বিভাবতীর জীবন পর্বঃ৩

0
2734

#বিভাবতীর_জীবন
#লেখিকাঃতামান্না
#পর্বঃ৩

বিভা কাদঁতে কাদঁতে দেখল সবুজের ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন। ফোনটাকে আছড়ে ফেলে সে কাদঁতে লাগল।
এই জীবনটা রেখেই কি লাভ? কিছু নেই তার, কিছুই নেই!

সারাটা রাত বিভা এপাশ ওপাশ করে শুতে চেষ্টা করল।
এই সময়টা একটা মেয়ের জীবনে কতটা যন্ত্রণার তা ভাষায় প্রকাশ করার মত না। পাশ ফিরে দেখল মিলি ঘুমাচ্ছে। মিলিকে আর বিরক্ত করল না। মিলির দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগল।
মিলির সাজানো সংসার, কখনও কোন ঝামেলা হয়না, রেজওয়ান ও খুব ভালো মানুষ। বিভা যখন এইচএসসি দিচ্ছিল তখন মিলির পেটে মিলির মেয়েটা ছিল। গর্ভাবস্থায় রেজওয়ান তার অনেক খেয়াল রেখেছিল। মিলির স্বামী রেজওয়ান একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে।
হাতে সময় না পেলেও যেটুকু কেয়ার করতো তাতেই যথেষ্ট ছিল। বাড়ি থেকে কাজের মেয়ে আনার পর ও রেজওয়ান প্রতিদিন প্রায় একঘন্টা পরপর ফোন করে খোঁজ নিয়ে জানতো মিলি কি খাচ্ছে, মিলি কি করছে। পাচঁ মিনিটের ভরসা দেওয়া আর খোজ নেওয়া ফোনগুলো ঘন্টার পর ঘন্টা কাজ করে যেত। মিলির মুখের হাসি দেখাযেত সঙ্গে ফুটে উঠতো লজ্জার আভাস । এখনও মনে আছে বিভার, একদিন মিলি বিভাদের বাসায় বেড়াতে এসেছিল। সেখানেও এতগুলো মানুষের সামনে বসা অবস্থায় ফোন করে খবর নেওয়াটা তাকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেললে ও মিলির মুখটায় একটা উজ্জ্বলতা কাজ করতো।

বিভা কিছুটা খিচিঁয়ে বসলো, আজ শরীরটা কেমন করছে। এমন করছে কেন? কিছুক্ষণ নড়চড়ে বিছানায় আবার শুয়ে পরল বিভা। রাত প্রায় তিনটায় উঠে বসল,ঘুমই যখন আসে না তখন নাহয় তাহাজ্জুত নামাজ পড়া যায়। রাতের বেলায় উঠে অজু করে নামাজ পড়ে নিল সে।
নামাজ পরে কিছুক্ষণ সূরা ও দোয়া পাঠ করতে লাগল।
নিঝুম রাত্রীর ইবাদত নাকি রাব্বুল আলামিনের নিকট সবচেয়ে পছন্দনীয়। বিভা সূরা ও দোয়া পড়তে পড়তে দেখল ফজরের আজানের ধ্বনি আসছে। ফজরের নামাজটা পড়ার পরপরই উঠে দাড়ালো।
মিলির পাশে গিয়ে আবার শুয়ে পরল। মিলিকে জাগিয়ে নামাজ পড়তে বলে সে আবার ঘুমাতে চলেগেল।

পাচঁদিন হয়েগেছে বিভা এখানে আছে। মিলি একদিন ও তার যত্নে কোন অবহেলা করেনি। বরং নিজের মায়ের পেটের বোনের মত তাকে রেখেছে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে বিভার এখানে থাকাটা একদমই উচিৎ নয়। মিলি বা তার স্বামী রেজওয়ান হয়তো কিছু মনে করেনি। কিন্তু তাই বলে সে ও তো দায়িত্বজ্ঞানহীনের মত একজনের বাসায় পরে পরে থাকতে পারেনা। নিজের ব‍্যাগ ঘুছিয়ে নিল বিভা এবার বের হতে হবে তাকে। কিছু একটা করে হলেও এই জীবনের লক্ষ্য স্থীর করতে হবে। মিলির রুমের কাছে এসে মিলির সঙ্গে কথা বলার জন‍্য রুমে প্রবেশ করার আগেই শুনতে পেল তার বড় মামি মিলিকে বলছে –

–” বিভা যে এখানে এসেছে তুই আমাকে জানাসনি কেন?”

–” আম্মা, ও তো মাত্র পাচঁদিন হয়েছে এখানে এসেছে।
তাই অতটা বলার প্রয়োজন বোধ করিনি।”

–” মানি একটা মানুষ আজ পাচঁদিন তোর বাসায় পরে আছে। আরে বিপদে পাশে দাড়া নিষেধ করেনি তোকে তাই বলে একেবারের জন‍্য মেয়েটাকে ঘাড়ে তুলে নিবি?
আক্কেল জ্ঞান নেই তোর? তোর কি ঢাকায় ওদের মত ডুপ্লেক্স বাড়ি একটা সাত তলা বাড়ি আছে? তোর জামাই আর তুই তো নিজেদের সংসার চালাতে হিমশিম খেয়ে যাস এই জিনিসটা তুই বুঝবি না? জামাইটা সারাদিন বাইরে খেটে আসে, তুই তো চাকরি করিস না ওর ও তো কম খাটনি না এত টাকা রোজগার করা। কিছু বুঝতে চেষ্টা কর ওর মা-বাবা আজ রেগে আছে কাল ও তাদের সামনে গেলে রাগ ভেঙ্গে যাবে। একটা মাত্র মেয়ে তাদের ওর কপালেই সব আছে। তুই কেন এইসব ঝামেলায় জড়াতে চাস?”

–” আম্মা ফুফু ও কে অনেক কথা শুনিয়েছে, ফুফু ও তো ওকে রাখতে দিবে না। তাহলে ও যাবে কোথায়?”

–” আমি কিছু বুঝতে পারছিনা, তোকে ও বা কি বলবো আর ওকে ও বা কি করে কি করবো। কিন্তু এভাবে বসে ও তো থাকা যাবে না।”

–” মা চিন্তা করো না তো, সব ঠিক হয়ে যাবে। ”
বিভা আর রুমে এগোতে পারল না সেখান থেকেই তার থাকার রুমে চলে এলো। কিছুক্ষণ বসে থাকার পর সে আবার উঠে দাড়ালো।

মিলির সামনে দাড়িয়ে বলল-

–“আপু অনেক তো থাকলাম এবার চলে যাই, আমাকে এতটা দিন থাকতে দিয়েছো আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ আপু। ঐ অবস্থায় তুমি যদি আমাকে থাকতে না দিতে সত‍্যিই আমার খুব কষ্ট হতো। ধন‍্যবাদ!”

–” ছি! কি বলছিস তুই এগুলো, আর ব‍্যাগ নিলি কেন? তুই চলে যাবি ভেবে নিলি, থাকবি কোথায়?”

–” ইনশাআল্লাহ! কোথাও না কোথাও ঠিকই জায়গা হয়ে যাবে আপু।”

–” আরে তুই কি পাগল হলি নাকি,এই অবস্থায় এমন করিস না। ”
বিভাকে জোর করে ও মিলি রাখতে পারল না। বিভা তার হাত ছেড়ে সরে গেল। বাসা থেকে বেড়িয়ে চলেগেল।
বিভা ভেবে নিয়েছে একা জীবনটাকে সে সামলে নিবে।
বিভা ইডেন কলেজের ছাত্রী অনার্স তৃতীয় বর্ষে।
আর তার জন‍্য সবুজই চেষ্টা করেছে নিজেই বিভাকে সে ভর্তি করিয়েছে। সবুজকে আজও সে বুঝতে পারে না। যে সবুজ তাকে পড়াশুনা করানোর ব‍্যবস্থা করেছিল যেন সবুজের জন‍্য বিভার জীবনে কোন দাগ না লাগে। বিভার কেরিয়ার না নষ্ট হয়,সেই সবুজের আজ কিনা সংসারের প্রতি অনিহা তার প্রতি, কি এমন কারন যার জন‍্য সবুজের এত তিক্ততা! এতটা খারাপ ভাষায় কথা বলার মত সবুজ তো নয়।

বিভা ক্লাসমেট নীড়ার সঙ্গে কথা বলে হোস্টেলে থাকার ব‍্যবস্থা করে নিল। হোস্টেলের সামনে এসে দাড়াতেই নীড়াকে ফোন করে জানিয়ে দিল সে। নীড়া ও তাকে এগিয়ে আনতে নিচে এসে দাড়ালো। খুব ব‍্যাথা করছে বিভার প‍েটের দিকটায় তবুও অগ্রাহ্য করে সে আস্তে আস্তে সিড়ি সিড়ি বেয়ে তিনতলায় নিজের ঠিক করা রুমে এসে দাড়ালো। নীড়া বিভার এই অবস্থা আর এভাবে হঠাৎ এখানে আসার কারন জানতে চাইলে সে উত্তরে কিছুই বলল না।

নীড়া হোস্টেলের রান্নাঘর থেকে ম‍্যানেজ করে খাবার এনে খাইয়ে দিল বিভাকে। সম্ভবত অতিরিক্ত চলাচলের কারনে বিভার শরীর কিছুটা দূর্বল হয়ে পরেছিল। তাই সে বসে থাকতে পারছেনা একটু শুয়ে পরল। পেটটা এখনও কিছুটা ব‍্যাথা করছে। বিকেল বেলা ঘুম থেকে উঠেই বিভা একটু বিছানা থেকে নামল ব‍্যাথাটা বেড়েগেল তার কমছে না। নীড়া তার সামনের ব‍েডে বসেছিল। হঠাৎ তার চোখে পরল বিভা যেখানে দাড়িয়েছিল সেখানে রক্তে ভেসেগেছে। নীড়া বিভাকে চিৎকার করে বলল-

–” বিভা এগুলো কি? রক্ত এলো কি করে?”
আরেকটু এগিয়ে এসে বলল –” বিভা তোমার কিছু হলো না তো? তুমি কি জার্নি বেশি করেছো?”
বিভা নিজের দিকে একবার তাকিয়ে নীড়ার দিকে তাকালো। অসহায় চোখে তাকিয়ে সে চিৎকার করে বলল-

–” নীড়া আমার সর্বনাশ হয়েগেল। আল্লাহ্ আমার কোন পথ রাখল না। আমার সবশেষ করেদিল।”
বিভা সেখানেই মাথাঘুরে পরে যেতে নিলে নীড়া তৎক্ষণাৎ তাকে ধরেই, সবাইকে ডেকে উঠলো। হোস্টেলের ম‍্যাডামকে ডেকে এনে সব কিছু বলে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো। পরিবারের কোন সদস‍্য আছে কিনা জানার জন‍্য নীড়াকে জিজ্ঞেস করতেই নীড়া বিভার মোবাইল থেকে দেখে নিল লাস্ট কল কার ছিল। মিলির নাম্বারে কল করেই বলে দিল বিভা হাসপাতালে ভর্তি এবং কি কারনে ভর্তি তাও বলে দিল সে।

ঘন্টা খানেক পর মিলি ও তার স্বামী রেজওয়ান এসেছে পিছন পিছন বিভার মা আর বাবা ও এসেছে।
সন্তান যত বড় অন‍্যায় করুক মা বাবা কখনই সেই সন্তানকে ফেলে দিয়ে দূরে চলে যায় না। তার ব‍্যাতিক্রম বিভার বাবা-মা ও করেনি। বিভার মা এককোণে বসে নিজেই নিজেকে দোষারোপ করতে লাগলেন। আজ যদি তিনি অমন অভিশাপ না দিতেন তাহলে তো মেয়েটার এমন কিছু হতে পারতো না। বিভার বাবা মিলির থেকে শুনেছেন আজ পাচঁদিন বিভা মিলির বাসায় ছিল কি পরিস্থিতি তার উপর দিয়ে গেছে তা মিলি সব খুলে বলেছে তাকে। ভদ্রলোক নিজেই অবাক হয়েগেলেন নিজের স্ত্রীর আচরণে। একবার প্রশ্ন পর্যন্ত করল না মেয়েটা কেন ফোন করেছে। না শুনেই ইচ্ছে মত কত গুলো কথা শুনিয়ে দিল।

বিভার মিসক‍্যারেজের কথা নিয়ে টেনশনে আছে মিলি।
মেয়েটা তো শেষ হয়ে যাবে।

চলবে।
[শেয়ার এবং লাইক করুন, পেজ রিচ অনেক কম।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here