#বেলীফুল
পর্ব-২৪
কিছু জায়গার এমন গুণ আছে, যেখানে গেলেই মন ভালো হয়ে যায়। মৌরিদের বাড়িতে ঢুকে সাজিদের মনটাও তেমনি সতেজ হয়ে গেল। সেই যে একদিন হাঁটতে হাঁটতে বাগানবিলাস লাগানো বাড়িটা দেখেছিল, সেটাই মৌরিদের বাড়ি। বাইরে থেকে দেখে বোঝা যায় না ভেতরটা এত বড়। মৌরির বাবা সিরাজউদ্দীন বেশ সাজিয়ে গুছিয়ে বাড়িটা করেছেন। গেট দিয়ে ঢুকে একফালি বাগান। নানা রকমের ফুল আর ক্যাকটাসে ভর্তি। সীমানা প্রাচীরের গা ঘেঁষে উঠে৷ গেছে বড় বড় সব সেগুন-মেহগনি গাছ। সাদা রঙের একতলা বাড়িটাও দেখার মতো। রঙিন কাচের জানালাগুলো বেশিরভাগই খোলা। ভেতরের কারুকাজ করা আকাশি রঙের পর্দার ঝলক দেখা যাচ্ছে।
ইট বিছানো পথ ধরে এগিয়ে গেল সাজিদ আর তার বাবা। রইসুদ্দিন আজ সারাদিন টানা বকবক করে গেছেন। এখনো বকে যাচ্ছেন, “জানো সাজিদ, এই এলাকাটায় যে সব বদ মানুষ থাকে তা না, এত সুন্দর পরিবেশ, কিছু ভালো লোকও থাকে। এই বাড়ির উল্টোদিকে মজিদ খানের বাড়ি। তার মতো মানুষ হয় না…”
“বুঝেছি বাবা। এখন এগোও। দাঁড়িয়ে পড়লে কেন?”
“দেখ পাথরকুচি। এটার পাতা লবণ দিয়ে খাওয়া যায় জানিস?”
“খাওয়ার জিনিসের অভাব দেশে? পাথরকুচি খাবে কেন?”
“ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে গেল।”
“আচ্ছা চলো এখন।”
“যাওয়ার আগে একটা পাতা নিয়ে যাব।”
“সত্যি খাবে?”
“না, না। মাটিতে পুতে দেব। পাথরকুচির পাতা থেকে গাছ হয় শুনিসনি?”
“ঠিক আছে।” বলে আবারও একটা বেগুনী ফুলগাছের সামনে দাঁড়িয়ে পড়া বাবাকে টেনে নিয়ে এলো সাজিদ।
দরজা নক করতেই সিরাজউদ্দীন সাহেব বেরিয়ে এলেন। একগাল হেসে বললেন, “আসুন আসুন।”
সাজিদ আর রইসুদ্দিনকে বসার ঘরে নিয়ে গেলেন তিনি। বসার ঘরটা খুব সুন্দর করে সাজানো। দেয়ালে চমৎকার সব পেইন্টিং, কিছু শোপিস, সেন্টার টেবিলে রাখা ফুলদানিতে তাজা ফুল। বড় জানালা দিয়ে প্রচুর আলোবাতাস ঢুকছে। ফ্যান ছেড়ে দিলে পর্দাগুলো দুলতে থাকল। টিকটিক করতে থাকা কালো কুচকুচে কাঠের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলল সাজিদ। সে কোনোদিন জানত না, এরকম বাড়ি তার পছন্দ। আচ্ছা, টাকাপয়সা হলে সে এমন বাড়ি করতে পারবে? নাকি করার মতো রুচি তার নেই? চাইলে ছোট্ট ঘরও সুন্দর করে রাখা যায়৷ কিংবা হয়তো এসব পুরুষদের কর্ম নয়। ঘরে নারীর ছোঁয়া না লাগলে সেটা ঠিক ঘর হয় না, যেমন সাজিদের কোয়ার্টার।
ওর ভাবনায় ছেদ ঘটিয়ে সিরাজউদ্দীন বলে উঠলেন, “তুমি তো ইউনিভার্সিটিতে পড়াও তাই না?”
“হ্যাঁ।”
“তোমাকে একান্তই ধন্যবাদ দিতে ডেকেছি এটা ঠিক, তবে কিছু কথাও বলার আছে।”
“কী বিষয়ে?”
“যেটা নিয়ে এত ঘটনা ঘটে গেল!”
“আপনার মেয়ে?”
“হ্যাঁ!”
“বলুন।”
সিরাজউদ্দীন কথাগুলো গুছিয়ে নিয়ে বললেন, “দেখো, ব্যাপারটা খুব সেনসিটিভ। উড়িয়ে দেবার মতো নয়। আমরা সেটা চাচ্ছিও না। যে বাজে ব্যাপারটা থেকে আজকে তুমি আমাদের বাঁচিয়ে দিলে সেটা তো একটা প্রভাব শুধু। আসল ঘটনাটা সত্যিকার অর্থেই ভয়ানক। সেটাই তোমাকে বলতে চাচ্ছি।”
সাজিদ একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল, “আপনি কি এমনিতেই বলতে চাচ্ছেন নাকি আমি এ ব্যাপারে কোনো ভূমিকা রাখতে পারি?”
“সেটা বলা শেষ হলে তুমি নিজেই বুঝবে।”
“আচ্ছা বলুন।”
“আপনার কোনো অসুবিধা হবে না তো রইসুদ্দিন সাহেব?”
রইসুদ্দিন বললেন, “নাহ আমার কেন সমস্যা হবে।”
সিরাজউদ্দীন বড় করে নিঃশ্বাস ফেলে বলতে শুরু করলেন,
“মৌরির পড়াশোনা ঢাকাতেই। মেয়েটা সুন্দরী, কিন্তু সেজন্য সেখানে কখনো কোনো ঝামেলায় পড়তে হয়নি। এত লক্ষী একটা মেয়েকে নিয়ে বিপদে পড়তে পারি এমন ভাবনাও কোনোদিন মাথায় আসেনি। কিন্তু বিপদ তো আর বলে কয়ে আসে না, হুট করে উদয় হয়৷ এই বাড়িতে ওঠার মাসখানেক পর একদিন মৌরি ইউনিভার্সিটিতে ঘুরতে গেল। সাথে এলাকারই কোনো এক মেয়ে ছিল। সেখানে কিছু বখাটে ওকে আজেবাজে কথা বলে। বলে নেই, বখাটেগুলো ইউনিভার্সিটির ছাত্র। পড়াশোনা করে না, রাজনীতি নিয়ে পড়ে থাকে। কোন পাতি নেতার কাছের লোক বলে এদের ভাবভঙ্গি অতিরিক্ত পরিমাণে বেপরোয়া।
তারা সেদিন মৌরির পিছু নিয়ে বাড়ি চিনে যায়। এরপর প্রায়ই দেখা যেত কয়েকটা ছেলে বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে। মৌরি রাস্তায় বের হলে ‘ভাবি’ বলে ডাকাডাকি করে। খুবই অসহ্যকর অবস্থা।
শেষে একদিন ছেলেগুলোকে ডেকে কথা বললাম৷ এরা সাফ বলে দিল, সরকারের জায়গায় দাঁড়াব, আপনার কী? বাড়িতে গিয়ে তো আর কিছু বলছি না।
বিশ্বাস করো, এইযে এলাকার লোকগুলো, এদেরকেই তখন আমি বলেছিলাম কিছু একটা করতে। এরা কেউ এগিয়ে আসেনি! গুন্ডাগুলোর ভয়ে পালিয়ে থেকেছে, একটা প্রতিবাদ করে কথা পর্যন্ত বলেনি। অথচ আজ এসেছে বিচার করতে! কোথায় যাচ্ছে লোকের মনুষ্যত্ব বলতে পারো?
যাহোক, এরপর একদিন অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করায় মৌরি এক ছেলেকে চড় মারে। সম্ভবত ওটাই পালের গোদা ছিল।
কিছুদিনের জন্য সব থেমে গিয়েছিল। ভেবেছিলাম আপদ বিদায় হয়েছে। কিন্তু আসলে আরও বড় কিছুর জন্য তৈরি হয়েই ওরা এসেছিল।
সেদিন সকাল আনুমানিক নয়টার দিকে মৌরি বাগানে কাজ করছিল। একটা ছোট্ট বাচ্চাকে পাঠিয়ে জরুরি দরকার বলে ওরা ওকে ডাকিয়ে নেয়। মৌরি বাইরে বের হতেই সেই শয়তান ছেলেকে দেখতে পায়। ও চলেই আসছিল, ছেলেটা ওকে নানা কথা বলতে থাকে, ক্ষমা চায়, এই ফাঁকে কখন মাইক্রোবাসটা এসে দাঁড়ায় ও নিজেও জানে না। একেবারে চোখের পলকে ওকে তুলে নিয়ে গাড়ি ছুটিয়ে পালিয়ে যায় ছেলেগুলো।”
এই পর্যন্ত বলে থামলেন সিরাজউদ্দীন। সাজিদ বলল, “চাচা আপনি একটু পানি খান। বাকি ঘটনা অন্যদিন শুনব।”
“সময় তো চলে যাচ্ছে বাবা, অপরাধীরা ঘুরে বেড়াচ্ছে বুক ফুলিয়ে। আর আমার মেয়েটা গুমরে মরছে দিনের পর দিন! আমি বলতে পারব। তুমি শোনো।”
“আচ্ছা।”
“ওরা আমার মেয়েকে নিয়ে হাত পা বেঁধে ফেলে রাখে কোনো এক পোড়োবাড়িতে। তারপর রাতে…
বুঝতেই পারছো! দু’দিন ওরা আটকে রাখে ওকে। তারপর সেই মাইক্রোবাসে করেই নিয়ে এসে বাড়ির সামনে ফেলে রেখে চলে যায় ঝড়ের গতিতে।
দু’দিন আমাদের মানসিক অবস্থা কেমন ছিল তা হয়তো বলে বোঝাতে হবে না! সেই ছোটো বাচ্চাটা সব দেখেছে। সেই জানিয়েছিল কী ঘটেছে মৌরির সাথে।
আমরা পুলিশে ডায়েরি করি। পুলিশ প্রথমটায় তেমন গা করল না! একে তো ছেলেগুলোর হাত যথেষ্ট লম্বা, এদের কিছু বলতে পুলিশেরই ভয়। তার ওপর মেয়েটা হারিয়েছে মাত্র ঘন্টাখানেক হয়েছে এই অযুহাত রয়েছে। অতএব তাদের কাজ ঢিমেতালে চলল, বা চলল কি না তাও জানি না! আমরা তো খুঁজলাম পাগলের মতো। পেলাম না।
সে যাই হোক, ও ফিরে এলে বেঁচেছি। কিন্তু মেয়েটাকে একেবারে মেরে ফেলেছে! আমার হাসিখুশি মেয়েটা! জানো, ও কত হাসত! গুনগুন করে গান গাইত আর বাগান করত। আমার ঘরের আলো ছিল মেয়েটা। চোখের আড়াল হওয়ার ভয়ে অনেক সম্বন্ধ পেয়েও বিয়ে দেইনি। ভেবেছিলাম আমার রাজকন্যার মতো মেয়ের জন্য রাজপুত্র নিয়ে আসব। কিন্তু….”
বেশ কিছুক্ষণ নিরবতার পর আবার সিরাজউদ্দীন বললেন, “আমার তো তেমন জানাশোনা নেই বাবা, অতি সাধারণ মানুষ আমি৷ পুলিশের ওপর ভরসা করে কোনো লাভ হয়নি। এদিকে নতুন এসে কারো সাহায্য যে পাব সেই আশাও নেই। উল্টে সবাই যেন আমাদের ওপর হামলে পড়েছে মড়ার ওপর আরও মারবে বলে। আমরা কী করব বলতে পারো? কোথায় গিয়ে বিচার চাইব?”
সাজিদ অবাক হয়ে বলল, “পুলিশ কিছুই করেনি? ছেলেগুলোকে তো মৌরি চিনত!”
“পুলিশ কী করেছে জানো? শুনলে বোধহয় আমাকেই অবিশ্বাস করবে! ওরা মৌরিকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করলেও আঘাত করেনি বা মারধোর করেনি। খুব কষ্টও দেয়নি। তাই ও যখন ফিরে এসেছে, শারীরিকভাবে তখন সুস্থ ছিল। রেইপ আর কিডন্যাপিং এর কেস যখন করতে গেলাম, পুলিশ বলল লক্ষণ দেখে মনে হয় না তেমন কিছু হয়েছে। মেয়ে নাকি স্বেচ্ছায় গেছে ওদের সাথে। গা ছাড়াভাবো একটা ডায়েরি করেছে ওরা, কিন্তু কোনো কাজ করেছে বলে মনে হয় না। মেডিকেল টেস্ট করানোর কথা বললাম, বলল সেসব পরে হবে। এলাকার লোকজনেরও তাই ধারণা মৌরি ইচ্ছে করে গেছে।”
সাজিদ কী বলবে কথা খুঁজে পেল না। পায়ের নখ দিয়ে কার্পেটে অজানা নকশা তৈরি করে যাচ্ছে। রইসুদ্দিনও চুপ।
সিরাজউদ্দীন সাহেব উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “দেখেছেন খালি মুখে বসিয়ে রেখেছি কতক্ষণ ধরে! অথচ চা খাওয়ার দাওয়াত দিয়েছি। ভেতর থেকে এতক্ষণে নাস্তা চলে আসত, কিন্তু বোঝেন তো, মন মেজাজ ভালো নেই কারো, মনেই নেই মেহমানের কথা।”
সাজিদ বলল, “আপনি ব্যস্ত হবেন না। মৌরিকে একটু ডেকে দিতে পারবেন? সে কি কথা বলবে? একটু দরকার ছিল।”
“হ্যাঁ ডাকছি।”
মিনিট পাঁচেক পর নাস্তাসহ মৌরি নিজেই এলো। সকালের মতো মেঘে ঢাকা চেহারা নেই তার, তবে বিষন্নতার কালো ছায়া তার মুখে স্থায়ীভাবে বসে গেছে। আনন্দের চিহ্নমাত্র নেই সেখানে।
সে এসে দু’জনকে সালাম দিল। সাজিদ প্রথমবার মৌরির গলা শুনল। মিষ্টি কণ্ঠের মেয়ে। বোধহয় খুব সুন্দর গান গাইতে পারে।
সাজিদ বলল, “বসুন। আপনার সাথে একটু কথা আছে।”
মৌরি বসল। তাকিয়ে রইল জানালার পাশে বেড়ে উঠতে থাকা মানিপ্ল্যান্টের দিকে। সাজিদ একটু কেশে গলা পরিষ্কার করে বলল, “ছেলেগুলোর সবার নাম জানেন?”
“অর্ক, উল্লাস, জিতেন, সাঈফ।”
“লিডার অর্ক?”
“হ্যাঁ।”
“চিনি। ইভেন অনেকদিন ধরেই এদের ধরার চেষ্টা করছি। অনেক বাড় বেড়েছে। এবার ধরা হবে। আপনার কাছে কোনো ধরণের প্রমাণ আছে?”
মৌরি একটু ভেবে বলল, “অর্ক আমাকে আজেবাজে মেসেজ পাঠাত, সেগুলো আছে।”
“মানে সেদিন কিডন্যাপের পর সে সম্পর্কিত কিছু? কানো আইডিয়া নেই কোথায় নিয়ে গিয়েছিল?”
মৌরি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, “আমি দু’একদিন ভেবে বলি? আমি কিছু কিছু বিষয় ভাবলে মনে করতে পারব। ওই কথাগুলো মনে করতে ইচ্ছে করে না বলে ভাবিনি।”
সাজিদ মাথা নেড়ে বলল, “ঠিক আছে। আপনি ভাবুন। আমার নাম্বার রাখুন। যাই মনে পড়বে, ফোন করে বলবেন। আমার একটা প্ল্যান আছে। ঠিকমতো সব করতে পারলে সবগুলোকে একসাথে ধরা যাবে। এতবড় ক্রাইম করে শুধু নেতার জোরে পার পেয়ে যেতে পারে না ওরা!”
মৌরি এতক্ষণ মাথা নিচু করে কথা বলছিল। এবার চোখ তুলে তাকাল। সাজিদ দেখল গভীর কালো চোখদুটি দিয়ে প্রবল আশা নিয়ে তাকিয়ে আছে মেয়েটি।
(চলবে)