উড়ো পাতার ঢেউ পর্ব: ৪৯

0
472

#উড়ো_পাতার_ঢেউ
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ৪৯
_________________

‘পাকিস্টানি গার্ল, উইল ইউ বি মাই মিসেস উমরান?’
কথাটা কয়েকবার প্রতিধ্বনিত হলো ইরতিজার কর্ণধারে। ক্ষণিকের জন্য পৃথিবীর সব কিছু ভুলে গিয়েছিল সে। শীতল তুষার কণাদের ছোঁয়াও তার উপলব্ধিতে ছিল না। হৃৎপিণ্ডটা দ্রিম দ্রিম করে লাফাচ্ছে এখনও। দু চোখে ঘোর, বিশ্বাসের সুতোয় টান পড়েছে। মনে হচ্ছে যা ঘটছে এটা স্বপ্ন! বাস্তবতা কি স্বপ্নের মতো এত বেশি সুন্দর হয়? এই নিঝুম রাতের নিঝুম ঝরে পড়া তুষারের মতো নিঝুম ভালোলাগার গাঢ় ঘনত্বে তার হৃদয় ছেয়ে যাচ্ছে। ভালোবাসা উঁকি দিচ্ছে যেমনভাবে মেঘের আড়াল থেকে মায়া ঝরা চন্দ্র উঁকি দেয় ধরণীতে। ভালোবাসা এত সুন্দর কেন? ইরতিজার দুচোখে অজ্ঞাতসারে আনন্দ জল এলো চুপিচুপি।

ক্যানিয়ল উত্তরের প্রত্যাশায় চেয়ে আছে। প্রতীক্ষাকৃত ওই চোখ জোড়ায় তাকিয়ে ইরতিজার দৃষ্টির সাথে সাথে মনও খুব বাজেভাবে আটকে গেল আজ। সে দু চোখের আনন্দ অশ্রুর পাশাপাশি ঠোঁটেও আনন্দ রেখা টানলো। উপর-নিচ মাথা নেড়ে বললো,
“ইয়েস…ইয়েস আই উইল!”

ক্যানিয়লের ওষ্ঠ জোড়া প্রসারিত হলো। আনন্দ ঘনিয়ে এলো অন্তঃকরণে। খুশিতে যখন ইরতিজাকে জড়িয়ে ধরার জন্য সামনে এগোলো, ঠিক তখনই ইরতিজা ছুটে গেল ঘরের দিকে। সে নিজ চৈতন্যে জাগরূক। একবার লক্ষও করেনি সামনের মানুষটা তাকে জড়িয়ে ধরার জন্য উদ্যত হয়েছিল।
ইরতিজা যখন প্রায় দরজার কাছাকাছি তখন ক্যানিয়ল বললো,
“হেই পাকিস্টানি গার্ল, দ্য হাগ ওয়াজ নট কমপ্লিট। হোয়্যার আর ইউ রানিং?”

ইরতিজা ক্যানিয়লের কথা শুনতে পেয়েছে বলে মনে হলো না। ক্যানিয়ল ইরতিজার এমন কাণ্ডে হেসে ফেললো। অস্ফুট আওয়াজে বললো,
“ক্রেজি গার্ল ইজা!”

সে এবার লনের উপর জমা পড়া তুষারদের উপর দৃষ্টি দিলো। তুষার আস্তরণের উপর দিয়ে মেয়েটা এত ভালোভাবে দৌড়ে গেল কীভাবে? ক্যানিয়ল আবার হাসলো। চোখ বুলালো প্রকৃতিতে। তুষারপাত ঝরছে। নিজেদের সর্বোচ্চ সৌন্দর্য ফুঁটিয়ে একই তালে ঝরে পড়ছে তারা। তাদের সাথে সাথেই যেন পৃথিবীতে ঝরে পড়ছে রাশি রাশি শান্তি। তুষার কণাদেরও যে এত সৌন্দর্য থাকতে পারে জানতো না সে। ক্যানিয়লের মনে হলো এত অভিনিবেশ দিয়ে এর আগে কখনও তুষারপাতের ঝরে পড়া দেখেনি সে। জীবনে অসংখ্য বার তুষার ঝরা পরিবেশের সাথে তার সাক্ষাৎ ঘটলেও, তুষার ঝরা এমন মুগ্ধময় পরিবেশের সাথে এই প্রথম সাক্ষাৎ ঘটলো তার। আগের পরিবেশে এমন মুগ্ধতা অনুপস্থিত ছিল।
ক্যানিয়ল অনুভব করছে তার হৃদাকাশ থেকেও তুষারপাতের মতো কোমল, শান্ত অনুভূতি ঝরছে। এই অনুভূতি মিষ্টি, বিশুদ্ধ এবং পূর্ণ! ক্যানিয়ল নিজের গাড়ির দিকে যেতে আরম্ভ করলো। গাড়িটার উপরও এতক্ষণে তুষারপাতের হালকা আস্তরণ পড়ে গিয়েছে। যেতে যেতে একবার পিছন ফিরে ইরতিজাদের বাড়ির দিকে তাকালো। বিড়বিড় করে বললো,
“এক উন্মাদিনীকে দেখতে এক উন্মাদ এই মাঝরাতে তুষারপাতের মাঝে ছুটে এসেছে। পৃথিবীর কি উচিত নয় এটা নিজের ইতিহাসের ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ করা?”

রুমে এসে বিছানায় কয়েকটা উল্টি-পাল্টিও খাওয়া হয়ে গেছে ইরতিজার। ভিতরকার আনন্দ ধারা এভাবে নিবারণ করা দায়। কিছুক্ষণ আগেও সে জানতো না এত সুন্দর একটি মুহূর্ত তার জীবনে আগমন করতে চলেছে। জানতো না এই সুন্দরতম মুহূর্তটা জীবনের অন্যতম বিশেষ মুহূর্ত হয়ে রচিত হবে তার জীবনবৃত্তান্তে। আবেগ সিক্ততাতে হঠাৎই আবার দুই নয়ন ভিজে উঠলো তার। সে কাঁদলো। মনের আনন্দে জীবনে এই প্রথম বার কাঁদলো সে। আনন্দের কান্নার মাঝেও যে এত আনন্দ আছে সে জানতো না আগে।
কিন্তু হঠাৎই থমকে গেল তার আনন্দের অশ্রু বিসর্জন। আনন্দ ধারাকে ছাপিয়ে হঠাৎই নেমে এলো কষ্টধারা। তার মনে পড়লো সে অন্য একজনের বাগদত্তা! মনে পড়লো নিজের ফ্যামিলির কথা। বুকের ভিতরটা দুমড়ে-মুচড়ে যেতে লাগলো দুর্বিষহ যন্ত্রণায়। মুহূর্তেই পার্থিব সবকিছুকে মনে হলো তিক্ত। দুই হাঁটুতে মুখ লুকিয়ে সহসা কেঁদে উঠলো সে। ভিতরের নিগূঢ় আর্তনাদ কান্না হয়ে ঝরে পড়তে লাগলো অবিরাম। নির্জন রজনীতে তার চাপা কান্নার শব্দ বড়ো মর্মান্তিক শোনালো। সে কাঁদতে কাঁদতে শুধু একটা প্রশ্নই আওড়াচ্ছিল মুখে,
“কেন আমার জীবন এমন? কেন?”

বিচূর্ণ হয়ে যাওয়া আনন্দগুলো আর জোড়া লাগছিল না। তার পরিবর্তে কান্নার বেগ আরও বেড়ে যেতে লাগলো। এই বিশেষ মুহূর্তটায় এমনভাবে বিষাদের ছটা এসে লাগবে এটা ভাবনায় ছিল না! এই বিশেষ মুহূর্তটায় কেন এভাবে কাঁদতে হচ্ছে তাকে? কেন তার জীবন এমন? কী হবে? আব্বুকে সবটা কীভাবে বোঝাবে?

_______________

স্নো ফল থেমেছে কিছুক্ষণ আগে। রাস্তায় নেমেছে স্নো ট্র্যাক। রাস্তা থেকে স্নো ফল সরানোর কাজ শুরু হয়েছে। কনকনে ঠান্ডা আজ। হাত-পা কাঁপছে কেমন। মোটা কাপড় গায়ে জড়িয়েও শীত থেকে নিস্তার পাওয়া যাচ্ছে না। রিশনদের গাড়ির সামনেই যাচ্ছে একটা স্নো ট্র্যাক। ধীর গতিতে গাড়ি চালাচ্ছে রিশন। রিশনের পাশের সিটে আছে ইরতিজা। পিছনের সিটে বসেছে জুহি। জুহি একটা পারফিউম বার কয়েক স্প্রে করেছে গাড়ির ভিতর। এই পারফিউমটা আন্দ্রেজ দিয়েছিল। জুহি স্প্রে করার পর জিজ্ঞেস করেছে,
“ঘ্রাণটা মিষ্টি না?”

রিশন বোনের এই কাজে বিরক্ত হয়েছে খুব। যদিও সে বিরক্তির বহিঃপ্রকাশ করেনি। শুধু একবার বিড়বিড় করে বলেছিল,
“শি ইজ ম্যাড!”

কথাটা কেবল ইরতিজা শুনতে পেয়েছে। ভালো যে জুহি শুনতে পায়নি। শুনলে হয়তো গাড়ির ভিতরের পরিবেশ এখন এত শান্ত থাকতো না। ইরতিজা জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো। কুয়াশার ভিতর থেকে ঝাপসা ভাবে পাহাড়ের শরীর দেখা যাচ্ছে। ইরতিজা জানে পাহাড়ের চূড়া গুলো এখন বরফে ঢেকে সাদা হয়ে আছে। কুয়াশা সরে গেলেই দেখা যাবে রুপার মতো চকচক করছে পাহাড়ের চূড়াগুলো। গতরাতের দৃশ্যটা এখনও ভাসছে তার মনশ্চক্ষুতে। কানে বাজছে ক্যানিয়লের সেই কথা,
‘পাকিস্টানি গার্ল, উইল ইউ বি মাই মিসেস উমরান?’

এটাও কি একটা শাস্তি? এত সুন্দর শাস্তি হয়? এমন সুন্দর শাস্তি এই প্রথম কেউ তাকে দিতে চাইছে। কিন্তু এই শাস্তি কার্যকর হওয়া কোনো সহজ ব্যাপার তো নয়! এই শাস্তির জন্য ছোটো-খাটো কিংবা বড়ো ধরনের একটা ঝামেলার সৃষ্টি হবে। সাজিদের সাথে এনগেজমেন্টের মাধ্যমে যে সম্পর্কের সৃষ্টি হয়েছিল তা চূর্ণ করতে হবে। আব্বুকে বোঝাতে হবে। পুরো লন্ডভন্ড এক পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে! যা ভেবে এখনই অন্তর কাঁপে ইরতিজার। এ জীবন এত ঝামেলাপূর্ণ কেন? এ জীবন সব সময় সুন্দর নয় কেন? দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো ভিতরের সকল আত্মগ্লানির পরিচয় নিয়ে।

রিশন ইরতিজার দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করার বিষয়টুকু লক্ষ করে বললো,
“কিছু হয়েছে?”

ইরতিজা রিশনের দিকে না তাকিয়েই উত্তর দিলো,
“আমার জীবন তো আগে থেকেই এলোমেলো হওয়া! এটা এলোমেলোই আছে। এলোমেলো অবস্থা আমাকে কষ্ট দিচ্ছে। আমি সেই কষ্টকে আগলে ধরছি। পরিপাটি সুন্দর জীবনের স্বপ্ন বুনছি! হয়তো বাস্তব করার সংগ্রামে নামতে এখনও দেরি।”

“তোমার কী হয়েছে?” পিছন থেকে বললো জুহি।

ইরতিজা জুহির উদ্দেশ্যে বললো,
“তোমার ভালোবাসার মানুষটা তোমার মন বুঝছে না বলে তুমি কষ্ট পাও। কিন্তু যদি তোমার ভালোবাসার মানুষটা তোমার মন বোঝে এবং নিজের মনের কথাও বলে দেয়, অথচ তোমাদের সম্পর্কটা পূর্ণতা পাওয়ার পথ যদি হয় কঠিন, তখন তোমার অনুভূতি কেমন হবে?”

কোনো উত্তর আসে না জুহির থেকে। ইরতিজার কথা শুনে বিমূঢ় হয়ে গেছে সে।
ইরতিজা আরও বললো,
“কাউকে ভালোবাসা সহজ, কিন্তু ‘ভালোবাসা’ বিষয়টি সহজ নয়। পৃথিবীর অন্যতম কঠিন বিষয় হলো ভালোবাসা। প্রকৃত ভালোবাসলে তা ভোলা সহজ নয়, আবার সে ভালোবাসা পূর্ণতা পাওয়ার দিকটাও সহজ নয়, কঠিন! সব কঠিন লাগছে!”

“ক্যানিয়লকে ভালোবাসো?” প্রশ্ন করলো রিশন।

ইরতিজা উত্তর না দিয়ে শুধু একটুখানি হাসলো। ওই হাসিতেই উত্তর লিপিবদ্ধ। রিশন গলায় বিরক্তির রেশ ছুঁইয়ে বললো,
“তোমরা দুজনই বেশ বোকা! ভালোবাসার জন্য উপযুক্ত মানুষ নির্ধারণ করতে পারোনি তোমরা।”
ইরতিজা আর জুহিকে উদ্দেশ্যে করে বললো রিশন।

ইরতিজা বললো,
“এটা নির্ধারণ করার জন্য কেবল একটা প্রশ্নের উত্তরের প্রয়োজন। প্রশ্নটা হলো, তুমি মানুষটার সাথে সারাজীবন কাটাতে পারবে কি না? যদি তোমার মনে হয় তুমি পারবে, তখন ধরে নেবে তোমার ভালোবাসার মানুষটা সঠিক।”

“আমার উচিত ছিল গাড়ির ভিতর ক্যামেরা সেট করে রাখা। তোমার এই ভারী ভারী কথাগুলো ইউটিউবে আপলোড করলে অনেক মানুষ উপকৃত হতো!”

রিশনের মুখে এই মুহূর্তে বিরক্তির গাঢ় একটা আবরণ লক্ষ করা যাচ্ছে। ইরতিজা হেসে ফেললো রিশনের কথা এবং ওর মুখের গাঢ় বিরক্তির পর্দাটা লক্ষ করে।

______________

এমন একটা দৃশ্য দেখতে হবে তা কল্পনাও করেনি জুহি। মার্টার চুলে সে যে ক্লিপ জোড়া দেখতে পাচ্ছে ওটা আন্দ্রেজের কাছে ছিল। এটা সেই ক্লিপ যা দেখে সে ভেবেছিল এটা আন্দ্রেজ তার জন্য কিনেছে। এটা মার্টার কাছে কীভাবে এলো? রাগে শিরা-উপশিরা দপদপ করে উঠলো জুহির। অপমানে আরক্ত হলো সে। কোনো রকম ভণিতা ছাড়াই এগিয়ে গেল মার্টার দিকে। মার্টার সাথে মার্টার দুই বান্ধবীও আছে। জুহি জিজ্ঞেস করলো,
“তুমি এই হেয়ার ক্লিপ কোথায় পেয়েছো?”

মার্টা হঠাৎ জুহির এমন একটা প্রশ্নে অবাক হলো। জুহি এমনিতেই তার সাথে কখনও কথা বলে না তেমন। কিন্তু আজ হঠাৎ…
মার্টা বললো,
“সমস্যা কী তোমার? আমি এই ক্লিপ কোথায় পেয়েছি তা দিয়ে তুমি কী করবে?”

জুহি আরও রেগে গেল,
“আমি যা জিজ্ঞেস করেছি তার উত্তর দাও।”

“তুমি এমনভাবে কথা বলছো কেন?”

জুহি রাগান্বিত হয়ে তাকিয়ে রইল।

মার্টা ঝামেলা না করে বললো,
“এটা কেউ একজন আমার বাসার দরজার সামনে রেখে গিয়েছিল। অর্থাৎ এটা একজন গিফট দিয়েছে আমাকে। বুঝেছো?”

“কে দিয়েছে?”

“কোথাও নাম উল্লেখ করে দেয়নি, বুঝবো কী করে…”

মার্টা কথা সম্পূর্ণ করার আগেই জুহি মার্টার চুল থেকে ক্লিপ খুলে আনলো।
বিস্ময়, বিমূঢ়তায় জমে গেল মার্টা। জুহি বললো,
“এই ক্লিপ তোমার নয়, এটা আমার। আর তুমি খুব ভালো করে জানো এই ক্লিপ কে দিয়েছে তোমাকে। অনেক ছেলে আছে তো যারা তোমার জন্য। তারপরও তোমার দৃষ্টি ওই খোঁড়াটার উপর কেন আটকায়? খোঁড়াটা হয়তো তোমায় পছন্দ করার অধিকার রাখে, কিন্তু তুমি ওর দেওয়া ক্লিপ মাথায় পরার অধিকার রাখো না। কারণ ও তোমার সাথে বেমানান। যে তোমার সাথে মানানসই নয়, তার দেওয়া ক্লিপ চুলে পরার অধিকার তোমার নেই।”

জুহি গটগট করে চলে গেল মার্টার কাছ থেকে।
মার্টা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল তার দিকে।
জুহি ক্লাসে এলো। জানে আন্দ্রেজ এখন ক্লাসেই আছে। সে আন্দ্রেজকে বললো,
“তোমার সাথে ইম্পরট্যান্ট কথা আছে, আমার সাথে এসো।”

“যা বলার এখানে বলো।”

“এখানে বলা যাবে না, আমার সাথে এসো।”

আন্দ্রেজ জুহির দু চোখের রাগ পড়তে পারলো। জুহি যেহেতু রেগে আছে তখন ক্লাসে উপস্থিত শিক্ষার্থীদের সামনে তাকে বেইজ্জতি করতেও বাধবে না ওর। আন্দ্রেজ তাই জুহির কথা মানাই যুক্তিসঙ্গত মনে করলো।
জুহি আন্দ্রেজকে নিয়ে এলো ক্যাম্পাসের নিরিবিলি একটা স্থানে। এখানে বেশি স্টুডেন্টদের ভিড় নেই।

জুহি হাতের ক্লিপ জোড়া দেখিয়ে বললো,
“হোয়াট’স দ্যাট?”

আন্দ্রেজ জুহির হাতে ক্লিপ জোড়া দেখে বেশ চমকালো।
“এগুলো তোমার কাছে কেন?”

জুহি এক পা সামনে এগিয়ে এসে বললো,
“তোমার সাহস কীভাবে হয় মার্টার জন্য ক্লিপ কেনার? কোন সাহসে কিনেছো তুমি?”

“আমি কারো জন্য কোনো ক্লিপ কিনিনি।”

“চুপ করো মিথ্যুক! আমি এই ক্লিপ তোমার বেডরুমে দেখেছিলাম। ভেবেছিলাম তুমি এটা আমার জন্য কিনেছো। কিন্তু তুমি ওই মার্টার জন্য এই ক্লিপ…কেন কিনেছো?”

আন্দ্রেজও অতিষ্ঠ বোধ করলো। ছোটো-খাটো বিষয় নিয়ে জুহির মাত্রাতিরিক্ত আচরণ যেন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। বললো,
“হ্যাঁ, আমি কিনেছি। আমার যাকে ইচ্ছা হবে আমি তার জন্য ক্লিপ কিনবো, তাতে তোমার কী? তুমি এত হাইপার আচরণ কেন করছো?”

“কারণ আমি তোমাকে ভালোবাসি!”
জুহি আরও একধাপ সামনে এগিয়ে এসে আন্দ্রেজের জ্যাকেট গলার কাছ থেকে চেপে ধরে বললো।
“ভালোবাসি তোমায়। তাই অন্য একটা মেয়ের প্রতি তোমার এমন অনুভূতি সহ্য করতে পারি না। আগে যেটুকু সহ্য ক্ষমতা ছিল ধীরে ধীরে তাও লোপ পাচ্ছে। আমি একদমই সহ্য করতে পারি না এসব। আমি ভেবেছিলাম তুমি এই ক্লিপ আমার জন্য কিনেছো। আমাকে গিফট দেবে। কিন্তু আজ আমি এই ক্লিপ মার্টার চুলে দেখতে পেলাম! কেন? তুমি জানো না তোমার প্রতি আমার অনুভূতি কেমন? জানো না আমি তোমাকে ভালোবাসি? ছোটোবেলা থেকে তোমায় ভালোবাসি জানো না? জেনেও না জানার ভাণ কেন করো গর্দভ? কেন? কেন এই ক্লিপ তুমি মার্টাকে দিয়েছো? কেন দিয়েছো?”

“বিকজ আই ডোন্ট লাভ ইউ।”

আন্দ্রেজের এই স্পষ্ট কথার ধ্বনিতে থমকে গেল জুহি।

“আমি ভালোবাসি না তোমাকে! সুতরাং আমার কোনো বিষয় নিয়ে এমন মাত্রারিক্ত বিহেভ করা বন্ধ করো। তুমি এমন করলে তোমাকে পাগল মনে হয়। তোমার এই পাগলামি বিরক্ত করে আমাকে। আমায় এমনভাবে বিরক্ত করা বন্ধ করো দয়া করে!”

জুহি স্তব্ধ হয়ে গেল। সে মনে করতো আংশিক পরিমাণ হলেও আন্দ্রেজের অনুভূতি আছে তার প্রতি, কিন্তু আজ মনে হচ্ছে তার ধারণা ভুল। এত দিনের ভ্রান্তি ধারণা ভেঙে গিয়ে কয়েক খণ্ডে পরিণত হলো। দু চোখে পানিকণা ভিড় জমালো। ভীষণ অভিমানের মেঘ জমলো মন আকাশে। রাগ আরও বেশি শক্তিশালী হয়ে কেঁপে উঠলো তার মাঝে। সে ক্ষুব্ধ হয়ে আন্দ্রেজকে জোরে একটা ধাক্কা দিলো। আন্দ্রেজ পিছনে থাকা গাছটার সাথে ধাক্কা খেলো। চেঁচিয়ে উঠলো জুহির সাথে,
“আর ইউ ম্যাড? কী করছো তুমি? খুব বেশি অতিরিক্ত করে ফেলেছো। পাগল তুমি! তোমার উচিত মানসিক হসপিটালে গিয়ে এডমিট হওয়া। এই ইউনিভার্সিটি তোমার জন্য নয়। বদ্ধ উন্মাদ তুমি!”

জুহি রাগে কাঁপতে কাঁপতে বললো,
“আমি কোথায় গিয়ে এডমিট হবো না হবো সেটা তোমার মতো একটা ছেলের কাছ থেকে জানতে হবে না আমার। ভালো আছি পাগল আছি। তোমার মতো হতে হবে না। কিছু মানুষ থাকে না, যারা মূল্যবান সম্পদ কাছে থাকাকালীন যত্ন করে না, যখন হারিয়ে যায় তখন আফসোস করে! তোমার অবস্থাও ঠিক তেমনই। কী ভেবেছো? তুমি আমাকে ভালোবাসো না বলে আমার নাওয়া-খাওয়া সব বন্ধ হয়ে যাবে? না, একদমই না। তোমার মতো একটা খোঁড়া ছেলেকে তো আমি গণনায়ও ধরবো না আর। তুমি আমার সাথে একদমই মানানসই নও। পৃথিবীর কোনো মেয়ের সাথেই মানানসই নও তুমি। হয়ে উঠতেও পারবে না কোনোদিন। তুমি খুব বাজে একটা ছেলে, প্রচণ্ড বাজে!”

ইরতিজা দূর থেকে আন্দ্রেজ আর জুহিকে ঝগড়া করতে দেখে এগিয়ে এলো। বললো,
“কী শুরু করেছো তোমরা এখানে? মানুষজন দেখছে তো! জুহি…”

ইরতিজা কিছু বলতে চাইলে তা না শুনেই হনহন করে চলে গেল জুহি। ইরতিজা তাকালো আন্দ্রেজের দিকে। আন্দ্রেজ বললো,
“ওকে দ্রুত একটা মানসিক হসপিটালে ভর্তি করিয়ে দাও। উন্মাদ হয়ে গেছে ও। এরকম খোলা পরিবেশে থাকলে উন্মাদনা আরও বৃদ্ধি পাবে!”

বলে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে চলে গেল আন্দ্রেজ।
ইরতিজা ঘটনার আগা-গোড়া কিছুই বুঝতে পারলো না। হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
দূর থেকে একজন তাকিয়ে আছে ইরতিজার দিকে। যে কি না গত সন্ধ্যার বার্থডে পার্টি থেকেই ভীষণ রকম রাগান্বিত ইরতিজার উপর। হ্যাঁ, ইরতিজার উপর রেগে থাকা এই মানুষটা জোনাস। পার্টিতে ক্যানিয়ল যে ইরতিজার হাত ধরেছিল সেটা দেখেছিল সে। সেটা দেখার পর থেকেই রাগ নিবারণ করতে পারছে না। কিন্তু সে মনে করছে এরকম রেগে থাকলে কোনো লাভ হবে না। কিছু একটা করতে হবে। ভালো কিছু। যেটা ইরতিজা পছন্দ করবে। জোনাস মনে মনে ভেবেও নিলো সে কী করবে। আগামীকালই তাহলে ঘটুক ওই সুন্দর ঘটনাটি!

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here