উড়ো পাতার ঢেউ পর্ব: ২৭

0
626

#উড়ো_পাতার_ঢেউ
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ২৭
_________________

ভোর রাত থেকে স্নো ফল শুরু হয়েছে। ঢেকে গেছে রাস্তাঘাট, গাছপালার ডাল, বাড়ি-গাড়ির উপরিভাগ। হাড় কাঁপানো শীত! তুষারপাত ঝরছে বাধাহীন। ইরতিজা গায়ে মোটা কাপড় জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে বারান্দায়। তুষারপাত এসে বারান্দার রেলিংয়েও দখল বসিয়েছে। যতদূর চোখ যায় সব সাদা। বাড়িগুলোর ছাউনির উপর পড়া তুষারপাত দেখতে দারুণ লাগছে। ইরতিজা হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখলো রেলিংয়ের উপরে থাকা তুষারপাত। ইরতিজার মনে হচ্ছে এগুলো আইসক্রিম। দেখলে একটুখানি খেয়ে দেখতে ইচ্ছা হয় তার। খাওয়া যায়ও অবশ্য। কারণ এগুলো একদম পরিষ্কার।
ইরতিজা বাইরে বের হওয়ার চিন্তা ভাবনা করছে। তুষারপাত বাইরে বের না হয়ে দেখলে তৃপ্তি মেটে না তার। রিশনকে দেখা যাচ্ছে। ও এখন রাস্তায়। কোন জায়গাটা রাস্তা ছিল, আর কোন জায়গা ঘাসে মোড়ানো সবুজ ছিল তা এখন তফাৎ করা দুষ্কর। বরফের পুরু আস্তরণ ঢেকে ফেলেছে সব। রিশন বরফের উপর শিথিল পা ফেলে হাঁটছে। পা ফেলার সাথে সাথে সেই স্থানে পা ঢুকে গিয়ে অগভীর গর্তের সৃষ্টি করছে। রিশন কিন্তু কাজহীন শখের বসে বাইরে বের হয়ে হাঁটছে না এই তুষারপাতের মাঝে। ও কাজে ব্যস্ত। বিরামহীন বক বক করে যাচ্ছে ভিডিয়ো রেকর্ডিংয়ের সাথে সাথে।
রিশন যেহেতু এখন বাইরে আছে সেহেতু এখন বাইরে বের হওয়াই ভালো হয় মনে হলো। ভাবতে যতটুকু দেরি, বাসা থেকে বের হতে দেরি হলো না ইরতিজার।

“এখন কোথায় বের হচ্ছ?” দরজা অতিক্রমের ক্ষণে প্রশ্ন করে বসলেন শারমিন আহমেদ।

“তুষারপাত দেখতে বের হচ্ছি। বাসার আশেপাশেই থাকবো।”

“এই ঠান্ডার ভিতর বাইরে বের হওয়া কি জরুরি?”

“সমস্যা নেই, রিশনও তো বাইরে এখন। নিশ্চয়ই ঠান্ডার জন্য ওর সমস্যা হচ্ছে না। তাহলে আমার কেন হবে?”

বাইরে বের হয়ে তুষারপাতের সান্নিধ্যে এসে অন্যরকম ভালো লাগার সৃষ্টি হলো। শব্দহীন ঝরে পড়া তুষারপাতের মাঝেও আসলে একটা নিঝুম নিভৃত শব্দ বিরাজ করছে। বরফের ক্ষুদ্র খণ্ড গায়ে পড়ে পিছলে যাচ্ছে। বাইরের এই শুভ্র সাদার মায়া মনে প্রবল মুগ্ধতার প্রতিস্থাপন রেখে যাচ্ছে। রিশন হাঁটতে হাঁটতে এতক্ষণে খানিক দূরে চলে গেছে। ইরতিজার মনে হয়েছিল এই তুষারপাতের মাঝে বোধহয় কেবল সে আর রিশনই বাইরে বের হয়েছে। কিন্তু না, আরও কয়েকজনকে দেখা যাচ্ছে। তারা বিভিন্ন রকম ফটোশ্যুট করছে। মাতামাতি করছে তুষারপাতের সঙ্গে।
ইরতিজা রিশনকে আর বিরক্ত করলো না। একা একা হাঁটতে হাঁটতে চলে এলো সুইমিং পুলে। পুলের পানি এখন বরফ। ইরতিজা ওখান থেকে প্রস্থান করলো। হেঁটে হেঁটে এরিয়ার বাসাগুলো দেখছিল। কেউ কেউ বাসার অভ্যন্তরে দাঁড়িয়ে উপভোগ করছে তুষারপাত। এই তুষারপাতে ক্যানিয়লের বাড়িটার কী অবস্থা জানতে ইচ্ছা করলো হঠাৎ। সে ক্যানিয়লের বাড়ির এদিকটায় চলে এলো।
ওই তো ক্যানিয়লের দুই তলা গাঢ় ব্রাউন রঙের বাড়িটা দেখা যাচ্ছে। বরফের প্রলেপ ছুঁয়ে রেখেছে বাড়িটার শরীর। দরজায় তালা ঝুলতে না দেখে অবাক হলো। বাড়ির ভিতরে কেউ আছে? ক্যানিয়ল কি এখন এই বাড়িতে?
ইরতিজার হৃদয় ঢিপ ঢিপ করে শব্দ তুললো। ক্যানিয়লের কথা ভাবলে ইদানিং তার অদ্ভুত একটা অনুভূতি হয়। কেমন অসহ্যকর ঠেকে এই অনুভূতি। ক্যানিয়লের সাথে তার দেখা হচ্ছে না দুই দিন হলো। ক্যানিয়ল ভার্সিটি যায়নি। তার মন আর চোখ দুটো ভার্সিটি থাকার পুরোটা সময় ধরে নীরবে খুঁজে যাচ্ছিল ক্যানিয়লকে। ক্যানিয়ল আর ওর মায়ের ব্যাপারে জানার প্রবল ইচ্ছা ছিল তার। জেনেছে। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টাই অজানা। ক্যানিয়লের মা কেন ক্যানিয়লকে রেখে চলে গিয়েছিল? ক্যানিয়ল নিজেই যেখানে এই প্রশ্নটার উত্তর জানে না সেখানে তার উত্তরটা খুঁজে পাওয়া এত সহজ হবে না।
ইরতিজা বাড়িটার উপর আরেকবার চোখ বুলালো। প্রথমে চেয়েছিল ক্যানিয়ল ভিতরে আছে কি না দেখবে, কিন্তু পরে মত পরিবর্তন করলো। এই মুহূর্তে সে ক্যানিয়লের মুখোমুখি হতে চায় না। অস্বস্তি আর অস্থির বোধ হবে তার। ইরতিজা ফিরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। একই জায়গায় কিছুক্ষণ স্থির দাঁড়িয়ে থাকার জন্য পা কেমন আটকে গিয়েছিল বরফে। বরফের মাঝ দিয়ে সাবধানে পা ফেলে চলে গেল।
ঘরের ভিতরে বসে ক্যানিয়ল লক্ষ করলো মেয়েটা চলে যাচ্ছে। মেয়েটা তাকে লক্ষ করেনি, কিন্তু কাচের জানালা দিয়ে বাইরে চোখ পড়তেই সে দেখেছিল মেয়েটাকে। এবং মেয়েটার দিক থেকে চোখ সরায়নি সে। এমনকি এখনও মেয়েটার দাঁড়িয়ে থাকা শূন্য স্থানটার দিকে অন্যমনাভাবে তাকিয়ে রইল।

ইরতিজা এসে দাঁড়িয়েছে একটা ওক গাছের নিচে। ওক গাছের পাতার উপর বরফের সাদা আস্তরণ। পাতার উপর থাকা বরফে সে এত গভীরভাবে কী দেখছিল নিজেও জানে না। অন্যমনস্ক হয়ে সকল ধ্যান সে ওই বরফের উপরই নিবদ্ধ রেখেছিল। ওক গাছের ডাল নিচু হয়ে ঝুলে পড়েছে। চাইলেই হাত বাড়িয়ে একটা তুষারে আবৃতকরণ ডাল ছুঁয়ে দেখা যায়। ইরতিজা হাত বাড়িয়েছিল ডাল ছুঁয়ে দেখার জন্য। কিন্তু ছুঁয়ে দেখার আগেই তার হাত অতিক্রম করে পিছন থেকে আসা দুটি হাত আঁকড়ে ধরলো ডালটা। ডালটা ধরে ঝাঁকুনি দিতেই ডালের উপর থাকা বরফ ঝরে পড়তে লাগলো। ইরতিজা চোখ খিঁচে ধরে মাথা নিচু করে ফেললো। বরফ সব পড়লো তার মাথার উপর। কে এমন একটা বেয়াদবি কাজ করলো সেটা দেখার জন্য নিদারুণ রাগ নিয়ে ইরতিজা পিছন ফিরলো। কিন্তু ক্যানিয়লের মুখখানি দেখে গুড়মুড় শব্দ করে ভেঙে গুঁড়িয়ে গেল তার সকল রাগ।
ক্যানিয়ল ইরতিজার মাথার উপর দখল বসানো বরফ দেখে হাসছে। ইরতিজার মাথার উপরিভাগ ডাল থেকে ঝরে পড়া বরফে সাদা দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে কেউ লবণ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দিয়েছে তার মাথায়।

ক্যানিয়ল বললো,
“মাথা ঝেড়ে নাও। নয়তো তোমার মস্তিষ্ক ফ্রিজ হয়ে যাবে।”

কথাটায় অপ্রস্তুত হয়ে ইরতিজা দুই হাতের সাহায্যে চুলের উপর থাকা বরফ ঝেড়ে নিলো। এখনও কিছুটা সাদা সাদা দেখাচ্ছে চুল। পুরোপুরি ঝেড়ে পরিষ্কার করা যায়নি।
ক্যানিয়ল এক পা এগিয়ে এসে বললো,
“আমার বাড়িতে উঁকিঝুঁকি মারছিলে কেন?”

“কখন?”

“এই একটু আগে। কেন উঁকি মারছিলে? রহস্য কী?”

ইরতিজা বুঝতে পারছে না সে কখন উঁকিঝুঁকি মারলো ক্যানিয়লের বাড়িতে? একটু সময় তাকিয়ে ছিল কেবল। সেটা কি উঁকিঝুঁকির ভিতর পড়ে? বললো,
“আমি তোমার বাড়ির ওদিকে যাইনি।”

“যাওনি? তাহলে কি আমি ভূত দেখেছি?”

“দেখতেও তো পারো।”

“তাহলে তুমি এখনও বেঁচে আছো কেন?”

ইরতিজা কথাটার মানে বুঝতে না পেরে জিজ্ঞাসু চোখে তাকালো।
ক্যানিয়ল বললো,
“শুনেছি মরে গেলে অনেকের আত্মা ভূত হয়ে যায়। তুমি তো ভূত। জীবিত চলে ফেরা করা উচিত নয় তোমার। তুমি এখনই মরে যাও।”

ইরতিজা হতবিহ্বল! ক্যানিয়ল কেমন ধরনের কথা বলছে? এখনই মরে যাও মানে? ইরতিজা কিছু বলবে তার আগেই ক্যানিয়ল প্রসঙ্গ পাল্টে বললো,
“সেদিন তুমি আমাকে কিছু না বলে চুপি চুপি এন্ডারসন হাউজ থেকে চলে কেন এসেছিলে?”

এই কথাটা এখন উঠানোর কি কোনো প্রয়োজন ছিল? না, কোনো প্রয়োজন ইরতিজার চোখে পরিলক্ষিত হচ্ছে না। প্রশ্নটা ইরতিজাকে বেশ বিভ্রান্তিতে ফেলে দিলো। তবুও সে উত্তর দিলো,
“তুমি কান্না করছিলে, পরিস্থিতিটা অস্বাভাবিক থাকায় চলে এসেছিলাম।”

“এই তোমার মানবিকতা ইজা? একটা মানুষ কান্না করছে আর তা দেখে তুমি চুপচাপ চলে এলে? কেউ কান্না করলে চুপি চুপি চলে আসতে হয় না গার্ল…”
ক্যানিয়ল ইরতিজার মাথায় আলতো করে একহাত রেখে বললো,
“এইভাবে হাত রেখে তাকে সান্ত্বনা দিতে হয়। জানো না এটা?”

মনঃস্থলে অদ্ভুত সব কার্যকলাপের সূচনা হয়েছে। যা নিয়ে এসেছে ইরতিজার মাঝে তটস্থ বোধ। সে দ্রুত ক্যানিয়লের হাতটা সরিয়ে দিলো। তার চোখে-মুখে স্পষ্টতর তটস্থবোধ প্রস্ফুটিত। ক্যানিয়ল হঠাৎ ইরতিজার মাঝে এমন ভাবগতি দেখে বিস্মিত হলো। ইরতিজা নিজেও বিস্ময়ান্বিত! আজকে কী হলো তার?
ক্যানিয়ল বিষয়টাতে গুরুত্ব না দিয়ে বললো,
“এমনভাবে কেউ কোনোদিন আমার মাথায় সান্ত্বনার হাত রাখেনি। ভেবেছিলাম তুমি হয়তো রাখবে, যেহেতু তুমি আমার প্রেমে পড়েছো। কিন্তু তুমিও তা করলে না।”
ক্যানিয়ল হতাশার দীর্ঘ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো। তারপর যাওয়ার জন্য উল্টো দিকে পা বাড়িয়ে দিয়ে যেতে যেতে বললো,
“এই দুনিয়ার সবাই নিষ্ঠুর! তুমিও নিষ্ঠুর ইজা!”

বলে বরফের উপর সাবধানী পা ফেলে এগোতে লাগলো।
ইরতিজার কানে কেবল কথা দুটো বাজতে থাকলো,
‘এই দুনিয়ার সবাই নিষ্ঠুর! তুমিও নিষ্ঠুর ইজা!’

ইরতিজা পিছন থেকে বলে উঠলো,
“তাহলে কি তোমার মাথায় সান্ত্বনার হাত বুলানো উচিত আমার?”

থামলো ক্যানিয়ল। ইরতিজা এগিয়ে এলো। ক্যানিয়লের সামনে দাঁড়িয়ে বললো,
“একটা মানুষ কাঁদলে তখন তার মাথায় কীভাবে সান্ত্বনার হাত রাখা উচিত?”

ক্যানিয়ল ভ্রু কুঁচকে অবাক হয়ে দেখলো ইরতিজাকে। অতঃপর আবার বিরক্ত ভঙ্গিতে বললো,
“ছাড়ো এসব।”

“কীভাবে রাখতে হয়? এভাবে?”
কথাটা বলে ইরতিজা একটা হাত রাখলো ক্যানিয়লের মাথায়।
ক্যানিয়লের হৃদস্পন্দন যেন থেমে গেল ওই মুহূর্তে। সে অবাক চিত্তে দেখতে লাগলো সামনে দাঁড়িয়ে থাকা আজব মেয়েটিকে। সে উপলব্ধি করছিল নিঃশ্বাসও যেন স্বাভাবিক গতিতে চলছিল না তার।

ইরতিজা বললো,
“এরপর থেকে যখন কাঁদবে তখন আমাকে জানাবে যে তুমি কাঁদছো। তোমার কান্নার মাঝে আমি গিয়ে তোমার মাথায় হাত রাখবো।”

ক্যানিয়ল অনিমেষ তাকিয়ে রইল। ক্ষণকাল নীরব থেকে বললো,
“মানুষের সামনে কাঁদতে আমি অস্বস্তিবোধ করি। আর আমার কান্নার হিসাবটা আমি ব্যতীত সকলের থেকে গোপন থাকুক সেটাই চাই।”

ইরতিজা স্মিত হেসে বললো,
“আমার সামনে কাঁদতে স্বস্তিবোধ করবে। আর সকল কাজেরই একজন সাক্ষী প্রয়োজন। তোমার কান্না করাটাও একটা কাজ। এই কাজটার সাক্ষী না হয় আমাকেই বানিয়ে নাও। তুমি কান্নার হিসাবটা ভুলেও যেতে পারো, তোমার মনে নাও থাকতে পারে। আমি তখন মনে করিয়ে দেবো ঠিক কতটা কেঁদেছিলে তুমি।”

ক্যানিয়ল বিমূঢ় ইরতিজার কথায়। কয়েকটা সেকেন্ড চুপ কেটে গেল। তারপর বললো,
“আর তোমার কান্নার কী খবর? তুমি কান্না করো না? তোমার কান্নার হিসাবের কী হবে?”

ইরতিজা একটুখানি নীরব হেসে বললো,
“কান্না করে না এমন মানুষ কি পৃথিবীতে আছে? সবার জীবনেই কান্না আছে। হুম আমিও কাঁদি। তবে আমাকে অত বেশি কাঁদতে হয় না। কান্নার পরিমাণটা কম বলে একাই এর হিসাব রাখতে পারি। কিন্তু আমাকেও হয়তো বেশি কাঁদতে হতো, যদি না আমার বাবার মতো একজন বাবা পেতাম। তখন হয়তো আমি আমার কান্নার পরিমাণটা হিসাব করে কূলোতে পারতাম না! আমার কান্নার সাক্ষী হিসাবে একজনকে খুব করে প্রয়োজন পড়তো আমার। কিন্তু বাবার জন্যই এই প্রয়োজনবোধটা নেই।”

ক্যানিয়ল মনোযোগ দিয়ে শুনছিল ইরতিজার কথা। জিজ্ঞেস করলো,
“তুমি কি তোমার ড্যাডকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসো?”

“ইয়েস। আব্বু আমার জীবনে দেখা সবচেয়ে সুন্দরতম মানুষ। আব্বুর সাথে আমি অন্য কাউকেই কখনও তুলনা করতে পারবো না। সে আমার চোখে আদর্শ একজন ব্যক্তি। খুব ভালোবাসি আমি আমার আব্বুকে।”
বেশি কিছু বললো না ইরতিজা। বাবার প্রতি তার ভালোবাসা, শ্রদ্ধা মুখে প্রকাশ করে প্রমাণ করা যাবে না।
ইরতিজা ক্যানিয়লকে প্রশ্ন করলো,
“তুমি কাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসো?”

“আমি?”
ক্যানিয়ল দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে বললো,
“যদি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসার প্রসঙ্গই ওঠে তাহলে আমি বলবো, আমি আমাকেই সবচেয়ে বেশি ভালবাসি। মানুষ নিজের থেকে অন্য কাউকে বেশি ভালোবাসতে পারে না।”

“এটা ভুল কথা।”

“হতে পারে ভুল। নিজে যতটুকু বাস্তবতা উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছি, তা থেকেই কথাটা মনে হলো। তবে আমি সবচেয়ে বেশি আমাকেই ভালোবাসি।”

ক্যানিয়ল মাথার টুপিটা খুলে ইরতিজার মাথায় দিয়ে বললো,
“বাসায় যাও ছিঁচকাঁদুনে মেয়ে। এই ঠান্ডার মাঝে বেশিক্ষণ থাকলে তোমাকে তো আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। দেখা যাবে বরফের নিচে ঢাকা পড়ে গেছো।”
ক্যানিয়লের পকেটে থাকা মোবাইল ফোনটা বেজে উঠলো। মোবাইল বের করে দেখতে পেল মিরান্ডার কল। মোবাইলটা ইরতিজার দিকে ফিরিয়ে বললো,
“লুক ইট, আমার উডবি ওয়াইফ কল করেছে। আমাকে এখন চলে যেতে হবে। টানা বিশ মিনিট কথা বলবো আমি ওর সাথে। বাই দ্য ওয়ে, তুমি কিন্তু নিজের কথা রক্ষা করোনি। বলেছিলে তোমাকে হিজাব ছাড়া আর কখনও দেখা যাবে না। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তোমার মাথায় আমি আজ কোনো হিজাব দেখতে পাচ্ছি না পাকিস্টানি গার্ল!”

ইরতিজার হিজাবের কথা খেয়ালই ছিল না একেবারে। এই মুহূর্তে সে ভীষণ লজ্জা বোধ করলো। বাইরে বের হওয়ার আগে অবশ্যই তার হিজাব পরে বের হওয়া উচিত ছিল।

ক্যানিয়ল বললো,
“বাইরে প্রচণ্ড ঠান্ডা। অন্তত একটা টুপি পরে তো বের হওয়া উচিত ছিল তোমার। কেন পরোনি? যাতে আমার টুপিটা পেতে পারো সেজন্যে? হঠাৎ আমার টুপির প্রতি তোমার এত ইন্টারেস্ট কেন জন্মালো? তুমি কি এখন আমাকে রেখে আমার দামি দামি টুপি গুলোর প্রেমে পড়ে যাচ্ছ?
আমার দামি জ্যাকেটগুলোর প্রেমে পড়লেও একটা কথা ছিল। কিন্তু টুপি? ইশ, তোমার চয়েজ এত বাজে পাকিস্টানি গার্ল? তোমাকে নিয়ে আমি হতাশ!”
ক্যানিয়ল কথাগুলো বলে চলে গেল।

ইরতিজা বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। টুপি… জ্যাকেটের প্রেম… কীসব বলে গেল ক্যানিয়ল?

_______________

জোনাস ব্যাগ প্যাক করছে। ঝিমঝিম শব্দে উদ্দীপনার বৃষ্টি নামছে তার অন্তঃকরণে। আনন্দও হচ্ছে। অনেক অপেক্ষার পর তার যাওয়ার সবকিছু ফাইনাল হলো। এতটাই খুশি লাগছে যে সে এই খুশিতে মনে মনে একটা পণ করে ফেললো। ইরতিজার সাথে তার দেখা হলেই সে একবার শক্ত বাঁধনে জড়িয়ে ধরবে ইরতিজাকে! ইরতিজা যদি এতে তাকে কঠিন কোনো শাস্তি দেয় তাতেও দ্বিমত করবে না সে।
রুমের বাহির থেকে মম-পাপার বিতর্কিত কথোপকথন শোনা যাচ্ছে। মম পাপাকে উদ্দেশ্য করে বলছে,
“জোনাস আমাদের একমাত্র সন্তান। ওকে কি করে অত দূরে যেতে দিতে পারি? ও ওখানে গেলে কি আমাদের যখন-তখন দেখা করার সুযোগ থাকবে? একটা অপরিচিত জায়গায় তুমি ওকে কীভাবে পাঠাতে সম্মত হলে হ্যারি? তুমি পাগল হয়ে গেছো, তাই বলে আমিও এটা মেনে নিতে পারি না। জোনাস কোথাও যাবে না। ওকে না দেখে থাকা পসিবল নয়!”

মায়ের কথাগুলো জোনাসের মনে কষ্ট দেয়। কিন্তু এখন এই কষ্টকে প্রাধান্য দেওয়ার চেয়ে ওখানে যাওয়াটা বেশি জরুরি বলে মনে করছে সে।
এই মুহূর্তে ইরতিজাকে একটা ম্যাসেজ পাঠালে কেমন হয়? ম্যাসেজটা হবে এমন,
‘ভালোবাসি টিজা। আমার জীবনের থেকেও তোমায় অত্যাধিক ভালোবাসি আমি। আমি ভালোবাসি তোমার চোখ, কান, নাক, ঠোঁট, চুলকে। ভালোবাসি গোটা তুমিটাকেই। আমি ভালোবাসি তোমার আচরণকে। ভালোবাসি তোমার বিরক্ত হয়ে বলা আগেকার সেই ‘স্টুপিড বয়’ কথাটাকে। এমনকি আমি ভালোবাসি তোমার করা সেই প্রত্যাখ্যানকেও!’

কিন্তু ম্যাসেজ লিখতে গিয়ে জোনাস আর এসব কথা লিখতে পারলো না। মনে মেঘ জমে কালো করলো আকাশ। মনে হলো ইরতিজাকে আসলে সে ঘৃণাই করে! মোবাইলটা ছুঁড়ে লাগেজের উপরের জামাকাপড়ের উপর ফেললো। বিড়বিড় করে বললো,
“ঘৃণা করা সত্ত্বেও আমি কেন তোমার কাছে ছুটে যাচ্ছি টিজা? তোমার প্রতি এ কেমন অদ্ভুত ঘৃণার জন্ম নিয়েছে আমার মাঝে?”

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here