে বড় বড় চোখে তাকিয়ে ‘গ, গ’ শব্দ করে হাসছে। নীড় মনে মনে ভেবে হেসে ফেলল, “ওরে ব্যাটা এখন থেকেই শ্বশুরকে হাত করার চেষ্টা করছিস!”
কুটুসকে নীড়ের কাছে দেওয়ার সময় সন্দেহের গলায় কথা বলল,
-বাচ্চা কোলে নিতে পারেন তো নাকি? বাবু কোলে নেওয়া আপনার বড় বড় চাপা মারার থেকেও কঠিন কাজ।”
নীড় তাচ্ছিল্যের হেসে বলল,
-তোমার মত তিন কথাকে কোলে নিয়ে সারাদিন ঘুরতে পারব। সেখানে এই বাচ্চা তো কিছুই না।”
-ওরে শক্তিমান রে! আমি আপনার শক্তির উপর সন্দেহ করছি না। ছোট বাচ্চাদের সাবধানে কোলে নিতে হয়। ওদের শরীর নরম তোলার মত হয়। তরল পদার্থের মত হাতের ফাঁক গলে পড়ে যাবার ভয় থাকে।”
নীড় বাঁকা হেসে কথার দিকে ঝুঁকে এসে বলল,
-ভালোই অভিজ্ঞতা অর্জন করেছ দেখা যাচ্ছে। তার মানে নিজের একটা বাচ্চা সামলানোর মত যথেষ্ট বড় তুমি হয়েছ। আমি আরও শুধু শুধু তোমাকে ছোট ভাবতাম। তাহলে বাড়ি ফিরে…
নীড় কথা শেষ করতে পারল না। ওর হাতে গরম কিছু অনুভব হলো। উষ্ণ পানির ধারা ওর শার্ট ভিজিয়ে গড়িয়ে পড়ছে। কথা সেদিকে লক্ষ করে শব্দ করে হাসতে লাগল। নীড় চোখ পাকিয়ে ছেলেটার দিকে তাকালে সে মহাখুশিতে নীড়ের মুখে হাত ছুড়ে হাসছে।
কথা কুটুসের গাল টেনে আহ্লাদী গলায় বলছে,
-কুটুস বাবু, ফুপার কোলে হিসু করে দিয়েছে! কুটুস বাবুর একটুও লজ্জা নেই। কুটুস বাবু ফুপাকে ভিজিয়ে দিয়েছে।”
-আমার বাবা হবার বয়সে তুমি আমাকে ফুপা বানাচ্ছ। সেই ছেলে আবার আমার কোলে দুই নাম্বার কাজটাও সেরে ফেলেছে। এরে তো কোনভাবেই আমার মেয়েকে দেওয়া যাবে না। উঁহু কক্ষনো না। এই ছেলের শ্বশুর হিসেবে আমার ভবিষ্যত আমি হিসুময় দেখছি।
চলবে_
@মায়ামহল (নিপা’র গল্প)