#কন্ট্রাক্ট_অফ_ম্যারেজ
Sadia afrin nishi
“পর্ব-২২”
বিষন্ন মনে ছোট্ট ছোট্ট পদচারণে বেলকনির দিকে অগ্রসর হচ্ছে মৃধা। শরীর টা ভীষণ খারাপ তার। মাথায় প্রচন্ড যন্ত্রণা হচ্ছে। চোখজোড়া অসম্ভব ফোলা। হয়তো সারারাত কান্না করার ফলে এমনটা হয়েছে। আয়ান তাকে এতটা অবিশ্বাস করে এটা সে কখনোই ভাবেনি। এই সামান্য করানে আয়ান তাকে প্রত্যাখ্যান করেছে? সবকিছু না জেনে শুনে এভাবে অন্যের কথা নিজের ভালবাসাকে অবিশ্বাস করাটাকে আর যাই হোক অন্তত ভালবাসা বলা যায় না। মৃধা নিজের মনে শপথ করে নিল, সে আর কখনোই আয়ানের কাছে কিচ্ছু প্রমান করতে চাইবে না। কী হবে প্রমাণ দিয়ে? যে ছেলের ভালবাসায় বিশ্বাস নেই তাকে কীসের প্রমাণ দেবে মৃধা? এখনও যদি সে আয়ানের আয়ত্তে চলাফেরা করে তাহলে নিজের বিবেকের কাছে চরম মাত্রায় পরাজিত হতে হবে তাকে। কিন্তু মৃধা সেটা কখনোই করবে না।
গতরাতে আয়ান নেশার ঘোরে মৃধাকে সেই ভিডিও সহ সেদিনকার সমস্ত ঘটনা খুলে বলেছে। মৃধা প্রথমে ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিল কারণ সে ভেবেছিল আয়ান তার সঙ্গে স্বামীর অধিকার ফলাতে চায়। কিন্তু না সেই মুহূর্তে আয়ান তাকে অবাক করে দিয়ে বাচ্চাদের মতো কান্না শুরু করে দেয়। মৃধার হাতজোড়া তখন আয়ানের দু’হাতে আবদ্ধ আর আয়ানের মুখ মৃধার গলার মাঝ বরাবর অবস্থানকৃত। আয়ানের এমন কান্নার মানে মৃধা কিছুই বুঝতে পারছিল না। পরক্ষনেই আয়ানকে জিজ্ঞেস করলে সে নেশার ঘোরে সবটা স্বীকার করে নেয় মৃধার কাছে।স্বীকার করে নেয় মৃধাকে ঘিরে শুরু থেকে তার লুকায়িত অনুভূতির কথা এবং বিয়ের দিনে ঘটে যাওয়া ঘটনা । তারপর ওভাবেই মৃধার শরীরের ওপর নিজের সমস্ত ভর ছেড়ে দিয়ে পাড়ি জমায় ঘুমরাজ্যে। মৃধার চোখে ঘুম নেই। সে শুধু একটা কথাই ভাবছে, এত ভালবাসার পরেও একটা মানুষ কীভাবে পারে এত সহজেই অবিশ্বাস করতে তাও আবার সামান্য একটি ভিডিও ক্লিপ এর ওপর নির্ভর করে।
————————-
আহিবা মৃধার বেস্ট ফ্রেন্ড হওয়ার সাপেক্ষে আগে থেকেই মুগ্ধের সাথে তার ভালো সম্পর্ক। মৃধার মতো আহিবাকেও মুগ্ধ বোনের মতো ভালবাসে। এ বাড়িতে এসে মৃধার সাথে সাথে আহিবাকেও সারাজীবনের জন্য একত্রে পেয়ে মুগ্ধ অনেক খুশি হয়েছে। আজ মুগ্ধের এইচ.এস.সি পরীক্ষার রেজাল্ট বের হবে। মুগ্ধ আপাতত অনেকটাই নার্ভাস। সে জানে তার পরীক্ষা ভালো হয়েছে তবুও চিন্তা কিছুতেই কমে না। আহিবা কিচেনে গিয়েছিল পানি আনতে সেখান থেকে মুগ্ধকে অস্থির হয়ে পায়চারি করতে দেখে তার কেমন একটা খটকা লাগলো। সে পানির জগটা রেখে দ্রুত মুগ্ধর কাছে ছুটে এসে বলল,
–‘ কী হয়েছে ভাই? এভাবে অস্থির হয়ে পায়চারি করছিস কেন?’
মুগ্ধ ভীত কন্ঠে বলল,
–‘ আরে আহিবা আপু ওপস সরি ভাবি। শোনা না আজকে আমার রেজাল্ট ঘোষণা হবে। টেনশনে মরে যাচ্ছি আমি। ‘
আহিবা মুগ্ধের এক কান টেনে দিয়ে বলল,
–‘ এতো টেনশনের কী আছে বুদ্দু। আমি জানি তোর রেজাল্ট খুব খুব খুব ভালো হবে। ‘
মুগ্ধ আহিবাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
–‘ তাই যেন হয় ভাবি। ‘
আহিবাও মুগ্ধকে জড়িয়ে ধরে বলে,
–‘ ইনশাল্লাহ হবে। আচ্ছা শোন বাসার কেউ জানে না তোর যে রেজাল্ট বের হচ্ছে আজকে?’
–‘ নাহ এখানো কাউকে বলিনি। এই তোমাকে বললাম শুধু। বাড়িতে একবারে রেজাল্ট হাতে পেয়ে জানাব। তুমি কিন্তু আগে থেকে কাউকে বলবে না। ‘
–‘ আচ্ছা ঠিক আছে বলব না কাউকে। ‘
–‘ হুমমমম’
তারপর আহিবা চলে গেল আদ্র সহ বাকি সবাইকে ব্রেকফাস্ট করার জন্য ডাকতে। আর এদিকে মুগ্ধ আহিবা যেতেই সঙ্গে সঙ্গে ডাইনিং টেবিলে লাফ দিয়ে বসে পরেছে। টেনশনে কী করছে না করছে সে নিজেও বুঝতে পারছে না।
————————–
হৈ-হুল্লোড়ের শব্দে রুম থেকে বের হতে নেয় মৃধা। ঠিক তখনই আয়ানের সঙ্গে স্বজোরে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যেতে নেয় সে। কিন্তু পড়ায় আগেই আয়ান তাকে নিজের বক্ষঃস্থলে আবদ্ধ করে নেয়। মৃধার ঘটনাটা বুঝতে কিয়ৎক্ষণ সময় লাগে। নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক করে নিয়ে মৃধা আয়ানকে ধাক্কা মেরে দুরে সরিয়ে দেয়। তারপর গটগট করে হেঁটে বাহিরে চলে যায়। ঘটনার আকষ্মিকতায় আয়ান হতভম্ব। উপকার করল অথচ ধন্যবাদের বদলে রাগ দেখতে হলো কেন? মৃধার আচরণে সকাল থেকেই ভয়াবহ পরিবর্তন লক্ষ্য করছে সে। কিন্তু এই পরিবর্তনের কারণ তার অজানা।
নিচে নেমে পুরো ঘটনা নিজের মস্তিষ্কে আয়ত্ত করে নিয়ে মৃধার আনন্দ আর দেখে কে। মুগ্ধ এইচএসসি-তে প্লাস পেয়েছে। এই খবর পেয়ে বাড়ি শুদ্ধ সবাই ভীষণ খুশি। আহিবা তো খুশিতে লাফিয়ে উঠে মুগ্ধকে বলছে,
–‘ কী বলেছিলাম না তোর রেজাল্ট ভালো হবেই।’
এদিকে আফরোজ চৌধুরী বলে দিয়েছেন মুগ্ধের ভালো রেজাল্টের জন্য বাড়িতে বড় করে সেলিব্রেশন হবে। কিন্তু মুগ্ধ এই প্রস্তাবে ঘোর আপত্তি জানিয়েছে। সে বলেছে সেই টাকা এতিমখানা সহ বিভিন্ন বৃদ্ধাশ্রমে বিতরণ করে দিতে। তাহলে অন্তত এতিম,বৃদ্ধ মানুষগুলো তার জন্য দোয়া করবে। সেই দোয়ায় সে আরও অনেক দুর যেতে পারবে। মুগ্ধের এমন সিদ্ধান্তে আপ্লুত সবাই। সবার ছোট হয়েও তার মধ্যে কী সুন্দর স্বচ্ছ চিন্তাধারা। এসব চিন্তার সঞ্চার হয়তো সেই ছোট্ট কুঁড়েঘরের জীবন থেকে হয়েছে। আয়েশ চৌধুরী ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন,
–‘ আমার ছেলেটা সত্যি সত্যিই অনেক বড় হয়ে গেছে। দোয়া করি এমন চিন্তাধারা তোমার মস্তিষ্কে সারাজীবন অব্যাহত থাকুক। গরীবদের কথা চিন্তা করে যে জন, তার কথা সয়ং আল্লাহ তায়ালা চিন্তা করেন। তোমার এমন বিবেচনাবোধ দেখে আমি সত্যিই ভীষণ ভাবে আনন্দিত এবং গর্বিত।’
আয়েশা চৌধুরীর কথায় সবাই সায় দিল। তবুও একদম কিছু হবে না সেটাতো হয় না। আদ্র বলল আজ রাতে খাওয়া দাওয়ার মেনুটা কিছুটা চেঞ্জ করা হবে। আপাতত এটাকেই আমরা সেলিব্রেশন বলে ধরে নিতে পারি। আদ্রের প্রস্তাবে সবাই রাজি। আয়েশা চৌধুরী আর আহিবা বলল তারা দু’জনে নিজেদের হাতে রান্না করে মুগ্ধকে খাওয়াবে৷ তাদের সঙ্গে সায় জানিয়ে মৃধা বলেছে সে মুগ্ধর পছন্দের একটা কেক তৈরি করবে। আয়ান বলেছে তার তরফ থেকে গিফট আসছে রাতে। সবার সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে কার্যক্রম শুরু হয়ে গেল।
—————————–
যত আনন্দঘন পরিবেশই হোক না কেন আয়ানের মনটা খারাপ। মৃধা তাকে ক্রমাগত ইগনোর করছে। কিন্তু কেন? এতদিন তো মৃধা এমন করে নি। তাহলে আজ কেন এমন করছে? তার দিকে একটি বার ফিরে অব্দি তাকাচ্ছে না। তার মনটা ভীষণ ছটফট করছে। ইতিমধ্যে সে অনেক বার চেষ্টা করেছে মৃধার সঙ্গে কথা বলার কিন্তু ফলাফল শূন্য।
ইয়া বড় একটা কেক নিয়ে হাজির মৃধা। সকলেই কেকটার খুব প্রশংসা করছে। এদিকে আহিবা মুগ্ধের জন্য তৈরি করেছে কিছু পদের পিঠা,মিষ্টি। আশেয়া চৌধুরী ছেলের পছন্দের সমস্ত খাবারের পদ আর সেই সঙ্গে পায়েস রেঁধেছেন। আয়ান আর আদ্র গিফট নিয়ে হাজির হয়ে গেছে। তাদের একমাত্র ছোট ভাইয়ের সেলিব্রেশন বলে কথা। তবে সব খাবার ঘরোয়া পদ্ধতিতে তৈরি। এই সেলিব্রেশনের মূল আকর্ষণ এটাই।
সবকিছু তৈরি। ঠিক কেক কাটার জন্য প্রস্তুত মুগ্ধ। মৃধার পাশে দাড়িয়ে মৃধার তৈরি কেকটা কাটতে চলেছে মুগ্ধ। সবেমাত্র মোমবাতি গুলো নিভিয়েছে সে। তারপর যখনই কেকটায় ছুড়ি চালাতে যাবে ঠিক সেসময়ই কেউ “আয়ান” বলে জোরে ডেকে ওঠে। সবার দৃষ্টি মুহূর্তেই চলে যায় সদর দরজায়।
চলবে,