#বেলীফুল
পর্ব- ৩৭
“কী করো?”
“রান্না।”
“কী রান্না?”
“ছোটো মাছের চচ্চড়ি। বাবা খেতে চাইলেন।”
“পারো?”
“কেন পারব না?”
“তাই তো! তুমি তো গুণবতী।”
“ধুর!”
“সত্যি বলছি।”
“আপনার জন্য কী রেঁধে রাখব?”
“আমি সবই খাই।”
“তবু আলাদা কিছু খেতে ইচ্ছে হলে বলতে পারেন।”
“তুমি যা রাঁধবে তাই অমৃত।”
“আপনি ইদানীং অনেক তেল দিচ্ছেন আমাকে। কারণ কী?”
“কোথায় তেল? পুরো মন থেকে বলি।”
“আচ্ছা আচ্ছা হয়েছে। ফিরবেন কখন?”
“দেখি। আজকে এক্সট্রা ক্লাস নেয়ার কথা ছিল। স্টুডেন্টদের পাত্তা নেই। না হলে তাড়াতাড়িই আসব।”
“ঠিক আছে। এখন কী করছেন?”
“বসে আছি।”
“ওহ।”
“রাখব?”
“হুম।”
“ওকে!”
“শুনুন…”
“বলো।”
“বাজারের কাছাকাছি এলে ফোন করবেন তো একটু।”
“কেন?”
“কিছু জিনিস আনতে বলব।”
“ওকে।”
“রাখছি তাহলে।”
“রাখো।”
“বাই।”
“আল্লাহ হাফেজ।”
ফোনটা নামিয়ে রেখে মৌরির মনে হলো, আরেকটু কথা বলা যেত। সারাদিনই কথা বলতে ইচ্ছে হয়, অথচ কেমন লজ্জা ঘিরে রাখে। কথাগুলো হারিয়ে যায়। আজ সাজিদের জন্মদিন। মৌরি খুব যত্ন করে ওর পছন্দের খাবারগুলো রান্না করেছে। ছোটো মাছ সাজিদ খুবই অপছন্দ করে, তাই ইচ্ছে করে সেটার কথা বলেছে। রান্নার ফাঁকে ঘরও সাজিয়েছে সুন্দর করে। কেক বানিয়েছে নিজ হাতে। আরও অনেক কিছু করতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু সাজিদের নেই ঠিক। কখন হুট করে চলে আসবে কেউ জানে না। এজন্যই বাজারের কাছে এসে ফোন করতে বলল মৌরি। ফোন পেলেই সে সাজতে বসবে।
***
সারাজীবন একা একা থাকা ইলা হঠাৎ করেই যেন ভীতু হয়ে গেছে। একা বাথরুমে যেতেও ভয় লাগে। কানন অফিসে চলে গেলে তার মনে হয় একা বাসায় ভূতেরা ফিসফিস করে। তার ধারণা অনেকদিন বদ্ধ থাকায় বাড়িটা ভূতেদের বাড়ি হয়ে উঠেছিল। এখন বাড়ির মালিক ফিরে আসায় তারা খুবই বিরক্ত হয়েছে। যে কোনোভাবে ভয় দেখিয়ে তাড়াতে চাইছে বাসিন্দাদের। এদিকে ইলার কথা কান দিয়ে ঢোকাতেও রাজি নয় কানন। সে মনে করে ইলা বিয়ের পর আহ্লাদী হয়ে গেছে। সে যতক্ষণ বাড়িতে থাকে ততক্ষণ আঠার মতো তার সাথে লেগে থাকে। ইলা আসলে চাইছে সে চাকরিবাকরি ছেড়ে সারাদিন বাড়িতে পড়ে থাকুক। কিন্তু তাতে তো আর চলবে না! মেয়েটা আগে বাস্তববাদী ছিল। বিয়ে করে বিগড়ে গেল কেন?
এসব ব্যাপারে কাকে বলবে ভেবে না পেয়ে দুলাভাইকে একদিন বলল কানন। দুলাভাইয়ের মগজভর্তি বুদ্ধি। সে তৎক্ষনাৎ উপায় বাতলে দিল।
“তোমার বউ আসলে চাইছে কোথাও বেড়াতে যেতে। বাসায় ভয় লাগে মানে কী? বাসায় থাকতে ইচ্ছে করছে না। এদিকে তোমার সাথেও সারাদিন থাকতে ইচ্ছে করে, যেটা বাপের বাড়িতে গেলেও হবে না। তার মানে ও তোমার সাথে সময় কাটাতে চায়, কিন্তু ওই বাসায় থাকতে চায় না। তাহলে একটাই উপায় থাকে, বেড়াতে যাওয়া। হানিমুনটা তো করলে না, এবার চলে যাও।”
“ভেবেছিলাম আপনারা চলে যাবেন ক’দিন পর, আমরা এর মধ্যে বেড়াতে গেলে কেমন হয় বলেন…”
“আরেহ এটাই তো সুযোগ। আমরাও যাব। এখানে প্রতিদিন আত্মীয়স্বজনের ভিড় লেগেই আছে। দেশে এলাম, একটু ঘুরলমাও না। অযুহাত দিতে পারব যে তোমরা জোর করে আমাদেরও নিয়ে যাচ্ছ। একসাথে বের হব, বের হয়ে আলাদা হয়ে যাব।”
“কিন্তু একসাথে গেলে দোষ কী?”
“আরেহ প্রাইভেসির ব্যাপার আছে না একটা? বিয়ের পর এত লোকজন নিয়ে কেউ হানিমুনে যায় নাকি?”
“বুঝেছি।”
“তাড়াতাড়ি প্ল্যান করো এবার।”
“হুম।”
কানন বাড়ি এসে কথাটা ইলাকে বলতেই ইলার চোখমুখ একেবারে দুইশো ওয়াট বাল্বের মতো জ্বলে উঠল। দাঁতগুলো বের করে বলল, “কোথায় যাচ্ছি আমরা?”
“তুমিই ঠিক করো।”
“সুইজারল্যান্ড?”
কানন চোখ ট্যারা করার ভঙ্গি করে বলল, “তোমার আমাকে কী মনে হয়? বড়লোক ম্যাক্স প্রো?”
ইলা খিলখিল করে হেসে বলল, “না, তুমি গরীব সেটা আমি জানি। চলো তাহলে লালবাগ কেল্লায় ঘুরে আসি। আসার সময় টিএসসিতে ফুচকা খেয়ে আসব। কেমন?”
“উফ ইলা….”
“এসব শুনব না। আমি সুইজারল্যান্ডেই যাব। নয়তো কোথাও না। ওহ চাইলে তুমি আমাকে মিশরে নিয়ে যেতে পারো। পিরামড দেখে আসব। কিংবা…চলো আমরা এবার এন্টার্কটিকা মহাদেশটা ঘুরে আসি।”
“মাথা খারাপ হয়ে গেছে।”
“না না, আমি সিরিয়াস। বরফের মধ্যে দিয়ে হাত ধরাধরি করে হাঁটব। জুলভার্নের অ্যাডভেঞ্চার গল্পের মতো মরু ভাল্লুকদের সাথে যুদ্ধ করব। বরফের ঘর বানিয়ে থাকব।”
“পাগল হয়ে গেছ তুমি।”
“তুমি পাগল বানিয়ে দিয়েছ।”
“ইলা শোনো না..”
“কী?”
“চলো কক্সবাজার যাই।”
“আমি ওই মাছের বাজারে যাব না।”
“তাহলে? সুন্দরবন?”
“হানিমুনে সুন্দরবন? ধ্যাৎ!”
“তুমিই বলো তাহলে?”
ইলার চোখদুটো স্বপ্নালু হয়ে ওঠে। গালে লাল আভা জাগে। বলি বলি করে বলে উঠতে পারে না ঠিক। কানন আবার জিজ্ঞেস করে, “বলো তো!”
“চলো সিলেটে যাই। বিস্তৃত চা বাগানের মাঝখানে টিলার ওপর ছোট্ট একটা রিসোর্টে কিছুদিন নিরবিলিতে কাটিয়ে আসব। জনশূন্য জায়গায় রিসোর্টটা থাকবে, বারান্দায় বসলে আশেপাশে কোনো মানুষ দেখা যাবে না, শুধু তুমি আর আমি। চারদিকে পাখিদের ডাকাডাকি, ঝুপ করে সন্ধ্যা নামা, সিলেটের মজার চা…এর মাঝে ঝর্ণা দেখতে যাব, চা বাগান ঘুরব, জাফলং যাব… আমার অনেকদিনের শখ জানো? আমি একজনের সিলেট ভ্রমণের কাহিনী পড়েছিলাম৷ তখন থেকে। নিয়ে যাবে?”
কানন ইলার কাছে এসে গালে আলতো করে টোকা দিয়ে বলল, “যাব।”
ইলা দু’হাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরল কাননকে। সবকিছু স্বপ্নের মতো সুন্দর কাটছে। কাননের মনে হয় এত সুখ কপালে ছিল বলেই তার মাঝের দিনগুলো অত কষ্টে কেটেছে।
***
তুলনের আজকাল ভালোই সময় কাটছে বাচ্চাদের সাথে। সকালে পরিপাটি হয়ে স্কুলে যায়। বাচ্চাগুলোকে খুব আদর করে সে। ওরাও তার ভক্ত হয়ে উঠেছে। তুলন মিস বলতে সব পাগল। অন্যান্য স্টাফদের সাথেও ভালো জমে গেছে তুলনের। আগের উচ্ছ্বলতা ফিরে আসছে একটু একটু করে। ক্লাস শেষে প্রায় সমবয়সী কলিগদের সাথে চায়ের দোকানে খানিক আড্ডা দেয়। আবার কলেজে গিয়ে নিজের ক্লাসেও মন দেয়। ছুটির পর ঘুরে বেড়ায় বন্ধুদের সাথে। জীবনটা নতুন আলো নিয়ে নিজেকে মেলে ধরেছে তুলনের কাছে।
প্রথম যেদিন সে বেতন পেল, বাসার সবার জন্য কিছু না কিছু কিনল। তার বেতন অল্পই, তবু চেষ্টা করল কিছু একটা কিনতে।
মায়ের হাতে যখন একজোড়া এমিটিশনের চুড়ি পরিয়ে দিল সে, তখন মা ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন। বাবাকে দেয়া ঘড়িটা দেখা গেল একটু পরপর ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছেন তিনি। তুলনের বুক ভরে গেল।
(চলবে)