#অনুভবে_তুমি
#পর্ব__৪৩
#মুমতাহিনা_জান্নাত_মৌ
ইভান কেয়ারটেকার লতিফ কে ফলো করতে লাগলো। সেজন্য সে বাসার বাহিরে সিসিটিভি ক্যামেরা সেটিং করলো।ইভান বুঝতে পারছে লতিফের মধ্যে কোন গড়বড় আছে।তা না হলে লতিফ কেনো মিথ্যা কথা বলবে?অতশীর যে কোনো বয়ফ্রেন্ড নাই ইভান এ ব্যাপারে নিশ্চিত।কারণ সে অতশীকে অনেক বেশি বিশ্বাস করে।কিন্তু ইভান এখন পর্যন্ত তার বাবাকে বিন্দুমাত্র সন্দেহ করতে পারলো না।সে বুঝতেই পারছে না এসবের পিছনে তার বাবার হাত আছে।তার বাবা নিজেই একজন নামকরা সন্ত্রাসী।মুহিব সাহেব পেশায় একজন উকিল হলেও তিনি সবার চোখের আড়ালে এসব অপরাধ করে থাকেন।লতিফ মুহিবের একজন বিশ্বস্ত সহযোগী, যে শুধু একজন সাধারণ কেয়ারটেকার নয়।
মুহিব সাহেব একজন এতিম ছেলে ছিলেন। আকবর নামের কোনো এক সন্ত্রাসী তাকে দত্তক নেই।কারণ আকবরের নিজের কোনো সন্তান ছিলো না।আকবরের কাছে থাকতে থাকতেই মুহিব সাহেব সবকিছু শিখে ফেলেন।কিন্তু আকবর কখনোই চাইতেন না মুহিব এ পেশায় আসুক।সেজন্য আকবর মুহিব কে পড়ালেখা করান যাতে সে তার মতো একজন সন্ত্রাসী না হয়।আকবরের খুব ইচ্ছা ছিলো মুহিব কে তিনি অনেক বড় একজন উকিল বানাবেন।কিন্তু মুহিবের এসব পড়ালেখায় তেমন কোনো আগ্রহ ছিলো না।তবুও আকবরের জোরাজোরি তে করতে হয়েছে পড়ালেখা।আর আকবরের জন্যই সে আজ উকিল হতে পেরেছে।
হঠাৎ একদিন পুলিশের হাতে আকবর ধরে পড়ে।এবং পুলিশ আকবরের পরিবারকেও খুঁজতে থাকে।কিন্তু আকবরের স্ত্রী মুহিবের কেরিয়ারের কথা চিন্তা করে তাকে নিয়ে পালিয়ে গ্রামে চলে যায়।এবং ওখানেই থাকা শুরু করে।কিছুদিন থাকার পর মুহিব গ্রাম থেকে আবার শহরে চলে আসে।আর আবার তার পেশায় যুক্ত হয়।সে সবসময় শুধু ভাবতে থাকে কি করে তার বাবাকে ছাড়িয়ে আনবে কিন্তু পারে না।এর মধ্যে আকবরের ফাঁসির আদেশ হয়।তাকে যখন কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয় রাস্তার মধ্যে কিছু সন্ত্রাসী পুলিশদের উপর এট্যাক করে। তার বাবার বিশ্বস্ত কয়েকজন সন্ত্রাসীদের নিয়ে মুহিব নিজেই এই গ্যাং টা তৈরি করেছিলো,যাতে সে তার বাবাকে ফাঁসির হাত থেকে মুক্ত করতে পারে।এজন্য সন্ত্রাসী আর পুলিশের মধ্যে তুমুল লড়াই হচ্ছিলো।মুহিব নিজেও উপস্থিত ছিলো সেখানে।সে তার বাবাকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করবে দেখেই এসেছিলো।কিন্তু হঠাৎ সন্ত্রাসীগুলো আকবরকেই গুলি করতে থাকে।মুহিব দূর থেকে সব দেখছিলো।সে ভাবতেই পারে নি তার বাবার বিশ্বস্ত লোকই তাকে খুন করবে।এদের চক্রান্তেই আকবর পুলিশের কাছে ধরা পড়েছিলো।কারণ আকবর না থাকলে তার পদ টা এরা দখল করতো।নিজের চোখে এই দৃশ্য দেখে মুহিবের মাথা গরম হয়ে যায়।সে সিদ্ধান্ত নেয় এদের সবাইকে সে নিজের হাতে খুন করবে।যেমন ভাবা তেমন কাজ।মুহিব সকল সন্ত্রাসীদের নিজের হাতে খুন করে।এইভাবে তার সাহস বেড়ে যায়।তারপর সে নিজেই তার বাবার জায়গা টা দখল করে।এভাবে ধীরে ধীরে মুহিব তার বাবার পেশাটাই গ্রহণ করে।তবে সে এখন পর্যন্ত কারো সামনে যায় নি।সে ছদ্মবেশেই এতো বড় একটা গ্যাং তৈরি করেছে।সেজন্য এখন পর্যন্ত মুহিবকে কেউ চিনতে পারে নি।বা তাকে ধরতে পারছে না।মুহিব সাহেবের কথা কারো মাথাতেই আসে না।ইভান এতো বড় একজন সি আই ডি অফিসার হয়েও বুঝতে পারছে না।আর বুঝবেই বা কি করে? সে তো জানে তার বাবার মতো সৎ আর আদর্শবান লোক আর কেউ নাই।
ইভানের নানাও একজন নামকরা উকিল ছিলেন।তিনি মুহিবের ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে তার মেয়ের সাথে বিয়ে দিয়ে দেন।মুহিব বিয়ের পর এই জগত থেকে সরে আসতে চেয়েছিলো। কিন্তু পারে নি।মানুষ খুন করা তার নেশা হয়ে গিয়েছিলো। মুহিব সাহেব ভাবতেও পারে নি তার নিজের ছেলেই একদিন এতোবড় একজন সি আই ডি অফিসার হবে।আর তাকে ধরার জন্য পাগল হয়ে যাবে।অন্য কেউ হলে তাকে কবেই শেষ করে ফেলতেন মুহিব সাহেব।কিন্তু নিজের ছেলে দেখে ইভানের কোনো ক্ষতিই করতে পারছেন না তিনি।তা না হলে পথের কাঁটা কবেই উপড়ে ফেলতেন।
তবে ইভান তার বাবাকে সন্দেহ না করলেও অতশী বুঝতে পারে।সে সেদিন মুহিব সাহেব কে ফলো করতে করতে তার পিছু পিছু চলে যায়।আর মুহিব সাহেব এবং কেয়ারটেকার লতিফের কিছু কথা শুনতে পারে।কিন্তু অতশী পালানোর আগেই ইভানের বাবা অতশীকে দেখে ফেলে। সেজন্য সাথে সাথে অতশীর চোখে মুখে কাপড় পেঁচিয়ে তাকে ধরে ফেলেন।আর তার হাত পা বেঁধে তাকে দূরে কোথাও নিয়ে যান।কিন্তু ইভান সন্দেহ করবে দেখে তাকে বলে সে নিজের ইচ্ছায় কোনো এক ছেলের সাথে বাহিরে গিয়েছে।কারণ ইভানের বাবা জানে ইভান পালটা প্রশ্ন করবে,যে অতশী কিভাবে উধাও হলো?এতো লোকজনের মধ্যে তাকে কেউ কিভাবে ধরে নিয়ে গেলো?
এদিকে আহসানকে ধরে ফেলায় সারাদেশে তোলপাড় শুরু হয়ে গেলো।কারণ কেউই বিশ্বাস করতে পারছে না আহসান এতো বড় একজন সন্ত্রাসী!শুধু আহসান না,এক এক করে অনেকের নামই বের হয়ে আসলো যারা যারা এতোদিন আড়ালে ছিলো।আহসান কে রিমান্ডে নেওয়া হলে তাকে অনেক বেশি নির্যাতন করা হয়।তবুও সে মুখ খুলতে চাইছিলো না।তবে যখন সে আধামরা হয়ে যাচ্ছিলো তখন তাকে আবার জিজ্ঞেস করা হলে সে কিছু কথা শেয়ার করে সবার সাথে।।আহসান জানায় তাকেও শপথ করে নেওয়া হয়েছে।এজন্য সে বলতে চাইছিলো না।তবে সে সত্যি জানে না তাদের সেই বড় লিডার কে?তার লিডারের সাথে শুধু তার ফোনে কথা হয়। তার লিডারের নির্দিষ্ট কোনো ফোন নাম্বার ছিলো না।একেক দিন একেক নাম্বার থেকে কল দেয় তিনি।তার লিডার তাকে কল করে আর আহসান সেই অনুযায়ী কাজ করে।আহসান এই কাজে তার শশুড়ের কোম্পানি টা কাজে লাগায়।আহসানের শশুড় মারা গেলে আহসান তার শশুড়ের কোম্পানি টা দেখাশোনা করে আর এই কোম্পানি তে যত ইয়ং ছেলে চাকরি করতে আসে তাদের ব্লাকমেল করে এভাবে সন্ত্রাসী পেশায় যুক্ত করে।এই ব্লাকমেলের স্বীকার হয়েছে অয়ন। যার জন্য অয়ন আজ এতো বড় একজন সন্ত্রাসী।আহসানের কারণেই মুহিব সাহেবের গ্যাং টা এতো বড় হয়েছে।সেজন্য মুহিব সাহেব আহসান কে অনেক বেশি ক্ষমতা আর দায়িত্ব দিয়েছেন।আহসান নিজেই সবগুলো গ্যাং পরিচালনা করে। সেজন্য সবাই আহসান কেই লিডার ভাবে।আহসান আর চুপ করে থাকতে পারলো না।সে এক এক করে সকল পুলিশ অফিসারের নাম বলে দিলো যারা যারা তাকে সাহায্য করতো।দেখা গেলো অর্ধেক পুলিশের লোকই টাকার বিনিময়ে আহসানের কাছে বিক্রি হয়ে গেছে।অফিসার আকরাম ও ছিলো এদের দলে।
এবার শুভ্র আর অয়নও মুখ খুললো।তারা বলে দিলো যে শুভ্রর ফ্যামিলিকে ধরে নিয়ে গেছে আহসান।যার জন্য তারা দুইজনই মিথ্যা বলেছে।আহসান কে যখন জিজ্ঞেস করা হলো এ ব্যাপারে সে জানালো এসব কিডন্যাপ এর কাজ তার লিডার নিজেই করে।সে এসবের ব্যাপারে কিছু জানে না।
অয়ন কে মুক্তি না দিলেও শুভ্র কে মুক্তি দেওয়া হলো।এবং সে আবার তার সি আই ডির পদ ফিরে পেলো।
এবার ইভান আর তার টিমকে দায়িত্ব দেওয়া হলো আহসানের থেকে সেই ফোন নাম্বার গুলো নিয়ে এর আসল মালিক কে খুঁজে বের করা।কিন্তু ইভান অতশীকে খোঁজার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।সেজন্য সে অন্য কাউকে এই দায়িত্ব দিতে বলে।কারণ ইভান অতশীকে না পেয়ে একদম পাগলের মতো হয়ে গেলো।সে আর সন্ত্রাসীর পিছনে না ছুটে সবকিছু ফেলে অতশীকে খুঁজতে লাগলো।ইভান বুঝতে পারছে না কাকে ধরবে এখন?আর কোথায় খুঁজবে অতশীকে?
এদিকে আহসানের দেওয়া নাম্বার গুলো এক এক করে ট্রাকিং করতে লাগলো পুলিশ।নাম্বার ট্রাকিং করে সেই ঠিকানায় পৌঁছে গেলো পুলিশ।কিন্তু যার নামে সীম রেজিষ্ট্রেশন করা আছে তারা কেউই বেঁচে নেই।তাদের পরিবারের লোকেরা জানালো কেউ একজন খুন করেছে তাকে।এইভাবে প্রতিটা ঠিকানায় গিয়ে পুলিশ সেম তথ্য পেলো।যাদের নামে সীম রেজিষ্ট্রেশন করা তারা প্রত্যেকই মৃত্যু বরণ করেছে।এ থেকে পুলিশ ধারণা করলো সন্ত্রাসী এসব লোকদের খুন করে তাদের সীমটা ব্যবহার করছে।আর নানা রকমের অপকর্মে লিপ্ত হচ্ছে।পুলিশ কিছুই করতে পারলো না।সেজন্য তারা চুপচাপ থাকলো।
কিন্তু এভাবে চুপচাপ থাকলে হবে না।তা না হলে সন্ত্রাসী কে কখনোই ধরা যাবে না।সেজন্য উপর থেকে আবার ইভানকে দায়িত্ব দেওয়া হলো।কিন্তু ইভান এবারও না করে দিলো।কারণ সে কিছুতেই তার কাজে মনোযোগ দিতে পারছে না।কারণ এই মুহুর্তে তার অতশীকে খোঁজা বেশি প্রয়োজন।সে এখন সন্ত্রাসী ধরার মুডে নাই।দরকার হলে সে চাকরিই ছেড়ে দেবে তবুও এসব দায়িত্ব কাঁধে নেবে না।
ইভানের এমন পাগলামি দেখে শুভ্র,দিশান,নীলয় ভীষণ টেনশনের মধ্যে পড়ে গেলো।তারা বুঝতেই পারছে না ইভানকে কিভাবে তার দায়িত্বে ফেরাবে।সেজন্য ওরা ইভানকে অনেক বোঝালো। শুভ্র আর দিশান অনেক বেশি রিকুয়েষ্ট করলো তাকে।যে এবার যেনো ইভান রাজি হয়।এভাবে ইভান যদি তার দায়িত্ব থেকে সরে পড়ে তাহলে ব্যাপার টা আর কেউই সলভ করতে পারবে না।এটা ইভানের জন্য অনেক বড় একটা চ্যালেঞ্জ। ইভান সবার রিকুয়েষ্ট এ আর চুপ করে বসে থাকতে পারলো না।সে তার তিন বিশ্বস্ত সহযোগী শুভ্র,দিশান আর নীলয় কে নিয়ে মাঠে নেমে পড়লো।ইভান বর্তমানে সবচেয়ে বেশি আতংকের মধ্যে আছে।একদিকে অতশীর জন্য চিন্তা অন্যদিকে দেশের সবচেয়ে বড় একজন সন্ত্রাসী কে ধরার চ্যালেঞ্জ! সে বুঝতেই পারছে না এর শেষ পরিনতি কি?
ইভান প্রথমেই সীম ট্রাকিং করা সেই ঠিকানায় আবার খোঁজ নিতে লাগলো।সে এক এক করে সবগুলো লোকের চোদ্দগুষ্টি সম্পর্কে জানতে লাগলো।এইভাবে খুঁজতে খুঁজতে ইভান আজ এক মহিলার বাড়ি পৌঁছে গেলো।মহিলাটির নাম ছিলো মুন্নি বেগম।কারণ এই মুন্নি বেগমের নামেও সীম রেজিষ্ট্রেশন করা আছে।আর এই সীম থেকেও আহসানের লিডার ফোন দিয়েছিলেন।মুন্নি বেগমের খোঁজ নিতে গিয়ে ইভান দেখলো তিনি এখনো বেঁচে আছেন।তবে মহিলা টি একদম মৃত্যু শয্যায়,সেজন্য এই মহিলাকে কিছু জিজ্ঞেস করলেও তো তার থেকে কোনো উত্তর পাওয়া যাবে না।সেজন্য ইভান মুন্নি বেগমের সেবায় নিয়োজিত মহিলা দুইদিকে জিজ্ঞেস করলো।কিন্তু মহিলা দুইটি কিছুই বলতে পারলো না।তখন ইভান উলটো প্রশ্ন করলো এই মহিলার আত্নীয় স্বজন কোথায়?মহিলা দুইটি তখন দুইজন দুইজনার দিকে তাকালো।আর বললো,আমরা কিছুই জানি না।আমরা শুধু এনার সেবা করি।ইভান তখন জিজ্ঞেস করলো আপনারা কি নিজের থেকে সেবা করছেন না কেউ বলেছে আপনাদের?
মহিলা দুইটি তখন বললো না কেউ বলে নি।আমরা মানবতার খাতিরে দেখাশোনা করছি এনার।কারণ আমাদের বাড়ি পাশেই।চোখের সামনে মহিলাটির এমন দুর্দশা দেখে আর চুপ করে থাকতে পারি নি।সেজন্য আমরা নিজেরাই সেবা করছি।যতদূর শুনেছি এনার কোনো আত্নীয় স্বজন নাই।ইনি কোথায় থেকে এসেছেন সেটাও জানি না।
ইভানের মাথা এবার চক্কর দিতে লাগলো।সে বুঝতে পারলো না এই বুড়ির সাথে সন্ত্রাসীর কিভাবে যোগসূত্র থাকতে পারে?নীলয় তখন বললো স্যার এমনতো হতে পারে এনার কোনো ছেলে ছিলো আর তাকেই খুন করে তার সীমটা নিয়ে নিয়েছে সন্ত্রাসী।হয় তো সেই সীমটা এই বুড়ির নামে ছিলো।
ইভান তখন বললো হতে পারে।কিন্তু আমি ভাবছি অন্য কথা।যে মহিলা দুইটি সেবা করছে মুন্নি বেগমের, এদের মুখ চোখ দেখে মনে হলো এরা মিথ্যা কথা বলছে।এরা এমনিতেই কখনো এই মহিলার সেবা করতেই পারে না।নিশ্চয় বুড়ির কোনো সম্পদ আছে।আর সে লোভেই এরা বুড়ির সেবা করছে।আমাদের খোঁজ নিতে হবে।কেনো জানি আমার অনেক বেশি সন্দেহ হচ্ছে।কারণ মানুষ স্বার্থ ছাড়া কখনোই কাউকে সাহায্য করে না। আর এই মহিলা দুইজন কি করে কোনো স্বার্থ ছাড়াই অসুস্থ মুন্নি বেগমের সেবা করতে পারে?
#চলবে,