#উড়ো_পাতার_ঢেউ
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ৪৬
_________________
হাসপাতালে প্রথমে এসে পৌঁছলো ক্যানিয়ল। রিশন ধারণা করে নিলো ক্যানিয়ল ইরতিজাকে বেশি ভালোবাসে। কিন্তু তার এই ধারণা দীর্ঘক্ষণ বিচরণের সুযোগ পেল না। কারণ হিসেব মোতাবেক ক্যানিয়লেরই আগে পৌঁছনোর কথা। ক্যানিয়ল রেডমন্ডের বাসিন্দা। এখানে আসা তার জন্য অল্প কিছু সময়ের ব্যাপার। অন্যদিকে সাজিদ থাকে সিয়াটল। এছাড়া সাজিদের অফিসও আছে। সবকিছু ম্যানেজ করে আসতে সাজিদের সময় লাগবে এটাই স্বাভাবিক। তো এটা দিয়ে সে ঠিক বুঝতে পারলো না ইরতিজাকে কে বেশি ভালোবাসে। রেডমন্ড-সিয়াটলের ব্যাপারটা আগে তার খেয়ালই ছিল না।
ইরতিজার অবস্থানরত রুমের দরজাটা ক্যানিয়ল খুলে ফেললেই নওরিন ক্যানিয়লকে দেখে একটু চমকে গেল। কারণ ক্যানিয়ল তার কাছে একজন অপরিচিত ব্যক্তি। ক্যানিয়লের সাথে মি. হেনরিও আছে। দুজন অপরিচিতকে দেখে নওরিন বিস্মিত আঁখি জোড়া জুহির উপর ফেললো। জুহি কোনো কিছু না ভেবেই নওরিনকে জানালো,
“আমাদের ফ্রেন্ড, ক্যানিয়ল।”
“ওহ…” অস্ফুটে উচ্চারণ করলো নওরিন। তারপর বললো,
“জানলো কীভাবে?”
“রিশন জানিয়েছে বোধহয়।” জুহি ধারণা করলো কাজটা তার ভাইয়েরই হবে হয়তো।
ক্যানিয়ল প্রবেশ করার পর থেকে ইরতিজার দিকেই তাকিয়ে ছিল। ইরতিজাও অবাক হয়ে চেয়ে আছে। সে হয়তো এই সময় এখানে ক্যানিয়লকে কোনো ভাবেই আশা করতে পারেনি। ক্যানিয়ল হঠাৎ নওরিন আর জুহির উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
“তোমরা কি একটু বাইরে যেতে পারবে?”
নওরিনের কপালে ভাঁজ পড়লো। বাইরে যাবে মানে? সে কিছু বলার প্রস্তুতি নিচ্ছিল এর মাঝে জুহি দাঁড়িয়ে বললো,
“চলো।”
নওরিন অবাক হয়ে তাকালো। ছেলেটা বলছে আর জুহি যেতে রাজি হয়ে গেল? তাদের কেন বাইরে যেতে হবে? ছেলেটা কি তাদের সামনে যা বলার বলতে পারে না?
ক্যানিয়ল নওরিনকে দ্বিধাগ্রস্ত দেখে বললো,
“তুমি কি বাইরে যেতে অনিচ্ছুক? তাহলে কি আমি ইজাকে নিয়ে বাইরে চলে যাব?”
নওরিন হকচকিয়ে গেল ক্যানিয়লের কথায়। ছেলেটা তো দেখছে খুব সেয়ান। নওরিন আর কিছু না বলে বাইরে চলে এলো জুহির সাথে।
ক্যানিয়ল টুল টেনে একেবারে বেডের কাছে এসে বসলো। কিছুক্ষণ নীরব চেয়ে থেকে দেখলো ইরতিজাকে। তারপর বললো,
“হঠাৎ করে এত অসুস্থ হয়ে পড়েছো কেন তুমি?”
ইরতিজা একবার মি. হেনরির দিকে তাকিয়ে অতঃপর দৃষ্টি আবারও ক্যানিয়লের উপর নিয়ে এসে বললো,
“কই? আমি তো অসুস্থ নই।”
“অসুস্থ নও? তাহলে হসপিটালে কেন এসেছো? হ্যান্ডসাম ডক্টর আর মেল নার্সদের দেখার জন্য?”
ইরতিজা বুঝতে পারলো পূর্বের কথাটা বলে সে বোকামি করেছে। এ নিয়ে সে কথা বাড়াতে ইচ্ছুক নয়। তাই বললো,
“ও আমার বোন ছিল। ওর সাথে এমনভাবে কথা বলা উচিত হয়নি তোমার।”
“তোমার বোন? আমি কী করে বুঝবো যে ও তোমার বোন? হ্যাঁ একদিন দেখেছিলাম ওকে। কিন্তু তাই বলে বুঝবো কী করে ও তোমার বোন? তোমার প্যারেন্টস কোথায়? ডেকে এনে পরিচয় করিয়ে দাও। নয়তো পরে তাদেরও তো চিনতে পারবো না।”
“মা-বাবা নিউ ইয়র্ক আছে।”
“নিউ ইয়র্ক না থেকে এখানে থাকলে কি পরিচয় করিয়ে দিতে?”
ক্যানিয়লের মুখ নিঃসৃত কথাটা শেষ হওয়া মাত্রই রিশন প্রবেশ করলো। ভিতরে না ঢুকে সবটা অবলোকন করবে কী করে?
রিশন প্রবেশ করায় ভিতরে অবস্থান করা তিনজন মানব-মানবীর দৃষ্টিই তার উপর চলে এলো। তবে কারো দৃষ্টিই বেশিক্ষণ টিকলো না। কেউ যেন তাকে গ্রাহ্যই করলো না এমন ভাব প্রকাশ পেল। ক্যানিয়ল আবারও ইরতিজার দিকে দৃষ্টি নিয়ে বললো,
“এখন কেমন বোধ করছো?”
“ভালো বোধ করছি বলেই হয়তো স্বাভাবিকভাবে কথা বলছিলে।”
“না হলে কি অস্বাভাবিকভাবে কথা বলতাম?”
“হুম। তোমার এখনকার ব্যবহারের চেয়ে তখনকার ব্যবহার ভিন্নতর হতো।”
“কেন হতো?”
ইরতিজা থেমে রইল কিছুক্ষণ। রিশন কান পেতে রেখেছিল। ইরতিজা বিব্রত চোখে একবার মি. হেনরি এবং রিশনকে দেখলো। তারপর সহসা ক্যানিয়লের কাছে জানতে চাইলো,
“আমি কি তোমার ভালো থাকার মাধ্যম?”
ক্যানিয়ল অপ্রস্তুত হয়ে গেল হঠাৎ এমন প্রশ্নে। তবে বিচলিত ভাব সে দীর্ঘ সময় নিজ মাঝে পুষলো না। সহজ গলায় বলতে চেষ্টা করলো,
“হবে হয়তো! আমি কী করে জানবো?”
“জানো না? তাহলে আমি সেন্সলেস হয়ে হসপিটালে আছি শুনে কেমন অনুভূতি হয়েছিল তোমার সেটা কি জানো?”
ক্যানিয়ল ইরতিজার চোখে পূর্ণদৃষ্টি রেখে বললো,
“আমি সব জানি।”
ইরতিজা হাসলো। দু চোখে চিকচিক করে উঠলো পানি। বললো,
“আমি কেন তোমার ভালো থাকার মাধ্যম? কীভাবে, কখন হয়ে উঠলাম এটা? আমি কী করে ভালো রাখবো তোমায়? ওই সময়টাতে তো ভালো রাখতে পারবো না। আমার পাওয়া ভালো থাকার মাধ্যম কথাটাতে কলঙ্ক লাগবে তখন।”
ক্যানিয়লের দুই ভ্রুর মধ্যিখানে সূক্ষ্মভাবে দুটো ভাঁজ ফুঁটে উঠেছে। সে ভারি বিস্ময় আবিষ্ট কণ্ঠে বললো,
“কী বলছো তুমি? কিছু বোধগম্য হচ্ছে না আমার।”
ইরতিজা আর কিছু বললো না। ধীরে ধীরে চক্ষু বুজলো। নওরিন আর জুহি দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। এতক্ষণের সব কথা শুনছিল তারা। নওরিন সবটা শোনার পর তার মস্তিষ্কে চাপ অনুভব করছে। অজানা এক শঙ্কায় ধুকধুক করছে বুক। ভালো থাকার মাধ্যম মানে?
ইরতিজার শেষের কথাটা কারোরই বোধগম্য হয়নি। শুধু মি. হেনরি যেন ধরতে পারলো ইরতিজার ওই কথাটার মানে।
ক্যানিয়ল যখন বোঝার চেষ্টা করছিল ইরতিজার কথাটাকে, এমন সময়ে তার মোবাইল বেজে উঠলো। ড্যাড কল করেছে।
“হ্যালো ড্যাড!”
“জরুরি বিষয়ে আলাপ আছে। তোমাকে বাড়িতে প্রয়োজন। এখনই কি আসতে পারবে?”
“এখনই?”
ক্যানিয়ল ইরতিজার দিকে তাকালো। মেয়েটা এমনভাবে চোখ বুজে আছে মনে হচ্ছে যেন ঘুমাচ্ছে। সে বললো,
“ও কে, আসছি।”
কল কাটার পর ক্যানিয়ল ইরতিজার মাথায় হাত রেখে বললো,
“চলে যাচ্ছি পাকিস্টানি গার্ল! পরে আবার দেখা করতে আসবো।”
বলে সে ইরতিজার দিকে ঝুঁকে পড়লো। সকলের চোখ স্ফীত হয়ে উঠলো আচমকা। মি. হেনরি ব্যতীত বাকি তিনজনের মনেই সৃষ্টি হয়েছিল ভ্রান্তি ধারণা। কিন্তু ক্যানিয়ল ইরতিজার কানের কাছে মুখ নিয়ে গেল। ইরতিজা তখনও চোখ বুজে আছে। অনুভব করতে পারছে ক্যানিয়ল এখন তার খুব কাছাকাছি, তবুও সে চোখ খুললো না। একটু পরই ক্যানিয়লের ফিসফিসানো কণ্ঠ শুনতে পেল,
“পাকিস্টানি গার্ল, আমার চোখে ভ্রম হচ্ছে? না কি তোমার চোখে ভালোবাসার ঢল নেমেছে? তোমার দু চোখে কি সত্যিই আমার জন্য ভালোবাসা? না কি এটা আমার মিছে মিছে কল্পনা?”
ইরতিজা চোখ মেলে তাকালো। ক্যানিয়লের চোখে চোখ পড়তেই আটকে গেল তার হৃৎস্পন্দন। ক্যানিয়ল মুচকি হেসে সরে গেল।
“লেট’স গো মি. হেনরি।”
“তুমি একা যাও, আমার একটু কাজ আছে এখানে। আমি সেটা সমাপ্ত করে আসছি।”
ক্যানিয়ল অবাক হয়ে বললো,
“হসপিটালে কী কাজ তোমার?”
“পরিচিত একজন ভর্তি আছে এখানে। ওর কাছে যাব।”
“ও কে, আমি তাহলে তোমার গাড়ি পাঠিয়ে দেবো।”
ক্যানিয়ল বেরিয়ে এলো। তার পিছন পিছন রিশনও এলো। রিশন বললো,
“তুমি টিজার কানে কানে কী বলেছো?”
ক্যানিয়ল পিছন ফিরে রিশনের দিকে তাকালো। রিশনকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার দেখে নিয়ে বললো,
“তোমাকে যখনই দেখি তখনই ইচ্ছা হয় মে/রে হাত-পা ভে/ঙে দিই।”
“হোয়াট?” ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলো রিশন।
“সাবধানে থেকো, আমি হয়তো খুব শীঘ্রই তোমার মাথায় হকি স্টিক ভাঙতে চলেছি।”
“তুমি কিন্তু…”
ক্যানিয়ল রিশনকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ঘুরে আবার হাঁটতে শুরু করলো। কিন্তু রিশন দমলো না। পিছন পিছন আসতে আসতে বললো,
“তোমাকে পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়ে কেন আবার ছেড়ে দেয়? তুমি যে প্রকাশ্যে মানুষকে মারার হুমকি দাও তা কি তারা জানে না? হুমকি দেওয়াও একটা ভয়াবহ ক্রাইম। তারা যখন তোমার এই ক্রাইমের জন্য তোমাকে ধরতে না আসছে তখন তোমার উচিত নিজ থেকে গিয়ে সারেন্ডার করা পুলিশের কাছে।”
নওরিন আর জুহি নেই এখানে। নওরিন জুহিকে নিয়ে কোথায় যেন চলে গেল। মি. হেনরি কোথাও নড়লো না। ইরতিজার মনে হলো মি. হেনরি কোনো রোগীকে দেখার জন্য হসপিটালে থেকে যায়নি। ক্যানিয়লকে মিথ্যা বলেছে সে। ইরতিজা মি. হেনরিকে একা পেয়ে বললো,
“আপনার কি মনে হয় না ক্যানিয়লকে সব জানানো উচিত?”
“বিষয়টা জানার পর তোমারই এই অবস্থা, ক্যানিয়ল জানার পর ওর কি অবস্থা হবে সেটা নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারছো!”
ইরতিজা এ কথার জবাব দিলো না। মি. হেনরি বললো,
“আমার ধারণা ক্যানিয়ল মানসিক ভাবে ভীষণ বিপর্যস্ত হয়ে পড়লেও অজ্ঞান হয়ে যাবে না। তাহলে তুমি কেন এভাবে অজ্ঞান হয়ে গেলে?”
“জীবনে প্রথম এমনভাবে এই বিষয় সম্পর্কে জানতে পেরেছি। আর যার সম্পর্কে জেনেছি সে ক্যানিয়লের মম! এটা আমার জন্য ধাক্কা স্বরূপ ছিল। আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে, অস্থিরতা লাগছে।”
ইরতিজা কিছু সময় নীরব থেকে বললো,
“তাহলে ক্যানিয়ল নিজের মমের ব্যাপারে এখন কিছুই জানতে পারবে না, যখন জানবে তখন অলরেডি ওর মম মৃত থাকবে! আর ওর মম কেন ওকে ছেড়ে গিয়েছিল এটাও মমের মৃত্যুর পরই জানতে পারবে, তাই তো?”
“হুম।”
ইরতিজার চোখের কোণে আবার পানি জমলো। বললো,
“ক্যানিয়ল তো তাহলে কিছুই পারলো না। মমের মৃত্যুর আগে ও মমকে জানাতে পারলো না ও তাকে কতটা ভালোবাসে। যখন ওকে ছেড়ে ওর মমের চলে যাওয়ার কারণটা জানতে পারবে, তখন মমের প্রতি ওর ভালোবাসার পরিমাণটা আরও বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু সেটা জানানোর সুযোগ তখন ওর থাকবে না। নিজের প্রতি নিজে তখন তিক্ততা অনুভব করবে। ভীষণ তিক্ততা!”
ইরতিজা চোখ বুজে ফেললো। চোখের কোণ বেয়ে উষ্ণ একটা ধারা নেমে গেল টুপ করে।
মি. হেনরি বললেন,
“আর বেলা লিমাসের মৃত্যুর আগে ক্যানি এসব জানতে পারলে কেমন হবে? তখন বেলা লিমাসের মৃত্যু মেনে নেওয়াটা ক্যানির জন্য খুব কষ্টকর হবে। মমের মৃত্যুর আগেও ও কষ্ট পাবে, এমনকি পরেও। কষ্টের পরিমাণটা তখন বেশি হবে। আর বেলা লিমাসও ভীষণ কষ্ট পাবেন ছেলের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ দেখে। কারণ ছেলের ভালোবাসার আবেশে জড়িয়ে থাকার জন্য দীর্ঘ সময় পাবেন না তিনি। বেলা লিমাসের মৃত্যুর পরেই ক্যানিয়লের সবটা জানা ভালো হবে। কারণ তখন বেলা লিমাস মৃত থাকবে! শোকটা কাটিয়ে ওঠা সহজ হবে ওর জন্য। আর ক্যানিয়ল আগে জানলে বেলা লিমাস যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন কষ্টে ডুবে থাকবে ও, তার মৃত্যুর পরও কষ্ট পাবে।”
“বেলা লিমাস আমাকে কেন বললেন তার রোগ সম্পর্কে?”
“কারণ ক্যানিয়লের কাছে তুমি বিশেষ, আর ক্যানিয়ল তার কাছে বিশেষ। উনি মনে করেন ক্যানিয়ল ভেঙে পড়লে তোমার কারণে আবার স্বাভাবিক হতে পারবে সহজে। এটা সত্যও। মানুষ একাকিত্বে থাকলে তখন কষ্টগুলো যেন আরও বেশি করে আষ্টেপৃষ্ঠে ধরার সুযোগ পায়, কিন্তু কেউ সঙ্গ দিলে সেই সঙ্গকে ভালোবেসে কষ্ট ভোলা যায়। আমার ধারণা তুমি ক্যানিয়লের একজন ভালো সঙ্গী হবে। ”
ইরতিজা বেশ কিছু সময় নীরব থাকলো। ভাবলো। ক্যানিয়ল বেলা লিমাসের সন্নিকটে এসে দাঁড়ানো মৃত্যুর খবর জানতে পারলে ওর মানসিক অবস্থা ভীষণ করুণ হয়ে উঠবে। বেলা লিমাসের সেই করুণতা সহ্য করার ক্ষমতা নেই। ইরতিজা বললো,
“ঠিক আছে, বেলা লিমাস যখন চাইবেন তখনই জানবে ক্যানিয়ল!”
“ক্যানিয়লের সাথে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করো।”
“হুম। কিন্তু মমের মৃত্যু এবং অতীতে মমের চলে যাওয়ার কারণ জানার পর ক্যানিয়ল নিজেই তো অস্বাভাবিক হয়ে যাবে!”
“তখন তুমি ওকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করবে। আমি যাচ্ছি। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি তিনি যেন সম্পূর্ণ রূপে তোমাকে সুস্থতা দান করেন।”
মি. হেনরি চলে যেতে উদ্যত হলে ইরতিজা বললো,
“আপনি তো বেলা লিমাসের গুপ্তচর। আমার আর ক্যানিয়লের সম্পর্কে ওনাকে বিস্তারিত সব আপনিই তো জানিয়েছেন, তাই না?”
“হুম।”
“তাহলে আমাকে একটা বিষয় সম্পর্কে জানান তো। ক্যানিয়লের কাছে আমি কেন প্রিয়? ফেমাস ব্যালে ড্যান্সার কেন নয়?”
“উম…এটার উত্তর দেওয়া খুব কঠিন। এমন ধরনের প্রশ্ন সচরাচর কঠিনই হয়। দেখো, মানুষের ব্যক্তিগত একটা পছন্দ থাকে। সবার কাছে সবাইকে ভালো লাগে না। ছোটো বেলা থেকে মিরান্ডার সাথে থেকেও ক্যানি কখনও বিশেষ অনুভূতি উপলব্ধি করেনি মিরান্ডার প্রতি। কিন্তু তোমার সাথে দেখা হওয়ার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তুমি ওর মনে বিশেষ প্রভাব ফেলেছো। এখন মিরান্ডার প্রতি বিশেষ অনুভূতি না জন্মিয়ে তোমার প্রতি কেন জন্মালো এটা ভাবা আসলে বোকামি। ঈশ্বর চেয়েছেন বলেই এমন হচ্ছে এটা তোমার মনে রাখতে হবে।”
মি. হেনরি চলে গেল। ইরতিজার চোখ আবারও ভিজে উঠছিল অহেতুক। ইরতিজা এক প্রকার রাগ করলো চোখের সাথে। আসলেই কি সে ছিঁচকাঁদুনে? ছিঁচকাঁদুনে না হলে এমন কান্না কান্না পাচ্ছে কেন তার কাঁদবে না বলে প্রতিজ্ঞা করার পরও?
নওরিন জুহিকে নিয়ে ইরতিজার অবস্থানরত রুম থেকে অনেকটা দূরে এসেছিল। এসে জুহিকে জিজ্ঞেস করেছে,
“তুমি কি শিওর ছেলেটা কেবল তোমাদের ফ্রেন্ড, অন্য কিছু নয়?”
নওরিনের সন্দেহের দৃষ্টি দেখে ঘাবড়ে গিয়েছিল জুহি। যদিও ইরতিজা কিছুই বলেনি তার কাছে, তবুও সে এ বিষয়ে নিশ্চিত যে ইরতিজা আর ক্যানিয়লের মাঝে বিশেষ কিছু আছে। কিন্তু এটা এই সময় নওরিনকে বলা যুক্তিসঙ্গত মনে হলো না তার। ঘাবড়ে যাওয়া সত্ত্বেও সে যথেষ্ট স্বাভাবিকতা বজায় রেখে বলেছে,
“ইয়াহ, বন্ধু ছাড়া আর কী হবে?”
“ছেলেটার কথাবার্তা মোটেই স্বাভাবিক লাগছিল না।”
“অস্বাভাবিকও কিছু ছিল না।”
নওরিন আর জুহির মাঝে বিষয়টা নিয়ে বেশ কিছুটা বাক্যালাপ চললো। নওরিন এটাকে যত ভিন্ন আঙ্গিকে দাবি করছিল, জুহি তত তাকে এটা স্বাভাবিক বলে বোঝানোর চেষ্টায় ছিল। নওরিন এক সময় বিরক্ত হয়ে এ নিয়ে কথা থামিয়ে দেয়। কিন্তু জুহি লক্ষ করছিল নওরিনের মুখে তখনও সন্দেহের দুত্যি ঝিলমিল করছে।
একটু পরই সাজিদ এলো। রিশন মনে মনে ভীষণ অসন্তুষ্ট। কারণ সে যা প্ল্যান করে ক্যানিয়ল আর সাজিদকে এক সাথে কল দিয়ে খবরটা জানিয়েছিল, তা কিছুই হয়নি। সে বুঝতে পারেনি কে ইরতিজাকে বেশি ভালোবাসে। কারণ হিসাব মোতাবেক তো ক্যানিয়লেরই আগে আসার কথা ছিল। আর চেয়েছিল সাজিদ আর ক্যানিয়ল সামনাসামনি হলে কেমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় সেটা দেখতে। কিন্তু ক্যানিয়ল তো সাজিদ আসার অনেক আগেই চলে গেছে। আর যাওয়ার সময় কী খারাপ আচরণটাই না করলো তার সাথে! যা মনে পড়তেই রিশনের মনে হচ্ছে ক্যানিয়লকে খবরটা জানিয়ে সে চরম ভুল করেছে। এরপর রইল ইরতিজার প্রতি দুজনের আচরণ বিশ্লেষণ। এটা দ্বারাও সে কিছু বুঝতে পারলো না। তবে ক্যানিয়ল আর ইরতিজাকে দেখে সে এটুকু বুঝতে পেরেছে যে, দুজনেরই দুজনের প্রতি অনুভূতি বিদ্যমান। যেটা সাজিদের বেলায় লক্ষ করেনি। সাজিদের অনুভূতি একপাক্ষিক মনে হয়েছে তার কাছে।
সাজিদ বেশ কিছু সময় ধরে ইরতিজার দিকে তাকিয়ে আছে। আর ইরতিজা অন্যদিকে তাকিয়ে রয়েছে। সে বেশ বিব্রত বোধ করছে সাজিদ এরকম তাকিয়ে থাকায়। ক্যানিয়ল হাসপাতালে আসায় সে যতটা অবাক হয়েছিল সাজিদ আসায় তার থেকে দ্বিগুণ অবাক হলো। সাজিদ তাকে দেখতে এই সময়ে হাসপাতালে আসতে পারে এটা তার ভাবনার ধারে কাছেও ভিড়েনি কখনও। সাজিদ তাকিয়ে থাকাতে এবার সে প্রচণ্ড বিরক্ত বোধ করলো। অতিষ্ঠ হয়ে বললো,
“এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? আমি কি মন্সটার? উৎসাহী হয়ে মন্সটার দেখছেন?”
“মন্সটার নয়, আমি উৎসাহী হয়ে মানুষই দেখছি।”
“কেন? জীবনে আর কোনোদিন মানুষ দেখেননি?”
“মানুষ অনেক দেখেছি, আপনাকেও দেখেছি বহুবার। তবে এখনও অজস্রবার দেখা বাকি।”
ইরতিজা ভ্রু কুঁচকালো। সাজিদ বললো,
“আপনার কী হয়েছে? ঠোঁটে আঘাত পান, এখন আবার অজ্ঞানও হয়ে যাচ্ছেন! ব্যাপার কী?”
“আমার ব্যাপার নিয়ে আপনাকে অহেতুক ভাবতে বলছি না আমি।”
“কিন্তু আমার তো ভাবতে হবে। বিয়ের পর যদি আপনি হুটহাট করে অজ্ঞান হয়ে যেতে শুরু করেন তাহলে আমার মা-বাবা তো বলবে তাদের জন্য ফিট খাওয়া বউ মা নিয়ে এসেছি।”
“আপনার বাড়িতে আমি যাব না কি? আপনার মা-বাবা বলবে কী করে?”
“আপনি না গেলেও আমি আপনাকে জোর করে তুলে নেবো যে, সেজন্যে।”
“আপনি চলে যান। আমার কারো সাথে কথা বলতে ভালো লাগছে না। বাসায় গিয়ে শুধু আব্বুর সাথে কথা বলবো। এরপর ডিরেক্ট ঘুমিয়ে যাব। আপনি চলে যান।”
“কিন্তু আমার কথা বলতে খারাপ লাগছে না। আর আমার ঘুমানোরও তাড়া নেই। ঘুমাতে গিয়ে বিছানার ওপাশটা খালি দেখলেই ঘুম উবে যায় চোখ থেকে। খুব শীঘ্রই আসলে আমার বিয়ে করে ফেলা উচিত। বিছানার ওপাশটা পূর্ণ হয়ে গেলে ঘুমও পরিপূর্ণ হতো।”
“আপনাকে বিয়ে করতে তো কেউ নিষেধ করছে না। আপনার ঘাড় ত্যারামির জন্যই আপনার বিছানার ওপাশটা খালি। এতদিনে একটা ভালো মেয়ের খোঁজ করে বিয়ে করে ফেললে আমরা একটা বিয়ে খাওয়ার সুযোগ পেতাম।”
সাজিদ ফিক করে হেসে দিলো ইরতিজার কথা শুনে। এরপর বললো,
“ভালো মেয়ে না, খারাপ মেয়ে বিয়ে করবো আমি। আর সেই বিয়েতে তোমাকে দাওয়াত দেবো না। যদি পারো বিনা নিমন্ত্রণে বিয়ে খেতে এসো।”
____________
বাড়িতে যে জরুরি বিষয়ে আলাপ করার জন্য ডেকে আনা হয়েছে এতে রীতিমতো বিরক্ত হলো ক্যানিয়ল। সে বিষয়বস্তুটা ধরতে পেরে বললো,
“আগামী দশ বছরেও আমি বিয়ে করার জন্য প্রিপেয়ার নই ড্যাড।”
কথাটা শুনে মুহাম্মদ ইসহাক যেমন চমকালেন, তেমনি চমকালেন বাকিরাও। মাদার সোফিয়া বললেন,
“কী বলছো উমরান?”
“ইয়েস মাদার সোফিয়া। আমি প্রিপেয়ার নই। সুতরাং এক মাসের মধ্যে আমার বিয়ে কার্য সম্পন্ন হোক এটা চাওয়া দুরাশা।”
মুহাম্মদ ইসহাক বললেন,
“এলজে বলছিল একমাসের ভিতর বিয়েটা হয়ে গেলেই ভালো হয়। শুধু শুধু দেরি করে লাভ কী? আমারও মনে হয় বিয়েটা হয়ে গেলে মন্দ হয় না।”
ক্যানিয়ল বুঝতে পারলো নিশ্চয়ই মিরান্ডা নিজের ড্যাডের মাথায় এই বিয়ে দ্রুত হয়ে যাওয়া ভালো এই বিষয়টা ঢুকিয়েছে। এখন মিরান্ডার ড্যাডের মাথা থেকে তার ড্যাডের মাথায়ও বিষয়টা ট্রান্সফার হয়েছে। ক্যানিয়ল বললো,
“আমি কিন্তু নিজ ইচ্ছাতে এই এনগেজমেন্ট করিনি। আমি তোমাকে বলেছিলাম মিরান্ডার প্রতি আমার কখনও ভিন্ন কোনো অনুভূতি ফিল হয়নি। তুমি বলেছিলে, নেই তো কী হয়েছে? হবে। একসাথে থাকলে অনুভূতি ক্রিয়েট হবে। সময় নিয়ে দেখো। ততদিনে এনগেজমেন্ট হয়ে যাক। এটা নিয়ে সমস্যা তো নেই। তোমার কথা অনুযায়ী এনগেজমেন্ট হলো। আমি চেষ্টা করলাম মিরান্ডার প্রতি অনুভূতি ফিল করতে, কিন্তু এটা কাজ করলো না। আমাদের এনগেজমেন্টের এক বছর হয়ে গেছে, এত দীর্ঘ সময়েও এটা কাজ করলো না। আমার মনে হয় না এটা আর কাজ করবে। স্যরি ড্যাড! আমার মনে হয় না আমি মিরান্ডাকে বিয়ে করতে পারবো!”
মুহাম্মদ ইসহাকের মাঝে অবিশ্বাসের ঝাপটা লাগলো,
“তুমি কী বলছো এটা?”
“আমি মিরান্ডাকে বিয়ে করবো কি না সে ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলাম না। পাকিস্টানি গার্লের সাথে দেখা না হলে আমি মিরান্ডাকে বিয়ে করতেও পারতাম, আবার না-ও করতে পারতাম। ওটা ছিল অনিশ্চিত বিষয়। কিন্তু পাকিস্টানি গার্লের সাথে দেখা হওয়ার পর বিষয়টা নিশ্চিত হয়েছে। আমি স্যরি! আমি বিয়ে করবো না মিরান্ডাকে।”
ক্যানিয়ল উঠে দাঁড়ালো। যেতে চেয়ে পা বাড়ালো। দুই কি তিন কদম এগিয়ে গেলেই মুহাম্মদ ইসহাক বললেন,
“তুমি কার কথা বলছো? কোন পাকিস্তানি গার্ল?”
ক্যানিয়ল থামলো। পিছন ফিরে বললো,
“শি ইজ দ্য ব্রাইটেস্ট স্টার ইন মাই স্কাই।”
“হোয়াট?” বুঝতে পারলেন না মুহাম্মদ ইসহাক।
“ও আমার গার্লফ্রেন্ড নয়, কিন্তু আমি ওর বয়ফ্রেন্ড। আবার ব্যাপারটা এমনও হতে পারে, ও আমার গার্লফ্রেন্ড, কিন্তু আমি ওর বয়ফ্রেন্ড নই। ব্যাপারটা এমনও হতে পারে, আমরা কেউই কারো গার্লফ্রেন্ড-বয়ফ্রেন্ড নই। আবার ব্যাপারটা এরকমও হতে পারে, আমরা দুজনই দুজনের গার্লফ্রেন্ড-বয়ফ্রেন্ড।”
(চলবে)