#তোমার_নামে_আমাকে_ডাকো
#লেখিকাঃ সারজীন ইসলাম
|পর্ব-১২| সংযোজিত অংশ ( দ্বিতীয় খন্ড )
প্রকৃতির নিয়মে দিন শেষ হয়ে সন্ধ্যা নামে। ধীরে ধীরে কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করছে চারিপাশে। সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে হিম বাতাস। এই হিম বাতাসের মধ্যে এক দৃঢ় ইচ্ছা নিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে শীতকে উপেক্ষা করে বসে আছে ইধা। ইচ্ছে করছে না বাড়ি ফিরতে। বাড়ি ফিরে গেলেই আমার বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা হবে। মায়ের মমতাময়ী চেহারা নিয়ে স্নেহ ভরা চোখে তাকালে ইধা সেই দৃষ্টি উপেক্ষা করতে পারবে না। হয়তো সব মান অভিমান ভুলে ঠাঁই নিবে মায়ের বুকে। হিম বাতাস ধীরে ধীরে বেড়ে চলেছে। সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শীত। ইধা শীতের মধ্যে নিজেকে টিকিয়ে রাখতে না পেরে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। বসা থেকে উঠলে তার আগে কারো পায়ের আওয়াজ শুনে থমকে যায়। ভাবে এই নির্জন জায়গায় কে আবার এলো? উত্তরের অপেক্ষা না করে ইধা উঠে দাঁড়ালো। তারপর পরে কারো ‘আপু’ বলে ডাক শুনে পায়। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় মৃদু কৃষ্ণ নিমজ্জিত অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে ইরা হেঁটে আসছে। ইধা ইরাকে দেখে আনমনে হেসে ফেলে। মেয়েটার নিজ জীবনে কষ্টের শেষ নেই। আবার অন্য কারো দুঃখ কষ্টের ভাগ নিতে চার কদম এগিয়ে থাকে মেয়েটা। ইধার ভাবনারা সমাপ্তি ঘটে ইরা মৃদু স্বরে।
‘ আপু তুমি এখানে? এদিকে বাড়ির সবাই তোমাকে কোথায় কোথায় খোঁজ করছে তুমি জানো?’
ইরা থেকে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নেয়। ইধা তাকায় মেয়েটার দিকে। হয়তো মেয়েটা দৌড়ে এখানে এসেছে তার জন্য নিঃশ্বাস জোরে জোরে ওঠানামা করছে। ইরা ইধার দিকে তাকিয়ে মৃদু চিৎকার করে বলল,
‘ তুমি এই শীতের মধ্যে পাতলা ফিনফিনে জামা পড়ে আছো, গরম জামাকাপড় না পড়ে?’
ইধা উত্তর না দিয়ে হাসি মুখে বলল,
‘ তুমি এখানে? আমার খোঁজ পেলে কীভাবে?’
ইরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
‘ আপু তুমি আমার সেই আগের নীরা আপু হয়ে যেতে পারো না? যে আমার সঙ্গে দুষ্টুমি করবে? আমার জন্য অন্যদের সঙ্গে মারামারি করবে? যে কথায় কথায় বলবে, ইরা এটা এভাবে না ঐ ভাবে হবে। ইরা তোর কী বুদ্ধিশুদ্ধি কখনো হবে না?’
ইধা কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে বলল,
‘ তোমার সঙ্গে এখন আর তুই শব্দটা যায়না। তুমি শহরের নামকরা ভার্সিটির একজন লেকচারার। তোমাকে যদি তুই করে বলি তাহলে লোকে কি বলবে?’
কথাটা শেষ করে ইধা হেসে ফেলে। ইরা অভিমানে গাল ফুলিয়ে বলল,
‘ ওহ আমি লেকচারার বলে এখন আর আমাকে তুই বলা যাবে না?’
ইধা সঙ্গে সঙ্গে বলল,
‘ আমি এখনে আছি তা তুই জানলি কীভাবে?’
ইরা ইধার মুখে সেই চিরচেনা আপন ডাক শুনে অন্তরালে খুশির জোয়ারে ভাসতে থাকে। কতগুলো বছর পরে আবার সেই ডাক শুনতে পেয়েছে ইরা।
গাড়িতে উঠার পরে ইরা নিজের সাইট ব্যাগ থেকে একটা শাল বের করে ইধা কে দেয় জড়িয়ে নেওয়ার জন্য। শীতে হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। তবু মুখ ফুটে কিছু বলেনি মেয়েটি। ইরা ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকিয়ে কিছু একটা দেখে বলল,
‘ তুষার ভাইয়ের গাড়ি এখনো আমাদের গাড়ির পিছনে দাঁড়িয়ে আছে।’
ইধা হেসে বলল,
‘ ওহ যাবে না। যতক্ষণ পর্যন্ত না আমি এখান থেকে যাচ্ছি ততক্ষণ ও এখান থেকে যাবে না। দেখলি না কিভাবে আমার লোকেশন ট্র্যাক করে তোকে নিয়ে এখানে চলে এসেছে। ছাড় ওসব কথা আমার তোর সঙ্গে কিছু ইমপর্টেন্ট কথা আছে।’
ইরা ভ্রু কুঁচকে তাকায়। ইধা নিঃশ্বাস নিয়ে বলল,
‘ তুই তোর জীবনটাকে নতুন করে আবার শুরু করছিস না কেন? ওই রাস্কেল টার জন্য তুই কেন একাকীত্ব বেছে নিবি? তুই কি কখনো প্রশ্ন করেছিস নিজেকে ওই রাস্কেল টা তোকে আদৌ ভালোবাসতো কী না? আমি বলছি শোন, ওই রাস্কেল টা তোকে কখনো ভালোবাসিনি। শুধু রিভেঞ্জস নিতে ভালোবাসার অভিনয় করেছে। তুই হয়তো জানিস না ওদের ফ্যামিলির সঙ্গে আমাদের ফ্যামিলির পূর্ব শত্রুতা রয়েছে। তার উপরে ইমন ভাইয়া ওই রাস্কেল টাকে মেয়েদেরকে ইভটিজিং করার জন্য রাস্তায় ফেলে মারধর করেছিল। ক্ষমতায় আমাদের সঙ্গে পারবে না বলে, তোর মাধ্যমে প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিল। তার আগেই ওই রাস্কেল টার ফ্যামিলি তার জন্য বিয়ে ঠিক করে ফেলে। আল্লাহর কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া আদায় কর অল্পের জন্য মস্ত বড় বিপদের হাত থেকে বেঁচে গেছিস।’
ইধা থেমে ইরার দিকে তাকালো। মেয়েটার চোখেমুখে বিষ্ময় ছাপ। মেয়েটা হয়তো তার প্রাক্তন প্রেমিকের সম্পর্কে এসব কিছুই জানত না। ইরার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে আর কিছু না বলে গাড়ি স্টার্ট দেয়।
ভার্সিটি ওঠার সঙ্গে সঙ্গে কিশোরীর মনে আবেগ অনুভূতি কাজ করতো ইরার। স্বপ্ন ছিল কেউ একজন আসবে তার জীবনে যে তাকে নিজের থেকেও বেশি তাকে ভালোবাসবে। জীবনের সাকিবের আবির্ভাবে মনে করেছিল জীবনটাই রঙিন হয়ে গেল। কিন্তু না সে যে পাক্কা এক বছরের মতো সময় ধরে অভিনয় করে গেছে তার সঙ্গে। এত নিখুঁত অভিনয় কোন ফিল্মস্টার কে হার মানাবে। মানুষটার বিয়ের খবর শুনে পাগলের মত করেছিল মেয়েটা। কিন্তু মেয়েটা তো জানতো না ওই হৃদয় বিহীন মানুষটা ওর সঙ্গে দিনের পর দিন অভিনয় করে গেছে শুধু প্রতিশোধ নেওয়ার আশায়। মানুষটার বিয়ের পর নিজেকে সবকিছু থেকে গুটিয়ে নিতে শুরু করে। একে একে বন্ধু-বান্ধব থেকে দূরে সরতে শুরু করে। নিজেকে হাজার কাজের মধ্যে ব্যস্ত করে রাখতে শুরু করে। আজ যদি ইধা এসব কথা না বলত তাহলে হয়তো এই সব কিছুই অজানা থেকে যেত। ইরার এখন আফসোস হচ্ছে। কেন এই সময় আবেগে গা ভাসিয়ে ছিল?
—————-
জমিদার বাড়ি থেকে দশ মিনিটের দূরত্বে অবস্থিত একটা রেস্তোরাঁয় ইরা আর ইধা অপেক্ষা করছে খাবার আসার জন্য। ইরা বুঝতে পেরেছে ইধা বাড়িতে গেলে আর খাওয়া-দাওয়া করতে চাইবে না তাই ইধা কে জোর করে এই রেস্তোরাঁয় নিয়ে এসেছে। ইরা আর ইধা ভিআইপি কেবিনে বসেছে। যেন খাওয়া-দাওয়ার সময় কেউ মুখ দেখে অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো ঘটনা না ঘটতে পারে তাই এই ব্যবস্থা। ওয়েটার এসে খাবার পরিবেশন করে দিয়ে গেছে। দুজনে খাওয়া শুরু করলে ইরা মৃদু স্বরে বলে,
‘ আপু তুমি তো এবার অনেকদিন দেশে আছো। আমার একটা অনুরোধ রাখবে? অবশ্য আমার একার অনুরোধ নয় দিঘীরো এই একই অনুরোধ। কিন্তু বেচারী তোমার সঙ্গে কথা বলতে ভয় পাচ্ছে।’
ইধা কপাল ভাঁজ করে ইরার দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ কী কথা?’
ইরা খাওয়া থামিয়ে বলল,
‘ কাল দিঘীর বন্ধু রাজুর জন্মদিন। তুমি কল্পনা করতে পারবে না ছেলেটা অসম্ভব ভালো। কয়েক বছর হল ওর বাবা মারা গেছে। ওর বাবার পেনশনের টাকা এবং ওর টিউশনির টাকায় কোন মত সংসার চলে ওদের মা ছেলের। অবশ্য রাজুর বড় একটা ভাই আছে। শুধু নামেমাত্র ভাই। তার বিয়ের পর তিনি আলাদা হয়ে যান। কোন খোঁজ খবর নে না রাজু আর ওর মায়ের। অর্থ এবং সময়ের অভাবে রাজু তেমন একটা মুভি দেখে না কিন্তু তাও ওহ তোমার বিশাল ভক্ত। বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে তোমার তিন-চারটে মুভি দেখেছে। সেই থেকে তার একমাত্র ক্রাশ তুমি। তাই দিঘী চাইছে রাজুর জন্মদিনে তোমাকে ওর সামনে নিয়ে গিয়ে একেবারে চমকে দেবে। এই পরিকল্পনার বেপারে দিঘীর বন্ধুরা কিছু জানে না। দিঘী শুধু আমাকে এ কথাটা বলেছে। তাই বলছি তোমার কী সময় হবে কাল?’
ইরার সমস্ত কথা শুনে ইধা ঠোঁটে এক নিদারুণ সুন্দর হাসি ফুটিয়ে তোলে।
চলবে….
নোট : কাল সন্ধ্যা ছয়টায় পরীক্ষা দিয়ে বাসায় ফিরেছি। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে গল্প লিখতে বসে যাই। গল্প লেখার পরে অতিরিক্ত ক্লান্তির কারনে গল্প আর রিচেক করতে পারিনি। আজকেও গল্প রিচেক করার সময় পাইনি। গল্প যদি কোন ভুল ত্রুটি থেকে থাকে তাহলে আমাকে অবশ্যই বলবেন আমি তা সংশোধন করে নেব। ধন্যবাদ।