তোমার নামে আমাকে ডাকো পর্ব-১৮

0
3099

#তোমার_নামে_আমাকে_ডাকো
#লেখিকাঃ সারজীন ইসলাম

|পর্ব-১৮|
জ্যোৎস্নার আলাে-ছায়ার নৃত্যে প্রকৃতি প্রেমী নিসর্গ বিলাসীর শিরা-উপশিরা দুলে ওঠে। আলাের চুম্বনের দাগ প্রকৃতির অধরে। চাঁদের মায়াবী আলােয় রাত কে দিন বলে ভ্রম হয়। এমন স্বগীয় সৌন্দর্য মণ্ডিত রাত মানুষের সমস্ত প্রয়ােজনের অতীত। এ যেন কেবল অকারণ আনন্দ উপভােগের জন্য উদযাপিত। সমস্ত কর্মচাঞ্চল্যের অবসানে, স্বার্থমগ্ন জগৎ-সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এ যেন পরম এক শৈল্পিক উপলব্ধি এক সুন্দর স্বভাব বিরহের মধুরতা। তখন যেন কোন হৃত-জন-মুখ চাঁদের অবয়বে ফুটে ওঠে আর উচাটন মনে অবদমিত বেদনায়। আজ আঠেরো দিনের মত হয়ে গেছে রাহাত খান চৌধুরী ইন্ডিয়া এসেছে। দিন পনের তিনি চেন্নাই শহরের নামকরা হসপিটালে এডমিট ছিলেন। তার ট্রিটমেন্ট এর কোনো ত্রুটি রাখেনি ইধা। দুই দিনের মত হবে রুহিদের বাড়িতে ছিল রাহাত খান চৌধুরী। তিনি হসপিটালে এডমিট থাকা অবস্থায় রুহির বাবা-মা বেশ কয়েকবার গিয়ে তাকে দেখে এসেছে। রুহির মা তার সেবা যত্নে কোন ত্রুটি রাখেনি। রুহি নামের মেয়েটাকে তার বেশ মনে ধরেছে। কি অমায়িক ব্যবহার তার। সারাক্ষণ দাদুভাই, দাদুভাই বলে তাকে মাতিয়ে রাখে। আজ তিনি বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন শুধু রাহাত খান চৌধুরী নয় রুহি এবং রুহির বাবা-মার সঙ্গে যাচ্ছে তার। বলতে গেলে এক প্রকার রাহাত খান চৌধুরী তাদের জোর করে নিয়ে যাচ্ছে। ইধা সেও যাবে তবে সে ঘন্টা কয়েক থেকে আবার ফিরে আসবে। তার নতুন মুভির শুটিং নিয়ে আবার ব্যস্ত হয়ে পড়েছে সে। তবে রাহাত খান চৌধুরীর ট্রিটমেন্ট চলাকালীন সময় যথেষ্ট ফ্রী থাকার চেষ্টা করেছে ইধা। আর একঘন্টা পরে দিল্লির এয়ারপোর্ট থেকে ফ্লাইট উঠবে তারা। বিলাসবহুল গাড়ির জানালার পাশে বসে জোসনাময় আকাশের দিকে তাকিয়ে এইসব ভাবছিল রাহাত খান চৌধুরী। এখন শুধু তার অপেক্ষা কখন তার নিজ নিবাসে ফিরতে পারবে।

—————–

চাঁদনি রাতের স্বতন্ত্র একটি রূপ-বৈচিত্র্য আছে। এমন রাতের সৌন্দর্য উপভােগ ও অবলােকন করা সকলের পক্ষে সম্ভব নয়। এ সৌন্দর্য-সুধা পান করতে চায় ভাবুক মন। চাঁদের আলাে শুধু পৃথিবীকেই আলােকিত করে না, ক্ষণিকের তরে হলেও আলােকিত করে সৌন্দর্য পিপাসু মানুষের মনকে। বিশেষ করে ভাবুক মনে জ্যোৎস্না বপন করে সৌরভ স্নিগ্ধতার বীজ। চাঁদনি রাত আমাদের ভিতরে বহুমাত্রিক উপলব্ধিকে জাগিয়ে তােলে। সে উপলব্ধি যেমন ব্যাপক তেমনি বিচিত্র যেমন গভীর তেমনি অন্তর্মুখী সূক্ষ্মানুভব। বিষন্নতার বাহনে চড়ে বিমল সুন্দর যেমন মূর্তরূপ ধারণ করে তেমনি সৃষ্টিশীল সত্তায় স্বভাব বিরহ অশ্রান্ত অনুরণী হয়। নির্মোহ আনন্দের আতিশয্যে মানুষ মৃত্যুকে বন্ধুর মতাে হাসি মুখে জড়িয়ে ধরে। কেননা, আত্মার আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হলে, মৃত্যুতেও মহাতৃপ্তি বিরাজ করে। আর তা যদি হয় স্বর্গীয় সুন্দর কোনাে মুগ্ধ পরিবেশ, তাহলে তাে কথাই নেই। ইধারা জমিদার বাড়িতে এসে পৌঁছেছে আধা ঘন্টার মত হবে। এরমধ্যে হুলুস্থুল কাণ্ড লেগে গেছে জমিদার বাড়িতে। রাহাত খান চৌধুরীর স্ত্রী কিছুক্ষণ পরপর শব্দ করে কেঁদে উঠছে। তার মতে, তার স্বামী এত দিন ধরে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিল। অথচ কেউ তাকে তার কাছে যেতে দেয়নি। এই নিয়ে তার স্বামীর কাছে তার অভিযোগের শেষ নেই। রাহাত খান চৌধুরী তার স্ত্রীকে শান্ত করে পরিচয় করিয়ে দেয় রুহি এবং রুহির বাবা-মার সঙ্গে। রাহাত খান চৌধুরীর স্ত্রী কান্না থামিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে অতিথি আপ্যায়নের জন্য। ইধা মেজো চাচা চাচী তাদের আদরের মেয়েকে আজ কত বছর পরে কাছে পেয়ে খুশি যেনো তাদের ঠোঁটে ধরে না। তাদের উল্লাস প্রকাশ পাচ্ছে তাদের চোখে-মুখে। অয়ন আর তাজ দু’জনে ইধার দুহাত ধরে ইধা কে নিয়ে সোফায় বসে আছে।

রাতে খাবার টেবিলে রাহাত খান চৌধুরী জানান কাল সকালের ফ্লাইটে ইধা চলে যাবে। এটা শুনে কেঁদে বুক ভাসিয়েছে ইশা চৌধুরী আর আশা খান চৌধুরী। আশা খান চৌধুরী রীতিমতো তার স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া শুরু করে দিয়েছে তার নাতনির যাওয়া নিয়ে। রাহাত খান চৌধুরী তার স্ত্রীকে শান্ত করে বলল,

‘ গিন্নি তোমাকে একটা কথা বলি মন দিয়ে শোনো, আমাদের নিরা, তোমার কিংবা আমাদের বাড়ি অন্য সব বউদের মত ঘর কন্নার কাজ করে অফুরন্ত সময় পার করে না। এই কটা দিন আমি নিজে দেখেছি, নিরা নিঃশ্বাস নেওয়ার সময় পর্যন্ত পায় না। সকালে মুম্বাইতে শুটিং তো রাতে রাজস্থানের শুটিং। সারাদিন হিল্লি-দিল্লি করে বেড়ায় মেয়েটা। ওর এতো নাম যশ খ্যাতি এমনি, এমনি তো আর হয়নি। হাড়ভাঙা পরিশ্রমের ফলে ও এমন খ্যাতি অর্জন করেছে। নিরার দৌলতে কয়েকজন ডিরেক্টর এসে আমার সঙ্গে দেখা করেছে হসপিটালে থাকা অবস্থায়। তাদের মধ্যে একজন ছিল মিস্টার জেনি, তার মুখে শুনেছি, নিরার সাথে তিনি তিনটি মুভির কন্ট্রাক সাইন করেছেন। তার মতে নিরা হয়তো দুই তিন বছরের মধ্যে তার কোন মুভিতে হাত দিতে পারবে না। দুই এক মাসের মধ্যে নিরা বর্তমানে যে মুভির শুটিং করছে তার জন্য ক্যানাডা চলে যাবে। হয়তো ক্যানাডা থেকে ফিরতে তার এক, দেড় মাস সময় লাগবে। এত ব্যস্ত সিডিউল তার। এত ব্যস্ততার মাঝে যে আমাদের জন্য একটু সময় বের করছে এটাই আমাদের জন্য অনেক কিছু গিন্নি, তুমি আর এই নিয়ে মন খারাপ করোনা।’

এইটুকু বলে থামে রাহাত খান চৌধুরী। কারো উত্তর এর অপেক্ষা না করে ইমনের দিকে তাকিয়ে বলল,

‘ ইমন, কাল সকালবেলা তোমার কোন কাজ আছে?’

ইমন খানিকটা বিচলিত গলায় বলল,

‘ না দাদুভাই। কোন প্রয়োজন ছিল দাদুভাই?’

রাহাত খান চৌধুরী ধীর গলায় বলল,

‘ হুম, প্রয়োজন আছে। কাল সকাল বেলা তুমি তোমার বোনকে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিয়ে আসবে। যতক্ষণ পর্যন্ত না নিরা যে উড়োজাহাজের যাবে সে উড়োজাহাজ আকাশে উঠছে, ততক্ষণ পর্যন্ত তুমি এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে থাকবে।’

————————-

শীতের সকালে গ্রামাঞ্চলে সাধারণ মানুষদের কন কনে ঠান্ডা আর ঘন কুয়াশা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। শীতকালে মাঝে মাঝে শুরু হয় শৈত্যপ্রবাহ। এ সময় তাপমাত্রা খুব নিচে নেমে আসে। হাড় কাঁপানো তীব্র শীত গ্রাম বাংলার মানুষ-জীবজন্তুর সাথে প্রকৃতি অসাড় হয়ে পড়ে। এমন শীতের হাত থেকে হত-দরিদ্র মানুষ বাঁচতে আপ্রাণ চেষ্টা করে। তাদের সাধ্যমত শীতবস্ত্র কেনারও ধুম পড়ে যায়। ফেব্রুয়ারি মাসে এমন হাড় কাঁপানো শীতের দেখা খুবই কমই মেলে। গতকাল মাঝরাত পর্যন্ত কেমন ভাবসাব গরম লাগছিল ইধার। ভোরের দিকে শীতে হাড় কাঁপিয়ে আনে ইধার। শীতের কোন পোশাক সঙ্গে না নিয়ে আসায়, দাদিমার শাল জড়িয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়েছে ইধা। একনজর সামনে তাকায়, ড্রাইভার সেট এর পাশের সিটে বসে আছে ইমন ভাইয়া। দাদুভাইয়ের কথা রাখতে তাকে পৌঁছে দিতে এই কন কনে শীতে তার সঙ্গে বের হয়েছে বাড়ি থেকে। এসব ভেবে ইধা গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। শীতের সকালে ও রাতে ছিন্নমূল মানুষ আগুন জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা চালায়। শীতের সকালে শহর এবং গ্রামে শিশু, যুবক বা বৃদ্ধসহ সব বয়সের মানুষকে যেন আগুনের কুন্ডলী তৈরি করে উত্তাপ নিতে দেখা যায়। এ আগুন জ্বালিয়ে উত্তাপ নেওয়ার মধ্যেই রয়েছে আলাদা এক অনুভূতি। অনেক দেরিতেই ওঠে সূর্য। প্রকৃতির ওপর সূর্যের নির্মল আলো ছড়িয়ে পড়ে। তাই তো মনে হয়, সূর্যের আলোতে কোনো তেজ নেই। শীত মৌসুমে ফসল তোলা মাঠ যেন দিগন্তব্যাপী সীমাহীন এক শূন্যতা বিরাজ করে। আসলে ভালো আর মন্দের সমন্বয়েই যেন এই শীত। সুতরাং এই শীতের সকালেই কনকনে ঠান্ডা আর ঘন কুয়াশাতে সব কিছু জড় সড় হয়ে আসে, সামনের কোনো কিছুই ঠিক মতো দেখা যায় না, সব কিছু যেন খুব অস্পষ্ট মনে হয়। কখনো কখনো কুয়াশার স্তর এত ঘন থাকে যে, দেখলে মনে হয় সামনে কুয়াশার পাহাড় দাঁড়িয়ে আছে। কোনো কোনো এলাকায় ঘন কুয়াশার সঙ্গেও ঝিরিঝিরি শিশির বিন্দুর অপরূপ দৃশ্য চোখে পড়ে। কুয়াশা ভেদ করে সূর্য মামার উঁকি দেয়া প্রকৃতির রঙিনতা আবহমান বাংলার সকল জনপদ রাঙিয়ে তোলে। রাস্তায় গাড়িগুলো চলে হেডলাইট জ্বালিয়ে। তার মধ্যেই যেন শীতের রংবেরঙের বিভিন্ন পোশাক গায়ে জড়িয়েই মানুষ ছুটে চলে কাজের নিমিত্তে নিজ গন্তব্যে।

হঠাৎ করে গতকাল রাতের কথা মনে পড়ে যায় ইধার। রাত হয়তো তখন দুটোর বেশি বাজে। দরজায় লাগাতার কড়া নাড়ার শব্দে ইধা ঘুম ঘুম চোখে দরজা খুলে তাকায়, মাঝরাতের দরজার সামনে নিলাংশ কে দেখে চমকে উঠে ইধা। বিস্ময় গলায় নিয়ে নিলাংশের দিকে প্রশ্ন করে, ‘আপনি এখন এখানে?’ নিলাংশ আমতা আমতা করে প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনি। ইধা বুকে দুহাত গুঁজে নির্ভীক ভাবে দাঁড়িয়ে নিলাংশ কে নিখুঁত চোখে পর্যবেক্ষণ করে গেছে। আচমকা নিলাংশ ইধার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,

‘ তুমি নীরের নিরা! শুধু নীরের নিরা।’

কথাটা বলে আর এক মুহূর্ত দাঁড়ায়নি, হনহনিয়ে চলে গেছে সেখান থেকে। ইধা ভুরু কুঁচকে তাকায়। ইধার জানা মতে নিলাংশ সাহেব তাকে ‘আপনি’ বলে সম্মোধন করতো কিন্তু হঠাৎ করে আচমকা ‘তুমি’ বলার কারণ খুঁজে পাচ্ছে না ইধা। আর ‘নীরের নিরা’ ই বা কে?

আচমকা বিস্ফোরিত শব্দ শুনে ইধা তার ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে আসে। ইধা কৌতুহলী চোখে আশেপাশে তাকায়। তাদের গাড়ি মাঝ রাস্তায় থেমে গেছে। আশেপাশের মানুষজন দিক বিদিক ভুলে ছোটাছুটি করছে। ইধা কিছু বলবে তার আগে ইমন ঘাড় ঘুরিয়ে ইধার দিকে তাকিয়ে চিন্তিত গলায় বলল,

‘ বোন, একদম গাড়ি থেকে নামবি না। যা কিছু হোক না কেন নিজেকে শক্ত করে গাড়িতে বসে থাকবি। আমি যে কোনো ভাবে কিছুক্ষণের মধ্যেই রাস্তা ক্লিয়ার করে দেবো, ড্রাইভার আঙ্কেল তোকে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দেবে। তুষার তোর বডিগার্ড নিয়ে পিছনের গাড়িতে আসছে। তাকে আমি ফোনে মেসেজ করে দিয়েছি। তুষার তোকে সেভলি মুম্বাইতে নিয়ে যাবে।’

ইধা এইটুকু অনুমান করতে পারছে কোন বড়োসড়ো বিপদ ঘটতে চলেছে তাদের সঙ্গে। তার ভাই তাকে বিপদে পড়ার আগেই বিপদ থেকে রক্ষা করার কথা ভেবে ফেলেছে। ইধা আতঙ্কিত গলায় বলল,

‘ কী হয়েছে? এমন করছো কেনো?’

ইমন রাস্তার দিকে তাকায়। তাদের গাড়ি থেকে খানিকটা দূরে কিছু লোক গাড়ি ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ করছে। এই কন কনে শীতের মধ্যে ইমন দরদরিয়া ঘামতে শুরু করে, জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,

‘ কিছুদিন আগে বিরোধী দলের সঙ্গে সাংঘাতিক ঝামেলা হয় আমাদের দলের। ওই ঝামেলায় ওই দলের দুজন নেতা মারা গিয়েছে, আরো কয়েকজন আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি আছে। কয়েকদিন ধরে তাদের টার্গেট ছিলাম আমি এবং আমার ডান হাত শফিক। আজ হয়তো কোনো ভাবে জানতে পেরেছে আমি এই রাস্তা দিয়ে যাবো, তাই ওই দলের ছেলেপেলে গুলো এই ভয়ানক অগ্নিকাণ্ডের শুরু করেছে। কিন্তু তুই একদম চিন্তা করিস না, আমি তোকে সেভলি পৌঁছে দেওয়ার সব ব্যবস্থা করব। তারপর আমি দেখবো ওই শালার কত বড় কলিজা যে আমার ওপরে হামলা করতে আসে।’

ইমন আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে গাড়ি থেকে নেমে পড়ে। ইধা কিছু বুঝে উঠার আগেই দেখে ইমন গাড়ি থেকে নেমে মারামারি শুরু করে দিয়েছে। ইধার চোখে মুখে আতংক। না জানি কোন বিপদ তাদের জন্য সামনে অপেক্ষা করছে।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here