অনুভবে তুমি পর্ব-২২

0
2981

#অনুভবে_তুমি
#পর্ব_২২
#মুমতাহিনা_জান্নাত_মৌ

অতশী হঠাৎ রিয়ার হাত থেকে নাস্তার ট্রে টি নিজের হাতে নিলো।আর বললো,আমি এটা নিয়ে যাচ্ছি।তা শুনে রিয়া বললো, ম্যাডাম কি করছেন এটা?আপনি কেনো নিয়ে যাবেন?
অতশী কোনো উত্তর না দিয়ে রুমের ভিতর চলে গেলো।
এদিকে অতশীর হাতে নাস্তার ট্রে দেখে ইভান দাঁড়িয়ে গেলো।সে তার নিজের চোখ কে বিশ্বাস করতে পারছিলো না।অতশী কোন সাহসে এ রুমে এসেছে?

অতশীকে নাস্তার ট্রে নিয়ে রুমে ঢুকতেই সবাই ওর দিকেই তাকিয়ে রইলো।তা দেখে ইভানের ভীষণ রাগ হচ্ছিলো।সবার সামনে কিছু বলতেও পারছে না।সেজন্য ইভান রুম থেকে বের হয়ে গেলো।আর রিয়াকে বকতে লাগলো।
রিয়া তখন বললো,স্যার আমার কোনো দোষ নাই।অতসী ম্যাডাম জোর করেই আমার হাত থেকে ট্রে টি নিয়ে নিলো।ইভান সেই কথা শুনে অতশীর অপেক্ষা করতে লাগলো। কিন্তু অতশী আর রুম থেকে বের হলো না।
এদিকে অতশী মৌরির পাশে বসে পড়লো। আর মৌরি সেই থেকে ঘোমটা দিয়ে আছে।এখন পর্যন্ত ঘোমটা খোলে নি।
অতশীকে দেখে পাত্রপক্ষের একজন জিজ্ঞেস করলো ইনি কে?
অতশী তখন নিজেই উত্তর দিলো যে সে মৌরির বান্ধুবি হয়।
মুহিব সাহেব সেই কথা শুনে ভীষণ অবাক হলেন।হঠাৎ অতশীর কি হলো?এভাবে বলছে কেনো সে?

তখন আরেকজন পাত্রপক্ষের লোক বললো,মেয়ের ঘোমটা টা একটু উঠাতে বলেন।অতশী সেই কথা শুনে মৌরির ঘোমটা টা তুলে দিলো।

মৌরিকে দেখে সবাই ভীষণ অবাক হলো।এ কেমন চেহারার অবস্থা!একদম বাজে লাগছিলো দেখতে।পাত্র নিজেও তার মুখ অন্য দিকে ঘুরালো।এই মেয়েকে তারা দেখতে এসেছে!এই সেই রূপবতী সুন্দরী কন্যা।এদিকে মুহিব সাহেব ভেবেছে তার মেয়েকে মনে হয় পছন্দ হয়েছে সবার।সেজন্য তিনি হাসিখুশি মুখেই থাকলেন।মুহিব সাহেব এটা তো আর জানে না যে মৌরি বাজে একটা সাজে বসে আছে।যাতে তাকে কেউ পছন্দ না করে।ওদিকে ইভান ও জানে না পার্লারের মেয়েটি মৌরি কে নয়,অতশীকে সাজিয়েছে।

মৌরিকে দেখা শেষ হলে পাত্রপক্ষের একজন বললো,
আচ্ছা ঠিক আছে।আমাদের দেখা হয়ে গেছে।
সেই কথা শুনে মুহিব সাহেব বললেন, অতশী মৌরিকে নিয়ে যাও।অতশী সেই কথা শুনে মৌরিকে নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেলো।অন্যদিকে ইভান অতশীর অপেক্ষায় সেই থেকে দাঁড়িয়ে আছে দরজায়।
অতশী ইভান কে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকা দেখে বুঝে গেলো আজ অনেক খারাপ কিছু হতে যাচ্ছে তার সাথে।অতশী তখন মৌরিকে ফিসফিস করে বললো তুমি তাড়াতাড়ি করে তোমার রুমে চলে যাও।তা না হলে তোমার ভাই যদি তোমার এই সাজ দেখে তাহলে অজ্ঞান হয়ে যাবে।
মৌরি সেই কথা শুনে মাথার ঘোমটা টা ভালো করে দিয়ে এক দৌঁড়ে তার রুমে চলে গেলো।

অতশী নিজেও পালানোর চেষ্টা করলো।কিন্তু ইভান তার আগেই অতশীর হাত টেনে ধরে পাশের রুমে নিয়ে গেলো।
–এই? কি করছেন?ছাড়ুন আমাকে।

ইভান সেই কথা শুনে আরো জোরে হাত চেপে ধরলো অতশীর হাত,আর বললো, তুমি এখানে কেনো?
কি জন্য এসেছো?
অতশী তখন বললো, সে কৈফিয়ত আপনাকে দিবো কেনো?
ইভান সেই কথা শুনে অতশীর একদম কাছে চলে গেলো আর চোখ বড় বড় করে বললো,নিজের লিমিট ক্রস করো না অতশী।ভুল করেও যেনো আমাদের পারিবারিক ব্যাপারে নাক গলাতে আর না দেখি।ডোন্ট লিমিট ইওর ক্রস।বুঝতে পেরেছো?
অতশী তখন বললো,আমি কি করেছি?যার জন্য আপনি আমাকে এভাবে বকছেন?
–কি করেছো এখনো বুঝতে পারছো না?
–না বুঝতে পারছি না।আমি তো শুধু মৌরির সাহস যোগানোর চেষ্টা করছিলাম।মৌরি একা একা যেতে ভয় করছিলো সেজন্য আমাকে থাকতে বলেছিলো।আমি সেজন্য ও রুমে গিয়েছিলাম।এতে আমার অন্যায় টা কোথায়?

ইভান সেই কথা শুনে চিৎকার করে বললো,এটাই অন্যায় যে তুমি ওই রুমে গিয়েছিলে।খবরদার!মৌরির আশেপাশেও যাবে না।তোমার যেটা কাজ শুধুমাত্র সেটাই করবে।বুঝলে?
অতশী তখন বললো,আপনি এতো ভয় পাচ্ছেন কেনো?আমি কি ছেলে মানুষ যে আপনার বোন কে উঠিয়ে নিয়ে যাবো?
–শাট আপ অতশী!তুমি যে এতো নির্লজ্জএকটা মেয়ে আমার জানা ছিলো না।
অতশী সেই কথা শুনে বললো, আমি না হয় নিলর্জ্জ, আমাকে দেখলে না হয় আপনার গা জ্বলে ওঠে।যদিও এর কারণ আমি জানি না, তবুও একটা কথা জানার ভীষণ ইচ্ছা আমার,
যাকে ভালোবাসেন,যার ছবি মনের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছেন,যার জন্য একসময় পাগল ছিলেন সেও কি আমার মতোই নির্লজ্জ!
ইভান সেই কথা শুনে অতশীর হাত ছেড়ে দিলো।আর বললো,আমি আগেও বলেছি আর এখনো বলছি, আমি কাউকে ভালোবাসি না,আর আমি কারো জন্য পাগল নয়!
এই বলে ইভান রুম থেকে বের হয়ে গেলো।

মৌরি ইতোমধ্যে তার রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে শুয়ে আছে।
ইভান সোজা মৌরির রুমে চলে গেলো।
ইভান কে দেখামাত্র মৌরি বিছানা থেকে উঠে এলো।

ইভান তখন বললো তুই অতশীকে ডেকেছিস?
মৌরি মাথা নাড়িয়ে বললো হুম।
–কেনো?
মৌরি কোনো উত্তর দিলো না।সে নিচ মুখ হয়ে থাকলো।
ইভান তখন বললো চুপ করে আছিস কেনো?জবাব দি।আমার বারণ করা সত্ত্বেও ওকে আজ কেনো ডেকেছিস?
আমি বলেছি না ওর সাথে মিশবি না এমনকি কোনো কথাও বলবি না।
মৌরি তখন বললো,কেনো?ওর সাথে মিশলে কি হবে?তুমি ওকে কেনো এতো অপছন্দ করো ভাইয়া?এর কারণ কি?
ইভান তখন চিৎকার করে বললো,তুই জানিস না আমি অয়ন কে অপছন্দ করি।অয়ন কে দেখলে আমার গায়ের রক্ত গরম হয়ে যায়!
–মানে!অয়নের সাথে অতশীর কি সম্পর্ক?

–অতশী অয়নের বোন হয়।অয়ন আর অতশী আপন ভাই বোন।

মৌরি একদম অবাক হয়ে গেলো।সে ভাবতেও পারে নি অতশী আর অয়ন আপন দুইভাই বোন।তাছাড়া অয়ন কখনোই বলে নি অতশীর কথা।

হঠাৎ রুমে মুহিব সাহেব আসলেন।তিনি এসে ইভান কে বললেন,বাবা ইভান!তুমি এ রুমে কি করো?পাত্রপক্ষের সাথে কথা বলতে হবে না?সবাই তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।
ইভান সেই কথা শুনে তার বাবার সাথে চলে গেলো।
এদিকে পাত্রপক্ষ কি ডিসিশন দিবে সেটা শোনার জন্য সবাই অধীর আগ্রহে বসে আছে।ইভানও চলে গেলো সেখানে।
পাত্রপক্ষের কারোরই মৌরিকে ভালো লাগে নি।সেজন্য তারা এই সমন্ধ এখানেই থামাতে চান।কিন্তু সেটা নিজদের মুখে আর বললো না।তারা জানালো বাসায় গিয়ে ডিসিশন নিয়ে তবেই জানাবে।
পাত্রপক্ষের কথা শুনে ইভানের কিছুটা সন্দেহ হলো। কারণ তাদের যদি পছন্দ হতো তাহলে আজকেই বলে দিতো।এভাবে সময় নেওয়ার মানে টা কি?তার মানে কি পছন্দ হয় নি মৌরি কে?তার বোন তো অপছন্দ হওয়ার মেয়ে নয়!
নিশ্চয় অতশী কিছু করেছে।এই জন্য ইভান অতশীকে খুঁজতে লাগলো।

ইভান খুঁজতে খুঁজতে অতশীকে তার রুমের মধ্যে পেলো।ইভান রুমে ঢুকতেই দেখে অতশীর হাতে তার ডায়রি।
অতশী মনোযোগ দিয়ে ডায়রি টা দেখছে।
অতশী ডায়রির পৃষ্ঠা উল্টাতেই ইভান ডায়রি টা ছোঁ মেরে কেড়ে নিলো আর বললো,আমার ডায়রি কোন সাহসে ধরেছো?আর তুমি আমার রুমে কেনো?

অতশী তখন বললো,
যে সাহসে আপনি আমাকে পার্সেল পাঠাতেন।যে সাহসে আপনি আপনার মনের সমস্ত অনুভূতি চিরকুটের মাধ্যমে প্রকাশ করতেন।

ইভান অতশীর কথা শুনে চুপ করে রইলো।সে বুঝতে পারলো অতশী সব জেনে গেছে।

অতশী তখন ইভানের হাত ধরে বললো,
হঠাৎ কি এমন হলো যে আপনি আমাকে ভুলে গেলেন!আমাকে একদম সহ্য করতেই পারছেন না।

ইভান তখন অতশীর হাত ছেড়ে দিয়ে বললো,তুমি কি শুরু করেছো এসব?আবোলতাবোল বলা বন্ধ করো।নিজের আবেগ নিজের কাছেই রাখো।

অতশী তখন চিৎকার করে বললো,আপনি এর পরও মিথ্যা কথা বলছেন?
কেনো?
আপনি আমাকে যতগুলো চিরকুট পাঠিয়েছেন আর তাতে যা যা লেখা ছিলো সবকিছু আমি আপনার ডাইরিতে দেখলাম।

ইভান এবার রুম থেকে বের হয়ে যেতে ধরলো।
অতশী তখন ইভানের হাত ধরে বললো,
আমি কি আপনাকে আগে প্রেম নিবেদন করেছি?না কোনো চিরকুট পাঠায়ছি?সব কিছু আপনি শুরু করেছেন।এখন কেনো এভাবে লুকোচুরি করছেন।ভালো না বাসলেন কিন্তু আমার তো জানার অধিকার আছে কি জন্য আমাকে এসব প্রেমপত্র পাঠাতেন?

ইভান তখন বললো,হ্যাঁ আমিই এসব পাঠাতাম।কারন প্রথম দেখাতেই তোমাকে আমি ভালোবেসে ফেলি।কিন্তু নিজের ভালোবাসার কথা মুখ ফুটে বলতে পারছিলাম না।সেজন্য রোজ রোজ এসব পার্সেল পাঠাতাম।কিন্তু যখন জানতে পারলাম তুমি অয়নের বোন মুহুর্তের মধ্যে আমার মন টা ভেংগেচুরে গেলো।আমি ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করলাম তোমাকে।আর এখন সম্পূর্ণভাবে ভুলেও গেছি।

অতশী সেই কথা শুনে ইভানের কাছে এগিয়ে এলো।
আর বললো,কেনো?কি করেছে আমার ভাইয়া?কেনো ওর উপর এতো রাগ?

ইভান তখন বললো,তোমার ভাই আমার বোনের মাথা নষ্ট করে ফেলেছে।সেজন্য সে তাকে ছাড়া কিছুই বুঝছে না এখন।কিন্তু আমি বেঁচে থাকতে অয়নের সাথে আমার বোনের সম্পর্ক কখনোই মানবো না।

অতশী ইভানের কথা শুনে বললো,ভাইয়া মৌরিকে ভালোবাসে!কি বলছেন এসব?তারমানে ভাইয়াই মৌরির সেই বয়ফ্রেন্ড!
ভাইয়া আপনার বোনকে ভালোবাসে বলেই আপনি আমাকে এড়িয়ে চলছেন?

ইভান তখন বললো,না।সেজন্য না।

ইভান আজ আর কিছু গোপন রাখতে পারলো না।সে অতশীকে বললো,তোমার ভাইয়া একজন সন্ত্রাস। সে একটা গ্যাং এর সাথে যুক্ত আছে।টাকার বিনিময়ে মানুষ খুন করে সে।

অতশী ইভানের কথা কিছুতেই বিশ্বাস করলো না।সে উলটো ইভান কেই সন্ত্রাস বলে গালিগালাজ করতে লাগলো।

ইভান তখন বললো,তুমি কি আমার আসল পরিচয় জানো?আমি কি করি?আমার কাজ কি?

অতশী তখন বললো কি আর করবেন?আপনি যে একজন সন্ত্রাস তা আমি আগে থেকেই জানি।কারণ সন্ত্রাস ছাড়া কারো কাছে কখনো পিস্তল থাকে না।আর নিজের দোষ ঢাকানোর জন্য আমার ভাইকে সন্ত্রাস বলে চালিয়ে দিচ্ছেন!

ইভান তখন বললো,আমি কোনো সন্ত্রাস না।আর আমি ভার্সিটির কোনো বড় ভাই ও না।আমি একজন সি আই ডি অফিসার।

অতশী মুহুর্তের মধ্যে শকড খেয়ে গেলো।ইভান কি বলছে এসব!

ইভান তখন বললো আমি মাত্র জয়েন করেছি।আর আমি একটা তদন্তের জন্যই রোজ রোজ ভার্সিটিতে যেতাম।কারণ ভার্সিটির অনেক স্টুডেন্ট ই এই গ্যাং এর সাথে যুক্ত।তোমার ভাইয়ার ফ্রেন্ড বলে যাদের কে জানো তারা সবাই এই গ্যাং এর সাথে যুক্ত।

অতশী এবার একটু একটু বিশ্বাস করলো।কারন সেই জন্য হয় তো তার ভাই তানিমের সাথে তার বিয়েটা মেনে নিতে চাইছিলো না।তার কোনো ফ্রেন্ডকে কখনো বাসার মধ্যে আনতো না।

অতশী তখন বললো,আপনারা তো জানেনই অয়ন ভাইয়া একজন সন্ত্রাস তাহলে আপনার বাবা ভাইয়াকে কেনো ছাড়িয়ে আনলেন?
–অয়ন তমাল কে খুন করে নি।সে সম্পূর্ণ নির্দোষ। তমাল কে খুন করেছে তানিম।তাছাড়া বাবা তো জানেই না অয়ন একজন সন্ত্রাস।তাহলে কখনোই অয়নের পক্ষ নিতো না।
আমার পরিবারের কেউ যদি জানতো তুমি একজন সন্ত্রাসের বোন, তাহলে কোনদিন কি আমার ভাইদের পড়াশোনার জন্য তোমাকে নিয়োগ করতো?

এটা আমাদের টিমের একটা সিক্রেট কথা ছিলো।তোমাকে উত্তেজনার বশায় বলে ফেললাম।এখন নিশ্চয় তুমি তোমার ভাইয়াকে বলে দিবে।
আর বলে দিলেও কোনো প্রবলেম নেই।আমরা প্রমাণ জোগাড় করে একদম হাতে নাতে ধরে ফেলবো সবাইকে।যেখানেই লুকিয়ে থাকে না কেনো?

অতশী তখন চিৎকার করে বললো,আমি বিশ্বাস করি না,আমার ভাইয়া এরকম কাজ করতেই পারে না।কারণ আমার ভাইয়া সবার থেকে সেরা।আপনি কখনোই আমার ভাইয়ার আশেপাশে যাবেন না।আমার ভাইয়ার যদি কোনো ক্ষতি হয় একদম শেষ করে ফেলবো আপনাকে।এই বলে অতশী দৌঁড়ে তার বাড়ি চলে গেলো।

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here