বেলীফুল পর্ব-১৯

0
1186

#বেলীফুল
পর্ব-১৯

“তুমি কি বুঝে কথা বলছো ইশরাত? ছেলেটাকে ভালো করে চিনি না, জানি না, মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেব ওর সাথে? ছেলের কোনো চালচুলো নেই, মা বাবা নেই, কারো সাথে মেশে না। কিছুই জানি না আমরা ওর সম্পর্কে। মেয়েটা কত ছোট, ও কি বোঝে ভালো মন্দ? তুমিও তাল দিচ্ছ ওর সাথে! পাগল হয়েছ নাকি?”

হাবিব বেশ রেগে গেছেন ইশরাতের কথা শুনে। একমাত্র মেয়েকে অনেক বেশিই আদর করেন তিনি। ইলার ছোটবেলাটা বেশিরভাগ সময় বাবার সাথে কেটেছে। মা পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থেকেছে, বাবাই ওকে দেখে রেখেছে। হাবিবের তাই মেয়ের জন্য আবেগের কমতি নেই। মেয়ে এত ছাড় হাবিবের প্রশ্রয়েই পেয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ইশরাতের ইচ্ছে হলো এসব বলার, কিন্তু বলল না। বেশিরভাগ সময় সে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাতে ঝগড়া না লাগে। এখন তো মাথা একদম ঠান্ডা রাখতে হবে। আর মেয়ের বিয়ের বিষয়ে মাথা গরম করে একটা কিছু করে ফেলা যাবে না। হাবিব ঠিকই বলেছে, বিয়ে তো সারাজীবনের ব্যাপার। হুট করে আবেগের বশে নিয়ে নেয়া বেশিরভাগ সিদ্ধান্ত ভুল হয়।

ইশরাত বলল, “তোমার মনে আছে নারায়নগঞ্জের সেই দোতলা বাড়ির পাশের ফ্ল্যাটের দম্পতির কথা?”

হাবিবের মনে পড়ল। আর ভালোমতো সবটা মাথায় এসে যাওয়ায় সে আর কথা খুঁজে পেল না।

তখন হাবিবের চাকরিসূত্রে তাদের যেতে হয়েছিল নারায়ণগঞ্জে। সস্তায় একটা ছোটো দোতলা বাড়ির দুই রুমের ফ্ল্যাট ভাড়া পেয়ে উঠেছিল সেখানেই। পাশের ফ্ল্যাটে থাকত এক দম্পতি। খুব ভাব দু’জনার মধ্যে। ওরা ছয় মাস বেশ ভালোই ছিল, হঠাৎ এক সন্ধ্যায় চেঁচামেচি শুনে ঘরের বাইরে বের হয়েছিল ইশরাত আর হাবিব। দেখেছিল ওই ফ্ল্যাটের মেয়েটাকে নিয়ে ঝামেলা। জেনেছিল বাড়িতে রাজি হয়নি বলে মেয়েটা রাজশাহী থেকে পালিয়ে এসে প্রেমিকের সাথে থাকছে। তাদের নাকি বিয়েও হয়নি। অথচ বিবাহিত বলে এখানে উঠেছে। মেয়ের বাড়ির লোক তার খোঁজ পেয়ে নিতে এসেছে। মেয়ের সে কি কান্না!

মেয়েটাকে জোর করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সেদিন৷ তারপর শুনেছিল মেয়েটা আত্মহত্যা করেছে, আর ছেলেটা পাগল হয়ে গিয়েছিল।

হাবিব এক গ্লাস পানি ঢকঢক করে গিলে নিয়ে বলল, “কী বলতে চাইছ তুমি? আমার মেয়ে ওরকম করবে না।”

ইশরাত অন্যমনষ্ক ভঙ্গিতে বলল, “আমি এ পর্যন্ত যতবার ব্যাপারটা নিয়ে ভেবেছি ততবার আমার এই ঘটনা আর আমার আপার ঘটনা মনে পড়েছে। তুমি তো জানো সব! আমার কেন ভয় করবে না বলতে পারো? ইলা এমন নয়, কিন্তু যদি এমন করে ফেলে? মানুষের মনের কোনো বিশ্বাস আছে? তাছাড়া ওর ওই ছেলের প্রতি যে পরিমাণ টান, তুমি না দেখলে বিশ্বাস করবে না।”

হাবিব তিক্ত গলায় বলল, “হারাম সম্পর্কে আবার টান হয়?”

ইশরাত ভাবল কিছুক্ষণ। বলল, “জানি না। যা ঘটছে সব তো সৃষ্টিকর্তার অগোচরে ঘটছে না৷ তার বিধান ঠিকমতো শিক্ষা দিতে পারলে হয়তো মেয়েটা এভাবে ছেলেটার প্রতি দুর্বল হয়ে যেতে পারত না৷ যেহেতু আমরা ওকে সেরকম করে মানুষ করতে পারিনি, সেভাবে শিক্ষা দেইনি, এখন তা নিয়ে প্রশ্নও তুলতে পারি না।”

“তুমি কী বলতে চাও?”

“তুমি ছেলেটার ব্যাপারে খোঁজ নাও। হাওয়া থেকে তো উদয় হয়নি, কোথাও না কোথাও খবর পেয়ে যাবে। আমি মেয়ের সাথে কোনোরকম জোর জবরদস্তি করতে পারব না। অপরিনামদর্শীতা করে ওর জীবনটা দুর্বিষহ করে তুলব না।”

“তুমি সিরিয়ালসি বলছো ইশরাত?”

“হ্যাঁ! অনেক ভেবেই বলছি। তুমি দেখো কী করতে পারো।”

হাবিব থম মেরে কিছুক্ষণ বসে থেকে উঠে বাইরে চলে গেল।

হাবিব বের হওয়ার পরপরই ইশরাতের মাথায় একটা বুদ্ধি এলো। একবার পরীক্ষা করেই দেখা যাক ইলা কী করে!

***

তুলন কফি মেকার ছাড়াই বেশ চমৎকার কফি বানাতে পারে। কিছুটা সময় দিতে হয়, অনেকক্ষণ নাড়তে হয় কফির ফেনা তৈরি করতে। সে সপ্তাহে একদিন এভাবে কফি বানিয়ে খায়। অন্য কাউকে সচরাচর দেয় না, ভাবিরা মাঝে মাঝে চেয়ে খায়। আজও বানাচ্ছে। হাসপাতাল থেকে ছুটি পেয়েছে গত পরশু। এখন সে মোটামুটি সুস্থ। শুধু আয়নার সামনে দাঁড়ালে নিজেকে দুর্ভিক্ষ কবলিত বলে মনে হয়। তাই আয়না দেখা বাদ দিয়েছে। বেশি করে খাওয়াদাওয়া করে চেহারা ফেরানোর চেষ্টা করছে।

মেসেঞ্জারে টুং করে শব্দে ফিরে তাকাল সে। আকাশ মেসেজ দিয়েছে। সেই ঝাঁকড়া চুলের ছেলেটা নামই আকাশ। কয়েকদিন ধরে তাদের ভালোই কথাবার্তা হচ্ছে। ছেলেটা সপ্রতিভ। খুবই অমায়িক ব্যবহার।

তুলন দুপুরে মেসেজ দিয়েছিল, “কী করছেন?”

এখন উত্তর এসেছে, “ঘুম থেকে উঠলাম।”

তুলনের কফি বানানো শেষ। সে কফির ছবি তুলে পাঠিয়ে দিয়ে বলল, “খাবেন?”

আকাশ জিভে জল আসার ইমোজি দিয়ে বলল, “লোভ দেখাও কেন? বানিয়ে দিয়ে যাও।”

“নিজে বানিয়ে খান।”

“পারি না।”

“কাউকে বলুন।”

“কেউ নেই!”

“আচ্ছা আমি বানিয়ে খাওয়াব।”

“কবে?”

“সুযোগ পেলে।”

“সুযোগ কি কখনো আসবে?”

“কেন আসবে না?”

“সুন্দরী মেয়েরা ছেলেদের অত পাত্তা দেয় না। বলছো ভদ্রতা করে।”

“একদম না। সুযোগ পেলে সত্যি খাওয়াব।”

“ওকে! দেখা যাবে।”

“হুম।”

“আমি বরং টং দোকানে গিয়ে চা খাই।”

“আচ্ছা।”

“শোনো, তুমি কফিতে চুমুক দিও না। আমার জাস্ট দুই মিনিট লাগবে চায়ের দোকানে যেতে।”

“ওয়েট করছি।”

আকাশ মিনিট পাঁচেক পর চায়ের ছবি পাঠিয়ে লিখল, “এখন শুরু করতে পারো। চিয়ার্স!”

“চিয়ার্স!”

তুলন যতক্ষণে কফিতে চুমুক দিল, ততক্ষণে সেটা ঠান্ডা হয়ে গেছে। কিন্তু এই কফির স্বাদ অন্যরকম। এত মজা কেন? প্রেমে পড়ার কী দারুণ অনুভূতি! আকাশ একেবারে তার মনের মতো। ভীষণ রোমান্টিক!

***

ইলা জানালার ধারে বসে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল বাইরে। কাননের আজকের কর্মকাণ্ড তাকে নাড়িয়ে দিয়ে গেছে একেবারে। শান্ত ইলা আরও শান্ত হয়ে গেছে। এতদিনের বাঁধভাঙা অস্থিরতা কেমন স্থির হয়ে এসেছে। কানন তাকে ভালোবাসে! সে বোধহয় ভাবেনি এমন হতে পারে। কিন্তু ছেলেটা এমন সময়ে এসে কথাটা বলল যখন সব এলোমেলো! আগে বললে গুছিয়ে কতকিছু করা যেত!

কারো পায়ের শব্দ শুনে ফিরে তাকাল সে। মা এসেছে।

“কিছু বলবে?”

“বোস।”

ইলা বসল। ইশরাত খেয়াল করল ইলার চোখমুখে কেমন অন্যরকম আভা দেখা যাচ্ছে। ছোট্টো মেয়েটি আর ছোট্টো নেই! সে একটু গম্ভীর হওয়ার চেষ্টা করে বলল, “আমি আর তোমার বাবা ঠিক করেছি আমরা বাড়িটা ছেড়ে দেব এই মাসে।”

ইলা চোখের পানি সংবরণ করে বলল, “আচ্ছা।”

“তুমি কাননের সাথে যোগাযোগ রাখতে পারবে না।”

এবারও ইলা অস্পষ্ট সুরে বলল, “আচ্ছা।”

“তুমি কি আমাদের ওপর অনেক রাগ করবে? আমি আর তোমার বাবা কিন্তু তোমার ভালোর জন্যই সব করছি।”

“হুম।”

ইশরাত কী যেন বলতে চাচ্ছিলেন, ইলা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “ওয়াশরুমে যাব মা।” বলেই ছুটে চলে গেল।

ইশরাতের ভয় হতে শুরু করল। ওয়াশরুমে গিয়ে কিছু করে ফেলবে না তো? ভয়টা তাকে ক’দিন ধরে পুরোপুরি পেয়ে বসেছে। স্থির হয়ে থাকতে পারছেন না একটুও। এখন ভয়ের মাত্রা বেড়ে গেল। তিনি চেয়েছিলেন ইলার রিয়াকশন দেখতে। কিন্তু হিতে বিপরীত হয়ে যায় যদি?

“ইলা এতক্ষণ কী করছ?” ডেকে ওঠেন ইশরাত।

ইলা ধরা গলায় উত্তর দেয়, “আসছি।”

ইলা বের হলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ইশরাত।

ইশরাত ইদানীং ইলার সাথেই ঘুমায়। আজ তো না ঘুমানোর প্রশ্নই ওঠে না, কিন্তু হাবিবের হঠাৎ শরীর খারাপ লাগছে। প্রেশার বেড়ে গেছে অনেকখানি। তিনি ইশরাতকে বললেন, “আজ আমার সাথেই থাকো। শরীরের ভরসা পাচ্ছি না।”

ইশরাত হাবিবকে বলেননি ইলার সাথে কী কথা বলেছেন। না করতে পারলেন না। অগত্যা থাকতে হলো স্বামীর সাথেই।

মা-বাবার ঘরের লাইট বন্ধ হওয়ার পর ইলা নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে দিল। এতক্ষণের আটকে রাখা কান্না উথলে উঠল প্রবলভাবে। সে হারিয়ে ফেলছে মানুষটাকে! পেতে পেতে হারিয়ে ফেলছে! আজ হাসপাতালে যে মায়াময় অসহায় মানুষটাকে সে খাইয়ে দিয়ে এসেছে, সে না থাকলে তার কী হবে? ইলা চলে গেলে কানন নিশ্চিত মরে যাবে। কিন্তু মা বাবার অবাধ্য হওয়া তার পক্ষে কোনোদিন সম্ভব নয়।

ফোনটা বেজে উঠল। সাজিদের ফোন। রাত সাড়ে এগারোটায় এই ছেলে তাকে কেন ফোন করছে? এত ভাবাভাবির দিকে গেল না ইলা। ফোনটা ধরল। তার খুব ইচ্ছে করছিল দুঃখের কথা কাউকে বলে। সাজিদের কাছে বলা যায়। খুব সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলেন সাজিদ। হয়তো তাকে একটু স্বান্তনা দিতে পারবে।

সাজিদ পরিকল্পনা মতো সব কথা গুছিয়ে নিয়েছে। সে দাঁড়িয়ে আছে ছাদে। জ্যোৎস্নায় প্লাবিত জগতের সামনে সে তার ভালোবাসার কথা প্রকাশ করবে। ইলাকে ফোন করল সে। ফোন রিসিভ হওয়ার সাথে সাথে ওপাশ থেকে ফোপাঁনোর আওয়াজ ভেসে এলো।

সাজিদ চিন্তিত সুরে বলল, “কী হয়েছে ইলা?”

ইলা কাঁদতে কাঁদতে বলল, “আমার কী করা উচিত একটু বলে দেবেন?”

“ঘটনা কী সেটা তো বলো!”

“আমাকে যে কোনো একটা চুজ করতে হবে। মা বাবা, নয়তো ভালোবাসার মানুষ। আমি কোনোটাই পারছি না। মরে যেতে ইচ্ছে করছে।”

সাজিদ পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইল। বুঝতে পারছে না পরের শব্দটা সে কী বলবে! পৃথিবীটা এত অনর্থক, চাঁদের আলো এত ভুতুড়ে তার আর কোনোদিন মনে হয়নি!

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here