#তোমার_নামে_আমাকে_ডাকো
#লেখিকাঃ সারজীন ইসলাম
|পর্ব-১৮| সংযোজিত অংশ
মুহুর্তের মধ্যে পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যেতে দেখছে ইধা। ইধার গাড়ির সামনে দুটো গাড়ির পরের গাড়িটাতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে বিরোধী দলের ছেলে পেলেরা। দাউদাউ করে জ্বলছে আগুন। টায়ার পুড়িয়ে রাস্তা অবরোধ করে ফেলেছে। কাঁচের বোতলে কেরোসিন আর আগুন লাগিয়ে গাড়ি ঘোড়ার দিকে ছুঁড়ে মারছে। দম বন্ধ কর পরিবেশ। তুষার আর ইধার অন্যান্য বডিগার্ডরা ইমনের সঙ্গ দিয়ে পরিস্থিতি প্রতিকুল আনার চেষ্টা করছে। কিন্তু বিরোধী দলের সংখ্যা তো আর কম নয়। তাদের কার্যকলাপে বলছে, এটা তাদের পূর্ব পরিকল্পিত প্লান। না হলে এমন আটঘাট বেঁধে নামা তো মুখের কথা নয়। ইধা আর গাড়িতে বসে থাকতে না পেরে, নেমে পড়ে গাড়ি থেকে। ড্রাইভার বারংবার নিষেধ করেছে তাকে গাড়ি থেকে নামতে। কিন্তু ইধা তার কথা না শুনে গাড়ি থেকে নেমে পড়ে।
ইমন পরিস্থিতি অনেকটা সামলে নিয়েছে। এখন শুধু তার বোন কে এখান থেকে বের করে নিয়ে যেতে পারলে তবেই সে প্রাণ খুলে নিঃশ্বাস নিতে পারবে। ইমন যখন এসব ভাবতে, ভাবতে অন্যমনস্ক হয়ে মারামারি করছিল তখন কারো আর্তনাতে শুনে তৎক্ষণাৎ পিছন ফিরে তাকায় ইমন। বিধ্বস্ত চোখে তাকিয়ে আছে ইমন ইধার দিকে। ইধার কপাল বেয়ে রক্তের স্রোত বয়ে যাচ্ছে। তার পরনে অফ হোয়াইট রঙের ড্রেসে ইতিমধ্যে রক্তের ছোপ ছোপ দাগ পড়ে গেছে। ইমন তার প্রাণাধিক প্রিয় বোনের এই অবস্থা দেখে বেসামাল হয়ে পড়ে। যেনো অন্য একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেছে সে। আবছা আবছা দৃষ্টিতে দেখতে পাচ্ছে তুষার ইধা কে ধরে সামনের লোক গুলোর দিকে তাকিয়ে চিৎকার চেঁচামেচি করছে। কারো ধাক্কায় ইমন ঘোর থেকে বেড়িয়ে এলে দৌড়ে চলে তার বোনের কাছে। তুষারের কাছ থেকে ইধা কে ছাড়িয়ে নিয়ে নিজের বুকে আগলে রেখে, উত্তেজিত গলায় ইধার গালে হালকা হালকা চড় দিয়ে বলল,
‘ এই বোন কি হয়েছে তোর? তুই গাড়ি থেকে নেমেছিলি কেন? আমি তোকে বারণ করিনি গাড়ি থেকে নামতে? এই বোন কথা বলো? কি হয়েছে তোর? এই বোন!’
ইধার জ্ঞান নেই, হয়তো আঘাত পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান হারিয়েছে। তুষার ইমনের দিকে তাকিয়ে ব্যতিব্যস্ত গলায় বলল,
‘ স্যার এখন এখানে দাঁড়িয়ে আমাদের সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না। ম্যাম কে এক্ষুনি হসপিটালে এডমিট করতে হবে। এখন প্রতিটা সেকেন্ড আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ।’
তুষারের কথা শুনে ইমন রাস্তার দিকে তাকায়, এই মুহূর্তে এখান থেকে গাড়ি নিয়ে বেরনো অসম্ভব। কিন্তু তাকে তার বোনকে নিয়ে যে কোনো মূল্যে এখান থেকে বের হতে হবে। ইমন তুষারের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ আমি বোনকে কোলে নিচ্ছি, তুমি আর গার্ডরা সামনের রাস্তা ক্লিয়ার করো। এখান থেকে গাড়ি নিয়ে বেরনো অসম্ভব। তোমরা সামনে এগিয়ে সিএনজি, রিক্সা যা পাও থামাও আমি বোনকে নিয়ে আসছি। দ্রুত তুষার আমাদের হাতে একদম সময় নেই।’
তুষার আর এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে এগিয়ে যায় সামনের দিকে। ইমন ইধার দিকে এক পলক তাকিয়ে কোলে তুলে নেয় তার ছোট্ট বোনকে।
——————-
শীতকাল যাদের প্রিয় একবাক্যে স্বীকার করে নেবে যে শীতের দুপুর হলো শীতের দিনের সবচেয়ে মোহময়ী পর্যায়। শীতকালে এই সময় প্রকৃতি এক অদ্ভুত মায়াবী রূপে সেজে ওঠে। শীতকালে দিনের সবচেয়ে সুন্দর সময় নিঃসন্দেহে শীতের সকাল হলেও, দিনের সবচেয়ে মোহময়ী পর্যায় হলো শীতকালের দুপুর। অন্যান্য ঋতুর দুপুরের মতন শীতের দুপুর গুলি সাধারণত যৌবনহীনা হয়না। বরং শীতকালের দিনে দুপুর গুলিই শীতের যৌবনকে পূর্ণতা দান করে। শীতের দিনে সকাল থেকে চারপাশের আবহাওয়ায় যে শিহরণ লেগে থাকে, তা দূর করে পৃথিবীতে মুহূর্তের আরাম দান করে শীতের দুপুর। গৃহস্থালির কাজ সেরে মানুষ শীতের দুপুরে গিয়ে বসে শীতের মৃদু রোদে শরীরকে তপ্ত করতে। বাঙালি সংস্কৃতিতে শীতের দুপুরে খোলা জায়গায় জমে ওঠে পরিবারের সদস্যদের সমবেত আড্ডা। শীতকালের কথা শুনে সাধারণত আমাদের মনে প্রথম ভেসে আসে রুক্ষতা, ঝরে যাওয়া, আর শূন্যতার স্মৃতি। সেই জন্যই হয়তো শীত কাব্যেও উপেক্ষিত। ঠিক যেমন আমাদের প্রতিটা মানুষের জীবনে শূন্যতা বা ঝরে পড়া না থাকলে আমরা আনন্দ ও উল্লাসকে উদযাপন করতে পারতাম না, ঠিক তেমনি শীতকাল না থাকলে বাকি পাঁচ ঋতুরঙ্গকে আমরা সাদরে আলিঙ্গন করতে পারতাম না। আমরা যদি আর একটু সংবেদনশীলতার সাথে দেখি, তাহলে বুঝতে পারবো শীত আপন রূপে, আপন অনন্যতায় অনন্য। সম্প্রতি এই শীতকালে আমার এক অনিন্দ্য সুন্দর দুপুরের অভিজ্ঞতা হয়েছিল, যা আমার স্মৃতিপটে চিরকাল অক্ষুন্ন হয়ে থাকবে। টিচার রুমের জানলা দিয়ে পিছনের বাগানের দিকে তাকিয়ে ইরা ঋতুরঙ্গের প্রকারভেদঃ করছিল। তার ভাবনার সমাপ্তি ঘটে কারো উত্তেজিত কণ্ঠস্বর শুনে। জানলা থেকে চোখ ঘুরিয়ে নিয়ে টেবিলের সামনে তাকায়, দিঘী দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখে-মুখে আতঙ্কের ছাপ। দিঘী কোন সমস্যা হয়েছে কিনা ভেবে ভুরু আপনা আপনি কুঁচকে যায়। চিন্তিত গলায় বলল,
‘ কি হয়েছে? এমন দেখাচ্ছে কেন তোকে?’
দিঘী জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে নিতে তালগোল পাকানো কন্ঠে বলল,
‘ আপু, আপু, বড় আপু একসিডেন্ট করেছে।’
কথাটা শোনা মাত্র ইরা চেয়ার থেকে দাঁড়িয়ে যায়। দিঘীর দিকে তাকিয়ে আতঙ্কিত গলায় বলল,
‘ কি বলছিস এসব? সকালের ফ্লাইটে আপুর মুম্বাইতে যাওয়ার কথা। সেখানে এই দুপুর বেলা আপু এক্সিডেন্ট করবে কোথা থেকে? তোর মাথা ঠিক আছে তো?’
দিঘী ক্লাস শেষ করে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে ক্যান্টিনে গেছিল, সেখানে ক্লাসের অন্যান্য বন্ধুদের থেকে শোনে, আজ শহরের রাস্তায় বিশাল ঝামেলা হয়েছে, সেখানে মুম্বাই শহরের নামকরা অভিনেত্রী ইধা চৌধুরী গুরুতর আহত হয়েছে। ব্যাস দিঘী এই কথা শোনা মাত্র আর কালবিলম্ব না করে ছুটে আসে ইরার কাছে। দিঘীর মুখে সমস্ত ঘটনা শোনার পরে ইরা ধুপ করে চেয়ারে বসে পড়ে। টিচার রুমে উপস্থিত কয়েকজন টিচার এসে দিঘী আর ওর বন্ধুদের জিজ্ঞাসা করে কি হয়েছে? রাজু প্রথম থেকে সব কিছু খুলে বলে তাদের। তারা সবকিছু শুনে বেশ বিস্ময় হয়। কিছুদিন আগে তারা সকলেই জানতে পেরেছে ইধা চৌধুরী কোন জমিদারের নাতনি। কিন্তু সে যে রাহাত খান চৌধুরীর নাতনি তা জানতো না তারা। ইরা আর কালবিলম্ব না করে দিঘী কে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে ভার্সিটি থেকে।
চলবে