উড়ো পাতার ঢেউ পর্ব: ১০

0
791

#উড়ো_পাতার_ঢেউ
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ১০
__________________

কুয়াশার দল উড়ে বেড়াচ্ছে পাহাড়ের আশপাশ দিয়ে। পাহাড়ের গায়ে তুষারের সাদা ছোঁয়া। আজ তাপমাত্রা শূন্য ডিগ্রির নিচে। খোলা জানালা দিয়ে প্রবেশকৃত দৈত্য হাওয়া শরীর ছুঁয়ে কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছে। সজারুর কাঁটার মতো খাড়া হয়ে উঠছে লোম। প্রকৃতির এই শীতলতা শরীরে প্রভাব ফেললেও, মন অবধি পৌঁছতে পারছে না। মনের অবস্থা এখন কেমন? অগোছালো, এলোপাথাড়ি!
ক্যানিয়লের গায়ে মাত্র সাদা নরমাল একটা টি-শার্ট। ইচ্ছাকৃত সে এমন দাঁড়িয়ে আছে। জানালা দিয়ে পাহাড়ের ভিউ দেখছিল, আর ভাবছিল মিস বেলা লিমাসকে নিয়ে। মিস বেলা লিমাসকে নিয়ে ভাবতে গেলে হৃদয়ভার হয় তার। বিদঘুটে একটা কষ্ট গ্রাস করে নেয় হৃদয়ের খুঁটিনাটি। চোখ দুটো জ্বালা করে উঠলো ক্যানিয়লের। পানির ঝাপটা এসে ঝাপসা করে দিলো দৃষ্টি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানালার কাচ টেনে দিলো। এসে বসলো কাউচে। তার সামনে দেয়ালে বিশাল আকৃতির একটা ছবি টানানো। ভাবলেশহীন চোখে ক্ষণ মুহূর্ত তাকিয়ে রইল ছবিটার দিকে। ভাবলেশহীন! এতটুকু ভাবনা তার মন মাঝে জাগ্রত হলো না। সহসা এক সময় হেসে উঠলো। ছবিটা তার পরিবারের। সে সহ পরিবারের প্রতিটা সদস্য ছবির মাঝে উপস্থিত। এটা তোলা হয়েছিল গত বছরের উইন্টারে। ছবিটার একটা কপি সে বাধাই করে টাঙিয়ে রেখেছে এখানে। তার পরিবার যে খুব আজব একটা কারখানা এটা মানতে বাধ্য সে। তার বাবা মুহাম্মদ ইসহাক ইবনে মাসউদ, যে কি না চারটা বিয়ে সম্পন্ন করেছে! প্রথম স্ত্রী সোফিয়া নিঃসন্তান! সোফিয়া নিঃসন্তান হওয়ার দরুণ সে দ্বিতীয় বিয়ে করেছিল ইয়াদাকে। ইয়াদার ঘরে দুই ছেলে এক মেয়ে। তৃতীয় বিয়ে করতে হয়েছিল ট্রাপে পড়ে, নাইলা সালেমকে। নাইলা সালেম ক্রিশ্চিয়ান ধর্মাবলম্বী ছিল। মুহাম্মদ ইসহাককে বিয়ে করার পূর্বে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল। নাইলা সালেমেরও দুই ছেলে, এক মেয়ে। চতুর্থ বিয়ে যাকে করেছিল সেও ছিল ক্রিশ্চিয়ান। বিয়ের আগে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল। তার নাম বেলা লিমাস। বেলা লিমাসের এক পুত্র সন্তান হয়েছিল। বেলা লিমাস ছিল অল্প বয়সী। যখন বিয়ে হয় তখন তার বয়স ছিল সতেরো। আঠারো বছর বয়সে সে পুত্র সন্তানের জননী হয়েছিল।
মুহাম্মদ ইসহাক বিয়ে করেছিল চারটা। কিন্তু এখন তার ঘরে স্ত্রী আছে তিনজন। একজন চলে গেছে। চতুর্থ স্ত্রী, বেলা লিমাস। সে চলে গেলেও রেখে গেছে তার পুত্র সন্তান ক্যানিয়লকে। ক্যানিয়লের বয়স তখন আট বছর। আট বছর বয়সে কতটুকু বড়ো ছিল সে? বড়ো তো ছিল না, ছোটো ছিল। মা চলে যাওয়ার পর ছোটো ক্যানিয়ল ডুবে গিয়েছিল এক সমুদ্র বিষাদে। কষ্ট, যন্ত্রণার ঢেউ আছড়ে পড়েছিল তার চরণপানে। অতি কষ্টে সেই ঢেউ সামলে নিতে শিখেছে। ক্যানিয়লের স্পষ্ট মনে আছে সেই দিনটার কথা, যেদিন তার মা চলে গিয়েছিল রাজ প্রাসাদের মতো প্রাচুর্য ছেড়ে। বিষাদগ্রস্ত ছোটো রাজপুত্রকে একলা রেখে গিয়েছিল রাজ প্রাসাদে। সেদিন সে ঘুমন্ত অবস্থায় ছিল। ঘুমের কড়া নড়েছিল মায়ের আলতো ডাকে,
“ক্যানি…ক্যানিয়ল!”

চোখ খুলে পিটপিট করে মায়ের দিকে তাকালো ক্যানিয়ল। অস্ফুট স্বরের শব্দটা মুখ ফুঁটে বেরিয়ে এলো,
“মম!”

উঠে বসলো সে। মায়ের মুখটা ভালো করে দেখে হৃৎপিণ্ড কম্পিত হলো। মায়ের চোখে অশ্রু টলমলে। জলের ফোয়ারা নেমে যাচ্ছে গন্ডদেশ পেরিয়ে। ছোটো ক্যানিয়ল উৎকণ্ঠা হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“তুমি কেন কাঁদছো মম?”

মা তাকে সন্তর্পণে দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন,
“ড্যাডের কাছে ভালো থাকবে ক্যানিয়ল। এই জায়গাটা আমার জন্য নয়। এখানে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে আমার। মুক্ত ভাবে নিঃশ্বাস নিতে হলে আমাকে এখান থেকে চলে যেতে হবে।”

“মম…” অবুঝ শিশুর মতো ডাকলো ক্যানিয়ল।

“আমার সাথে গেলে শুধু কষ্টই পাবে জীবনে! ড্যাডের কাছে থাকলে সুখী থাকবে। মাদার সোফিয়াও তোমায় ভালোবাসবে…”
বেলা লিমাস একটু থেমে বললেন,
“মম তোমায় অনেক ভালোবাসে ক্যানিয়ল, অনেক।”
ছেলের কপালে স্নেহের চুম্বন এঁকে দিলেন বেলা লিমাস। তারপর ছেলেকে বাহু বন্ধন হতে মুক্ত করে দিয়ে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেলেন। ক্যানিয়ল স্তব্ধ ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইল। শরীর মৃদু কাঁপছে তার। চোখের কোল বেয়ে শান্ত জলধারা চুপিসারে নেমে যায়। বুকের ভিতর তোলপাড় হয়ে সব কিছু যখন এলোমেলো করে দিলো, তখন সে চিৎকার করে ডেকে উঠলো,
“মম…”

অতীতের দৃশ্য হতে বেরিয়ে এলো ক্যানিয়ল। ওষ্ঠে দুর্বোধ্য হাসির রেখা জল ছলছল চোখের সাথে অদ্ভুত দেখালো। হাসতে হাসতে মুখে উচ্চারণ করলো,
“তুমি আমাকে ভালোবাসতে না মম!”

ঘর থেকে বের হয়ে অলিন্দে এসে দাঁড়ালো। এক কামরার ছোট্ট একটা ঘর। অনেক উঁচুতে। সিঁড়ির ধাপ অতিক্রম করে উঠতে হয়। এটাকে সাধারণত ট্রি হাউজ বলে। এখান থেকে দেখা যায় একটু দূরে স্বচ্ছ জলের লেক। দেখা যায় বিশাল অরণ্য। অনেক বুনো ফুলের সাক্ষাৎ ঘটবে এই অরণ্যে। একেক জাতের ফুল নিজ সৌন্দর্য নিয়ে ফুঁটে থাকে। এর মাঝে ক্যানিয়লের সবচেয়ে পছন্দের হচ্ছে ভায়োলেট রঙের ফুল। ফুলটার নাম অজানা। তাই সে নিজে এর একটা নামকরণ করেছে, ‘ভায়োবিন’! নামটা একটু অদ্ভুত শোনালেও তার ভালো লাগে। ট্রি হাউজের পাশেই একটা গাছের সাথে দোলনা তৈরি করেছে। সে নিজে না। লিটল ব্রাদার সামুরা তৈরি করেছে। সামুরা ভাই-বোনদের ভিতর সবচেয়ে কনিষ্ঠতম। মিসেস নাইলা সালেমের সন্তান সে। ভাই-বোনদের ভিতর এই একজনকেই পেয়েছে যাকে দেখলে মনে হয় এ সত্যিই ভালোবাসে তাকে। ক্যানিয়ল টের পায় সামুরার হৃদয়ে তার জন্য ভালোবাসার সরল একটা স্থান আছে। অন্য ভাই বোনদের কেউ সত্যিকার অর্থে তাকে ভালোবাসে কি না জানে না। তবে ড্যাড যে তাকে সর্বাপেক্ষা একটু বেশি ভালোবাসে এটা সে জানে।
সম্পত্তি নিয়ে সকল ভাই-বোনদের মাঝেই একটা প্রতিযোগিতা মূলক মনোভাব বিরাজ করে সর্বদা। এই মনোভাব থেকে শুধু তার আর সামুরার নামটাই বোধহয় বাদ পড়বে। ড্যাড তার নামে সম্পত্তির বড়ো একটা অংশ লিখে দেওয়ার চিন্তা ভাবনা করছে। কিন্তু ক্যানিয়ল সেটা চায় না। কারণ সম্পত্তির বড়ো একটা অংশ যদি তার নামে লিখে দেওয়া হয় তবে সেটা কেউই মানবে না। ভাই-বোনদের সাথে বিরোধে জড়াতে চায় না সে। ড্যাডকে বলে দিয়েছে, সম্পত্তির সবচেয়ে ক্ষুদ্র ভাগটা তাকে এবং সামুরাকে দিলেই হবে। যেহেতু সে এবং সামুরা কেউই বিজনেস ক্ষেত্রে কোনো অবদান রাখেনি, সেহেতু এটাই তাদের প্রাপ্য। কিন্তু ড্যাড কথাটা মেনে নেয়নি। বুক চিরে হতাশার দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো ক্যানিয়লের।
ট্রি হাউজে আর থাকবে না। বাড়ি ফিরে যেতে হবে। গতকাল বিকেল থেকে সে এখানে আছে। অবসর সময়ে মাঝে মাঝে আসে এখানটায়। ভেবেছিল রাত্রিকালে জোনাকি দলের দেখা পাবে। কিন্তু আজব! তিনটা-চারটা জোনাকি ছাড়া আর জোনাকির দেখা পায়নি। মাঝে মাঝে এত এত জোনাকি এসে এখানটায় ভিড় করে যে সেই সময়টার বর্ণনা দিতে পারবে না ক্যানিয়ল। তখন সে শুধু মুগ্ধ নয়নে অবলোকন করে জোনাকিদের ওড়া-উড়ি। নির্জন অরণ্যে একা জোনাকিদের সাথে কাটানো রাত্রিগুলো প্রতিবারই রোমাঞ্চকর হয়।

যাওয়ার আগে এক কাপ কফি বানিয়ে খেয়ে গেল ক্যানিয়ল। আর কিছুটি পেটে পড়েনি। গাড়ি পার্ক করে রেখে এসেছিল ট্রি হাউজ থেকে অনেকটা দূরে। এদিকে গাড়ি নিয়ে আসার কোনো ওয়ে নেই।
নিজ বাড়ি থেকে যখন চৌদ্দ-পনেরো মিনিট দূরত্বে তখন রাস্তায় দেখা হয়ে গেল ছিঁচকাঁদুনে মেয়ের সাথে। মেয়েটাকে পিছন থেকে দেখেছে সে। দেখে নিমেষেই কীভাবে যেন চিনে গেল। হাঁটার ধরনটা মূলত তাকে ধারণা দিয়েছে। দুষ্টু চিন্তার উদয় ঘটলো ক্যানিয়লের মস্তিষ্কে। সে গাড়ির কাচ নামিয়ে হাত বাড়ালো বাইরে। যখন মেয়েটার নিকটে চলে এলো, তখন বাড়ানো হাতটা দিয়ে মেয়েটার মাথায় থাকা শীত টুপিটা এক টানে খুলে হাতে নিয়ে এলো। পিছন থেকে ঘটনার আকস্মিকতায় মেয়েটা চিৎকার করে উঠলো,
“হেই!”

গাড়িতে ব্রেক কষলো ক্যানিয়ল। জানালা দিয়ে মুখ বের করে পিছনে তাকালো।
ইরতিজার কপাল সংকুচিত হলো। ক্যানিয়লকে সে মোটেই আশা করেনি এটা তার চেহারাই বলে দিচ্ছে।
ক্যানিয়ল উচ্চৈঃস্বরে জানতে চাইলো,
“হোয়াট?”

“তুমি আমার মাথার টুপি নিয়ে গিয়েছো।”

ক্যানিয়ল হাতে থাকা টুপিটা দেখিয়ে বললো,
“এটা?”

“হ্যাঁ, ওটা।”

ক্যানিয়ল টুপিটা নিজের মাথায় পরে নিয়ে বললো,
“আমি কি মেয়ে টুপিতে দেখতে সুন্দর লাগছি?”
বলে ওষ্ঠ বাঁকিয়ে কেমন অদ্ভুত হেসে মাথা গাড়ির ভিতর নিয়ে গেল। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে একটু সামনে এগোতেই ইরতিজা পিছন থেকে চিৎকার করে উঠলো,
“স্টপ…”

গাড়ি থামলো। একটু পর গাড়ি থেকে নামতে দেখা গেল ক্যানিয়লকে। ক্যানিয়ল বিরক্ত কণ্ঠে বললো,
“কী হয়েছে?”

ইরতিজা তড়িৎ গতিতে এগিয়ে এলো। এসেই হাত বাড়ালো ক্যানিয়লের মাথার দিকে। উদ্দেশ্য টুপি খুলে আনবে। কিন্তু ক্যানিয়ল ইরতিজার হাতটা খপ করে ধরে ফেলে বললো,
“আমাকে স্পর্শ করার চেষ্টা করলে হাত ভে/ঙে দেবো, আন্ডারস্ট্যান্ড?”
বলে ইরতিজার হাতটা ছিটকিয়ে সরিয়ে দিলো।

ইরতিজার মুখ রাগে কম্পিত হচ্ছে। ছেলেটা তার মাথার টুপি চুরি করে নিয়ে গেছে, আবার বলছে হাত ভে/ঙে দেবে? এত সাহস?
ক্যানিয়ল ইরতিজার রাগান্বিত দৃষ্টি লক্ষ করে বললো,
“এরকম করে তাকাবে না, চোখের প্রতি মায়া করো। নয়তো চোখ বরাবর ঘু/সি মে/রে চোখের অবস্থা খা’রা’প বানিয়ে দেবো।”

“তুমি কি মানুষ? না কি অমানুষ?” রাগে কাঁপছে ইরতিজা।

“মানুষ মানুষই, অমানুষ কীভাবে হয়?”

“নিজেকে দেখলেই উত্তরটা পেয়ে যাওয়া উচিত তোমার। জীবনে কখনও আর তোমার সামনে পড়ার ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু ঘুরে ফিরে সেই তোমার সাথেই কেন দেখা হয়ে যাচ্ছে? তোমার মতো পাজি একটা মানুষের সাথে দেখা হোক কখনও চাই না। তোমার সাথে যার একবার দেখা হয়েছে সেটাও তার জীবনে চরম একটা ভুল ছিল বলে আমার ধারণা। সেখানে এই ভুলটা কয়েকবার ঘটে গিয়েছে আমার জীবনে। ভাবতে কষ্ট হচ্ছে আমার। এত খারাপ কেন তুমি? কেন এত অহংকারী? কেন এত বেয়াদব?”
সবটুকু কথা শেষ করে শান্তি অনুভব করলো ইরতিজা। কালে কালে সে কম কিছু বলেনি।

“কারণ বড়ো লোকদের এটাই ফ্যাশন। তাদের ভালোর পাশাপাশি খারাপ হতে হবে, অহংকারী হতে হবে, বেয়াদব হতে হবে। তুমি গরিব দেখে শুধু ঝগড়া করতে জানো। আর কোনো গুণাগুণ নেই তোমার মাঝে।”

“তোমার এই অহংকার থাকবে না দেখো, একদিন ঠিকই ধ্বংস হবে।”

“তখন তোমার কাছ থেকে না হয় একটু ঝগড়া করার ট্রেনিং নেবো।” শ্লেষাত্মক হাসলো ক্যানিয়ল।

“আমার টুপি ফেরত দাও।”

“নীচু মন মানসিকতার মেয়ে! সামান্য একটা টুপির জন্য যে এমন করে সে যে কতটা নীচু মন-মানসিকতার সেটা দেখলেই বোঝা যায়। তোমার এই নোংরা টুপি রাখার কোনো ইচ্ছা আমার নেই। শুধু একটা প্রশ্নের উত্তর দাও।”

ইরতিজা দাঁতে দাঁত চেপে ধরলো। চাইলে সে এখন ছেলেটার প্রতিটা কথার দাঁত ভাঙা জবাব দিতে পারে। নীচু মন-মানসিকতার মেয়ে বলার সাহসও ভুলিয়ে দিতে পারে, কিন্তু সে কিছু বলবে না। কারণ, কারো শত্রু রূপে সে থাকতে চায় না। জীবনে শত্রু নামক ব্যক্তিগুলো খুব ভয়ানক হয়!

ইরতিজার থেকে কোনো প্রত্যুত্তর না এলে ক্যানিয়ল বললো,
“পাকিস্টানি গার্লের নাম কী?”

ইচ্ছা তো করছিল ‘আমি পাকিস্তানি নই’ বলে ভুল ভাঙিয়ে দেয়। কিন্তু আর কতবার কথাটা বোঝাবে একে? দরকার নেই বোঝানোর। যা ভাবার তাই ভাবুক। ইরতিজা উত্তর দিলো,
“আমার নাম ইরতিজা।”

ঠিক ভাবে শুনতে না পেয়ে মানুষ যেমন প্রশ্ন করে তেমনভাবে প্রশ্ন করলো ক্যানিয়ল,
“হ্যাঁ? কী?”

“ইরতিজা।”

“ইরি…ইরি…হোয়াট?”

“ইরতিজা…”

“ইরিইটিইজা?”

“…’টিজা’! টিজা আমার নাম।”
উপায় না পেয়ে আমেরিকান ভার্সন নামটাই বললো ইরতিজা।

ক্যানিয়ল হেসে উঠলো,
“টিজা? এত বাজে নাম নিয়ে ঘোরো তুমি? কী অর্থ এই নামের?”

ইরতিজা কটমট করে তাকিয়ে বললো,
“মুখ সামলে কথা বলবে।”

“এ নাম চলবে না। আগে কী যেন একটা নাম বলেছিলে না? ইরুইটা না কী যেন? ওটা বলো আবার।”

“ওটা বুঝতে বুঝতে তোমার দাঁত ভেঙে যাবে।”

“উফ, পাকিস্টানি মেয়েদের নাম এত কঠিন হয় আমি জানতাম না।”
ক্যানিয়ল হাত দেখিয়ে বললো,
“এখানে লিখে দাও তোমার নাম। ইরু…উহুঁ, ইরি। ওটা লিখে দাও।”

“কী দিয়ে লিখে দেবো?”

ক্যানিয়ল গাড়ি থেকে একটা পেন বের করে দিলো।

ইরতিজা ক্যানিয়লের হাতে লিখলো,
“Irtija.”

ক্যানিয়ল চোখ বাঁকিয়ে কেমন অদ্ভুত ভঙ্গি করে নামটা দেখলো কিছুক্ষণ। তারপর বললো,
“ইজা!”
ক্যানিয়লের উচ্চারণটা, ‘ইজ-আহ’ এর মতো শোনালো।

“কী?”

“তোমার নাম। আমি দিলাম। আজ থেকে তোমার নিক নেম ‘ইজা’।”

“কিন্তু আমার নিক নেম আছে। ওটাই সুন্দর।”

“হোক ইজা অসুন্দর। এই অসুন্দর ডাকই তোমার শুনতে হবে।”

গাড়িতে উঠে বসলো ক্যানিয়ল। মাথা থেকে টুপিটা খুলে ইরতিজার দিকে ছুঁড়ে মারার জন্য হাত প্রস্তুত করলো। কিন্তু ছুঁড়ে মারলো না। গাড়ির দরজা টেনে দিয়ে গাড়ি স্টার্ট করলো। ইরতিজা বললো,
“আরে…”

আর কিছু বলার সুযোগ পেল না, তার আগেই গাড়ি নিয়ে ছুট দিলো ক্যানিয়ল। ইরতিজার আর টুপিটা ফিরে পাওয়া হলো না। ছেলেটা কোন ধরনের পাজি ভেবে পাচ্ছে না সে!

______________

ঘুম পলায়ন করতে চাইছে মোবাইলের বিরক্তিকর রিংটোনের শব্দে। এত রাতে কে কল দেয়? প্রশ্নটা মনে জাগতেই জোনাসের নাম মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। জোনাস? ইরতিজার ঘুম পলায়ন করলো সম্পূর্ণ রূপে। পাশ ফিরে মোবাইল হাতে নিয়ে কল রিসিভ করলো।

“কেমন আছো সুইটহার্ট?”

উত্তর দিলো না ইরতিজা। ‘সুইটহার্ট’ শব্দটা শুনে অকস্মাৎ চোখের কোণে জল জমলো। কেন জমলো? যথোপযুক্ত উত্তর নেই এর।

“ইউ নো, আজ আমি ড্রিংক করেছি?”

কোনো কথা বললো না ইরতিজা। শুধু মনে মনে ভাবলো, কেন ড্রিংক করেছে জোনাস? ড্রিংক করা পছন্দ করে না সে।

“আমি কল দিলেই তুমি কেন কল রিসিভ করো টিজা? এটা কিন্তু একদম ঠিক করো না।”

“হুম, ভুল করি কল রিসিভ করে।”

“তুমি কেন এই ভুলটা করো জানো?”

ইরতিজা জানে জোনাস কী বলবে। জোনাস যেটা বলবে আসলে সেটা সত্যি নয়। ইরতিজা বললো,
“জানি না, আর জানতেও চাই না।”

“কিন্তু তবুও তোমাকে জানাতে হবে। তুমি এই ভুলটা করো কারণ তুমি আমাকে ভালোবাসো। ভালোবাসলেই সচরাচর এমন ভুল করে মানুষ। তুমিও করছো। ঠিক করছো না।” জোনাসের কথা কেমন জড়ানো। ড্রিংক করেছে বিধায় এমন শোনাচ্ছে ওর কথা।

“আচ্ছা টিজা, আমি যদি রেডমন্ড তোমার কাছে চলে আসি তাহলে কেমন হয়? ভালো হয় না এটা খুব? রেডমন্ড এসে আমি একটা নতুন সাইকেল কিনবো। সেই সাইকেলে তোমায় নিয়ে ঘুরে বেড়াবো। নিউ ইয়র্কে তোমায় নিয়ে ঘোরার ইচ্ছাটা পূরণ হয়নি, রেডমন্ডে তোমায় নিয়ে সাইকেলে ঘুরতে চাইলে তুমি কি এবারও আমার ইচ্ছা অপূর্ণ রাখবে?”

নেশাগ্রস্ত হয়ে যাচ্ছেতাই বলছে! এমনটাই মনে হলো ইরতিজার। তবে সেই সাথে কষ্টও হচ্ছে তার। ছেলেটা এমন পাগলামিপূর্ণ কথা কেন বলে?

“তোমার কথা শুনে তোমাকে একজন পাগল মনে হচ্ছে জন।”

জোনাস অট্টহাসিতে ফেঁটে পড়লো। অনেকক্ষণ বাদে সেই হাসির সমাপ্তি ঘটলে বললো,
“আমি তো পাগলই টিজা। কেউ একজন খুব যত্ন করে আমাকে পাগল বানিয়েছে। এমনটা কেন হলো? আমি নিজেও নিজের কাছ থেকে এটা আশা করতে পারছি না। আমি তো তোমাকে ঘৃণা করি। তাহলে কেন তোমায় ভুলে থাকতে পারি না? কত যত্ন করে আমাকে পাগল বানিয়েছো দেখো টিজা!”

ইরতিজার চোখের কোণ বেয়ে অশ্রু ঝরে পড়লো। পাগল আসলে সে নিজে হয়ে যাচ্ছে মনে হয়। হ্যাঁ, বেশ টের পাচ্ছে এটা। আর না হলে জোনাসের জন্য তার মন এমন করছে কেন? ভালো তো সে বাসে না জোনাসকে, তবুও হৃদয়ে এমন কষ্ট কেন হয়? জোনাসের আর একটা কথা শোনারও শক্তি, ইচ্ছা তার নেই। তাই কল কেটে ফোন সুইচ অফ করে রাখলো। বালিশটা আঁকড়ে ধরলো শক্ত বাঁধনে। মনে মনে একটা কথার উপরই জোর দিলো, সে ভালোবাসে না জোনাসকে!

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here