উড়ো পাতার ঢেউ পর্ব: ৪৫

0
512

#উড়ো_পাতার_ঢেউ
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ৪৫
_________________

ক্লান্ত শরীরখানা কোনো রকম চালিত করে এপার্টমেন্ট এরিয়া থেকে বের হলো ইরতিজা। তার হাতে সবজির ব্যাগ ঝুলছে। ঘাম ঝরে পড়ছে হিজাবের নিচ থেকে। মনে হচ্ছে ব্যাপারটা জানার চেয়ে না জানা শ্রেয় ছিল তার জন্য। এপার্টমেন্ট এরিয়া থেকে খানিকটা দূরে চলে আসলে হঠাৎ ক্যানিয়লের সাথে দেখা হয়ে গেল।
ক্যানিয়ল ইরতিজাকে দেখতে পেয়ে গাড়ি থামালো ক্ষণ সময়ের জন্য। ইরতিজা ক্যানিয়লকে দেখতে পায়নি। সে আগের ন্যায় হেঁটে যাচ্ছিল। ক্যানিয়ল ডাকলো,
“হেই পাকিস্টানি গার্ল!”

ডাক কানে এলে দাঁড়ালো ইরতিজা। পিছন ঘুরে তাকিয়ে দেখতে পেল ক্যানিয়লকে। ক্যানিয়ল বললো,
“এখানে কী করছো তুমি?”

এই সময়ে ক্যানিয়লকে দেখতে পেয়ে ভীষণ কষ্ট অনুভব করলো ইরতিজা। বুক মুচড়ে কান্না বেরিয়ে আসার প্রস্তুতি নেওয়ার কার্যক্রম শুরু হলো। কিন্তু তবুও সে এটা দমিয়ে রাখতে চেষ্টার হাল ছাড়লো না। শেষমেশ নিজের অশ্রু সংযত রাখতে সক্ষম হলো। বললো,
“কিছু না, জাস্ট যাচ্ছিলাম এখান থেকে। ওই যে ওখানে একটা শপ আছে, সেটা দিয়ে কেনাকাটা করলাম।”

ক্যানিয়ল ইরতিজার হাতের ব্যাগটায় তাকালো। হ্যাঁ, এখান থেকে কিছুটা দূরে একটা শপ আছে। ইরতিজা মূলত সেই শপ দিয়ে কেনেনি। কিন্তু জানে ওদিকে একটা শপ আছে, তাই ওই শপের নামটাই ব্যবহার করলো অতিরিক্ত বাক্যালাপ থেকে বিরত থাকতে।

ক্যানিয়ল বললো,
“এসো তোমাকে বাসায় নামিয়ে দিচ্ছি।”

“দরকার নেই। আমি চলে যেতে পারবো।”
বলে পা’টা সামনে বাড়ালো, অমনি ক্যানিয়লের গম্ভীর কণ্ঠ বলে উঠলো,
“আর এক পা সামনে বাড়ালে তোমার পা কা’টা যাবে মেয়ে! সুতরাং সামনে এগিয়ো না আর, পিছিয়ে এসো। গাড়িতে ওঠো এবং বসো আমার পাশে।”

ইরতিজা অবসন্ন চোখে চাইলো। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। চোখের দৃষ্টি ঝাপসা ঝাপসা মনে হচ্ছে কেমন। এখান থেকে আর একটুকুনি হেঁটে যাওয়ার শক্তিও বোধহয় তার মাঝে জমাকৃত নেই। সে ক্যানিয়লের কথা মতো গাড়িতে উঠে বসলো। দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে চুপচাপ বসার পর অনুভব করলো তার শরীর আসলেই খুব খারাপ হয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। সারা শরীর নিসাড় হয়ে আসছে। ক্যানিয়ল ইরতিজার দিকে তাকিয়ে বললো,
“এরকম লাগছে কেন তোমাকে?”

“কী রকম লাগছে?” ক্যানিয়লের দিকে তাকালো ইরতিজা।

“অস্বাভাবিক লাগছে। তুমি কি অসুস্থ?”

“না।”

“তাহলে এরকম লাগছে কেন?”
ক্যানিয়ল নড়েচড়ে উঠলো,
“এই, তোমাকে কেউ কিছু বলেছে? বেলিকের বাসা তো এদিকেই। ওর সাথে দেখা হয়েছিল? ও কিছু বলেছে?”

ইরতিজার বন্ধ চোখের কোল বেয়ে পরাপর দুটো জলধারা নেমে গেল। অকস্মাৎ কেঁদে উঠলো সে। কান্না জড়ানো কণ্ঠে বললো,
“কেউ কিছু বলেনি। তুমি প্লিজ, বাসায় নিয়ে চলো তাড়াতাড়ি।”

বলে একনাগাড়ে কাঁদতে থাকলো। হৃদয়ে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি কষ্টটা হচ্ছে ক্যানিয়লের জন্য। ছেলেটা যখন সবকিছু জানবে তখন কী হবে? নিশ্চয়ই খুব কাঁদবে! এতটা কষ্ট হবে তখন ছেলেটার হৃদয়ে, মনে হবে যেন হৃদয় ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছে। এমন অনুভূতিই হবে না ওই সময় ছেলেটার? হুম, এমনই অনুভব করবে সে। হয়তো এর থেকেও বেশি হৃদয়বিদারক যন্ত্রণা পাবে।
ইরতিজাকে কাঁদতে দেখে দিগভ্রান্ত হয়ে পড়লো ক্যানিয়ল। দু চোখে বিস্ময় এবং উদ্বিগ্নতার আঁধার নেমে এলো। সে ব্যতিব্যস্ত কণ্ঠে শুধালো,
“হেই ইজা, তুমি কি অসুস্থ বোধ করছো? হসপিটালে নিয়ে যাব তোমাকে?”

ইরতিজা এখনও কাঁদছে। চোখ জোড়া মুদিত। কাঁদতে কাঁদতে জানালো,
“বাসায় নিয়ে চলো। শুধু বাসায় পৌঁছে দিলেই হবে।”

ক্যানিয়ল বুঝতে পারছে না কিছু। হঠাৎ করে ইরতিজা কাঁদতে শুরু করলো কেন? অসুস্থ বোধ করছে বলে কাঁদছে? হুম, ইরতিজার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে অসুস্থ। ক্যানিয়ল গাড়ি স্টার্ট দিলো দ্রুত।
গাড়ি এসে থামলো একেবারে ইরতিজার বাসার সামনে। ইরতিজা নামার আগে দু চোখ ভরে দেখলো ক্যানিয়লকে। এই ছেলেটার চোখ দিয়ে বৃষ্টি ঝরবে! পারবে না সে সেই করুণ বৃষ্টিপাতের দৃশ্য দেখতে। হৃদয়ে ভীষণ ব্যথা হবে ওই অশ্রুআঁখি দেখে। ইরতিজার শুকিয়ে যাওয়া চোখের কোণে আবারও অশ্রু জমলো। ক্যানিয়ল বললো,
“আমার সুন্দর মুখে এত কি খুঁত খুঁজছো তুমি?”

ইরতিজা গভীর চোখে চেয়ে থেকে বললো,
“এই মুহূর্তে কোনো খুঁত নেই তোমার এই সুন্দর মুখে। খুঁত তো তখনই দৃশ্যমান হবে, যখন তোমার আঁখিতে বর্ষা নামবে। আমার মনে হয় না ওই খুঁতটার চেয়ে আর কোনো খুঁত বেশি মারাত্মক হবে তোমার এই সুন্দর মুখটির জন্য।”

“কিন্তু আমি তো জানতাম মানুষ কাঁদলে তাকে আরও বেশি সুন্দর লাগে।”

“সকল কান্নায় সৌন্দর্য প্রকাশিত হয় না, অনেক কান্নায় কেবল হৃদয়ের চূর্ণিত দশা প্রকাশ পায়।”

“এমন কান্না আমার চোখে নামবে কেন?”

“কান্নারা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে তাই!”

ক্যানিয়ল কিছু বুঝতে পারলো না। স্তব্ধ নয়নে তাকিয়ে রইল ইরতিজার পানে। হঠাৎ ইরতিজার এমন ভারী ভারী কথা বলার মানে আদৌ বুঝতে সক্ষম হলো না তার মন।
ইরতিজা নেমে গেল গাড়ি থেকে। শরীরের দুর্বলতা স্থির। কোনো নড়চড় হচ্ছে না এই দুর্বলতার। ইরতিজা ব্যাগটা শক্ত করে আঁকড়ে ধরে এগিয়ে যাচ্ছিল ঘরের দিকে। এমন সময় ক্যানিয়ল অকস্মাৎ গাড়ির জানালা দিয়ে মাথা বের করে বলে উঠলো,
“আমি কান্না করলে তোমার আমার মাথায় হাত রাখার কথা ছিল ইজা। হতে পারে আমার কান্না সৌন্দর্য প্রকাশ করবে না, কিন্তু আমি কান্নারত থাকাকালীন আমার মাথায় এক ছিঁচকাঁদুনে মেয়ের সান্ত্বনার হাত নিশ্চয়ই পৃথিবীর অন্যতম এক সৌন্দর্যের প্রকাশ ঘটাবে।”

ক্যানিয়লের কথাগুলো ইরতিজার হৃৎমাঝার বরাবর এসে আঘাত হানলো। যে আঘাতে হৃদয় কাঁপলো। সৃষ্টি হলো গভীর অনুভূতির। অতলস্পর্শীয় এই অনুভূতি বিজ্ঞাপিত হয় না বাইরে, শুধু হৃদয় অতলে নিজ বার্তা ছড়াতে থাকে গোপনে।

_________________

নওরিনের ঘরের কোণে অন্ধকার জমতে শুরু করেছে। আলো-আঁধারি পরিবেশে সে বসে আছে ফোন হাতে। হামাদের কাছে কল দিতেও ঘৃণা হচ্ছে তার। ছেলেটা তাকে ঠকানোর সাহস করে কীভাবে? কদিন হলো হামাদ তাকে কল দেয় না? কল না দিয়ে পারে কী করে ছেলেটা? রাগে নওরিনের প্রতিটা লোম জাগ্রত হয়ে উঠছে। আজ তাকে কল দিয়ে কিছু বলতেই হবে হামাদকে। নওরিন আর ইতিউতি না করে দ্রুত কল দিলো হামাদের কাছে। কিন্তু হামাদের ফোন বন্ধ পেল। কী পরিমাণ রাগ যে লাগলো নওরিনের! ইচ্ছা হলো রাগে চিৎকার করে গলা ফাটিয়ে। কিন্তু সে নিজের রাগকে ধাতস্থ করলো। আস্তে আস্তে ঘন অন্ধকারে তলিয়ে গেল রুম। পুরো বাসাই অন্ধকারে তলানো। আজাদ চৌধুরী আর শারমিন আহমেদ বাসায় নেই। তারা বিকেলেই নিউ ইয়র্কের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে। নিউ ইয়র্কে জরুরি একটা কাজ পড়ে যাওয়ায় তাদের যেতে হয়েছে সেখানে। বাড়িতে কেবল সে আর ইরতিজা আছে। ইরতিজার আবার শরীরটা ভালো না। দুপুরে মার্কেট থেকে আসার পর থেকেই সে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আজাদ চৌধুরী ওষুধপত্র সব গুছিয়ে দিয়ে গিয়েছেন। ইরতিজা রেস্ট নিলে আর ওষুধ খেলেই সুস্থ হয়ে যাবে বলেছেন। আর ইরতিজার প্রতি নওরিনকে যত্ন নিতে বলেছেন তিনি।
নওরিন রুম থেকে বের হয়ে বাসায় আলো জ্বালালো। এরপর কিচেনে এলো ইরতিজা এবং নিজের জন্য দুই গ্লাস কাঁচা আমের শরবত বানাতে। বানাতে বেশি সময় লাগলো না। বানানো হলে তা নিয়ে ইরতিজার রুমে এলো। ইরতিজার রুম অন্ধকার। বোর্ড হাতড়ে আলো জ্বালালো। প্রথমেই বিছানায় নজর পড়লো। যা দেখলো তাতে সে ভয় পেয়ে গেল প্রথমে। দেখলো ইরতিজা বেডের উপর বসা অবস্থায় পাশের দিকে কেমন মুষড়ে পড়ে আছে। সম্ভবত বেডে হেলান দিয়ে বসা ছিল ও। এক দেখায়ই বোঝা যাচ্ছে ইরতিজা সজ্ঞানে নেই, অবচেতন!
নওরিন জুসের গ্লাস টেবিলে রেখে দৌড়ে এলো ইরতিজার কাছে। ইরতিজাকে নাড়া দিয়ে ডাকলো,
“ইরতিজা!”

ইরতিজা সাড়া শব্দহীন। নওরিন লক্ষ করলো ইরতিজার সারা শরীর ঘর্মাক্ত। এই শীতের মাঝেও মেয়েটা ঘেমে নেয়ে একাকার। গায়ের ধূসর গেঞ্জিটা ঘামে ভিজেছে। অনেকক্ষণ ডাকাডাকির পরও ইরতিজা যখন চেতনায় ফিরলো না তখন নওরিনের মনে ভয় কামড় দিলো। দিশেহারা হয়ে গেল সে। কী করবে না করবে কিছু বুঝতে পারলো না। মা-বাবাও বাড়িতে নেই! নওরিন চাচাদের বাসায় ছুটে গেল। দরজার বাইরে দাঁড়িয়েই ডেকে বলতে লাগলো ইরতিজার অবস্থা সম্পর্কে। রিশন পড়ার টেবিলে ছিল, নওরিনের ডাক শুনতে পেয়েই সবার আগে ছুটে এলো সে। নওরিনের সাথে কিছু না বলেই সে ওদের বাসায় প্রবেশ করলো। নওরিনও রিশনের পিছন পিছন ছুটে এলো।
ইরতিজার রুমে প্রবেশ করে দেখলো ইরতিজা অবচেতন হয়ে আছে। রিশনও ডাকাডাকি করলো। ততক্ষণে জুহি আর চাচিও এসে পড়েছে। জুহি তো আতঁকে উঠলো পুরো ঘটনা প্রত্যক্ষ করে। সে এগিয়ে এলো ইরতিজার কাছে। ইরতিজার মুখে দুই হাতের স্পর্শ বুলিয়ে বললো,
“টিজা, কী হয়েছে তোমার? চোখ খোলো। কী হয়েছে? ওঠো। এই ওঠো।”

রিশন বোনকে ঠেলে দূরে সরিয়ে দিলো। বিরক্ত চাহনি দিয়ে বললো,
“এরকম করলে ও জেগে উঠবে না, ওকে হসপিটালে নিতে হবে। সো আদিখ্যেতা বন্ধ করো।”

রিশন আর কারো কোনো কথা শোনার তোয়াক্কা না করে ইরতিজাকে পাঁজাকোলে তুলে নিলো। এরপর বাইরে বের হয়ে ইরতিজাকে গাড়ির ব্যাক সিটে শুইয়ে দিলো। রিশনের পাশের সিটে জুহি উঠে বসা দিলেই রিশন বললো,
“এ স্থান তোমার জন্য নয়, নওরিনের জন্য। অন্য গাড়িতে এসো তুমি। আর নয়তো হেঁটে এসো।”

ইরতিজাকে হাসপাতালে এডমিট করা হয়েছে। বেশ কিছুক্ষণ হয়েছে তারা হাসপাতালে আছে। এতক্ষণে আজাদ চৌধুরীকে জানানো হয়েছে ঘটনাটা সম্পর্কে। শোনার পরই আজাদ চৌধুরী উতলা হয়ে উঠলেন। পারলে এখনই ওয়াশিংটন চলে আসেন এমন উদ্বিগ্নতা তার মাঝে। কিন্তু এখনই তো রওনা দেওয়া সম্ভব নয়। সে সকলের সাথে কথা বলে ফোন রাখলেন। শুধু ইরতিজার সাথে কথা বললেন না। ইরতিজার সাথে কথা বলার জন্য এটাকে উপযুক্ত সময় হিসাবে মনে হলো না তার। ইরতিজা আগে খানিক সুস্থ হয়ে উঠুক তারপর তিনি কথা বলবেন।
রিশন আবার এর মাঝে একটা কাণ্ড ঘটিয়েছে। সে ক্যানিয়ল আর সাজিদকে কল করে জানিয়েছে ইরতিজা অসুস্থ এবং হাসপাতালে ভর্তি আছে। খবরটা শুনে দুজনই বেশ উতলা হয়ে উঠেছে। এমনকি কথা বলার সময় তাদের প্রস্তুতি এমন মনে হলো যে তারা এখনই ছুটে আসবে হয়তো হাসপাতালে। রিশনও সেটাই দেখতে চাইছে, কে আগে আসবে ছুটে। যে আগে আসবে সে নিশ্চয়ই ইরতিজাকে বেশি ভালোবাসে। তাছাড়া সে সামনাসামনি দেখতে চাইছে ইরতিজার প্রতি কার ব্যবহার কেমন হবে এই মুহূর্তে। ইরতিজার সাথে কি ক্যানিয়লের আসলেই তেমন কোনো সম্পর্ক আছে? সবই আজ সামনাসামনি দেখতে চাইছে সে।
ক্যানিয়ল আর সাজিদ দুজন মুখোমুখি হয়ে কী করবে সেটাও দেখতে চাইছে! উত্তেজনায় ভিতরটা কাঁপছে রিশনের। এই পুরো সময়টা যদি সে ক্যামেরাবন্দি করে রাখতে পারতো খুব ভালো হতো।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here