তুমিই আমার প্রিয় নেশা পর্ব:৩৬

0
1906

#তুমিই_আমার_প্রিয়_নেশা
#পর্ব:36
#Suraiya_Aayat

নূর ছুটছে সেই মেয়েটার পিছনে,জানে না যে মেয়েটা ঠিক কোথায় যাচ্ছে ৷ মেয়েটা যেন তার পায়ের পদধ্বনির সাথে সাথে আরো কোন একটা বাড়তি পদধ্বনি শুনে থেমে গেলো ৷ তারপর হঠাৎ থেমে যেতেই নূর ও থেমে গেল, চারিদিকে পিনপতন নিরবতা আর অন্ধকারের মাঝে দেওয়ালে দেওয়ালে মশাল জ্বলছে , আগুনের হলুদ আভায় নূরের মুখটা ঘেমে নেয়ে একাকার ৷ মৎয়েটার চোখ দিয়ে জল টুপিয়ে টুপিয়ে পড়ছে, সে যে কাঁদছে এটা তার ই বহিঃপ্রকাশ ৷ নূর চমকে গেল , ও ধরা খেয়ে গেছে,সত্যিই তো ধরা খাওয়ার মতোই কাজ করেছে নূর, একটা মানুষ যখন দ্রুত গতিতে দৌড়ায় আর তার পিছন পিছন আর একটা মানুষ ও যদি সমান তালে দৌড়াতে থাকে তাও এতো নিস্তব্ধতার মধ্যে তাহলে এটা বোঝা খুবই সহজ একটা মানুষের জন্য যে তার পিছনে কেউ দৗড়াচ্ছে তেমনি তার ক্ষেত্রেও ঘটনাটির ব্যাতিক্রম হলো না ৷ মেয়েটি নূরের দিকে তাকিয়ে আছে অশ্রুমাখা এক ভয়ংকর দৃষ্টিতে,নূর মেয়েটার চোখের দিকে তাকিয়ে দু কদম পিছিয়ে গেল, হাতে নাতে ধরা খেয়েছে ও , ইচ্ছা করছে পালাতে , এটা যদি স্বপ্ন হতো তাহলে নূর প্রান পনে চেষ্টা করতো পালানোর কিন্তু এটা যে স্বপ্ন না এটা হলো বাস্তবতা আর বাস্তবটা তেঁতো হলেও তাকে মানিয়ে নেওয়াটা ভীষন কঠিন আর তার থেকে দূরে পালিয়ে পালিয়ে বেড়ানোটা হলো আলাদিনের প্রদীপে হাত ঘষে কিছু চাওয়ার মতো , অর্থাৎ বাস্তবকে পিছু ছাড়ানো দুস্কর ৷ নূর দু কদম পিছিয়ে গেল, শাড়ির আঁচলটা টেনে গলার ঘাম মুছতেই সেই আধপৌড়ে
শাড়ি পর মেয়েটা একটু রাস ভারী করে বলল
” কি চাই তোমার? কি কারনে এসেছো এখানে আর আমার পিছুই বা নিচ্ছ কেন?”

নূর এদিক ওদিক চেয়েও চাইতে পারছে না, সাহসে কুলাচ্ছেনা ৷ নূর একটু ফিচেল কন্ঠে আমতা আমতা করতেই মেয়েটা গলা ছেড়ে হুংকার দিয়ে বলল
” যাও এখান থেকে, এক্ষুনি চলে যাও আর কখনো এখানে আসবে না আর না এই গলির সীমা অতিক্রম করবে না অন্যথায় নিজের বিপদ নিজেই টেনে আনবে নয়তো ৷ ”

নূর ভয়ে কুঁকড়ে গেল,কাঁপা কাঁপা কন্ঠে কিছু বলতে চাইলেই মেয়েটা আবার বলল
” বলেছি না যাও ৷”

নূরের শরীর কেঁপে উঠলো, শরীরের লোম গুলো শিউরে উঠলো , ঠোঁট কাঁপছে জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছা করছে অনেক কিছু কিন্তু চাইলেও কিছু বলতে পারবে না কারন ইতিমধ্যেই দ্রুত সেই স্থান পরিত্যাগ করার নির্দেশ পেয়েছে ‌ ৷ নুর এক পা এক পা করে পিছিয়ে যেতে লাগলো তারপর হঠাৎ দৌড়ে চলে গেল সেখান থেকে ৷ অন্ধকার বারান্দার গলিটা পার করতেই নূর হাঁপাতে লাগলো আর বড়ো বড়ো শ্বাস নিতে লাগলো, কানে বাজছে সেই মেয়েটার পদধ্বনি ৷ নূর আড়াল থেকে উঁকি মেরে দেখতেই দেখলো মেয়েটা আগের ন্যায় ছুটছে যেনো কিছু একটা হারিয়ে যাওয়ার পথে ৷
নূর বেশ কিছুখন সেখানে দাঁড়িয়ে রইলো হাজার ও ভাবনা চিন্তা মনের মাঝে কড়া নাড়ছে , এক মুহূর্তেই যেন সব কঠিন কঠিন আর রহস্যর বেড়াজালে ঘেরা উত্তর গুলো পেতে ইচ্ছে করছে ভীষন ৷ চোখ বন্ধ করলো নূর , বুক দূরুদুরু করছে এখনো, কিছুখন আগের ঘটনাটা ভাবলেই শিউরে উঠছে আর শরীর কাঁপছে ৷
বেশিখন সেখানে দাঁড়িয়ে থেকেও কোন লাভ হবে না জেনে ঘরের দিকে পা বাড়ালো তাছাড়া মেয়েটা যদি ফিরে আসার সময় আবার নূরকে সেখানে দেখে তাহলে লোক জড়ো করে কি কেচ্ছা কেলেঙ্কারিটাই না করবে সেই ভয়ে সেখানে আর দাঁড়াতে ইচ্ছা করলো না ৷ নিজেও খানিকটা দৌড়ে ঘরে এলো ৷ আসার আগে মেঝো মামির ছোট বউকে পাশ কাটিয়ে এসেছে, নূরের দৌড়ানোর গতিতে উনি নূরকে আর কিছু জিজ্ঞাসা করে ওঠার সময় পাইনি ৷ নূর ঘরে এসে দরজা দিলো,এক এক সময়ে নতুন করে এক একটা বিপদের মুখে পড়ছে ও যদিও বিপদটা নিজে ঘাড়ে করে নিয়েছে নূর ৷ উনি এখন ডাকলেও দরজা খুলবেনা নূর কারন উত্তর দেওয়ার মতো কোন ভালো যুক্তি ওর কাছে নেই থাকলেও নূরের কথা বলার ভঙ্গি শুনে ঠিক ধরে ফেলবে যে মিথ্যা বলছে কারন নূর মিথ্যা বলতে পারে না, মিথ্যা বলতে গেলেই ওর গলার স্বর কাপে শরীরে একরাশ নারভাসনেস এ ভরে যায় ৷ কথাটা ভেবে দরজাটা হালকা করে ঠেলে দিয়ে বিছানায় এসে জড়োসড়ো হয়ে শুয়ে পড়লো , আর যায় হোক এই বড়ির বউরা করোর ঘরে বিনা অনুমতিতে প্রবেশ করে না ৷ বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করলো আর মনে করতে লাগলো পুরোনো সব কথা , আপাতত আয়াশের সব ভাবনা চিন্তর কোন অংশই নূরের মগজে নেই ৷ হঠাৎ করে দরজার খট করে খোলার আওয়াজ হতেই নূর চোখ মুখ খিঁচে আরো জড়োসড়ো হলো, হয়তো ছোট বউ এখন জিজ্ঞাসা বাদ করত এসেছে তাই নূর ঘুমানোর ভান করলো ৷ হঠাৎ চারিদিকে আবার নিস্তব্ধতায় ছেয়ে যেতেই নূর চোখ খুলবে কি ভাবলো সেই সময় পেট থেকে শাড়ির আঁচলটা সরিয়ে অপর একটা হাত ওর হাতকে স্পর্শ করে ঘাড়ে এসে নামতেই নূর একটু থীত হলো , ঠোঁটের স্পর্শ গুলো গলায় , ঘাড়ে , আর গালে এসে পড়তেই বুঝতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা হলো না বুঝতে যে আয়াশ এসেছে ৷ আয়াশের ঠোঁটের স্পর্শ গুলোর সাথে সাথে কোমরে আর পেটে হাতের স্পর্শ গুলোও বাড়তে লাগলো ৷ নূর হালকা চোখ খুলে বেশ নরম কন্ঠে বলল
” সরে যান কাছে আসবেন না ৷”
কিন্তু আয়াশ কখনোই নূরকে পরোয়া করেনি তাই আজও কোন কথা গায়ে না মেখে নূরকে সোজা করে শোয়াতেই নূর চোখ খুললো ৷ শাড়ির আঁচলটা শরীর থেকে আরো বেশি সরাতে গেলেই নূর বলে উঠলো
” আপনার যখন আবার মন মেজাজ ঠিক হবে , যখন মনে হবে যে আমিও একটু ভালো ব্যাবহার পাওয়ার যোগ্য তখন না হয় কাছে আসবেন ৷ এই কখনো মেঘ কখনো রোদ্দুরের মতো লুকোচুরি খেলা আমার সবসময় ভালো লাগে না, বড্ড একঘেয়েমী চলে এসেছে ‌৷”
সামান্য অভিমান মিশ্রিত কন্ঠে বলল নূর কারন কিছুখন আগে আয়াশ ওর প্রতি আচমকাই যে ব্যবহারগুলো করে গেছে সেগুলো নূরের কাম্য না তাই এক্ষেত্রে নূরের কথাটা বলাটা যায়েজ ৷
কথাটি শোনার পর আয়াশ বেশ কিছু খন নূরের দিকে তাকিয়ে রইলো,নূরের চোখের দিকে তাকিয়ে আয়াশ কি ভেবেছে নূর জানে না বা ওর কথাগুলো আয়াশের মনে গিয়ে আঘাত করেছে কি তাও জানে না ,কিন্তু হঠাৎ আয়াশ নূরের ঠোঁটের দিকে এগোতে গেলেই নূর অবাক হলো , তবে তৎক্ষনাৎ ই কারোর ভাঙা কন্ঠে কান্নার তীব্র আওয়াজ শুনে নূর আয়াশকে ধাক্কা মারলো,আয়াশ দূরে ছিটকে গেল ৷নূর উঠে বসতেই দেখলো আয়াশ ওর দিকে বেশ রাগী চোখে তাকিয়ে আছে, আয়াশের দৃষ্টি উপেক্ষা করে নীচের দিকে তাকাতেই আয়াশ রুম থেকে বেরিয়ে গেল, নূর মনে মনে একটু কষ্ট পেলো এটা ভেবে যে আয়াশকে ও আচমকাই ধাক্কা মারলো তাতে আয়াশ কি না কি ভাববে ওকে ৷ শাড়ির আঁচলটা ঠিক করে বিছানা থেকে নেমে ঘোমটা টেনে নিলো নূর, বাইরে যাবে কারন বাইরে থেকে কান্নার আওয়াজটা ক্রমশ গাঢ় হয়ূ আসছে, প্রথমে একজন কাঁদছিলো কিন্তু এখন বেশ কয়েকজনের কান্নার আওয়াজ আসছে ৷ নূর ঘরের বাইরে আসতেই দেখলো বাড়ির বউ সহ কাজের লোকেরা ছুটছে , নূর ও ওদের মাঝের একজন বাড়ির বউকে জিজ্ঞাসা করলো
” ভাবী ছুটছেন যে ? কারোর কোন বিপদ হলো ?”

ছোট মামীর বড়ো বউ খানিকটা কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললেন
” বড়ো মা একটু আগে মারা গেছে, মানুষটা খুব ভালো, তবে এতো তাড়াতাড়ি যে তিনি আমাদেরকে ছেড়ে চলে যাবেন এটা ভাবিনি ৷”

কথাটা শোনা মাত্রই নূরের পা দূটো যেন থেমে গেল সামনের দিকে আর এগোতে চাইলো না ৷ নূর রিতিমতো স্তব্ধ ৷ এমন একটা খবর শোনার জন্য হয়তো মোটেও প্রস্তুত ছিল না ৷ সবাই নূরের পাশ কাটিয়ে ছুটছে ‌ ৷ নূরের চোখের কোনে অজান্তেই জল জমে এলো ,যে মানুষটাকে দেখেনি তার প্রতি অদ্ভুত এক চাপা কষ্ট জমা হয়ে এলো ৷
নূর ও এবার সবার সাথে পা চালিয়ে হাটলো ৷ যেই ঘরটার সামনে মানুষজন জড়ো হয়ে আছে সেই ঘরটাতেই তো সেই বউটা দুপুরবেলা খাবার নিয়ে গিয়েছিলো আর সেই তো কিছুখন আগে কাঁদতে কাঁদতে কোথাও যাচ্ছিলো , তাহলে আমি যাকে এতক্ষন মানসিক রোগী ভাবছিলাম তিনি আর কেউ নন বড়ো মামি ?”

কথাটা ভাবতেই যেন নূর কেঁপে উঠলো, কোন কিছুই মিলছে না, সবকিছু গড়মিল ৷ মানুষের ভিড় কাটিয়ে নূর তার মুখটা দেখার চেষ্টা করলো ৷ তার মুখটা রুগ্ন, চোখের নীচে কালি, শরীরের গঠন ও ভেঙে গেছে,মাথার চুল এলোমেলো ,পরনে ময়লা একটা শাড়ি, যৌবনকালে তিনি যে বেশ রুপবতী একজন ছিলেন তা তার মুখের গঠন দেখরেই বোঝা যায়, খুব বেশি বয়স তো তার না, মাত্র 47 তাই তার মুখটা এক পলক দেখে এতো কিছু কল্পনা করতে নুরের অসুবিধা হলো না ৷ সেই বউটাও ওখানে বসে কাঁদছে ৷তাহলে হয়তো তিনি আগেই বুঝতে পেরেছিলেন যে উনি আর বাঁচবেন না হয়তো অবস্থা খারাপ তাই হয়তো তাকে শেষ বারের মতো বাঁচানোর জন্য কাউকে ডাকতে গেছিলেন ৷ কিন্তু সবার থেকে বেশি তিনি কাঁদছেন, তাঁর এতো কান্নার কারনটা কি?

কথাগুলো ভাবতে ভাবতে হাটছে নূর ৷ওনার মতো একজন রুপবতী বউ থাকতেও আয়াশের মামার এতো গুলো বিয়ে করার প্রয়োজনীয়তা আয়াশের বলার আগে অবধি নূর একরকম ভাবে নিজের মনকে বুঝিয়েছিলো কিন্তু এখন যে আর মন মানছে না ৷ বেশ পা চালিয়ে ঘরে এলো নূর ৷ ফোনটা হাতে নিয়ে ফোন করলো ইফার কাছে ৷ ইফার বদলে ফোনটা ধরলো আয়াশের খালামনি মানে ইফার মা৷ ফোনটা ধরতেই নূর বললো
” হ্যালো ইফা শুনছো?”

এটুকু কথা শুনতেই ইফার মা বললেন
” আরে বৌমা আমি খালামনি , ইফা এখানে নেই তাই আমিই ফোনটা ধরলাম,কিছু বলতে ইফাকে? ”

নূর এবার উত্তেজিত হয়ে বলল
” খালামনি তোমার বড়ো ভাবী মারা গেছেন কিছুখন আগে ৷ তুমি বাবাকে খবরটা দিও আর তাড়াতাড়ি চলে এসো ‌৷”

নূরের কথাটা শুনে উনি অবাক হয়ে বললেন
” আরে বৌমা কি বলছো এটা ,আমার ভাবী আসবে কোথা থেকে আমার তো কোন ভাই ই নেই?”

কথাটা শুনে নূর বিরাট একটা ঝটকা খেলো , কি বলছেন উনি এসব ৷ নূর একটু না অনেকটাই অবাক হয়ে বলল
” খালামনি তোমার বড়ো ভাবী মারা গেছেন আর তুমি বলছো যে তোমার ভাবী নেই?”

উনি এবার কিছু একটা ভেবে বললেন
” ও হ্যাঁ হ্যাঁ আছে তো , আমার ভাবী আছে ৷ বড়ো ভাবী মারা গেছেন? আমার একটাই ভাবী আর এতো তাড়াতাড়ি মারা যাবে ভাবিনি !”

কথাটা বেশ ভাঙা গলায় বললেন উনি ৷নূর শুনে খুব অবাক হলো, উনি কি আদেও সত্যি বলেছেন কিন্তু ওনার কথা শুনে তা মনে হচ্ছে না, আর একটাই ভাবী মাত্র? তাহলে আয়াশের মামার তো 4টে বিয়ে উনি কি জানেন না?”
কথাগুলো নূরের মাথায় আসলো ,তারপর বলল
” হ্যাঁ তোমার ভাবী, তোমরা তাড়াতাড়ি এসো ৷”
কথাটা বলে রেখে দিলো নুর ৷ ইফার মায়ের কন্ঠস্বরটা ছিল কাঁপা, তিনি সত্যি বলেলনি সেটুকু সমন্ধে নূর নিশ্চিত , আর উনি কেনই বা বললেন ওনার একটাই ভাবী ৷ তাহলে কি উনি আয়াশের খালামনি নন! এর পিছনে কি কোন বড়ো একটা সত্য লুকিয়ে আছে ?”

কথাগুলো ভাবতেই নূরের নিজেকে পাগল পাগল মনে হচ্ছে ৷ তবে ও সবকিছু আয়াশের থেকে জেনেই ছাড়বে আজ না হয় অন্য দিন ৷ আসল সত্যি টা কি?

#চলবে,,,,

এবার সব রহস্য ধীরে ধীরে কিছুটা হলেও সামনে আসবে ‍ ৷ ধৈর্য ধরুন ৷ আর কেমন হয়েছে আজকের পর্বটা ?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here