অনুভবে তুমি পর্ব-৫

0
3942

#অনুভবে_তুমি
#পর্ব_০৫
#মুমতাহিনা_জান্নাত_মৌ

ভাইয়া আমার হাত থেকে চিরকুট টা কেড়ে নিলো আর একনজর দেখেই চিৎকার করে বললো কে এই ছেলে?
তাড়াতাড়ি পরিচয় বল।
আমি ভাইয়ার এমন রাগান্বিত চেহারা দেখে ভয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললাম, চিনি না আমি।কে জানি চিরকুট টা আমার গায়ে ছুঁড়ে মারলো।ভাইয়া আমার কথা শুনে আর এক মুহুর্তও দেরী করলো না।তাড়াতাড়ি করে ছাদ থেকে নেমে সেই ছেলেকে খুঁজতে লাগলো।আর জোরে জোরে চিৎকার করে ডাকতে লাগলো,কে তুই সামনে আয়?সাহস থাকলে আমার সাথে কথা বল।প্রেম করার এতো সখ তাহলে লুকিয়ে আছিস কেনো?আমি ভাইয়ার এমন পাগলামি দেখে আরো জোরে জোরে কাঁদতে লাগলাম।কারন আমি এখনো আগের চিরকুট গুলোর কথা বলি নি।ভাইয়া যদি এখন সেগুলোর ব্যাপারে জেনে যায় কি হবে তখন?আমি বলবো কি বলবো না সেই টেনশনে শেষ হয়ে যাচ্ছি।

এদিকে দাদী আমাকে তার রুমে নিয়ে গেলেন।আর আমার গা মাথা বুলিয়ে বললেন, আমাকে সত্যি করে বলতো কি হয়েছে?তুই কি চিনিস ছেলেটাকে?আমি দাদীর কথা শুনে কাঁদতে কাঁদতে বললাম,তুমিও বিশ্বাস করছো না?বললাম তো চিনি না আমি।দাদী তখন বললো, তাহলে তুই এভাবে কাঁদছিস কেনো?তোর চোখেমুখে এতো ভয় কেনো?মনে হচ্ছে তুই আসল অপরাধি।আমি সেই কথা শুনে দাদীর গলা ধরে বললাম,দাদী তোমাকে মিথ্যা কথা বলবো না।ভাইয়াকে এই কথা বলবে না খবরদার। এই ছেলে বেশ কিছুদিন ধরেই চিরকুট পাঠাচ্ছে আমাকে। এতোদিন পার্সেল হিসেবে পাঠাতো।তুমি তো জানো ভাইয়াকে দেখে আমি ভীষণ ভয় পাই।সেজন্য বলি নি ভাইয়াকে। দাদী সেই কথা শুনে আমার মুখ টিপে ধরে বললো, চুপ চুপ।এসব কথা আর ভুল করেও বলিস না।এমনিতেই যে পাগলামো করছে সবকথা শুনলে না জানি আর কি কি করবে?এরপর থেকে পার্সেল আসলে আর রিসিভ করবি না।বাকিটা এখন তোর ভাই দেখে নেবে।

এদিকে ভাইয়া কখন যে দরজায় এসে দাঁড়িয়ে আছে আমরা কেউ টের পাই নি।ভাইয়া হঠাৎ করে আমাকে দাদীর কোল থেকে টেনে আনলো আর চিৎকার করে বললো আমার কাছ থেকে এতো বড় একটা ঘটনা কেনো লুকিয়ে রাখলি?আবারো বলছি সত্যি করে বল কে এই ছেলে?
আমি সেই কথা শুনে বললাম,ভাইয়া বিশ্বাস করো এই ছেলেকে আমি চিনি না।প্লিজ বিশ্বাস করো।

–তাহলে বলিস নি কেনো আমাকে?আমাকে জানালি না কেনো?পার্সেলে যদি খারাপ জিনিস থাকতো?তুই অচেনা লোকের পার্সেল রিসিভ করলি কেনো?সেটা আবার একবার নয় বার বার।কেনো?কেনো করলি এমন?
আমি ভাইয়ার এই প্রশ্নের কি উত্তর দিবো?সত্যিই আমার কাছে এর কোনো উত্তর নাই।কেনো রিসিভ করলাম?কেনো কাউকে বললাম না?
এবার আম্মু এগিয়ে আসলো।আর বললো,সেইজন্যই তো বলি প্রতিদিন এতো কি অর্ডার দেস?তুই তলে তলে এতোদূর চলে গেছিস সত্যি ভাবতে পারছি না।অয়ন শোন আর দেরী করিস না,এতো পড়ালেখার দরকার নাই।ভালো একটা ছেলে দেখে তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দে।আম্মুর কথা শুনে আমার চোখের পানি কিছুতেই আর থামছে না।আম্মু সবসময় শুধু আমার দোষটাই দেখে।আর কথায় কথায় বিয়ে বিয়ে করে।

দাদী এবার কথা বলে উঠলো, তোমরা চুপ করবা একটু?মেয়েটাকে শাসন করতে করতে এমন এক অবস্থায় নিয়ে গেছো যে ভয়েই কিছু বলে নি।ওর কোনো দোষ নাই।ওকে কেউ কিছু বলো না।আর কথায় কথায় এতো বিয়ে বিয়ে করো কেনো?পড়ালেখা টা শেষ করুক আগে।তাছাড়া ওর তো কোনো দোষ নাই।যে এই কাজটি করেছে তাকে গিয়ে ধরো।
আর অয়ন?এই ব্যাপার এখানেই থামিয়ে দে।মেয়ে মানুষ ও।এই কথা বাহিরে গেলে ওরই দুর্নাম হবে।তুই দয়া করে চুপচাপ থাক।
অয়ন ভাইয়া এই কথা শোনার পর কিছুটা শান্ত হলো।তবে সে মনে মনে এখনো রাগান্বিত। আমার উপর এতোটাই রেগে আছে যে আমার দিকে একবারও তাকালো না।এদিকে আম্মু যা নয় তাই বলে যাচ্ছে।সেজন্য দাদী আমাকে ধরে তার রুমে নিয়ে গেলো।আর দরজা বন্ধ করে দিলো।দাদী এইভাবে সবসময় আমাকে সাপোর্ট করে।এই মানুষ টা না থাকলে আমার যে কি হতো এতোদিনে সেটা শুধুমাত্র উপরওয়ালাই জানে।

পরের দিন আর ভার্সিটিতে গেলাম না।মনের দুঃখে সারাক্ষন রুমের মধ্যেই শুয়ে থাকলাম।এতোকিছুর পরও কেনো জানি বার বার সেই চিরকুটের কথা মনে পড়ছে।আর সেই অচেনা প্রেমিকের কথা।কেনো সে এভাবে চিরকুট পাঠালো?কেনো আমার মনে প্রেমের সৃষ্টি করলো?এখন যে সারাক্ষন শুধু তার কথাই মনে হচ্ছে?
ঠিক তখনি হঠাৎ করে কলিং বেল বেজে উঠলো।সাথে সাথে আমার বুক টা ধক করে উঠলো। সেই অচেনা প্রেমিক আবার পার্সেল পাঠালো না তো?ভয়ে আর দরজা খুলতেও গেলাম না।
কিন্তু না,ভয়ের কোনো কারণ নেই।ভাইয়া এসেছে বাসায়।ভাইয়া বাসায় এসেই আমার রুমে চলে এলো।
আমি ভাইয়াকে দেখে চোখ বন্ধ করে থাকলাম।তখন ভাইয়া আমার পাশে এসে বসলো,আর জিজ্ঞেস করলো আমি জেগে আছি কিনা?কিন্তু আমি কোনো কথা বললাম না।ভাইয়া ভেবেছে আমি ঘুমাইছি সেজন্য সে চলে গেলো।
কিছুক্ষন পর আমি নিজেই বিছানা থেকে উঠলাম।তারপর একটু ফ্রেশ হয়ে নিলাম।কিন্তু খেয়াল করলাম গেস্ট রুমে সবাই আলাপ আলোচনা করছে।সেজন্য আমিও গেস্টরুমের দিকে চলে গেলাম।ভাইয়া আমাকে দেখামাত্র বললো,আয় এইদিকে।আমি বুঝতে পারলাম না কিছু।তখন ভাইয়া বললো তোর জন্যই বসে আছি।তুই ঘুমাইছিস দেখে তোকে ডাকি নি।আমি তখন বললাম, কেনো কি হয়েছে?ভাইয়া তখন বললো রেডি হয়ে আয়।আজ আমরা সবাই মিলে ঘুরতে যাবো।
বাহিরে ঘুরতে যাওয়ার কথা শুনে মন টা আনন্দে নেচে উঠলো।কি যে আনন্দ হচ্ছিলো?কিন্তু কাউকে সেটা বুঝতে দিলাম না।আর ভাবতে লাগলাম ভাইয়া আমার মন খারাপ দেখেই হয়তো বাহিরে ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যান করেছে।

আমি কালচে খয়েরী কালারের একটা গাউন আর সেম কালারের একটা হিজাব পড়লাম।আমার সাজগোছ মানেই মুখে একটু ক্রিম আর পাউডার লাগালেই শেষ হয়ে যায়।মাঝে মাঝে মন ভালো থাকলে হালকা করে একটু লিপিস্টিক দেই বা চোখে কাজল।কিন্তু আজ আর কিছু দিলাম না।বিনা কারনে ভাইয়া যে বাহিরে ঘুরতে নিয়ে যাচ্ছে সেটাই অনেক।আম্মু আর দাদীও রেডি হয়েছে।ভাইয়া রেডি হয়ে অনেক আগেই বাহিরে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।আমাকে দেখে দাদী থু থু ছিটিয়ে দিয়ে বললো কারো খারাপ নজর যেনো না লাগে। আমি তা শুনে মুচকি একটা হাসি দিয়ে বললাম চলো তো তাড়াতাড়ি। ভাইয়া অপেক্ষা করছে।

আমরা বাসা থেকে বের হতেই দেখি ভাইয়া ইতোমধ্যে একটা সিএনজিও ডেকে এনেছে।আমরা তা দেখে আর এক মুহুর্তও দেরী করলাম না।সবাই সীটে গিয়ে বসলাম।আমি সীটে বসে জিজ্ঞেস করলাম ভাইয়া কই যাচ্ছি আমরা?ভাইয়া তখন বললো গেলেই বুঝতে পারবি।আমি সেজন্য আর কথা বাড়ালাম না।আমাদের সি,এন,জি একদম সোজা একটা পার্কের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।তা দেখে আমি তো ভীষণ খুশি হলাম।কারণ এই পার্ক টা আমার ভীষণ প্রিয় ছিলো।প্রতিবছর জন্মদিনে ভাইয়া এখানে নিয়ে আসে আমাকে।তবে আজ আমার জন্মদিন ছিলো না।

সি,এনজি থেকে নামতেই চারজন ছেলে এগিয়ে আসলো আমাদের দিকে।তারা আম্মু আর দাদীকে সালাম দিলো।ভাইয়া তখন পরিচয় করে দিলো যে এরা নাকি ভাইয়ার ফ্রেন্ড হয়।আমি সেই কথা শুনে ছেলেগুলোর দিকে ভালো করে তাকালাম।কারন এই ছেলেগুলো কে আমি সবসময় জানালা থেকেই দেখেছি।কাছ থেকে কখনোই দেখি নি।ভাইয়াকে নেওয়ার জন্য মাঝে মাঝে আসে বাসায়।তবে কখনো ভাইয়া বাসার ভিতর আনে নি এনাদের।কিন্তু আজ কেনো সবাই এসেছে সত্যি বুঝতে পারছি না।

আমি পার্কের ভিতর ঢুকেই আমার ফেভারিট জায়গাতে গিয়ে বসলাম।কিছুক্ষন একা একা ঘুরে বেড়ালাম।কিন্তু ভাইয়া আমাকে সেখান থেকে ডেকে আনলো।আর হাত ধরে এক জায়গায় নিয়ে আসলো।সেখানে গিয়ে দেখি আম্মু আর দাদীর সাথে আরো কিছু লোকজন বসে আছে।আমি কাউকেই চিনতে পারলাম না। বা এর আগে দেখি নি।এতো লোকজন দেখে অনেক বেশি অবাক হলাম।
আমাকে দেখামাত্র দাদী উঠে এলো আর ওনাদের সামনে নিয়ে আসলো।দাদী হঠাৎ আমার কানে ফিসফিস করে বললো সালাম দেস সবাইকে। আর অতিরিক্ত কোনো কথা বলবি না।ওনারা যা বলবে তার ভালোভাবে উত্তর দিবি।আমি এখনো বুঝতে পারছি না কি হতে চলেছে?কারন আমাকে আগে থেকে কিছুই বলা হয় নি।

আমি দাদীর কথামতো সালাম দিলাম সবাইকে।তখন এক মধ্যবয়সী মহিলা আমাকে ধরে তার পাশের সীটে বসালেন।খেয়াল করে দেখলাম তার পরের সীটে আরো একজন ছেলে।দেখতে মোটামুটি ভালোই।বয়স মনে হয় ২৭ বা ২৮ হবে।ছেলেটি আমার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে।আমি শুধু ভাইয়ার দিকে দেখছি।কারন ভাইয়া কি দেখছে না ছেলেটিকে?ছেলেটা যে এভাবে তাকিয়ে আছে ভাইয়ার তো রাগ হওয়ার কথা।কিন্তু ভাইয়া বেশ হাসিখুশি মুডেই আছে।ওনারা আমাকে বেশ কয়েকটি প্রশ্নও করলো।আমি ভালোভাবেই উত্তর দিলাম।তারপর মহিলা টি তার ছেলেকে বললো,বাবা তুই কিছু জিজ্ঞেস কর।ছেলেটি সেই কথা শুনে বললো, থাক দরকার নেই।তোমরা জিজ্ঞেস করলেই হবে।
সেই কথা শুনে ভাইয়ার এক ফ্রেন্ড বললো, কেনো দরকার নেই?অবশ্যই দরকার আছে।যার সাথে সারাজীবন কাটাবে তার ব্যাপারে তো তোমারও কিছু জানার আছে।

ভাইয়ার ফ্রেন্ড এর কথা শুনে মুহুর্তের মধ্যে শকড খেয়ে খেলাম।কি শুনলাম এটা?আমার বুঝতে আর বাকি রইলো না। যে এই ছেলের সাথে ভাইয়া বিয়ে ঠিক করেছে আমার।আমি কি করবো বা কি বলবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না।
খাওয়াদাওয়া শেষ হলে সবাই আরো কিছুক্ষন গল্প করলো।আমি বেশি অবাক হচ্ছি দাদীকে দেখে।যে দাদী সবসময় আমাকে সাপোর্ট করে আজ তিনিও আমার বিপক্ষে চলে গেলেন।একবারও আমার মতামত জানার কোনো প্রয়োজন মনে করলো না কেউ।কিছুক্ষন পর সবাই চলে গেলো।তবে ভাইয়ার ফ্রেন্ডরা রয়ে গেলো।

কিন্তু হঠাৎ ভাইয়ার সেই বন্ধুটাই বললো,অয়ন আরেকটু সময় নিলে হয় না?এতো তাড়াহুড়ো করছিস কেনো?বিয়ে টা তো একদিনের জন্য নয়।অতশীর পছন্দ হয়েছে কিনা সেটা একবার জিজ্ঞেস কর ওকে?এই বলে ছেলেটি আবার আমার দিকে তাকালো।আমিও কেনো জানি তার দিকে তাকালাম।চোখে চোখ পড়তেই আমি আমার চোখ ফিরিয়ে নিলাম।ছেলেটিকে দেখে কেমন যেনো লাগছে আমার।মনে হচ্ছে এর আগেও দেখেছি তাকে।অথচ আজকেই ফাস্ট দেখলাম।
ভাইয়ার বাকি ফ্রেন্ডগুলোও ভাইয়াকে বোঝাচ্ছে বাট ভাইয়া কেনো যেনো তাদের কথা বুঝতেই চাচ্ছে না।
তার কথা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়ে টা এই ছেলের সাথেই দেবে আমার।

#চলবে,,,,,,
গল্পটি কেমন লাগছে অবশ্যই কমেন্ট করে জানাবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here