সাজিদের সামনে এই মুহূর্তে যে মেয়েটি বসে আছে সে মেয়েটি তার হবু স্ত্রী। মেয়েটাকে গতকালই সে আংটি পরিয়েছে। কিন্তু আজ মেয়েটা দেখা করার জন্য ডেকে এনে বলছে,
‘দেখুন, আমি একটা খারাপ মেয়ে! আমাকে বিয়ে করবেন না আপনি।’
সাজিদ এই কথার প্রত্যুত্তরে কিছুই বলেনি এখনও অবধি। মেয়েটাকে দেখছে। মেয়েটি ওভার জ্যাকেটের সাথে ম্যাচ করে মাথায় খয়েরি শীত টুপি পরেছে। শ্যাম বরণ মুখে মেকআপের হালকা আস্তরণ। ঠোঁট দুটো লিপ জেলে ভেজা। সাজিদ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো কিছুক্ষণ। তারপর মেয়েটার চোখে পূর্ণদৃষ্টি দিয়ে বললো,
“কেন বিয়ে করবো না আপনাকে?”
ইরতিজা গলার জোর বাড়িয়ে দিলো,
“কারণ আমি একজন ভালো মেয়ে নই!”
সাজিদ দাঁত দিয়ে নিম্ন ওষ্ঠ কামড়ে ধরে হাসি চেপে রাখার চেষ্টা করছিল। কিন্তু ইরতিজার কথা তার চেষ্টা ব্যর্থ করে দিলো। ব্যর্থ হয়ে হেসে ফেললো সে। শব্দ তোলা হাসি।
সাজিদের হাসি দেখে ইরতিজার বদন অদ্ভুত এক বিস্ময়ের রেখা টানলো। বিস্ময় জড়িত কণ্ঠে বললো,
“হাসছেন কেন?”
সাজিদের হাসি থামলেও ওষ্ঠ হতে হাসির রেশ মুছলো না। হাস্য আভা জড়িত ঠোঁট নাড়িয়ে বললো,
“না মানে, পাত্রী স্বয়ং নিজে বিয়ে ভাঙতে এসেছে তো, ব্যাপারটা দারুণ লাগছে।”
ইরতিজার আশায় যে আঘাত লেগেছে মুখ দেখে তা সহজেই অনুমান করা গেল। সে ক্ষুণ্ন গলায় বললো,
“আমি আপনার সাথে জোক করছি না সাজিদ আহসান।”
“আমিও তো বলছি না আপনি জোক করছেন।”
“আমি ভীষণ সিরিয়াস। আমি কিন্তু আসলেই খারাপ! এই আমেরিকার রাস্তায় আমি একটা ছেলেকে মেরে রক্তাক্ত করেছিলাম। বুঝতে পারছেন, কত বড়ো সাংঘাতিক হলে কেউ এমন করতে পারে?”
“হুম, বুঝতে পারছি।”
ইরতিজা অসন্তুষ্ট হলো। লোকটার যেমন রিঅ্যাকশন দেখতে চাইছে লোকটা ঠিক তার উল্টোটা উপহার দিচ্ছে তাকে।
সাজিদ ওর এই অসন্তোষ ভাবগতিক বুঝতে পেরে সহজ গলায় বললো,
“তো আপনি চাইছেন, আমি যেন আপনাকে বিয়ে না করি?”
ইরতিজার চোখ আশায় চকচক করে উঠলো। ওই চকচক করা চোখ দুটো দেখে সাজিদের আবারও হাসি পাচ্ছে। কষ্টসাধ্য হলেও হাসি চেপে রেখে বললো,
“কিন্তু আমার তো একটা বউ প্রয়োজন। জীবনে উনত্রিশটা বছর পূর্ণ হয়ে গেছে। আর কতকাল একা একা থাকবো?”
ইরতিজার চোখ আরও দ্বিগুণ চকচক করে উঠলো। গলায় ফিরে পেল হারানো জোর,
“হ্যাঁ সেটাই তো, আর কতকাল আপনি একা থাকবেন? আমাকে বিয়ে করতে হলে তো আপনাকে আরও কয়েক বছর অপেক্ষা করতে হবে, যতদিনে না আমার গ্রাজুয়েট শেষ হচ্ছে। আপনি এত বছর কেন অপেক্ষা করবেন? কোনো প্রয়োজন কি আছে? আমাকে বিয়ে করার কোনো প্রয়োজন নেই আপনার।”
“কিন্তু আপনাকে ছেড়ে দিলে যদি আমি এত বছরে কোনো মেয়েই খুঁজে না পাই? এই বিদেশ বিভুঁইয়ে বিয়ের জন্য মেয়ে খুঁজে পাওয়া অতি কঠিন ব্যাপার। দেখা গেল আপনার মতো খারাপ মেয়েও আর খুঁজে পাচ্ছি না। তখন?”
ইরতিজার মুখে কথা রইল না। মানুষটার কথা তার মুখের কথা কেড়ে নিয়েছে। সে ফ্যালফ্যাল করে কেমন তাকিয়ে রইল। লোকটার কথায় যুক্তি আছে। আসলেই বিদেশের মাটিতে বিয়ের জন্য মেয়ে খুঁজে পাওয়া সহজ ব্যাপার নয়। কিছুক্ষণ নীরবতায় কাটলো। ইরতিজা অন্যমনস্ক হয়ে ভাবছিল। নীরবতার জাল চিরে শুনতে পেল সাজিদের কণ্ঠ,
“এক কাজ করুন, আমাকে আপনি একটা বউ খুঁজে দিন। আমার জন্য কোনো বউ খুঁজে পাওয়া গেলে তারপর না হয় আপনাকে বিয়ে করার চিন্তা বাদ দেবো।”
ইরতিজা হতভম্ব হয়ে গেল,
“আমি বউ খুঁজে দেবো আপনাকে?”
“হ্যাঁ, আপনারই তো দেওয়া উচিত। যেহেতু আপনি চাইছেন না আমি আপনাকে বিয়ে করি, সেহেতু আমার জন্য একটা বউ খুঁজে দেওয়া আপনার নীতিগত দায়িত্ব।”
ইরতিজার মুখে চিন্তা চিন্তা ছাপ পড়লো। লোকটার এ কথাতেও যুক্তি আছে। কিন্তু লোকটাকে একটা বউ খুঁজে দেবে কীভাবে? চিন্তায় ডুবে গেল সে। তবে খুব অল্প সময়েই একজনের কথা মাথায় এসে গেল। সে সাজিদের দিকে তাকিয়ে হেসে বললো,
“আপনি আমার বড়ো বোনকে তো দেখেছেন, তাই না? মাশাআল্লাহ! কী সুন্দর দেখতে আমার বড়ো বোন। ডানা কাটা পরি বললে ভুল হবে না। আপনি আমার বোনকে বিয়ে করতে পারেন কিন্তু। আপনাদের দুজনকে খুব ভালো মানাবে।”
“কিন্তু আপনার বড়ো বোনেরও তো এনগেজমেন্ট হওয়া, তার বয়ফ্রেন্ডের সাথে। দুই মাস আগেই তো তাদের এনগেজমেন্ট হয়েছে।”
ইরতিজার মুখ ধপ করে নিভে গেল। হাসির রেশটুকু বিলীন হলো নির্দয়ভাবে। সে অসহায় বোধ করলো, তারপর অতিষ্ঠ! উত্যক্ত হয়ে বলে উঠলো,
“আরে ভাই এত ঘাড় ত্যারামি কেন করছেন? যখন আমি বলছি আমি খারাপ, তখন এত ঘাড় ত্যারামি করার কী আছে?”
সাজিদ বিস্ময়ে প্রশ্ন করলো,
“ভাই?”
ইরতিজার কণ্ঠ হোঁচট খেয়ে থুবড়ে পড়লো। যে মানুষটা এখন হবু বর তাকে ভাই বলে সম্মোধন করাটা কোন ধরনের কাজ? নত হয়ে আসা মস্তকে বললো,
“স্যরি! আপনাকে ভাই বলে সম্মোধন করাটা উচিত হয়নি আমার।”
বলে আবার চোখে চোখ রেখে বললো,
“কিন্তু আপনার জন্য আমি কোনো বউ খুঁজে দিতে পারবো না। আমি এটা করতে বাধ্য নই।”
“অবশ্যই বাধ্য। এটা আপনার কর্তব্য।”
“উহুঁ, না।”
সাজিদ চুপ করে গেল। কথা বাড়ানোর আগ্রহ পাচ্ছে না। ইরতিজাও চুপ বসে রইল। এক সময় ধৈর্য হারা হয়ে সাজিদ বললো,
“বাস, এটুকুই বলার ছিল? এ জন্যই ডেকে এনেছেন? আপনার কথা শেষ? এবার কি তাহলে আমি যাব?”
“না, আপনি যাবেন না। যেহেতু আমি আপনাকে নিষেধ করেছি আমাকে বিয়ে করতে, সেহেতু আমার আগে চলে যাওয়াটাই বেশি সুন্দর দেখায়। আপনি থাকুন। আমি চলে যাচ্ছি।”
ইরতিজা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। অনামিকায় থাকা এনগেজমেন্ট রিংটা খুলে সাজিদের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
“এই নিন এনগেজমেন্ট রিং। আজকের পর থেকে আমাদের মাঝে আর কোনো সম্পর্ক থাকবে না। আপনি শুধু আমার আব্বুকে একটা কল করে জানিয়ে দেবেন আপনি আমাকে বিয়ে করবেন না। ও কে? বাই!”
ইরতিজার আচরণে খুব গোপনে মনে মনে হাসলো সাজিদ। ইরতিজা যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়ে চলেও গেছে কিছু দূর। কিন্তু পিছু ডাকে থামতে হলো।
“দাঁড়ান।”
ইরতিজা দাঁড়িয়ে পিছন ফিরলো।
সাজিদ টেবিল থেকে রিংটা হাতে নিয়ে ইরতিজার কাছে এলো। ইরতিজার হাত হাতে তুলে নিয়ে রিংটা যত্ন করে অনামিকায় পরাতে পরাতে বললো,
“যতদিন না আমার জন্য একটা বউ খুঁজে পাচ্ছেন, ততদিন আপনাকেই আমার হবু বউ হয়ে থাকতে হবে।”
ইরতিজা বিস্ময়ে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। সাজিদ ওর চোখের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললো। ইরতিজার নিকটে এগিয়ে এসে ফিসফিস করে বললো,
“আপনি যদি খারাপ হন, তবে আমিও খারাপের বাপ!”
বলে বাঁকা হেসে এখান হতে প্রস্থান করলো সাজিদ। বেরিয়ে গেল এক তলা অনুন্নত কফিশপটা থেকে।
ইরতিজা বিস্ময়ে থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কী বললো লোকটা? হাতের অনামিকায় জ্বলজ্বল করতে থাকা রিংটার উপর এসে দৃষ্টি স্তব্ধ হলো ইরতিজার।
_____________
হালকা স্নো ফল শুরু হয়েছে। বেশিক্ষণ স্থায়ী হবে না বলে জানিয়েছে ওয়েদার ফোরকাস্ট। ঘড়িতে এখন ১২: ২৩ পিএম। নওরিন লিভিং রুমের সোফায় আরাম করে বসে ফিয়ন্সের সাথে কথা বলছে ফোনে। তার পরনে কালো জিন্স এবং নেভি ব্লু ওমেন জাম্পার সোয়েটার। বাইরে হাড় কাঁপানো শীত হলেও একটা মাঝারি আকৃতির হিটারের বদৌলতে ঘর উষ্ণ। মেইন দরজার লক খোলার শব্দ হলে কান সচকিত হলো নওরিনের। একটু পরই দর্শন পেল ছোটো বোন ইরতিজার। ইরতিজা এসেই মাথায় থাকা খয়েরি টুপিটা ছুঁড়ে ফেললো ফ্লোরে। নওরিনের দিকে রুক্ষ দৃষ্টি দিয়ে বললো,
“কার সাথে আমার বিয়ে ঠিক করেছো তোমরা? ওই ছেলে আমাকে নিজের মুখে বলেছে সে একজন ‘খারাপের বাপ’! একজন খারাপের বাপের সাথে আমার বিয়ে দেবে তোমরা?”
নওরিন ততক্ষণে ফিয়ন্সের সাথে কথা বলার সমাপ্তি ঘটিয়েছে। ইরতিজার কথায় অবাক হয়ে বললো,
“কীসের বাপ?”
“খারাপের!”
নওরিন হাসে,
“ভালোই তো। তুমি তাকে বিয়ে করে খারাপের মা হয়ে যাও, তাহলেই তো হয়।”
ইরতিজার বড্ড অসহায় লাগলো,
“সিস্টার, আই অ্যাম ভেরি সিরিয়াস অ্যাবাউট দিস।”
নওরিন মুখে কেমন এক ভঙ্গি করে দুই কাঁধ ঝাঁকালো। নিজের প্রতি বোনের এহেন ভাবলেশহীন আচরণ দেখে কান্না পেল ইরতিজার। অশ্রু সংযত রেখে সে দ্রুত পায়ে রুমে চলে এলো। দরজা আটকে সাইড ব্যাগটা বিছানায় ফেলে রুম সংলগ্ন বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। হিমশীতল বাতাস কামড়ে ধরলো মুখের চামড়া। বাতাসের সাথে তুলোর মতো স্নো ঝরছে। শুরু হয়েছে একটু আগে। তেমন বরফ জমাট হয়নি। রাস্তায়, গাড়ির উপর, গাছের ডালপালায় একটু একটু করে শুভ্র আস্তরণ ফেলছে তুষারপাত।
এখন যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেটা তিন তলা এক বাড়ির দ্বিতীয় তলার বারান্দা। কিছুদিন পর আর এখানে দাঁড়িয়ে থাকা হবে না তার। পরিচিত এই নিউইয়র্ক ছেড়ে চলে যাবে রেডমন্ড। ভাবতেই বুকের মাঝটা চিনচিন করে ওঠে ব্যথায়। আবার নতুন শহরে নতুনত্বে জীবন শুরু করবে ভাবতেও একটা আনন্দ অনুভব হয়। কিন্তু পুরোনো জায়গার প্রতি মানুষের আলাদা একটা টান থাকে। ইরতিজা ভাবছে, সামান্য একটা ব্যাপারে তার জীবন কীভাবে মোড় নিলো! বিয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়ও চোখের পলকে ঠিক হয়ে গেল। যে মানুষটাকে ভালো করে চেনে না, জানে না, সেই মানুষটা এখন হবু বর। এ সব কিছুর জন্যই অর্টন দায়ী। উহুঁ, অর্টন নয়, জোনাস দায়ী।
ইরতিজার মনে পড়ছে, ঘটনাটা ঘটেছিল পাঁচদিন আগে সন্ধ্যায়। তার নিউইয়র্ক থেকে রেডমন্ড শিফট হয়ে যাওয়ার কথা শুনে অর্টন বেশ কিছুক্ষণ গম্ভীর হয়ে ছিল। তারপর এক সময় হুট করে চুমু খেয়েছিল তার কপালে! ওই চুমুটাই যত সমস্যার মূল। অর্টন চুমুটা সরল মনে খেলেও কেউ ওটা সরলভাবে নেয়নি। হয়তো জোনাস অমন না করলে চুমুটা সমস্যা না হয়ে সরলই থাকতো। কিন্তু যা করার জোনাসই করলো! সে কপালে চুমু খাওয়ার দৃশ্যটা কোত্থেকে যেন পরিলক্ষিত করে ক্যামেরাবন্দি করেছে। আর শুধু ক্যামেরা বন্দি করেই সে থামেনি, ছবিটা ম্যাসেঞ্জারে ফুফুর কাছে পাঠিয়েছে। ছবির সাথে দিয়েছে বিশাল আকৃতির এক ম্যাসেজ। যেখানে লেখা ছিল তার এবং অর্টনের রিলেশন সম্পর্কিত কথা। আসলে এমনটা কিছুই নয়। তার আর অর্টনের মাঝে প্রেম গঠিত কিছুই ছিল না কখনও। সম্পর্কটা শুধুই বন্ধুত্বের। তার মনে অর্টনের জন্য আলাদা করে কোনো বিশেষ অনুভূতির জন্ম নেয়নি কখনও। অনুমান বলে অর্টনেরও বিশেষ কোনো অনুভূতি নেই তার প্রতি। জোনাস ফুফুর কাছে ছবি এবং ম্যাসেজ পাঠানোর পরদিনই ফুফু বাড়িতে এসে উপস্থিত হয়। মা-বাবাকে অবগত করেন ছবি এবং অর্টনের সাথে রিলেশনের ব্যাপারে। ইরতিজা সে সময় বাড়িতে উপস্থিত ছিল না। বাড়িতে এসে লিভিং রুমের থমথমে পরিবেশ লক্ষ করে বুঝতে পারে কিছু একটা ঝামেলা হয়েছে। সে আর জিজ্ঞেস না করে পারে না। জিজ্ঞেস করে,
“হোয়াট হ্যাপেন্ড?”
প্রশ্নটা করার সাথে সাথেই মা সোফার কুশন ছুঁড়ে মারে তার দিকে।
ইরতিজার চোখের কোণ ভিজে ওঠে। মনশ্চঃক্ষে ভেসে ওঠে সেই সন্ধ্যার কাহিনীক্ষেত্র।
______________________________________________
[চারদিন আগে]
“আগেই বলেছিলাম মেয়েদের এত লাই দিতে নেই। তুই তো মেয়েদের কোনো শাসনই করিস না। দেখলি তো তার ফল! একটা ছেলে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কীভাবে চুমু খায় ওর কপালে? এটা কেমন দৃশ্য?”
অহনা চৌধুরী ভাইয়ের দিক থেকে চোখ সরিয়ে শারমিন আহমেদের দিকে তাকালেন।
“আর তুমি! কী শিক্ষা-দীক্ষা দিয়েছো মেয়েদের? এত ঠুনকো শিক্ষা দিয়েছো যে আমেরিকা আসার তিন বছর হতে না হতেই মেয়ে সব শিক্ষা-দীক্ষা ভুলে গেল? কেমন মা তুমি? কী শিক্ষা দিলে?”
ফুফুর কথাগুলো গায়ে কাঁটার ন্যায় এসে বিঁধছে ইরতিজার। অপমান, অভিমানে অন্তর গাঁট হয়ে আসছে। সে রুমে বসে শুনতে পাচ্ছে লিভিং রুমে চলমান কথাবার্তা। চেয়েছিল লিভিং রুমে থেকেই সব কথা শুনবে এবং প্রতিবাদ করবে। কিন্তু বাবা থাকতে দিলেন না। তিনি শান্ত স্বরে আদেশ করলেন,
“তুমি যাও ইরতিজা।”
অগত্যা চলে আসতেই হলো। ফুফু খুব সুন্দরভাবে বাবার কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান শুরু করেছে। তবে সমস্যা নেই। তার বাবা অমন মানুষ নয় যে মাথা গরম করে ফেলে যাচ্ছেতাই কাণ্ড ঘটাবে। তার বাবা শান্ত মাথার মানুষ। সব কিছু শান্ত এবং বিচক্ষণ ভাবে চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নেন। মানুষটাকে কখনো রাগতে দেখেনি। কোনো কিছুর উপরই যেন রাগ করতে পারে না মানুষটা। এত শান্তও কোনো মানুষ হয়? ইরতিজা মাঝে মাঝে অবাক হয় ব্যাপারটা ভেবে।
ফোনে এই নিয়ে চারবার কল এলো। তিনবারই কলটা এড়িয়ে গেছে লিভিং রুমে চলমান কথা শোনার জন্য। কিন্তু এবার এড়ালো না। বিছানা থেকে মোবাইলটা তুলে নিলো। ‘জোনাস’ নামটা ভাসছে মোবাইল স্কিনে। ইরতিজার ভিতর ক্রোধের ঢেউ দুলে উঠলো। দাঁতে দাঁত লেগে এলো রাগে। কত বড়ো সাহস ছেলেটার! ফুফুর কাছে ছবি, ম্যাসেজ পাঠিয়ে এত বড়ো একটা কাণ্ড ঘটিয়ে আবার তার কাছেই কল দিচ্ছে!
ইরতিজার ছেলে ফ্রেন্ড বলতে তার মাত্র তিনজন ফ্রেন্ডই ছিল। অর্টন, জোনাস এবং ক্রিস। তবে এই জোনাস ধীরে ধীরে বন্ধু থেকে শত্রুতেই পরিণত হয়ে চলছে। এমন হওয়ারও অবশ্য কারণ আছে।
ইরতিজা কল রিসিভ করলেই ওপাশ থেকে জোনাস ব্যঙ্গ ভরাট গলায় বললো,
“তোমার ফ্যামিলির অবস্থা কেমন চলছে টিজা?”
“তুমি আমার কাছে চরম ঘৃণিত একটা মানুষ হয়ে গেলে জন।” কথাটা বলতেও ঘৃণায় ইরতিজার বুক কাঁপছিল।
তার কথা শুনে জোনাস হাসলো। ওই হাসির শব্দ কী অসহ্যকর! প্রতিটা কোষ বিষাক্ত হয়ে উঠলো ইরতিজার।
“আমি তোমাকে প্রোপোজ করেছিলাম টিজা। তুমি ফার্স্ট গার্ল ছিলে যাকে আমি প্রোপোজ করেছি। ফার্স্ট গার্লের কাছ থেকে রিজেক্ট হওয়া কতটা অপমানজনক তুমি বুঝবে না। আমি ক্রিশ্চিয়ান, তোমার ফ্যামিলি আমাকে গ্রহণ করবে না, এসব বলে তুমি আমাকে রিজেক্ট করেছিলে। যেখানে আমি বর্জন হলাম, সেখানে অর্টন কী করে গ্রহণযোগ্য হলো তোমার কাছে? অর্টনও তো ভিন্নধর্মীই। কীভাবে এখন রিলেশনে আছো ওর সাথে?”
একটু থেমে আবার শুধালো,
“আর আমি যে তোমার কাছে ঘৃণিত একটা মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি পাবো এটাই স্বাভাবিক। তোমাকেও আমি ভীষণ রকম ঘৃণা করি। যে ভালোবাসা পূর্ণতা পায় না ওগুলো ঘৃণাতেই রূপ নেয়।”
“তুমি ভুল!” ভর্ৎসনার সুরে বলে উঠলো ইরতিজা।
“গড সঠিক সময়ে ওখানে উপস্থিত করেছিল আমায়, নইলে অর্টন তোমায় চুমু খাচ্ছে এই সুন্দর দৃশ্যটা কিছুতেই তোমার আন্টকে দেখাতে পারতাম না।”
“ওই আজেবাজে ম্যাসেজটা কেন লিখেছো তুমি?”
“ওটা মোটেই আজেবাজে নয়। তোমার আর অর্টনের মাঝে রিয়েল রিলেশনশিপ চলছে। অস্বীকার করার চেষ্টা করো না।”
“তোমার সাথে আমার সম্পর্কের এখানেই সমাপ্তি ঘটালাম। তুমি আমার বন্ধু হওয়ার যোগ্য নও।”
ইরতিজা কল কাটতে উদ্যত হলেই জোনাস বলে উঠলো,
“হেই, ওয়েট ওয়েট। সম্পর্কের সমাপ্তি ঘটাবে ভালো কথা। তার আগে একবার বারান্দায় এসো।”
“কী প্রয়োজনে?”
“আমি তোমার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছি।”
ইরতিজা জোনাসের কথা নিছকই মজা ধরে নিলো। তবুও দ্রুত পায়ে বারান্দায় এসে রাস্তায় দৃষ্টি দিলো সত্য-মিথ্যা যাচাইয়ের জন্য।
ওপাশে হাসির শব্দ শোনা গেল,
“দেখতে পাচ্ছ সুইটহার্ট?”
হ্যাঁ, দেখতে পাচ্ছে। রাস্তায় তেমন আলো নেই। অনেক দূরে জ্বলছে ল্যাম্পপোস্ট। তবে শপ, রেস্তোরাঁয় জ্বলতে থাকা আলোতে অনেক কিছুই দৃশ্যমান। সাদা রঙের গাড়িটার কাছে দাঁড়িয়ে আছে জোনাস।
ওপাশ থেকে জোনাসের শান্ত কণ্ঠ ভেসে এলো,
“রেডমন্ড চলে যাচ্ছ! চলে যাওয়ার আগে তোমাকে একবার দেখে নিলাম। জানি ওখানে গিয়ে পুরোপুরি ভুলে যাবে আমায়। আমিও তোমায় ভুলে যাব। তোমাকে আমি প্রচণ্ড ঘৃণা করি টিজা!”
কল কেটে গেল। ইরতিজা দেখলো জোনাস গাড়িতে উঠছে। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে চলে গেল সে। নাহ, জোনাসের হৃদয় ভেজানো কথাগুলোতেও তার হৃদয় ভিজলো না। সে হৃদয় হাতড়ে শুধু ঘৃণাই খুঁজে পেল।
রুমে ঢুকে পাতলা কম্বল গায়ে জড়িয়ে নিয়ে আবার বারান্দায় এলো ইরতিজা। ইজিচেয়ারে মাথা এলিয়ে দিয়ে বসলো। লিভিং রুমে চলমান কথাবার্তা শোনার আর মন নেই। দু কান আর সহ্য করতে পারছে না। ক্লান্ত দু চোখে নিদ্রা নামলো খুব যতন করে। চোখের পাতা বন্ধ করে দিলো আবেশে। কতক্ষণ ঘুমিয়েছিল খেয়াল নেই। দীর্ঘ সময়ই ঘুমিয়েছে বোধহয়। তন্দ্রাচ্ছন্ন ঘোর কাটলো বাবার কোমল কণ্ঠস্বরে,
“ইরতিজা!”
ডাকের সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ আঁখি খুললো ইরতিজা। বাবাকে পাশে টুলের উপর বসা দেখে নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসলো। মনের আকাশ গ্রাস করে ফেলেছে বৈশাখের ঘন কালো মেঘ। ওই মেঘে অপরাধ বোধের ঘনঘটা চলছে। জানে না কেন এই অপরাধ বোধের আগমন। সে তো কোনো অন্যায় করেনি। তবুও কেন মন এমন করছে? বাবা খুব নম্র কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“অর্টনকে ভালোবাসো তুমি?”
ইরতিজা ঘাবড়ালো না। কিন্তু কোনো এক কারণে বুক ধুকপুক করে যাচ্ছে। অগোছালো কণ্ঠে বললো,
“আসলে আব্বু…মানে… আসলে ব্যাপারটা এমন নয়। আমি ভালোবাসি না অর্টনকে। আমার ধারণা অর্টনেরও কোনো অনুভূতি নেই আমার জন্য। আর ও যেটা করেছে সেটা নিশ্চয়ই ফ্রেন্ডশিপ থেকে করেছে। এটাকে কি জটিল করে দেখা উচিত? ওরা আমেরিকান…”
“অর্টনকে আমি কখনও মেনে নেবো না সেটা নিশ্চয়ই তুমি জানো?” ইরতিজার কথার মাঝে বললেন আজাদ চৌধুরী।
“তুমি আমাকে অবিশ্বাস করছো আব্বু?”
“আমরা চাইছি তোমার অতি শীঘ্র এনগেজমেন্ট হয়ে যাক।”
“কিন্তু কেন? তোমার কি ধারণা তোমার মেয়ে…”
আজাদ চৌধুরী ইরতিজার কথা সম্পূর্ণ করতে দিলেন না, ওর মাথায় হাত রেখে বললেন,
“আমি চাইছি না অর্টনের সাথে তোমার আর কোনো রকম সম্পর্ক থাকুক। যে ছেলেটাকে আমরা ঠিক করেছি সেই ছেলে যথেষ্ট ভালো। সিয়াটল থাকে অফিস কার্যের জন্য। আর ওর মা-বাবা নিউ ইয়র্ক। ছুটিতে নিউ ইয়র্ক এসেছে। তোমার ফুফু, চাচা এবং আমি সকলেই চাইছি এই ছেলের সাথে তোমার এনগেজমেন্ট হোক।”
“কিন্তু আমি এখনও যথেষ্ট ছোটো। বিয়ের জন্য প্রিপেয়ার নই আমি।”
আজাদ চৌধুরী মৃদু হেসে জানালেন,
“বিয়ে তো এখনই দিয়ে দিচ্ছে না কেউ। আগে তোমার গ্রাজুয়েট কমপ্লিট হবে তারপর বিয়ে।”
“বিয়েটা যখন গ্রাজুয়েট শেষেই হবে তাহলে এখন এনগেজমেন্ট হওয়ার কী দরকার?” ইরতিজার অন্তঃকরণ ছটফট করে উঠলো।
আজাদ চৌধুরী কিছু বললেন না। ক্ষণকাল গম্ভীর রইলেন। ইরতিজা বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে ব্যাকুল হয়ে। জানতো তার বাবা মাথা গরম করে তার বিয়ে দিয়ে দেওয়ার কথা চিন্তা করবে না। কিন্তু বিয়ে সংক্রান্তই কিছু ভাববে এটা ভাবনায় ছিল না। তবে বাবা সব কিছু বিবেচনা করে ঠান্ডা মাথাতেই এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে। এমনকি এই সিদ্ধান্ত যে মেনে নিতে হবে এটাও জানে সে। বাবার কথা ফেলার উপায় তার নেই। এই মানুষটাকে সে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। তাই মানুষটার কথার অবাধ্য হয়ে মানুষটার মনে কষ্ট দিতে পারবে না। কিন্তু এই এনগেজমেন্টও মেনে নিতে পারবে না। এই এনগেজমেন্ট একটা শাস্তিস্বরূপ দেওয়া হচ্ছে তাকে। যেখানে কোনো দোষই ছিল না সেখানে এই শাস্তি কেন মেনে নেবে?
“ছেলেটাকে চেনো তুমি।”
বাবার কথায় অবাক হলো ইরতিজা,
“আমি চিনি?”
“হ্যাঁ। তোমার ফুফুর বাসায় একদিন দেখা হয়েছিল তোমাদের।”
ইরতিজা মনে করার চেষ্টা করলো, কিন্তু মনে করতে পারলো না।
“আমার এরকম কাউকে মনে পড়ছে না।”
“…’সাজিদ আহসান’ নাম। মনে নেই?”
অত বেশি কষ্ট করতে হলো না, টুপ করে লোকটাকে মনে পড়ে গেল ইরতিজার। গত সামারে দেখা হয়েছিল লোকটার সাথে। টুকটাক কথাবার্তাও হয়েছিল।
“আমি চাইছি তোমার এনগেজমেন্ট হয়ে যাক সাজিদের সাথে। তোমার ফুফুর কাছে ওরা আগে একবার এমন কথা তুলেছিল। কিন্তু সে সময় অতটা গ্রাহ্য করা হয়নি। তোমার ফুফু এবং চাচাদের সাথে ওর ফ্যামিলির ভালো সম্পর্ক রয়েছে। সম্বন্ধটা মোটেও খারাপ নয় বলে আমার ধারণা।”
ইরতিজার মুখ নেতানো ডালের মতো নেতিয়ে পড়লো। মুখে কৃষ্ণ মেঘের প্রলেপ আলতো করে ছুঁয়ে দিয়েছে। অনেকক্ষণ চুপচাপ থেকে বললো,
“ঠিক আছে, যখন চাইছো তখন হোক এনগেজমেন্ট।”
আজাদ চৌধুরীর মুখে প্রশান্তির হাসি দেখা গেল। মেয়ের কপালে স্নেহের চুম্বন খেয়ে বললেন,
“আব্বু সব সময় তোমার ভালো চায় ইরতিজা।”
বাবার কথায় ইরতিজার হৃদয়ে শান্তির বৃষ্টিপাত হয়। হৃদয় ভিজে আসে। এই মানুষটা যে তার ভালো চায় সেটা তার থেকে ভালো আর কে জানে? আবেগে অশ্রু টলমল করে উঠলো তার চোখে। বললো,
“কোন বাবা নিজের মেয়ের ভালো চায় না? আমি তো তোমারই মেয়ে আব্বু, তোমারই।”
(চলবে)
___________
#উড়ো_পাতার_ঢেউ
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ০১
আমার গ্রুপ লিংক― https://facebook.com/groups/3087162301558677/