#তোমার_নামে_আমাকে_ডাকো
#লেখিকাঃ সারজীন ইসলাম
|পর্ব-১৮| সংযোজিত অংশ ( দ্বিতীয় খন্ড )
সন্ধ্যায় যে চাঁদ ছিল পূর্ব গগনে, এখন সে পশ্চিমাকাশে হেলে পড়েছে। অথচ আমার ভিতরে কত সুধা, কত বেদনাই না সে জাগিয়ে। তুলছে। আনন্দ-বেদনায় বিগত দিনের স্মৃতি রােমন্থন করে আমার ভিতরে একটা গুমড়ে মরা অবরুদ্ধ আবেগ কান্না হয়ে বেরােতে চাচ্ছে। আমার চারপাশে একটা নিবিড় শান্তি বিরাজ করছে। পাশের বেত বনে ডাহুকি বিরহী হৃদয়ের আকুল কান্নায় ব্যথার রাগিণী জাগিয়ে তলচ। প্রকতির মনোেহর রূপ-মাধুর্যের লাস্যময়-হাস্যময় স্নিগ্ধ সৌন্দর্যের গভীরে আমার তনুমন সমর্পিত হয়ে আছে। চাদনি। রাতের অন্ধ ভরে বিরহী পাখির করুণ সুর আমার মগ্ন চৈতন্যে সহসা বেদনার ছোঁয়া দিয়ে গেল। পবিত্র এক পরিবেশ শুভ্রতার চাদর গায়ে দিয়ে সজাগ জীবনবােধে আমার হৃদয়ের গভীরে নাড়া দিয়ে গেল। আমার কোনাে মালিন্য নেই নেই কোনাে সাংসারিক দুশ্চিন্তা। জাগ্রত এই রাত আমাকে অনাবিল অনিন্দ্য ভুবনের মহিমাদীপ্ত জ্যোৎস্না-স্নিগ্ধ প্রকৃতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল।
বসন্তের কুয়াশাচ্ছন্ন চন্দ্রালােকিত গভীর রাত্রি। সমগ্র বিশ্ব দ্রিামগ্ন। কোথাও কোনাে সাড়া নেই। দূর-দিগ্বলয় পানে তাকালে মনে হয় রুপালি জ্যোৎস্নায় কুয়াশার সাদা বসন পরে বৈধব্যবেশী কোনাে নারী দাঁড়িয়ে আছে। রাত্রির নিস্তব্ধতা চৌচির করে দূরে দু’একটি কুকুরের চিৎকার। পূর্ণ চাদের নিথর রাত্রির বুকে আমি একা জেগে। একেবারে একা নিঃসঙ্গ অনিকেত। রজতধারায় ঝরনার মতাে চাঁদের রূপ পৃথিবীর বুকে ছড়িয়ে পড়ছে। আমার চেতনাকে আচ্ছন্ন করে ফেলছে। আমি ক্রমাগত গভীর উপলব্ধির অতলে ডুবে যাচ্ছি। অনন্তকাল ধরে চাদ তার আলাে ছড়াচ্ছে। শুধু একটি রাত আমি তার চলমান প্রক্রিয়ার সাথি হয়ে আছি। মহাকালের অসীম কালচক্রে এই রাত, এই দুর্লভ সুন্দর মুহূর্ত আর তাে ফিরে আসবে না। আসবে অন্য চাদনি রাত কিন্তু এই রাত তাে চিরতরেই বিগত হবে। এসব ভেবে আমার ভিতরে একটি অনির্বচনীয় শিহরণ জেগে উঠছে। কী জানি এমন ভাব। ইমন সেই কখন থেকে মিথিলাকে জাপ্তে জরিয়ে ধরে আছে। মিথিলা ইমনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করছে। আজ ইধার এমন অবস্থার জন্য নিজেকে দায়ী করছে ইমন। নিজেই নিজের গ্লানির সাগরে ডুবে যাচ্ছে। মিথিলা ইমনের মাথাটা নিজের কোলে রেখে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে আনমনে আজকে দুপুর বেলার কথা ভাবতে শুরু করে।
গতকাল রাতে মিথিলার হসপিটালের নাইট ডিউটি ছিল বিধায়, আজকে হসপিটালে আসতে আসতে দুপুর হয়ে যায় তার। হসপিটালে এসে দেখে এখন হুলুস্থুল কাণ্ড। হসপিটালের সামনে হাজারো মানুষের ভিড়। জনসাধারণ, প্রেস, মিডিয়া এমনকি প্রশাসনের লোক কেউ বাদ পড়েনি। মিথিলা ভিড়ভাট্টা ঠেলে হসপিটালে প্রবেশ করলে আরেক দফা চমকে যায়। হসপিটালের দুই একজন নার্সের মুখে শুনেছে মুম্বইয়ের নামকরা অভিনেত্রী ইধা চৌধুরী আহত হয়েছে। তাকে হসপিটালে এডমিট করা হয়েছে। তার জন্যই হসপিটালের বাইরে এত ভিড়ভাট্টা। একথা শুনা মাত্র মিথিলা আর কালবিলম্ব না করে জরুরি বিভাগে চলে যায়। সেখানে গিয়ে দেখে সিনিয়র কয়েকজন ডাক্তার ইধার কপালে ব্যান্ডেজ করছে। পাশে ইমন, ইধার দুই-একজন বডিগার্ড, পুলিশ কমিশনার সহ আরো কয়েকজনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মিথিলা। ইধা মিথিলা কে দেখে সঙ্গে সঙ্গে ঠোঁট এলিয়ে হেসে দেয়। ইমনের থেকে বিস্তারিত সব ঘটনা জেনে, মিথিলা ইমনের সঙ্গে রাগারাগী করে। মিথিলা অনেক আগেই ইমন কে বলেছি এই রাজনীতির পথ ছেড়ে আসতে। কিন্তু মিথিলার কথা শোনেনি সে। তাদের রাগারাগির মাঝে হঠাৎ করে ইধা তাকে ভাবী বলে সম্বোধন করে ডাক দেয়। কেবিনে উপস্থিত সবাই কমবেশি চমকায় ইধার মুখে বাংলা কথা শুনে। তার থেকে বেশি চমকায় মিথিলা, তাকে ভাবী বলে সম্বোধন করার। মিথিলা ইধার কাছে যায়। ততক্ষণে তার মাথায় ব্যান্ডেজ করা হয়ে গেছে। ইধার কাছে যাওয়া মাত্র ইধা বিছানা থেকে উঠে মিথিলার হাত ধরে বলল,
‘ ভাবি তুমি ভাইয়ার সঙ্গে রাগারাগি করো না। ভাইয়া আমাকে নিষেধ করেছিল গাড়ি থেকে নামতে তারপরও আমি তার নিষেধ অমান্য করে গাড়ি থেকে নেমে পড়েছিলাম।’
ইমন ইধার দিকে তাকায়, আজ কত বছর পরে তার আদরের বোন টা তাকে ভাইয়া বলেছে। ইধা এক নজর ইমনের দিকে তাকিয়ে তুষার আর পুলিশ কমিশনারের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ Tusar, I don’t know who or what attacked me. But I want to see them in front of me in 24 hours. ( তুষার, আই ডোন্ট নো হু অর হোয়াট অ্যাটাক মি। বাট আই ওয়ান্ট টু সী দেম ইন ফ্রন্ট ফর মি টুয়েন্টি ফোর আওয়ার্স। )
পুলিশ কমিশনার মৃদু স্বরে বলল,
‘ ম্যাডাম আপনি আগাম বার্তা ছাড়া হঠাৎ বিডিতে? আর আপনার ওপর যারা হামলা করেছে তারা কি আপনার পূর্ব পরিচিত?’
ইধা চোখ বন্ধ করে নিঃশ্বাস নিয়ে বলল,
‘ আপনারা হয়তো ইতিমধ্যে সকলেই জেনে গেছেন, আমার আদি নিবাস বাংলাদেশ। জমিদার রাহাত খান চৌধুরীর নাতনি আমি। ফ্যামিলির সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলাম, আজ সকালের ফ্লাইটে মুম্বাইতে ফিরে যাওয়ার কথা ছিল। ভাইয়া আমাকে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিতে যাচ্ছিল। কিন্তু মাঝ রাস্তায় কে বা কারা হঠাৎ করে আমাদের উপর অ্যাটাক করে তা জানি না। এখন এটা আপনাদের খুঁজে বের করতে হবে, কে আমাদের উপর অ্যাটাক করেছিল? তাদের মোটিভ কী ছিল?’
ইধা কথা শেষ করতে না করতেই কেবিন এর মধ্যে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে ইরা, দিঘী আর ওর বন্ধুরা। দিঘী উত্তেজিত গলায় বলল,
‘ আপু তুমি ঠিক আছো? হঠাৎ করে এমন কিভাবে হয়েছে ভাইয়া? আমাদের ফ্যামিলির এত নামডাক, এত পাওয়ার থাকা সত্ত্বেও আজ আপুর উপর হামলা হলো কিভাবে?’
পুলিশ কমিশনার ইধার দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলল,
‘ ম্যাডাম তাহলে আমরা আসি, তদন্তের জন্য অনেক দৌড়াদৌড়ি করতে হবে।’
ইধা হাসিমুখে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। ইধা চোখ ঘুরিয়ে ইরা আর দিঘীর দিকে তাকিয়ে, আশ্বস্ত করে সে ভালো আছে। তাকে নিয়ে উত্তেজিত হওয়ার কিছু হয়নি। এরমধ্যে মিথিলার হসপিটালের সিনিয়র ডাক্তার জেসমিন ওদের দিকে কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
‘ মিথিলা, তুমি বিবাহিত?’
মিথিলা ডান-বাম মাথা নাড়িয়ে ছোট করে বলল,
‘ না, ম্যাম।’
ডাক্তার জেসমিন অবাক হয়ে বলল,
‘ তাহলে উনি ( ইধা কে ইঙ্গিত করে ) তোমাকে ভাবী বলে সম্বোধন করেছে কেন?’
ডাক্তারের জেসমিনের কথা শুনে মিথিলা লজ্জায় লাল হয়ে যায়। এখন কিভাবে বলবে এই পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ টাকে সে সাংঘাতিক ভালোবাসে। তারা সঙ্গে বাকিটা জীবন কাটাতে চায় তাইতো অনেকটা পারিবারিক ভাবে তাদের বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। ইধা মিথিলার অবস্থা বুঝতে পেরে ডাক্তার জেসমিনের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলল,
‘ ডক্টর, আপনাদের হসপিটালের ডক্টর মিথিলা, আমাদের জমিদার বাড়ির হবু বড় বউ। ডক্টর মিথিলার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তি, তার বাকি জীবনের পথ চলার সাথী।’
ইধার কথা শুনে ডাক্তার জেসমিন আশাহত হয়। তার মনের অনেক দিনের সুপ্ত ইচ্ছে ছিল, মিথিলার সঙ্গে তার ভাইয়ের ছেলের বিয়ে দেবে। মিথিলা মেয়েটাকে তার ভীষণ পছন্দ। ভেবেছিলো এবার তার ভাইয়ের ছেলে দেশে ফিরলে এই নিয়ে কথা বলা যাবে। কিন্তু আফসোস তার আগেই মিথিলার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।
মাথায় সামান্য আঘাত পাওয়ায় বিকেলের আগে ছেড়ে দেয় ইধা কে হসপিটালে থেকে। হাজারো ভক্ত, প্রেস মিডিয়ার থেকে কোনো রকম বাঁচিয়ে ইমন আর তুষার ইধা কে গাড়িতে তুলে। বাড়িতে আসার পর থেকে ইমন ইধার সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনার জন্য নিজেকে দায়ী করেছিল। মিথিলা অনেক কষ্টে ইমন কে সামলিয়েছে। এসব ভেবে মিথিলা ইমনের দিকে তাকায়। মিথিলার কোলে ঘুমিয়ে পড়তে। তা দেখে মিথিলা মৃদু হাসে।
গভীর রাতে রুমের মধ্যে কারও উপস্থিতি টের পেয়েও চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে ইধা। মাথা ব্যথায় দু’চোখের পাতা এক করতে পারিনি। কারো নিঃশ্বাস নিজের খুব কাছে উপলব্ধি করে ইধা। একবার ভাবে চোখ ঘুরে তাকাবে, রুমের মধ্যে কে এসেছে তা দেখার জন্য। আবার ভাবে না থাক, কিছুক্ষণ শুয়ে থেকে দেখা যাক কী করে সে। অজ্ঞাত ব্যক্তির নিঃশ্বাস ধীরে ধীরে নিজের কাছে উপলব্ধি করছে। মুখের উপর আছড়ে পড়ছে তার নিঃশ্বাস। অজ্ঞাত ব্যক্তি যে তীব্র দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে তা বেশ বুঝতে পারছে ইধা। হঠাৎ করে চমকে যায় ইধা। অজ্ঞাত ব্যক্তি ইধার কপালে ঠোঁট ছুঁইয়েছে। গালের উপর আছড়ে পড়ছে এক বিন্দু পানি। পানি? না, না হয়তো চোখের জল। কয়েক মুহুর্ত পরে ইধা আলতো করে চোখ খুলে তাকায়। বিষ্ময় চোখে তাকিয়ে আছে দরজার দিকে। নিলাংশ বেরিয়ে যাচ্ছে। তাহলে কী সে একটু আগের সর্বনেশে কাণ্ড করেছে?
চলবে