#তোমার_নামে_আমাকে_ডাকো
#লেখিকাঃ সারজীন ইসলাম
|পর্ব-সমাপ্তি|
দিন যায়, সপ্তাহ যায়, পেরিয়ে যায় মাস। গতকাল সম্পূর্ণ হয়েছে ইধার দুই ভাইয়ের বিয়ে। রুহির পরিবার বিয়ের দুই সপ্তাহ আগে জমিদার বাড়িতে পৌঁছে গেছিলো। বিয়েতে সবাই উপস্থিত থাকলেও উপস্থিতি ছিল না বাড়ির আদরের মেয়ে নিরা। বিয়ের তিন দিন আগে থেকে কারো ফোন রিসিভ করছে না ইধা। এমনি তুষার ও না। ইধা এই খামখেয়ালিপনার জন্য সাঙ্ঘাতিক রেগে আছে রাহাত খান চৌধুরী এবং অন্য সদস্যরা। আত্মীয়-স্বজনরা কানাঘুষা শুরু করে দিয়েছে। তাদের ধারণা ইধা এতো বড় একজন নায়িকা হওয়ায় তার অহংকার এ মাটিতে পা পড়ে না। রাহাত খান চৌধুরী গতকাল দুপুরে বরযাত্রী নিয়ে বের হবার সময় সবাইকে স্পষ্ট করে বলে দিয়েছে, এ বাড়ির কেউ যেনো ইধা কে আর ফোন না করে। বিয়ে বাড়ি অথচ সকাল থেকে জমিদার বাড়ির পরিবেশ থমথমে। কিছু আত্মীয় স্বজন বসার ঘরে বসে টিভি দেখছে কিছু ডাইনিং টেবিলে বসে কথাবাত্রা বলছে।ডাইনিং টেবিলের এরিয়া থেকে বসার ঘরে টিভির এরিয়াটা স্পষ্ট দেখা যায়। জমিদার বাড়ির নিয়ম অনুসারে আজ বাদে কাল বৌভাত হওয়ার কথা। তাই আজ আত্মীয়-স্বজনের পরিমাণটা একটু কম। জমিদার রাহাত খান চৌধুরী পরিবারের অন্য সদস্যদের নিয়ে ডাইনিং টেবিলে খেতে বসে। মিথিলা আর অন্ত তাদের খাবার পরিবেশন করে দিচ্ছে। টিভিতে নিউজ চলছিল, হঠাৎ নিউজে বলা কিছু কথা শুনে সবাই খাওয়া থামিয়ে টিভির দিকে তাকালো।
আমেরিকার, নিউইয়র্ক শহরের বিখ্যাত ডক্টর ফিটার লিপাট ইন্ডিয়াতে এসেছে গতকাল রাত তিনটের ফ্লাইটে। তার আসার আগাম খবর জানতো না কেউ। কিন্তু মুম্বাই এয়ারপোর্ট থেকে বেরোনোর সময় মিডিয়ার লোকজন তাকে দেখে ফেলে। ঘিরে ধরে মিডিয়ার লোকজন তাকে এবং তার সহকর্মীদের। সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখে পড়ে ডক্টর ফিটার কে জানাতে হয় হঠাৎ করে তার ইন্ডিয়াতে আসার কারণ। তিনি সাংবাদিকদের জানান, অভিনেত্রী ইধা চৌধুরীর ওপেন হার্ট সার্জারির জন্য তিনি ইন্ডিয়াতে এসেছে। কথাটা জানা মাত্র অভিনেত্রীর ভক্ত সমাজে দুঃখের ছায়া নেমে আসে। ডক্টর ফিটার আরো জানান অভিনেত্রী ইধা চৌধুরী গত বারো এপ্রিল, মঙ্গলবার দুপুরের পরে অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে হসপিটালে ভর্তি করা হয়। এই তিনদিন হসপিটালে ডক্টরা অবজারভেশন করেছে তাকে কিন্তু তিন দিনের মধ্যে ইধা চৌধুরী স্বাস্থ্যের কোনো উন্নতি হয়নি। চৌদ্দ এপ্রিল ইধা চৌধুরীর অবস্থা আরো অবনতি হলে তাকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়। ইধা চৌধুরী স্বাস্থ্যের অবনতি দেখে তার বন্ধু অভিনেতা সেম ডক্টক ফিটার কে এমার্জেন্সি ইন্ডিয়াতে আনার ব্যবস্থা করে।
খবরটা শোনা মাত্র ইধার দাদিমা আল্লাহ বলে চিৎকার দিয়ে তৎক্ষণাৎ জ্ঞান হারায়। মাটিতে লুটিয়ে পড়ার আগে ধরে ফেলে দিঘীর বাবা। ইধা মার পা অবশ হয়ে পড়ে যেতে লাগলে ইধার মেজ চাচী তাকে পেছন থেকে ধরে ফেলে। হু হু করে কেঁদে ওঠে ইধার মা। ইধার বাবা আর দাদুভাই তাদের চোখগুলো রক্তিম বর্ন ধারন করে টিভির দিকে তাকিয়ে আছে। মূহুর্তের মধ্যে হতভম্ব হয়ে গেছে সবাই।
—————–
অন্ধকার রুমে চিত হয়ে শুয়ে আছে নিলাংশ। কাল বিয়ের অনুষ্ঠানে ওখান থেকে ঘুরতে চলে গেছিলো একা একা। তার দরুন বেশ রাত করে বাড়ি ফিরে নিলাংশ। হন্তদন্ত হয়ে রুমে এসে অন্ধকারে হাতরে আলো জ্বালানোর চেষ্টা করে নিলাংশের মা। কোনো রকম আলো জ্বালিয়ে নিলাংশের বিছানার মাথার পাশের জানালা খুলে দিয়ে পর্দা সরিয়ে দেয়। নিলাংশের গায়ে হাত দিয়ে ধাক্কা দিয়ে ডাকতে শুরু করে। বিরক্তিতে নাক মুখ কুচকে আছে নিলাংশের। পিটপিট করে তাকালো নিলাংশ ওর আম্মুর দিকে। নিলাংশ কে চোখ খুলে তাকাতে দেখে ওর আম্মু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে খুব দ্রুত বলল,
‘ বাবা তাড়াতাড়ি উঠ, উঠে ফ্রেশ হয়ে তৈরী হয়ে নে, দুই তিনটা জামাকাপড় প্যাক করে নে, আমাদের কিছুক্ষণের মধ্যেই বেরোতে হবে।’
নিলাংশ ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলল,
‘ উঃ আম্মু কি শুরু করলে তুমি সকালবেলা? কোথায় যাব তোমার সঙ্গে এত সকালবেলা?’
নিলাংশের গায়ে আবার ধাক্কা দিয়ে বলল,
‘ সকাল কোথায়? আট টার বেশি বাজতে চলল তাড়াতাড়ি উঠ।’
নিলাংশ শোয়া থেকে উঠে দুই হাত দিয়ে চোখ ডলতে ডলতে বলল,
‘ নেয়াও উঠেছি! এবার বল কোথায় যাব তোমার সঙ্গে?’
নিলাংশের আম্মু ছোট করে বলল,
‘ মুম্বাই।’
নিলাংশ ভ্রু কুঁচকায়। নিলাংশের আম্মু একে একে সব কিছু খুলে বলে। ইধার অসুস্থতার খবর শুনে নিলাংশ অস্বাভাবিক ভাবে নিঃশ্বাস নিতে শুরু করে। অস্থিরতা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে নিলাংশকে। হৃদরোগীদের মতো বুকের ভিতর তীব্র ব্যথা অনুভব করে নিলাংশ। নিলাংশের চেহারায় এমন হতভম্বের ছাপ দেখে নিলাংশের আম্মু ওর গায়ে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বলল,
‘ কিরে এমন করে শূন্যের দিকে তাকিয়ে আছিস কেন? জলদি তৈরী হয়ে নে। তোর ফুপা এমার্জেন্সি টিকিটের ব্যবস্থা করেছে। নিচে শুনে এলাম ঈশানের বউ আর হাতে গোনা কয়েকজনের পাসপোর্ট না থাকায় তারা বাড়িতে থাকবে। তাছাড়া সবাই টিকিটের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সবাই হয়তো একসঙ্গে যেতে পারবেনা, ফ্লাইট আগে পিছে হতে পারে। নে নে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নে, ওদিকে তোর বাবার জামা কাপড় গুছিয়ে নিতে হবে।’
নিলাংশের উত্তরের অপেক্ষায় বসে ওর আম্মুর রুম থেকে বেরিয়ে যায়। নিলাংশ এখনো বাকশূণ্য হয়ে শূন্যের দিকে তাকিয়ে আছে। এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না নিলাংশের, তার প্রিয়তমার লাইফ সাপোর্টে হসপিটালে এডমিট আছে এই মুহূর্তে।
—————–
দুপুরের পরপরই প্রথম ফ্লাইটে পৌঁছে যায় মুম্বাই শহরে ইধার দাদুভাই, বাবা-মা, ইমন, ঈশান, ইরা, রুহি, রুহির বাবা-মা, আর নিলাংশ। ফ্লাইট এর সংকট থাকায় পরিবারের অন্য সদস্যরা সন্ধ্যার পরে ফ্লাইটে মুম্বাই পৌঁছাবে।
হসপিটালে পৌঁছে বিশেষ কোনো লাভ হয়নি সবার। ইধার সঙ্গে কেউ দেখা করতে পারেনি। ইধার সঙ্গে কারো দেখা করারও সুযোগ নেই। আইসিইউ’র বাইরে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা করা হয়েছে। ইধার পরিবার হসপিটালে এসেছে পর থেকে তুষারের কোনো দেখা নেই। রায়হান খান চৌধুরী, নিলাংশ, রুহির বাবা, ইমন আর ঈশান হসপিটালে এসে এক দন্ড বসে না থেকে ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলার জন্য ছুটেছে। আইসিইউ’র বাইরে রাখার জন্য সিটে বসে পরিবারের সবাই অপেক্ষা করছে রায়হান খান চৌধুরীর জন্য, ইধার একটা ভালো খবর শোনার আশায়। ঘড়ির কাঁটায় ঠিক ত্রিশ মিনিটের মাথায় রায়হান খান চৌধুরী এবং অন্যরা সকলে চলে আসে। তাদের সঙ্গে তুষার, অভিনেতা সেম এবং দুজনে অপরিচিত মেয়েকে দেখতে পায়। ইধার মা উত্তেজিত হয়ে ইধার বাবা কে জিজ্ঞেস করল,
‘ ডাক্তার কি বলেছে? কি হয়েছে আমার মেয়ের? ঠিক হয়ে যাবে তো আমার মেয়ে? আমি আমার মেয়ের কাছে যাবো। ( দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বডিগার্ডের উদ্দেশ্য করে) এদের তুমি একটু বলো না আমাকে আমার মেয়ের কাছে যেতে দিতে।’
ইধার বাবার গলা ধরে আসছে। ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেরিয়ে আসার সময় মনে মনে এসব ভেবে নিয়েছিল কিভাবে ইশা কে সামলে নেবে, কিন্তু এখানে এসে এক মায়ের তীব্র আকুতি শুনে সব সাজানো কথাগুলো তালগোল পাকিয়ে গেছে। ইধার বাবাকে চুপ থাকতে দেখে রাহাত খান চৌধুরী ধমকের সুরে বলল,
‘ এমন পাথরের মতো দাড়িয়ে আছিস কেন বৌমা কী জিজ্ঞেস করছি উত্তর দেয়? ডাক্তাররা কি বলেছে? কেমন আছে আমার নাতনি?’
ইধার মা, ইধার বাবার দিকে তাকালো। তাকে কিছু বলতে না দেখে ইধার মা তুষারের দিকে তাকিয়ে কেঁদে দিয়ে বলল,
‘ তুষার বাবা তুমি অন্তত সত্যি বল কি হয়েছে আমার মেয়ের? ডাক্তাররা কি বলেছে?’
তুষার এক পলক সকলের দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে বলল,
‘ ম্যামের হার্টে ব্লক ধরা পড়েছে বছর দুয়েক আগে। একথা আমি কিছু জানতাম না। সেম স্যার, তার ওয়াইফ পলা ম্যাম এবং ডক্টর পূজা মিত্র ছাড়া এই কথা কেউ জানত না।’
রুহির মা উত্তেজিত হয়ে সেমের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ তাহলে তোমরা এতদিন বসে ছিলে কেন? ওর অপারেশন এর ব্যবস্থা করো নি কেন?’
সেম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
‘ আন্টি আপনার মনে আছে কিনা আমি জানিনা, ইধা বছর দুয়েক আগে আমার সঙ্গে একটা গানের শুটিংয়ের জন্য সিঙ্গাপুরে যেতে হয়েছিল। তখন একটা টানা অনেকদিন ধরে ইধার ফোন বন্ধ ছিল। তুষার হয়তো তখন ছুটিতে ছিলা। ওর বাবার অপারেশনের জন্য। সিঙ্গাপুরে যাওয়ার দুই কিংবা তিন দিন পরে শুটিং স্পটে ইধা হঠাৎ করে প্রচন্ড বুকে ব্যাথা শুরু হয়। তৎক্ষণাৎ টিমের সবাই মিলে ওকে হসপিটালে এডমিট করাই। তখন সেই হসপিটালে চাকরি করতো ডক্টর পূজা মিত্র। কিছু টেস্ট করার পরে জানা যায় ইধার হার্টে পাঁচটা ব্লক ধরা পড়েছে। তখনই আমি অপারেশন করিয়ে হার্টের রিং বসাতে চাইছিলাম। কিন্তু ইধার ডায়াবেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপের কারণে তা সম্ভব হয়নি। ডক্টর পুজা মিত্র এবং তার সিনিয়ররা জানায় এই মুহূর্তে ইধার ডায়াবেটিস কন্ট্রোল নেই তবে ডায়াবেটিস কন্ট্রোল এনে অপারেশন করা সম্ভব। কিন্তু একটা কিন্তু থেকে যায়। ইধার বয়স কম, তার উপরে ইধার হার্ট অত্যাধিক দুর্বল। অপারেশন টেবিলে ভালো-মন্দ কিছু হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা টেন পার্সেন্ট থেকে যায়। জ্ঞান ফিরলে আমি সব জানাই ইধা কে। ইধা সরাসরি অপারেশনের জন্য না করে দেয়। এই দুই বছরে আমি আর আমার স্ত্রী কম চেষ্টা করে নি ওকে অপারেশনের জন্য রাজি করাতে। কিন্তু ইধা কোনো এক অজ্ঞাত কারণে অপারেশন করাতে রাজি হত না।’
সব শুনে রাহাত খান চৌধুরী দুই পা পিছিয়ে গিয়ে, দেওয়ালে হাত দিয়ে নিজেকে সামলে নেয়। তুষার আফসোস করে বলল,
‘ ম্যাম তার ভাইদের বিয়ে নিয়ে খুব এক্সাইটেড ছিল। বিয়ের ডেটের এক সপ্তাহ আগে মুম্বাই চলে আসে ম্যাম। তার দুই ভাইয়ের বউয়ের জন্য কোরিয়া থেকে এমনকি মুম্বাই থেকে অফুরান কেনাকাটা করেছে। বিডিতে যাওয়ার একদিন আগে ম্যাম হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়ে। তাকে হসপিটালে এডমিট করে আগে আমাদের বারবার বলেছে, তার অসুস্থতার খবর যেনো কাউকে না জানাই। বিশেষ করে আপনাদের না জানাই।’
ইমন গম্ভীর গলায় বলল,
‘ নিরা বলল, আর তুমিও আমাদের জানালে না। আল্লাহ না করুক ওর যদি ভালো মন্দ কিছু হয়ে যেতে? তাহলে কী জবাব দিতে তুমি আমাদের?’
ইমনের কথা শুনে তুষার অপরাধীর মত মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। খানিকক্ষণ চুপ থেকে প্যান্টের পকেট থেকে একটা ফোন বের করে। ফোন টা ইরার বাবার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘ স্যার, ইধা ম্যাম ফোন টা আপনাকে দিতে বলেছিল।’
ইধার বাবা ফোন হাতে নিয়ে কৌতুহল চোখে তুষারের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ এটা কার ফোন? আর আমাকে ই বা ফোন টা দিতে বলল কেনো?’
তুষার জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,
‘ ফোনটা ইধা ম্যামের। ভিডিও অপশনে একটা ভিডিও আছে। ম্যাম ভিডিও টা আপনাকে দেখতে বলেছিল।’
——————-
‘ বাবা, বাবা তুমি এতক্ষণে হয়তো আমার অসুস্থতার খবর জেনে গেছো। কী ভাবছো বাবা? জীবনের এমন সঙ্কটময় মুহূর্তে তোমাকে এই ভিডিও টা দেখতে বলেছি কেনো? আমি তোমার জন্য একটা চিঠি লিখতে চেয়েছিলাম বাবা। কিন্তু আমার অসুস্থতার কাছে আমাকে হার মানতে হয়েছে। মাথা তুলে বসতে পারছি না আমি। তোমাকে কিছু কথা জানানোর জন্য সেম সাহায্য নিয়েছি। ওই ফোনটা ধরেছে আছে। জানো বাবা ছোটবেলায় ভাইয়ার কথা শুনে তুমি আমাকে মেরেছিলে, তখন আমার তোমার প্রতি খুব অভিমান জন্ম নেয়। দাদাভাই কে রাজি করিয়ে চলে যাই বাড়ি থেকে অনেক দূরে। যখন আমার বোঝার একটু বয়স হয়, তখন আমি বুঝতে পারি আমার বাবা কোনো ভুল করেনি। তিনি তার সন্তানদের সঠিক পথে রাখার জন্য শাসন করেছে। এর কয়েক বছর পরে আমি ফিরে যাই তোমাদের কাছে। জানো বাবার তোমাকে আর মাকে একসঙ্গে দেখলে আমার তোমাদের কে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে। তোমাদের স্নেহ মাখা আদরগুলো পাবার লোভ জাগে। কিন্তু আমি আমার মনকে পাথরে পরিণত করে নিয়েছি। আমি জানতাম আমি আর বেশি দিন বাঁচবো না। শুধু, শুধু আমার প্রতি তোমাদের মায়া নামে বাড়াতে আমি তোমাদের থেকে দূরে দূরে থেকেছি। আমার মনে হতো আমি তোমাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করলে, তোমাদের থেকে দূরে থাকলে, তোমরা আর আমাকে ভালোবাসবে না। কখনো যদি আমার কিছু হয়ে যায় তাহলে আর তোমরা তেমন কষ্ট পাবে না। আমি তোমাদের কষ্ট সহ্য করতে পারি না বাবা। ছোটবেলায় তোমার বুকের উপরে শুয়ে আমি একটা কথা বারবার বলতাম মনে আছে তোমার বাবা? আজ আমি কথাটা আবার বলতে চাই, আমি তোমাকে ভালোবাসি বাবা, ভীষণ ভালোবাসি। তোমাকে আর মাকে আমি আমার জীবনের থেকেও বেশি ভালোবাসি। একটা কথা জানো বাবা? ( ইধা খানিকটা হেসে বলল) তোমার বউয়ের বড় ভাইয়ের ছেলে আছে না, মিস্টার নিলাংশ সাহেব? ওই ভদ্র লোকটা আমাকে প্রপোজ করেছে। তারা ভাষ্যমতে লোকটা আমার পৃথিবীতে জন্ম নেওয়ার আগে থেকে আমাকে ভালোবাসে। আমি তার চোখমুখ দেখে উপলব্ধি করেছি, মানুষটার একবিন্দুও মিথ্যে বলিনি। তুমি বলো বাবা এমন পবিত্র ভালোবাসাকে প্রত্যাখ্যান করা যায়? কিন্তু তোমার এই নিষ্ঠুর মেয়ে সেই ভালোবাসাকে প্রত্যাখ্যান করেছে। আমি জানি আমার সঙ্গে মিস্টার নিলাংশ সাহেব তার জীবন জড়ালে তার ভবিষ্যত অন্ধকার কূপ এর মত হয়ে যাবে। তোমার মেয়ে এতটাও খারাপ নয় বাবা, তাই আমি পিছিয়ে এসেছি তার ভালোবাসা উপেক্ষা করে। মানুষটা যে জাদুকর সে কথা আমি আগে জানতাম না, তিনি আমার চোখের সামনে না থেকেও আমাকে তার ভালবাসার ফাঁদে ফেলেছেন। আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি বাবা। সেম আমার অপারেশনের ব্যবস্থা করেছে, জানিনা অপারেশন টেবিলে কি হবে? সেম এই দুই বছর অনেক চেষ্টা করেছে আমাকে অপারেশনের জন্য রাজি করানোর। কিন্তু আমার মনে হত আমি অপারেশন টেবিলে মারা যাবো, তোমাদের সঙ্গে আর দেখা হবে না, এই ভয়ে আমি অপারেশন করাতে রাজি হতাম না। কিন্তু এইবার আমার শরীর আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। সেই অপারেশনের জন্য রাজি হতেই হলো। তবে যদি বেঁচে ফিরি, মিস্টার নিলাংশ সাহেব আপনাকে আমি আর ছাড়ছি না। তোমার নামে আমাকে ডাকার জন্য হলেও আমাকে ফিরে আসতে হবে।
#পরিশিষ্ট-
স্যাঁতস্যাঁতে কাঁদার মধ্যে দিয়ে খালি পায়ে হেঁটে যাচ্ছে এক যুবক। তার পিছনে আরো কয়েকজন যুবক রয়েছে। মাছ বাজারে গিয়ে চোখে জরিপ করে বাজারের সব থেকে বড় মাছটি ক্রয় করে। সঙ্গে গরুর মাংস, খাসির মাংস, মুরগি কোন কিছুর কমতি নেই। কাঁচা বাজারের শেষ হলে খালি পায়ে বাজারের কাপড়ের দোকানে ঢুকে যুবক। পছন্দ অনুযায়ী কয়েক ডজন এর মতো কাপড় কিনে সে। আরো টুকটাক কিছু কেনাকাটা করে খালি পায়ে হাঁটা শুরু করে। তার সঙ্গের যুবকগুলো তাকে নিয়ে মজা করছে। চলার পথে কয়েক একটা ক্যামেরা লক্ষ্য করেছে সে। হয়তো মিডিয়ার লোক হবে। যুবকের ভিডিও ধারণের জন্য যুবকের ক্যামেরাম্যান যুবকদের সামনে সামনে হাঁটছে। আধা ঘন্টার মত হেঁটে এসে থামে যুবকদের বাহিনী জমিদার বাড়ির সামনে। জমিদার বাড়ির সাজসজ্জায় রাজকীয় ভাব। উৎসবমুখর পরিবেশ। যুবককে দেখে গেটের দারোয়ান হাসিমুখে গেট খুলে দেয়। বাড়ির সদর দরজায় দাঁড়িয়ে আছে একদল রমণী। তাদের মধ্যে একজন যুবকের নজর কেড়েছে আটপৌরে শাড়ি পড়ে, মাথায় ঘোমটা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে পায়ে আলতা। পায়ের সামনে পিতলের কলস রাখা। কারো আলত ধাক্কায় যুবক বাস্তবে ফিরে। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে ইমন চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে আছে তার দিকে। ইমন ঠাট্টার সুরে বলল,
‘ কী রে ভাই আর কতক্ষন আমার বোনের দিকে তাকিয়ে থাকবি? নজর লেগে যাবে তো আমার বোনের।’
ইমনের কথা শুনে নিলাংশ লাজুক হাসে। আড়চোখে তাকায় তার হৃদয়হরনীর এর দিকে। ইধা নিলাংশের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে। নিলাংশের পড়নে লুঙ্গি, গায়ে গেঞ্জি, কাঁধে গামছা ঝুলানো, অন্য একটা গামছা মাথায় প্যাঁচানো, চোখে সানগ্লাস। নিলাংশের এমন অদ্ভুত সাজ দেখে ইধা হাসে। বিয়ের পরে এই প্রথম ইধার বাপের বাড়িতে আসা। জমিদার বাড়ির নিয়ম অনুসারে বিয়ের পর বাড়ির মেয়ে প্রথম বাপের বাড়িতে আসার জন্য বড় ভাই অথবা বাবা বাড়িতে মেয়ে নিয়ে আসার জন্য পালকি নিয়ে মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে যায়, সেই পালকি চড়ে মেয়ে বাপের বাড়িতে আসে। নিয়ম অনুযায়ী ইধার বাবা আর তার দুই ভাই গেছিলো তাকে বাপের বাড়ি নিয়ে আসার জন্য। এবং মেয়ের জামাইকে বাড়ির সামনের রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রাখা হয় যতক্ষণ পর্যন্ত না মেয়ের জামাই খালি পায়ে লুঙ্গি পড়ে, গায়ে গেঞ্জি, কাঁধে গামছা ঝুলানো অবস্থায় বাড়ির সকলের জন্য বাজার করে না আসে ততক্ষণ পর্যন্ত তাকে বাড়িতে ঢুকতে দেওয়া হয় না। সেই নিয়ম রক্ষার্থে নিলাংশ খালি পায়ে বাজারে গিয়েছিলাম। এবার বাকি নিয়ম পালন এর দায়িত্ব ইধার। ইধা ধীর পায়ে এসে নিলাংশের হাত বড় মাছটা আর মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে পিছনের ইরার হাতে দেয়। সদর দরজা দিয়ে বাড়ির বড়রা তাকিয়ে আছে এই দিকে। ইধা হেঁটে গিয়ে হাতে কলস তুলে কোলে নেয়। দিঘী এসে গোলাপ ফুলের পাপড়ি দিয়ে সজ্জিত পাত্র রাখে নিলাংশের পায়ের সামনে। দিঘী নিলাংশের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ ভাইয়া এই পাত্রে দুই পা দিয়ে দাঁড়াও।’
দিঘীর কথা শুনে নিলাংশ তাই করলো। ইধা এসে নিলাংশের সামনে বসে কলস দিয়ে পানি ঢালতে শুরু করে নিলাংশের পায়ের উপরে। আশেপাশের সবাই উচ্ছ্বসিত হয়ে হৈ-হল্লা শুরু করে দেয়। নিলাংশের পা ধুয়ে দিয়ে ইধা তার শাড়ির আঁচল দিয়ে পা মুছে দেয়। ইধা উঠে দাঁড়ালে নিলাংশ আচমকা ইধা কে কোলে তুলে নেয়। উপস্থিত সবাই নিলাংশের এমন কাজে বাহবা দিয়ে হইহুল্লোর শুরু করে দেয়। ইধা লজ্জা নিবারণের জন্য নিলাংশের বুকে মুখ লুকায়।
সকল নিয়ম-নীতি পালন করে নিলাংশ আর ইধা কে সকলে একা ছেড়ে দেয়। নিলাংশ ইধার রুমের বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে আছে। ইধা সে ওয়াশরুমে। নিলাংশ ভাবে কয়েক মাস আগের দুর্বহ দিনগুলোর কথা। ঐদিন সম্পূর্ণ ভিডিওটা দেখার পরে উপস্থিত সবাই কি কেঁদেকেটে অবস্থা খারাপ করে ফেলেছিল। নিলাংশের কী অবস্থা হয়েছিল তা নিলাংশ ই জানে। ওই দিন রাত দশটার পরে অপারেশন টেবিলে নিয়ে যায় ইধার। ভয়, উত্তেজনা, দুশ্চিন্তার মধ্যে দিয়ে ইধা অপারেশন শেষ হয়। ডক্টরের নিখুঁত হাতের প্রচেষ্টায় সফল হয় অপারেশন। শুরু হয় তাদের প্রনয়ের অধ্যায়। সবার সেবাযত্নে মাস ছয়েকের মধ্যেই সুস্থ হয়ে ওঠে ইধা। নিলাংশ এই কয়েক মাস ছায়ার মতো থেকেছে ইধার সাথে। ইধা সুস্থ হওয়ার কয়েকদিন পরেই বিয়ের তারিখ ধার্য করা হয়। বাধা পড়ে পবিত্র সম্পর্কে দুজনে। নিলাংশের ভাবনার সমাপ্তি ঘটে ইধা ডাকে।
‘ শুয়ে পড়লে যে? যাও আগে ফ্রেশ হয়ে আসো।’
নিলাংশ ইধার হাত ধরে নিজের কাছে নিয়ে আসে। ইধা হাতের দিকে এক পলক তাকিয়ে বলল,
‘ কী হলো?’
নিলাংশ ইধার চোখে পলকহীন ভাবে তাকিয়ে বলল,
‘ ঐ কথাটা আবার শুনতে ইচ্ছে করছে।’
ইধা হাসে, ঠোঁট কামড়ে হেসে নিলাংশের থুতনিতে চুমু খেয়ে বলল,
‘ তুমি আমার প্রশান্তি। তুমি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি। তোমার নামে আমাকে ডাক টা সবথেকে বেশি ভালোবাসি। প্লিজ নীর একবার #তোমার নামে আমাকে ডাকো!’
নিলাংশ ইধার লালাটে ঠোঁট ছোয়ানোর অবস্থায় বলল,
‘ ভালোবাসি, নীরের নিরা কে ভালোবাসি।’
ইধা নিলাংশের দিকে এক পলক তাকালো, ইধার শরীর কাঁপছে এখনো। কণ্ঠস্বর জড়ানো। এই ছোট্ট ডাক টার মধ্যে কি আছে তা আজও বুঝতে পারেনা ইধা। ডাক টা শোনা মাত্র তারা সর্বাঙ্গে মাদকতা ছড়িয়ে যায়। নিলাংশ ইধার শরীরের কাঁপন টের পেয়ে আরো নিবিড় ভাবে নিজের সঙ্গে জড়িত নেয়।
সমাপ্ত —
[ অবশেষে গল্পটা শেষের দাড়ি টানতে হলো। কিন্তু সমাপ্তি নেই নীরের নিরার ভালোবাসার। গল্পটা থেকে আপনাদের অনেক ভালোবাসা পেয়েছি তার জন্য আপনাদের অনেক ধন্যবাদ। জানি না এই গল্পের শেষটা কেমন হয়েছে? শেষের দিকে গল্পটা কেমন ছন্নছাড়া ভাবে লিখেছি। গল্পটা নিয়ে আরো অনেক কিছু ভেবে রেখেছিলাম কিন্তু ব্যক্তিগত সমস্যার কারণে এখানেই সমাপ্তি টানলাম। আপনাদের কেমন লেগেছে জানাবেন প্লিজ। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সঙ্গে থাকার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাদের। ধন্যবাদ।]