#তোমার_নামে_আমাকে_ডাকো
#লেখিকাঃ সারজীন ইসলাম
|পর্ব-০৪|
জমিদার বাড়ির সকলে ঢাকার শহরের নামকরা এক হসপিটাল করিডোরে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের চোখে-মুখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। চিন্তার কারণ হচ্ছে জমিদার রাহাত খান চৌধুরী। তিনি আজ সন্ধ্যার কিছুক্ষণ আগে উত্তেজিত হয়ে বুকে ব্যথায় জ্ঞান হারায়। বাবার এমন অবস্থা দেখে তার বড় ছেলে রায়হান খান চৌধুরী আর এক মুহূর্ত কালবিলম্ব না করে ইমার্জেন্সি ঢাকার নামকরা হসপিটাল নিয়ে আসে। রাহাত খান চৌধুরীর হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে সবাই ধারণা করে বিকেলবেলা তার ছোট ছেলে মামুন খান চৌধুরীর বলা কথাগুলো। মামুন খান চৌধুরি বিকেলবেলা সবাইকে ডেকে জানায়, সে তার স্ত্রীকে ডিভোর্স দিচ্ছে তারা আর একসঙ্গে থাকতে চাইছি না। মামুন খান চৌধুরী এমন কথা শুনে তার বাবা তার সঙ্গে রাগারাগি করে উত্তেজিত হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ে। ঘন্টা খানেক পরে ইমার্জেন্সি রুম থেকে বেরিয়ে আসে ডক্টর মিথিলা। ডক্টর মিথিলা বেরিয়ে আসা মাত্র ঘিরে ধরে সবাই তাকে। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করার আগে ইমন খান চৌধুরী মিথিলার দিকে তাকিয়ে চিন্তিত গলায় বলল,
‘ দাদুভাই এখন কেমন আছে মিথিলা?’
মিথিলা ছোট নিঃশ্বাস ফেলে নিচু স্বরে বলল,
‘ ভালো নেই দাদুভাই। আজ নিয়ে দুই দুই বার দাদুভাই হার্ট অ্যাটাক করেছে। এরপরে যদি দাদুভাই আল্লাহ না করুক আবার উত্তেজিত বা রাগারাগী করে অসুস্থ হয়ে পড়ে তাহলে তাকে বাঁচানো সম্ভব হয়ে পড়বে।’
পাশ থেকে ইরা খান চৌধুরী অবাক গলায় বলল,
‘ দাদুভাই আজ আবার হার্ট অ্যাটাক করেছে?’
রায়হান খান চৌধুরী খানিকটা উত্তেজিত গলায় বলল,
‘ মিথিলা মা, বাবার এখন কী অবস্থা? বিপদ মুক্ত তো তিনি এখন?’
মিথিলা দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে বলল,
‘ সিনিয়র ডাক্তাররা এখনো দেখছে দাদুভাই কে, সিনিয়রের ডাক্তাররা আলোচনা করছে দাদুভাই একটু সুস্থ হলে তাকে চেন্নাই নিয়ে যাওয়ার জন্য রেফার করবে।’
মিথিলার কথা শুনে সবাই চুপ হয়ে যায়। মামুন খান চৌধুরি সব কথা শুনে অপরাধবোধে মাথা নিচু করে আছে। আজ তার কারনে তার বাবার এই অবস্থা। হসপিটালে পরিবারের মানুষ বলতে হাতে গোনা কয়েকজন আছে, বাকি সবাই আছে বাড়িতে। রায়হান খান চৌধুরী নির্দেশে তারা বাড়িতে আছে। রায়হান খান চৌধুরীর মতে এই মুহূর্তে হসপিটালে অধিক মানুষের আনাগোনা প্রয়োজন নেই। মিথিলা ইমনের দিকে তাকায়। মানুষটা আকাশ সমান চিন্তায় তলিয়ে আছে। লোকটাকে মিথিলা আজ থেকে চিনে না। পরিচয় তাদের বহুদিনের, দিন মিলাতে গেলে হাতে গোনা তিন বছরের বেশি সময় ধরে সে মানুষটাকে চিনে। ইমনের সঙ্গে পরিচয়ের কয়েক মাস পরে ঘটে ওদের মধ্যে প্রণয়। সেই থেকে একসাথে আছে ওরা। হাজার ঝগড়া মান অভিমান নিয়ে একে একে দিন পার করেছে ওরা। ইমন ছেলেটা বড্ড বদমেজাজী স্বভাবের। কারণে অকারণে রেগে যায়। নিজেদের পারিবারিক কয়েকটা ব্যবসা থাকা সত্ত্বেও সে তার বাবার মত অল্প বয়সে রাজনীতিতে যোগ দিয়েছে। কথায় আছে না কাজে মানুষের পরিচয়, ইমন তা প্রমাণ করে দিয়েছে। অল্প বয়সের মধ্যে নিজের ভালো নাম ডাক করে ফেলেছে। এত নাম ডাকের উপরে ইমনের কাছে তার পরিবার। এরজন্য ইমন কে মিথিলার এত ভালো লাগে। আজ তার দাদুভাইয়ের এমন অবস্থা দেখে না জানি তার মনের অবস্থা কেমন? হয়তো দাদুভাইয়ের চিন্তায় মনে মনে অস্থির প্রায়। এই ভাবে বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস ফেলে মিথিলা।
——————-
আজ নিঝুমের বিয়ের রং উৎসবের অনুষ্ঠান ছিল। হাসি আনন্দ হইহুল্লোড় মধ্যে দিয়ে কেটে গেছে দিনটা। এত হাসি আনন্দে মধ্যেও ইধা তাতে সামিল হতে পারিনি। ইধার হঠাৎ করে অস্ট্রেলিয়া আসার কথা শুনে লিওনি ম্যান্ডেলা তার সাথে দেখা করার জন্য অনুরোধ করে। হলিউড মুভির অসাধারণ একজন ডিরেক্টর তিনি। একটা অ্যাওয়ার্ড সাথে পরিচয় হয় ইধার সঙ্গে তার। সবে একটা মুভির শুটিং শেষ করে তার হাসবেন্ডের সঙ্গে বেড়াতে এসেছেন তিনি এখানে। তিনি বেড়াতে আসলেও তার হাসবেন্ড কিন্তু আদৌ বেড়াতে আসে নি। সে তার বিজনেস ডিলের জন্য অস্ট্রেলিয়া এসেছেন। সঙ্গে নিয়ে এসেছে তার প্রিয়তমা স্ত্রীকে। তার সঙ্গে দেখা সাক্ষাত করে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যায় ইধার। বসার ঘরে কারো উপস্থিত লক্ষ্য না করে ইধা তার নিজের রুমে চলে আসে। হয়তো সারাদিন ধরে রং খেলে সবাই ক্লান্ত হয়ে নিজ নিজ ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছে, তাই ভেবে ইধা ফ্রেশ হয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। চোখ বুজার কয়েক মুহুর্ত পরে নিজের ঘরে কারো উপস্থিতি টের পায় ইধা। চোখ খুলে তাকায় ইধা। নাদিয়া আহমেদ তার রুমে দাঁড়িয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ইধা শোয়া থেকে উঠে বসে নাদিয়া আহমেদ এর দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বলল,
‘ মামনি তুমি? কিছু বলবে?’
নাদিয়া আহমেদ হেঁটে এসে ইধার পাশে বসে মৃদু স্বরে বলল,
‘ কিছু বলতে হলে তোর কাছে আসতে হবে? তাছাড়া তোর কাছে কী আসা যাবে না?’
ইধা হাসে। হেসে ঠোঁট প্রসারিত করে বলল,
‘ ধুর তুমিও না। নেও এখন আমার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দেও তো।’
ইধা শুয়ে পড়ে নাদিয়া আহমেদের কোলে মাথা। নাদিয়া আহমেদ হেসে ইধার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
‘ রুহি আজ তোর উপরে বেজায় ক্ষেপে আছে। রুহি তোকে এখানে এনেছে কী জন্য? বিয়ের অনুষ্ঠানে আনন্দ হৈ-হুল্লোড় করার জন্য। কিন্তু তুই কী করেছিস? আজ রং খেলার অনুষ্ঠান ছেড়ে সাত সকালবেলা বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছিস। কেন এমন করেছিস মা? তোর কী অন্য সব মেয়েদের মতো আনন্দ উৎসব করতে ইচ্ছে করে না?’
ইধা পাশ ঘুরে নাদিয়া আহমেদ এর কোমর জড়িয়ে ধরে বলল,
‘ ইচ্ছে করে তো, খুব ইচ্ছে করে। আমিও চেয়েছিলাম আজকের অনুষ্ঠান অ্যাটেন্ড করতে কিন্তু হঠাৎ করে লিওনি ম্যান্ডেলা ফোন করে তার সঙ্গে দেখা করার জন্য অনুরোধ করে, তাই তার কথা আর ফেলতে পারিনি। জানো, লিওনি ম্যান্ডেলা হাসবেন্ডের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়েছে, ভিশন অমায়িক ব্যবহার তার। সবচেয়ে মজার ব্যাপার কী জানো? লিওনি ম্যান্ডেলা এবং তার হাজবেন্ড দুজনের বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল। দু’জন দু’জনকে অসম্ভব ভালোবাসে কিন্তু কেউ কারো কাছে স্বীকার করে না। লিওনি ম্যান্ডেলা এর হাসবেন্ড বলে তার ঝগড়া করার সঙ্গী হিসেবে লিওনি ম্যান্ডেলা কে তিনি বিয়ে করেছেন। তবে আসল সত্যি কী জানো? লিওনি ম্যান্ডেলা এর হাজবেন্ড তাকে চোখে হারায়। বিজনেস এর জন্য দূরে কোথাও গেলে লিওনি ম্যান্ডেলা কে সঙ্গে করে নিয়ে যায়, তাতে যদি লিওনি ম্যান্ডেলা শুটিং ক্যানসেল করতে হয় তো ক্যানসেল করবে অন্যথায় কোনো নোটিশ ছাড়াই লিওনি ম্যান্ডেলা এক প্রকার কিডন্যাপ করে তার সঙ্গে নিয়ে যায়। দু’জন দু’জনকে ভিশন ভালোবাসে, কেউ কাউকে ছাড়া এক দন্ড থাকতে পারে না, অথচ দেখো কেউ কারো কাছে স্বীকার করেনা তাদের ভালোবাসার গভীরতা, কী অদ্ভুত ভালোবাসো তাদের!’
ইধা নাদিয়া আহমেদের সঙ্গে গল্প করতে করতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ে তার কোলে। নাদিয়া আহমেদ সাবধানে ইধা কে শুইয়ে দিয়ে ধীর পায়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।
——————-
ইধা ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে করিডর পেরিয়ে সিঁড়ির দিকে যাচ্ছিল। হঠাৎ কারও কণ্ঠস্বর শুনে থমকে দাঁড়ায়। ঘাড় ঘুরিয়ে পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখে সাত-আট বছরের একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেটা এক প্রকার লাফিয়ে লাফিয়ে ইধার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল,
‘ তুমি না আমার ভাইয়ার গার্লফ্রেন্ড?’
ইধা চমকায় বাচ্চা ছেলের কথা শুনে। কী বললো বাচ্চাটা কার গার্লফ্রেন্ড ও? ইধা ভুরু কুঁচকে বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ বাবু তুমি কী বলছো এগুলো? গার্লফ্রেন্ড? কার গার্লফ্রেন্ড? তুমি বোধহয় আমাকে অন্য কারো সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেছে। আমি কারো গার্লফ্রেন্ড টার্লফ্রেন্ড নই।’
ইধার কথা শুনে বাচ্চাটা ঠোঁটে ফুলিয়ে হেসে বলল,
‘ তোমার কী আমাকে বোকা মনে হয়? যে আমি তোমাকে অন্য কারো সাথে গুলিয়ে ফেলবো? আমি জানি তুমি আমার ভাইয়ার গার্লফ্রেন্ড। তুমি কী আমার ভাইয়াকে অস্বীকার করছো? কিন্তু তুমি তো কালকে রাতে ভাইয়ার প্রপোজ সানন্দে গ্রহণ করেছো।’
ইধা এতক্ষণে বুঝতে পারে বাচ্চা ছেলেটা এতক্ষণ ধরে ওকে কী বলছিলা। নিঝুম এবং তাঁর কাজিনদের মুখে এই দুষ্টু ছেলে অনেক প্রশংসা শুনেছে ইধা। ইধা এই বাচ্চা ছেলের হাবভাব দেখে নিঃসন্দেহে বলতে পারে এই ছেলেটাই তাজ। ইধা নিচের ঠোঁট কামড়ে হেসে বলল,
‘ ওহ আচ্ছা, তুমি বুঝি আমার দুষ্টু হবু দেওর!’
চলবে….