বেলীফুল পর্ব-৩৪

0
1551

#বেলীফুল
পর্ব-৩৪

ইলাকে হলুদের সাজে খুব মানিয়েছে। এমনিতেই তাকে বেশ সুন্দর লাগে। সবাই বলে বিয়ের আগে রূপ খুলেছে। হালকা হলুদ রঙা শাড়ি পরেছে সে। হাতভর্তি চুড়ি আর ফুলেল গহনা। ইদানীং যেসব আর্টিফিশিয়াল গহনা পাওয়া যাচ্ছে সেসব নয়, সত্যিকারের ফুল দিয়ে বানানো গহনা। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ইলা নিজেই মুগ্ধ হয়ে গেল। কয়েকটা ছবি তুলে ফেলল নিজের। খুব ইচ্ছে করছে কাননকে দেখাতে। কিন্তু লজ্জাও লাগছে। ইলা তখন খেয়াল করল সেই সকালে কাননের সাথে ঝগড়া হওয়ার পর তাদের আর কথা হয়নি। এত ব্যস্ত ছিল যে খেয়ালই হয়নি। এমনিতে ব্যস্ততার মাঝেও মেসেজে টুকটাক কথা হতেই থাকে। আর সেটা হয়নি বলে অমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল! আচ্ছা থাক, আজকের দিনটাই তো। তারপর সব দূরত্ব চিরতরে শেষ।

ভাবতে ভাবতে ইলার কাছে ফোন এলো। কাননের কল।

“হ্যালো!”

“কী করো?”

“কিছু না। আপনি কী করছেন?”

“তোমার কথা ক্লিয়ার আসছে না..”

“আমি আপনার কথা শুনতে পাচ্ছি তো।”

“কী বললে? হ্যালো…”

নেটওয়ার্কে বুঝি সমস্যা! ইলা জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। “এখন শুনতে পাচ্ছেন?”

“জি ম্যাম! দেখতেও পাচ্ছি!”

ইলা অবাক হয়ে নিচে তাকাল। কানন দাঁড়িয়ে আছে। ইচ্ছে হলো ছুটে পালিয়ে ভেতরে চলে যেতে। কিন্তু পা কেন যেন সায় দিল না। সেও তাকিয়ে রইল কাননের দিকে।

বেশ অনেকটা সময় পার হওয়ার পর কানন বলল, “আচ্ছা যাই আমি কেমন? আপারা বোধহয় সব রেডি করে ওয়েট করছে।”

“কাল আসবেন তো?”

“না এলে তোমাকে নিয়ে যাব কেমন করে?”

“আচ্ছা।”

“শোনো…”

“বলুন।”

“তোমাকে এত সুন্দর লাগছে কেন?”

ইলা হঠাৎই রেগে গেল। “কেন সবসময় সুন্দর লাগে না? নাকি অন্য সময় পেত্নীর মতো লাগে, আজ সুন্দর লাগছে বলে কারন খুঁজছেন?”

“আমি কি এটা বলতে চেয়েছি?”

“তাহলে কী বলতে চেয়েছেন?”

“সিম্পলি সুন্দর লাগছে এটাই তো বললাম।”

“উহু, আপনি জিজ্ঞেস করেছেন সুন্দর লাগছে কেন?”

“ওইটা কোনো প্রশ্নবোধক বাক্য ছিল না। বিষ্ময়সূচক বাক্য ছিলো।”

“খুব গ্রামার পারেন মনে হয়!”

“দেখো এটা গ্রামারের বিষয় না, এটা হলো কথার ধরণ…”

“হয়েছে, আপনার সাথে আমি ঝগড়া করতে চাচ্ছি না। আমার অনেক কাজ আছে।”

“বিয়ের পর কাল আবার বলো না আপনি একাই চলে যান, আমার কাজ আছে।”

“আপনি এত আজেবাজে কথা বলছেন কেন?”

“আজেবাজে কথা কোথায় বললাম!”

“তো এসব কি ভালো কথা নাকি? কী আশ্চর্য লোক! আপনি এত ঝগড়ুটে জানতাম না।”

কানন হাল ছেড়ে দিয়ে বলল, “আচ্ছা আমি ঝগড়ুটে। তুমি খুব ভালো মেয়ে। কেমন?”

“বিদ্রুপ করে বললেন?”

“এখন তো কথার সুর ঠিকই ধরতে পারলে তখন প্যাচালে কেন?”

“আবার আপনি ঝগড়া শুরু করতে চাচ্ছেন?”

“ইলা….”

“হুম?”

“আই লাভ ইউ।”

ইলা ভীষণ লজ্জা পেয়ে চট করে জানালার সামনে থেকে সরে গেল। হঠাৎ এটা কী বলল কানন! এই হনুমান তো দিন দিন আনপ্রেডিক্টেবল রোমান্টিক হিরো হয়ে যাচ্ছে! বাবারে বাবা! একেবারে নেয়া যাচ্ছে না।

ইলা যখন ঘর থেকে বের হলো, তখন ওর খালা জিজ্ঞেস করল, “কিরে ইলা তুই কি গালে এক্সট্রা ব্লাশন লাগিয়েছিস? এত লাল লাল লাগছে কেন?”

ইলা কোনোমতে বলল, “না তো, কী যেন কেন হলো।”

***

মৌরির এলার্জির সমস্যা। পার্লারের মহিলা কী একটা ক্রিম যেন লাগিয়েছে, এখন হাত-পা-মুখ লাল লাল হয়ে গেছে। জ্বালা করছে খুব! এদিকে গায়ে হলুদ দেয়া শুরু হবে এখনই। ডাকছে সবাই। সাজিদদের যেহেতু হলুদের অনুষ্ঠান করার মতো লোকজন নেই, তাই ঠিক হয়েছে মৌরিদের বাড়িতে দু’জনের একসাথে গায়ে হলুদ হবে। সাজিদরা চলেও এসেছে।

মৌরি শেষ পর্যন্ত থাকতে না পেরে বাথরুমে ঢুকে শাড়িটা খুলে ফেলে শাওয়ার ছেড়ে দিল। অসহ্য যন্ত্রণা!

সে যখন বের হলো তখন সব সাজ ধুয়ে গেছে। চেহারা তবু লালচে হয়ে আছে। বাইরে থেকে সবাই খুব তাড়া দিচ্ছে।

মৌরি দ্রুত হাতে শাড়িটা পরে নিল। মুখে হালকা ক্রিম মেখে চোখে গাঢ় কাজল আর ঠোঁটে লিপস্টিক দিয়ে বের হয়ে এলো। তাকে একই সাথে বিধ্বস্ত এবং স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে এখন।

মা হতভম্ব হয়ে বললেন, “তুই সাজ ধুয়েছিস কেন?”

“মহিলাকে কতবার বললাম অচেনা কমদামি কোনো প্রোডাক্ট ইউজ না করতে, কিন্তু কী যে লাগিয়েছে, জ্বলুনিতে অবস্থা খারাপ।”

“শ্বশুরবাড়ির লোকজন আছে তোর, এভাবে যাবি?”

“খুব খারাপ লাগছে মা?”

মা কিছুক্ষণ দেখে বললেন, “নাহ। চল যাই। এখন সাজার সময়ও নাই।”

মৌরিকে দেখে সাজিদ একটু অবাক হলো। সে খেয়াল করেছে এখনকার বিয়েগুলোতে মেয়েরা এত সাজে যে চেনাই দায়! কিন্তু মৌরি খুব একটা সাজেনি৷ তাতেই খুব ভালো লাগছে। এত সাজগোজের দরকার কি বাপু! পরিপাটি হয়ে থাকলে সবাইকে সুন্দর লাগে। মৌরিকে হঠাৎ খুব ভালো লাগছে তার।

সাজিদের দৃষ্টি মৌরির চোখ এড়াল না। সাজিদকেও বেশ লাগছে! হলুদ পাঞ্জাবিতে ফরসা গায়ের রঙ টকটকে হয়ে আছে। বোধহয় খানিকটা লজ্জা পাচ্ছে। নাকের ডগা লাল। চোখদুটো খানিক ক্লান্ত। আজই তো দেখা হয়েছিল সকালে, তবু মনে হচ্ছে কতদিন পর দেখা হলো!

গায়ে হলুদ পর্ব শেষ হলে বাসায় ফিরে সাজিদ মৌরিকে মেসেজ পাঠাল, “বিয়েতে প্লিজ ভয়ানক মেকআপ করো না, তোমাকে এমনিতেই সুন্দর লাগে।”

মৌরির কখনোই পছন্দ নয় কেউ তার ব্যক্তিগত গেটআপ কেমন হবে সে ব্যাপারে নাক গলাক। কিন্তু সাজিদের সুরে কেমন যেন আন্তরিকতা মেশানো। অনুরোধ করে বলছে। ভালোলাগা আর লজ্জার মিশেলে আজকের আবহাওয়াটাই অন্যরকম লাগছে মৌরির। বসন্ত চলে গেছে আগেই, তবু মন গেয়ে উঠল, “বাতাসে বহিছে প্রেম, নয়নে লাগিল নেশা….”

কিন্তু হঠাৎ মন একটু একটু করে খারাপ হতে শুরু করল। সেই ভয়াল স্মৃতি! মনের মধ্যে বাসা বেঁধে থাকা কালো কুঠুরি থেকে গরল বাষ্প বের হয়ে মৌরিকে ধীরে ধীরে আচ্ছন্ন করে ফেলল। মনে হচ্ছে গলা চেপে ধরছে কালো কুচকুচে কোনো সরীসৃপ।

***

ভোরবেলা মৌরির ফোন পেয়ে জেগে উঠল সাজিদ।

“কী হয়েছে মৌরি?”

“একটা কথা বলতে ফোন করলাম।” মৌরি ধরা গলায় বলল।

“বলো।”

“আমাকে বিয়ে করতে হলে আপনার একটা শর্তে রাজি হতে হবে।”

সাজিদ একটু অবাক হয়ে বলল, “কী শর্ত?”

“আপনি কখনো আমার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়ে কথা তুলতে পারবেন না। আমাকে ওই ব্যাপারে কোনো কথা শোনাতে পারবেন না। যদি শোনান, তাহলে আমি সেদিনই চলে আসব।”

সাজিদের মনটা একটু খারাপ হলো। সে নরম সুরে বলল, “আমার কোনো আচরণে তোমার মনে হয়েছে আমি এরকম করব?”

মৌরি উত্তর দিল না। সাজিদ বুঝল সে কাঁদছে। ওকে কাঁদার সুযোগ দিল সে।

কিছুক্ষণ পর মৌরি নিজেই সামলে নিয়ে বলল, “আপনি বোধহয় আমাকে বিয়ে করে ভুল করছেন। আমার মাথা এলোমেলো হয়ে গেছে। ভুলভাল কথা বলি।”

“তুমি হীনমন্যতায় ভুগছ মৌরি। এটা হয়েছে বিয়ে ঠিক হওয়ার পর। আগে তো অনেক কনফিডেন্ট ছিলে! কেন এমন হলো?”

“আমি জানি না।”

সাজিদ বলল, “আমার বাড়িতে তুমি রানীর মতো থাকবে মৌরি। কোনোদিন তোমার এতটুকু অসম্মান হবে না। প্রমিজ করছি। যদি কোনোদিন ভাঙি, তুমি নাহয় শাস্তি দিও। আর এরপর যদি এসব বিষয় নিয়ে মন খারাপ করো, তাহলে খুব খারাপ হবে কিন্তু!”

মৌরি হেসে ফেলল। “আমি কি আপনার স্টুডেন্ট নাকি এভাবে কথা বলছেন যে?”

“অবশ্যই। আমার কাছ থেকে অনেক কিছু শেখার আছে তোমার।”

“কী শেখাবেন?”

“এসো আগে আমার বাড়ি। তারপর নিজেই জানতে পারবে।”

মৌরি ফোন রেখে ছোট্ট করে একটা নিঃশ্বাস ফেলল। ভেতরের কষ্টগুলো কখন যেন উধাও হয়ে গেছে। ছাদ থেকে নেমে আসা মধবীলতার সুঘ্রানে চোখজুড়ে ঘুম চলে আসছে। সারারাত ঘুমায়নি মৌরি। শোওয়ার সাথে সাথে হারিয়ে গেল গভীর ঘুমে। একটু পর যখন বোনেরা ডাকাডাকি শুরু করল পার্লারে যেতে দেরি হয়ে যাবে বলে, তখন সে সাফ জানিয়ে দিল, পার্লার থেকে সাজবে না, নিজে সাজবে। যে যা বলে বলুক!

***

সকালবেলা সারা শরীরে হলুদ ডলে গোসল করানো হলো ইলাকে। গোসল শেষে সে যখন চুল ছড়িয়ে আয়নার সামনে বসে আছে, তখন দেখল বাবা দাঁড়িয়ে আছেন দরজা ধরে। অসহায় দেখাচ্ছে তাকে। ইলা হঠাৎ বুঝতে পারল সে আজ এখান থেকে চলে যাবে চিরকালের জন্য। মা বাবার তো সে ছাড়া আর কেউ নেই। এই বাসাটায় একা একা দু’জনকে থাকতে হবে। কেমন করে থাকবে ওরা? ইলাই বা বাবা মাকে ছেড়ে কিভাবে থাকবে?

চোখ পানিতে ভর্তি হয়ে এলো তার। ছোটোদের মতো কেঁদে ফেলল ঠোঁট বাঁকিয়ে। বাবা কাছে এসে ইলার মাথাটা বুকে জড়িয়ে নিজেও কেঁদে ফেললেন। এত দ্রুত তার মেয়ে পর হয়ে যাবে এটা দূর ভাবনাতেও ছিল না। কেমন করে কী হয়ে গেল!

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here